ঢাকা, বাংলাদেশ  |  বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪



  বিভাগ : পরবাস তারিখ : ১৩-১০-২০২৪  


মেকং ডেল্টা

ভিয়েতনাম: দ্যা ল্যান্ড অব ড্রাগন্স-শেষ পর্ব


  লিয়াকত হোসেন, সুইডেন



লিয়াকত হোসেন, সুইডেন থেকে:

বলা হয়ে থাকে মেকং ডেল্টার নয়টি ড্রাগন।

হ্যালং উপসাগর থেকে দেশের বিপরীত দিকে অবস্থিত, দক্ষিণ ভিয়েতনামের মেকং নদী স্থানীয়ভাবে 'কু লং' বা 'নয়টি ড্রাগন নদী' নামে পরিচিত। মেকং নদীর ৯টি উপনদীকে ৯টি ড্রগন নামে অভিহিত করা হয়। ৯টি উপনদীই পূর্ব ভিয়েতনাম সাগরের সাথে মিলিত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দীর্ঘতম নদীটি তিব্বত মালভূমিতে জন্ম নিয়ে ভিয়েতনামের মেকং ডেল্টায় প্রবেশ করার পূর্বে চীন, মায়ানমার, লাওস, থাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেকং ডেল্টায় প্রবেশ করে। মেকং ডেল্টা কৃষিসমৃদ্ধ অববাহিকাটি দেশের বেশির ভাগ ধান, ফল ও সবজি এবং উপকূলীয় ও অভ্যন্তরীণ মাছ উৎপাদনে সহায়ক। ৪০,০০০ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি বিস্তৃত এবং দেশের ১২ শতাংশজুড়ে আবৃত মেকং ব-দ্বীপ থাইল্যান্ডের উপসাগর এবং দক্ষিণ চীন সাগর দ্বারা গঠিত একটি উচ্চ উৎপাদনশীল কৃষি অঞ্চল। ভিয়েতনাম ভ্রমণে মেকং ডেল্টা না দেখা অসম্পূর্ণ ভ্রমণের নিয়ামক।

মেকং ডেল্টার প্রাকৃতিক দৃশ্য

ভোরে ব্রেকফাস্ট সেরে সাতটার মধ্যেই লবিতে নেমে এলাম।

আজ মেকং ডেল্টায় যাবার প্রোগ্রাম। এতো সকালেই হোচিমিন সিটি জেগে ওঠেছে। ভোরের সূর্য তাপ ছড়াচ্ছে। চারদিক মানুষের চলাচল ও হোন্ডার ছড়াছড়ি। এদেশের অধিকাংশ জনগণ হোন্ডায় যাতায়াত করেন। দুচাকা যানের জন্য আলাদা লেন। হোটেলের নিচেই একটা কফির দোকান। অনেকেই সকালের কফি পান করছেন। হোটেলের সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তার ধারে এসেই দেখি আমাদের গতকালের গাইড ও ড্রাইভার। কী ব্যাপার আজতো নুতন গাইডের আসার কথা? গাইড জানান, ‘আমরাই এসেছি, ট্যুর এজেন্সি আমাদেরই পাঠিয়েছে। ‘ভালোই হলো আমরা গাড়িতে ওঠে বসলাম। গাইড জলের বোতল এগিয়ে দিলেন, এখান থেকে চার ঘণ্টার ড্রাইভ মেকং ডেল্টা। আমরা একটি গ্রুপে ডেল্টায় যাবো।

গ্রুপের অন্যরা কাছাকাছি বিভিন্ন হোটেলে আছেন।

মিনিট তিরিশের মধ্যে সবাইকে ওঠিয়ে নিয়ে গাড়ি ছুটে চলে মেকং ডেল্টার বিশেষ পয়েন্টে। চার ঘণ্টার ড্রাইভ। হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। সমগ্র ভিয়েতনামের রাস্তাঘাট খুবই উন্নত ও সাজানো গুছানো। রাস্তার পাশে দোকানপাট বা বাড়িঘরের সামনে কোনো না কোনো ফুলের গাছ। গাছে লাল নীল হলুদ সাদা ফুলের সমারোহ। দেখলে চোখ জুড়ায়। তিন ঘণ্টা ছুটে চলার পর বিশাল এক রিসোর্টে গাড়ি থামে। চা কফি স্ন্যাক্স ও আইস্ক্রিমের প্রচুর দোকান। গাইড জানালেন, এখানে মিনিট পনের বিশ্রাম, প্রয়োজনে আইসক্রিম চা কফি পান করা যেতে পারে। গাড়ি থেকে নেমে পা বাড়াতেই দমকা গরম হাওয়ায় ডুবে গেলাম। রেস্টরুমে ফ্রেশ হয়ে আইসক্রিমে শরীর শীতল করে আবার গাড়িতে এসে বসলাম। মেকং ডেল্টা এখান থেকে মাত্র একঘণ্টার পথ।

একঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা মেকং নদীর ঘাটে এসে পৌঁছালাম।

যন্ত্রচালিত ছাউনি দেয়া বড় নৌকা। নৌকার ভেতর বসার চেয়ার টেবিল। আমরা আসন নেয়ামাত্রই নৌকা ছাড়ে। মেকং নদীর জল বেশ ঘোলা। নদীর দুপাশে জলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে পামগাছের পাতার মত বিরাট জলজ, নলখাগরা ও অনান্য লতাগুল্মের গাছ। মাঝেমধ্যে নদীর পাড় ঘেসে গড়ে ওঠেছে শুকনো নারকেলের কারখানা। জলে খুব একটা স্রোত নেই তবে জল দিয়ে গাছের ভাঙ্গা ডালপালা, নারকেলের খোসা ও জলজগুল্ম ভেসে যাচ্ছে। মনে হলো, নেপালের বিখ্যাত পোখরা হ্রদে যন্ত্রচালিত কোনো নৌকা নেই, ওতে জল দূষিত হয়। মেকং নদীতেও কোনো যন্ত্রচালিত নৌকা থাকা ঠিক নয়। ঘণ্টাখানেক নৌকা চলার পর মেকং নদীর দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা একটি ঘাটে এসে পৌঁছালাম। গাইড জানালেন এখানে আমরা স্থানীয়দের হাতে তৈরি কিছু জিনিস দেখবো। নৌকা থেকে ঘাটে পা রাখা খুবই বিপদজনক। সরু পথ ও কঞ্চি ধরে ওঠতে হয়। ব্যালেন্স হারালেই নদীর জলে। একে একে আমরা সবাই উঠে এলাম। ছাউনি দেয়া এক দোকান। স্থানীয়দের হাতে তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী সাজানো। একজন দেখালেন কিভাবে এক মিনিটের মধ্যেই মাটিতে পোতা বল্লম জাতীয় অস্ত্রের সাহায্যে শুকনো নারকেলের খোসা ছাড়িয়ে ভেতরের সাশ বের করতে হয়। একে একে আমরা সবাই নারকেলের সাশ চিবিয়ে খেলাম, অপূর্ব স্বাদ ও মিষ্টি। দোকান ঘুরে ঘুরে দেখতে ওপরের র‌্যাকে বেশ কয়েকটি বড় কাচের বয়াম দেখতে পেলাম। দুএকটির ভেতর একহাতের মত লম্বা লম্বা চিকন সাপ, তবে জীবন্ত নয়। এটা একপ্রকার স্নেকওয়াইন বা সর্পশরাব। আজব এক শরাব, স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন যে এই সর্পশরাব পানে শরীরের সমস্ত রোগবালাই দূরীভূত হয় ও বিশেষ অঙ্গের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। দোকান থেকে আমরা নারকেল ভাজা ও খাঁটি মধু নিলাম।

কেনাকাটা শেষে আবার নৌকায়।

মেকং নদীর ভেতর দিয়ে আবার দীর্ঘ যাত্রা। আঁকাবাঁকা নদীপথ পেরিয়ে অন্য এক ঘাটে। জলের ওপর লম্বা লম্বা জলজ গাছ দাঁড়িয়ে। কোনো কোনো গাছের শাখা জলের ওপর এসে গেছে। আমাদের নৌকা ডালপালা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলে। নৌকার পাশ দিয়ে বিশাল বিশাল মালবাহিত নৌকা যাচ্ছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পর গাছের পাতার ছাউনি দেয়া এক ঘাটে এসে পৌঁছালাম। পাড়ে ওঠে দেখি সিমেণ্ট বাঁধানো পাকা রাস্তা গাছগাছালির ভেতর দিয়ে গ্রামের ভেতর চলে গেছে। রাস্তায় দাঁড়ানো কয়েকটি টেম্পো জাতীয় গাড়ি। ঐ গাড়িগুলো আমাদের বিশেষ একটি রিসোর্টে নিয়ে যাবে। ওখানে আমাদের জন্য বিশেষ লাঞ্চের আয়োজন করা হয়েছে। যেহেতু টুরিস্ট অ্যাজেন্সির সাথে আজই আমাদের শেষ প্রোগ্রাম। টেম্পোগুলোয় বসামাত্রই সরু রাস্তা দিয়ে কে কত জোরে ছুটতে পারে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। টেম্পো ড্রাইভাররা বোঝাতে চায় তারা দক্ষ চালক। প্রতিযোগিতার মধ্যেই আঁকাবাঁকা পথে রিসোর্টে পৌঁছালাম। গ্রামের ভেতর বেশ বড় রিসোর্ট, দু’চারটি লম্বা পাকা দালান। দালানগুলোয় বোগেনভেলিয়া ফুটে আছে।

খোলা এক লম্বা বারান্দায় চেয়ার টেবিল পাতা।

মেকং ডেল্টার রিসোর্ট আ্যলিফেন্ট ফিস দিয়ে দুপুরের লাঞ্চ

ওখানেই আমাদের লাঞ্চের যায়গা। গাইড জানালেন বিশেষ দু’ধরনের মাছের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেকং নদী থেকে ধরা গলদা চিংড়ি সেদ্ধ, অ্যালিফেন্ট ফিসের ফ্রাই, বিভিন্নপ্রকার সালাদ, ভাতের মন্ডের তৈরি কাগজ ও সঙ্গে কোমল পানীয়। আমরা পছন্দমত জায়গা নিয়ে বসলাম। কোমল শীতল পানীয় পরিবেশন করা হলো। গরমের ভেতর ভালোই লাগলো। এরপর টেবিলজুড়ে এলো অ্যালিফেন্ট ফিসের ফ্রাই। অ্যালিফেন্ট ফিসগুলো হাতির চারটে পা বাদ দিয়ে যে সাইজের হয় তেমন, মাথায় ছোট একটি শুড়ের মত থাকে, তবে আমাদের জন্য পরিবেশিত মাছটিতে ছিল না। আর এই মাছটি ছোট আকারের হয়তো শুড় তখনো গজিয়ে উঠতে পারেনি। মাছটি দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম, কারণ এর আগে এমন মাছ দেখিনি। বিভিন্নধরনের সালাদে টেবিল ভরে গেল। সঙ্গে এলো গলদা চিংড়ি সেদ্ধ ও ভাতের কাগজ। ভাতের পাতলা মন্ড থেকে তৈরি হয় ভাতের কাগজ। ভাত গলিয়ে পাতলা মন্ড তৈরি করে গরম তাওয়ার ওপর বেলে তৈরি করা হয় ভাতের কাগজ। কাগজটি খুব স্বচ্ছ সাদা ও হালকা ট্রান্সপারেন্ট। হাতে গ্লাভস পরে একজন সাহায্যকারি এগিয়ে এলেন। আমাদের দেখিয়ে দিলেন কিভাবে খেতে হয়। তিনি হাতে ভাতের কাগজ নিয়ে কিছুটা সালাদ রাখলেন, ফ্রাই করা অ্যালিফেন্ট ফিস থেকে দুচামচ ফিস উঠিয়ে নিয়ে ছোট পুড়ি বানিয়ে সস মাখিয়ে খেতে দিলেন। মুখে দিয়ে অনুভব করলাম অপূর্ব স্বাদ। ভাত, মাছ, সালাদ, সস একইসঙ্গে খাওয়া হলো। তিনি গলদা চিংড়ির খোসা ছাড়িয়ে ভেতরের সাদা চিংড়ি সস মাখিয়ে খেতে দিলেন। আমরা তার দেখিয়ে দেয়া প্রসেসে খেতে যেয়ে দেখি পুরো মাছই শেষ।

 মেকং ডেল্টার রিসোর্টে গলদা চিংড়ি দিয়ে দুপুরের লাঞ্চ

অভাবনীয় লাঞ্চের পর আবার ছুটে চলা।

অপেক্ষমান টেম্পোতে আমরা নতুন একটি ঘাটে এলাম। ঘাটে সারি সারি ডিঙ্গি নৌকা তবে যন্ত্রচালিত নয়। এক এক নৌকায় এক একজন মাঝি ও দুজন করে বসার যায়গা। মাঝিরা প্রায় সবাই স্থানীয় নারী। বৈঠা চালিয়ে মেকং নদী ধরে নিয়ে যাবেন প্রায় দেড় থেকে দুই কিলোমিটার। যারা সাঁতার জানেন না তারা ভেস্ত পরে নিলেন। অনেকে যেতে চাইলেন না তবে গাইড জানালেন, এটি স্মরণীয় নদী পথ। সত্যি মেকং নদীর স্মরণীয় নদী পথ, দুধারে জলের ভেতর ডুবে থাকা পাম গাছের মত গাছগুলো দুধারে নারকেল পাতার মত সবুজ পাতার ছাউনি বানিয়েছে। পাতার ফাঁক দিয়ে বিকেলের সূর্যের আলো এসে ছড়িয়ে পরেছে জলের ওপর। পাতার ছাউনির ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো মেখে আমরা এগিয়ে গেলাম।

 

সুইডেন, স্টকহোম

১৪-১০-২০২৪ 


 নিউজটি পড়া হয়েছে ১৩১ বার  


 এই ধারাবাহিকের সকল পর্ব  

•   ভিয়েতনাম: দ্যা ল্যান্ড অব ড্রাগন্স


•   হ্যালংবে


•   ভিয়েতনামের ট্র্যাজিক মাইলাই ও শান্ত হোইআন


•   হিউ ভিয়েতনাম ও হোচিমিনের জন্মস্থান


•   সায়গনের ১২১ কিলোমিটার লম্বা চুচি টানেল


•   ওয়ার মিউজিয়াম: মার্কিন নৃশংসতার দলিল


•   মেকং ডেল্টা






 

পরবাস

ওয়ার মিউজিয়াম: মার্কিন নৃশংসতার দলিল

নবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানে

সায়গনের ১২১ কিলোমিটার লম্বা চুচি টানেল

হিউ ভিয়েতনাম ও হোচিমিনের জন্মস্থান

ভিয়েতনামের ট্র্যাজিক মাইলাই ও শান্ত হোইআন

হ্যালংবে

ভিয়েতনাম: দ্যা ল্যান্ড অব ড্রাগন্স

মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে...

ইউথানেসিয়া: মৃত্যু নিয়ে বাণিজ্য!

মারিয়ার শেষ নিঃশ্বাস

পরবাস বিভাগের আরো খবর






সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি:
আবদুল্লাহ আল হারুন
প্রধান সম্পাদক:
আসিফ হাসান নবী

সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. জিয়াউল হক
বিশেষ সংবাদদাতা:
র‌বিউল ইসলাম সো‌হেল

আমাদের মানচিত্র

ঠিকানা: দেওয়ান কমপ্লেক্স (৩য় তলা), ৬০/ই/১, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়:
কক্ষ নং ১৪/সি, নোয়াখালি টাওয়ার (১৪ তলা), ৫৫-বি, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০

ফোন: ০১৯১৪-৭৩৫৮৫৮, ০১৯১৪-৮৭৫৬৪০
ইমেইল: info@amadermanchitra.news, amadermanchitrabd@gmail.com

Location Map
Copyright © 2012-2024
All rights reserved

design & developed by
corporate work