ঢাকা, বাংলাদেশ  |  বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪



  বিভাগ : পরবাস তারিখ : ১৭-০৩-২০২৪  


ইউথানেসিয়া: মৃত্যু নিয়ে বাণিজ্য!

দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের জন্য যন্ত্রণাহীন স্বেচ্ছা মৃত্যু


  আবদুল্লাহ আল-হারুন, জার্মানি থেকে



আবদুল্লাহ আল-হারুন: পাদ্রি নোয়েলের সাথে টমাসের বাড়িতে যখন আমরা এলাম, ঘড়ির হিসেবে বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যার আগমণ হওয়ার কথা। কিন্ত জুলাই মাস। ভর গ্রীষ্মকাল। সূর্যোদয় হয় শেষ রাত সাড়ে তিনটা-চারটেয়। রাত ৯ টায়ও অস্ত যাবার কোনও লক্ষণ থাকে না। একটানা ১৬-১৭ ঘণ্টার লম্বা বিরক্তিকর দিন! বেল টেপার পর টমাসের মেয়ে আনা দরজা খুলে বিরসমুখে এসে দাঁড়াল। আমাদের দেখে যে সে মোটেও খুশি হয়নি তা স্পষ্ট বোঝা যায়। কারণ আমি বা নেয়েল কখনই ভালো খবর নিয়ে আসি না। ওর মা লিজা তো আমাদের সাথে কথাই বলে না। তাদের এই সব অসন্তোষের কারণ আনার বাবা লিও যে আজ প্রায় দশ বছর ধরে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন। জগদ্বিখ্যাত এক মেটাল ইন্ডাস্ট্রিতে বিরাট অর্থের ইঞ্জিনিয়ার। কিন্ত দুর্ভাগ্য, কারখানায় একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় কোমর থেকে তার দেহের নিম্নাঙ্গ ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যায়। প্রথমদিন থেকেই সে শয্যাশায়ী। মোট চারবার অপারেশন করা হয়েছে। অবস্থারতো কোনো উন্নতি হয়ইনি; পা দুটিও শুকিয়ে চিকন কাঠির মত হয়ে গেছে। কথাবার্তা সব বলতে পারে, ক্ষুধা আছে, সর্বদা তৃপ্তির সাথে খাওয়া-দাওয়া করে কিন্ত কিন্ত হাঁটার ক্ষমতা নেই। একজনকে ধরে তাকে হুইল চেয়ারে বসাতে হয়, তারপর নিজের হাতই চেয়ার চালিয়ে সে সামান্য ঘোরাফিরা করতে পারে। প্রায় তিন বছর নানা হাসপাতাল, অর্থোপেডিক্স বিশেষ ক্লিনিক, এসবে থেকেও কোনো লাভ হয়নি। জোর করে সে বাড়ি ফিরে এসেছিল। প্রথম প্রথম বৌ-মেয়েও তাই চাইছিল। বাসায় একজন নার্স রাখা হয়েছিল। সে বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টাই ওর দেখাশোনা করত। বাসাতেই একটি ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা ছিল। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেটাল কারখানায় যেখানে অস্ত্র নির্মাণ করা হয়ে সেখানে প্রায় ২৩-২৪ বছর চিফ ইঞ্জিনিয়ার পদে সুনামের সাথে চাকরি করার জন্য টমাসের পাঁচ বছর আগে একটি বিরাট অংকের পেনশন, ক্ষতিপূরণ বাবাদ প্রায় এক মিলিয়ন (১০ লক্ষ মার্ক- পরে ইউরো) পেয়েছিল। স্ত্রীও সরকারি আমলা। একটি মাত্র সন্তান মেয়ে আনা উচ্চশিক্ষিত, কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ। বন্ধুর সাথে আলাদা থাকে। তবে একই শহরে। সেজন্য সময় পেলেই বাবা-মায়ের কাাছে চলে আসত। সুন্দর একটি ছিমছাম আদর্শ পরিবার। কিন্ত দুর্ঘটনায় সব তছনছ হয় গেল। বাড়িতে আসার পর প্রথম ২-৩ বছর মা-মেয়ে- নার্সের তত্ত্বাবধানে সব ঠিকমতই চলছিল। কিন্ত একজন শয্যাশায়ী, মৃত্যুপথযাত্রীর পরিবারে ২৪ ঘণ্টার অবস্থান একসময়ে সবার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। বৌ-মেয়ের আদর যত্নে ঢিল পড়ল। বৌর কর্মস্থলে বন্ধু জুটে গেল। সে প্রায়ই বাসায় আসে না। বন্ধুর সাথে রাত কাটায়। এককালে স্বামীর প্রতি যে অখন্ড ভালোবাসা ছিল, তা টমাসের পঙ্গুত্বের কারণে পাতলা হয়ে হয়ে এক সময়ে শূন্যের কোঠায় নেমে গেল। মেয়ে মাঝে মাঝে আসত, তাও ধীরে ধীরে কমে গেল! বৌ খুব চালাক। সাধারণত এরকম পরিস্থিতিতে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ হয়ে যাবার কথা। কিন্ত স্বামীর মোটা পেনসন, ব্যাংক ব্যালেন্স এসবই ডিভোর্স করে অন্যকে বিয়ে করলে হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই লিজা যেনতেন প্রকারে বিয়েটা টিকিয়ে রাখল। তার প্রতীক্ষা স্বামী কবে মহাযাত্রা করবে। তারপর সব টাকা পয়সা হাতিয়ে নতুন করে সংসার পাতবে। পশ্চিমা সভ্যতার এই সব বিকট, নির্লজ্জ ও  মর্মন্তুদ সত্য আমাকে সবসময় পীড়া দিত, আজও দেয়।

দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে নিপতিত আফ্রিকার গ্রামে একটি মুমুর্ষূ শিশু মরে যাচ্ছে, আর একটি শকুনি দূরেই বসে ওর মরার অপেক্ষা করছে। একসময়ে এই ছবিটি সারা পৃথিবীতে মহা আলোড়ন তুলেছিল। বছরদুয়েক হলো, টমাস হসপিসে এসেছে। বাসায় নার্স দিয়ে ২৪ ঘণ্টার সেবাশুশ্রুষার ব্যাঘাত হয় এই অজুহাতে লিজা তাকে হসপিসে আনার ব্যবস্থা করে। কথাটা সত্যিও। আপনজনেরা যেখানে বিমুখ সেখানে বেতনভোগী নার্সরা যন্ত্রের মত সেবা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না। নিম্নাঙ্গ অবশ হলেও, টমাসের মস্তিস্ক, বুদ্ধি, চেতনা ছিল সবই সজাগ ও সচল। সেও বুঝতে পারছিল, তার মোটা পেনসন আর ব্যাংক ব্যালেন্সের লোভে স্ত্রী তাকে ধরে আছে কিন্ত মায়ামমতা মোটেও নেই। তাই সেও হসপিসে আসতে রাজি হয়েছিল। এখানেই আমি প্রথম টমাসকে দেখি এবং প্রায়ই রাতে সঙ্গ দিতে গিয়ে তার প্রখর সচেতনতা, বুদ্ধিবৃত্তি এবং মানবিকতার সন্ধান পাই। তার সাথে আমার একরকম সখ্যতা গড়ে উঠে। তার স্ত্রী লিজাকে দেখার পর আমার সেই ছবির শকুনী আর মৃতপ্রায় শিশুটির কথা মনে হয়েছে। লিজা ওঁৎ পেতে আছে, কবে টমাস মরবে এবং সে অগাধ সম্পত্তির একলা মালিক হয়ে যাবে। মেয়ে আনার মধ্যেও আমি একই লালসার চিহ্ন দেখেছি। এক বছর হলো নানাধরনের ওষুধের পাশর্^প্রতিক্রিয়ায় ও একাধিক অপারেশনের কারণে টমাস প্রাণঘাতি এক অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগছে।

ডা. রেমন্ড এ মুডি জুনিয়র (জন্ম ৩০ জুন, ১৯৪৪), একজন আমেরিকান দার্শনিক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক এবং লেখক। তিনি ‘মৃত্যুর পরে জীবন’ এবং ‘নিকট-মৃত্যুর অভিজ্ঞতা’ (নেয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স) বিষয়ক বইগুলির জন্য সর্বাধিক পরিচিত। NDE (Near Death Experience) একটি শব্দ যা তিনি ১৯৭৫ সালে তার মৃত্যুসম্পর্কিত রচিত প্রথম বই, ‘জীবনের পর জীবন’ (Life after Life)-এ ব্যবহার করে একটি খুবই জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত সংজ্ঞার জন্ম দিয়েছিলেন। এটি তার সবচাইতে বেশি বিক্রি হওয়া বই। পঞ্চাশের অধিক ভাষায় এ পর্যন্ত অনুুদিত হয়েছে। এখনও নিয়মিত নতুন নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তার গবেষণায় মৃত্যুর কাছাকাছি অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া বিষয়গত ঘটনাগুলির ব্যক্তিগত বিবরণ অন্বেষণ করা হয়েছে, বিশেষ করে তাদের যারা দৃশ্যত মারা গিয়েছিলেন কিন্ত পরে পুনরুজ্জীবিত হয়েছিলেন। তিনি ‘মৃত্যুর কাছাকাছি-অভিজ্ঞতা’ মনোবিজ্ঞানের আলোকে তার মতামত ব্যাপকভাবে প্রকাশ করেছেন- যা নিতান্তই বিশ্বাসযোগ্য এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। তার একটি বিখ্যাত উক্তি: ‘দুরারোগ্য ব্যধির আক্রমণে শারীরিক যন্ত্রনা যখন সহ্যের বাইরে, রোগীর অসহায় ক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকালে অবশ্যই মনে হবে, দ্রুত মৃত্যুই এখন তার একমাত্র পরিত্রাতা।’ অর্থাৎ ডা. রেমন্ড মুডি বিশেষ পরিস্থিতিতে ‘মৃত্যু-সহায়তা’র (ইউথেনোসিয়ার) বিপক্ষে নন। অবশ্য এটাকে সাধারণ বিষয় হিসেবে নেয়া উচিৎ হবে না। নিতান্তই ব্যতিক্রম এবং অপরিহার্য ও অনিবার্য হিসেবে বিচার করতে হবে।

একটি দুরারোগ্য এবং বেদনাদায়ক রোগে বা অপরিবর্তনীয় কোমায় ভুগছেন এমন রোগীর জন্য কোনো চিকিৎসকের মাধ্যমে বেদনাহীন ও প্রশান্তির মৃত্যুর ব্যবস্থা করাকেই ইউথেনোসিয়া বলা হয়ে থাকে। তবে বেশির ভাগ দেশে এই অনুশীলনটি অবৈধ ও বেআইনি। আমরা এ ব্যাপারেই টমাসের স্ত্রী লিজার সাথে আলাপ করার জন্য আজ এসেছি। চার-পাঁচবার বেল বাজাতে হলো। মা-মেয়ে দুজনেই ভীষণ অলস। মায়ের মত আনারও বন্ধু আছে। তবে মায়ের তার বন্ধুর প্রতি খুবই টান। তাই দীর্ঘদিন ধরে একজন নিয়েই আছে। বন্ধুটি বিবাহিত। বৌর সাথে থাকে না। আলাদা বাসায় থাকে। লিজার সাথেও থাকে না। আমার সাথে কয়েকবার কথা হয়েছে। হসপিসে সে টমাসের সাথে মাঝে মাঝে দেখা করতে আসে। দুজনেই জানে কার মনে কী আছে! টমাস যতদিন সুস্থ ছিল, সে ছিল পারিবারিক বন্ধু। দুজনে একই কারখানায় কাজ করত। টমাসের অসুখের পর থেকে প্রথমে সে লিজা ও তার মেয়ের এক ধরনের অভিভাবক হয়ে যায়। তারপর টমাসের অসুখ খুবই মারাত্মক হয়ে যাবার পর তাকে সাধারন হাসপাতাল থেকে দুরবর্তী এক বিশেষ চিকিৎসার হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হলো। এখানকার হাসপাতালে যতদিন টমাস ছিল ওর বৌ এবং বন্ধু ভিক্টর চক্ষুলজ্জায় হোক বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, ব্যবধান বজায় রেখে চলত। অসুস্থ বন্ধুর পরিবারের সহায়তাকে সামনে রেখে ভিক্টর লিজার সাথে গভীর কোনো সম্পর্ক স্থাপন করেনি। অন্তত বাইরে বাইরে তারা শোভন ও ভদ্র আচরণ করত। তারপর টমাস বহু দূরে হ্যানোভারে বিশেষ হাসপাতালে বদলি হবার পর ভিক্টর তার শূন্যস্থান পূরণ করতে কোনো দ্বিধাই করেনি। বৌ লিজাও তো এরকমই একটা সুযোগ সন্ধান করছিল। সেই সময় মেয়ে আনাও তার পঞ্চম বন্ধুর সাথে স্টুটগার্ট শহরে থাকত। বিড়াল বেরিয়ে গেলে যেমন ইঁদুরেরা বাড়িতে পার্টির আয়োজন করে, তেমনি ভিক্টর ও লিজা সর্বসমক্ষে তাদের দ্বৈত রোমান্টিক জীবন শুরু করল। ভিক্টর তার বাসায় কাজের দিনগুলি থাকত এবং সপ্তাহান্তে দু’দিন লিজার সাথে থাকত। মেয়ে আনাও তার বন্ধুর সাথে বিচ্ছেদ হবার পর মায়ের বন্ধুকে পূর্ণভাবে মেনে নিয়ে ঘরে ফিরে এল। অর্থের অভাব নেই। টমের অসুস্থতার ভাতা প্রায় বেতনের সমান। ভিক্টর কারখানায় উচ্চপদস্থ! কাজেই টমাসের অনুপস্থিতিতে মা-মেয়ে আর ভিক্টরের জীবনযাপনে কোনোই অসুবিধা হলো না। জার্মানিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বিশ্বস্ততা, সংসারের প্রতি দায়িত্ববোধ, বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধা এসব ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। জার্মান-নারীরা  মহাযুদ্ধে নিহত লক্ষ লক্ষ পুরুষ ও মিত্রশক্তির হাতে বন্দিদের স্থানে অর্থনীতির হাল ধরে নারী-জাগরণ আর নারী স্বাধীনতার সূত্রপাত করল। সেই যে রমনীরা বাড়ির বাইরে আসলেন, আর ফিরে যাননি। আমি এসব কথা পাদ্রি নোয়েলের কাছে শুনেছি।

বিশেষ হাসপাতালে টমাস প্রায় নয়মাস ছিল। চিকিৎসায় কোনো উন্নতি হয়নি। প্রথমে পায়ের পাতা, তারপর হাঁটু, শেষে কোমর নাগাদ স্নায়ুর ক্রিয়া গোলমাল হয়ে অর্ধাঙ্গ অবশ হয়ে গেল। হুইল চেয়ারেও সে বসতে পারে না। সবসময় অন্যের সহায়তা লাগে। শুতে-বসতে-বাথরুম-স্নান-বেড়ানো সবই অন্যের সাহায্য ছাড়া অসম্ভব হয়ে গেল। শরীরের অর্ধেক অবশ হয়ে গেলেও টমাসের মস্তিস্ক পূর্ণ সচল ছিল। কথাবার্তা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। ক্ষুধা, অনুভূতি, সাধারণ কাজকর্ম যেমন লেখা, পড়া, টিভি দেখা সবই করতে পারত। দুই হাত সম্পূর্ণ কর্মঠ। এ সময়েই আকস্মিকভাবে তার রোগের নিশ্চিত পরিণতি দেখা দিল। যা ডাক্তাররা অনেক আগে থেকেই আশঙ্কা করেছিলেন। বুকে, পিঠে, মেরুদন্ডে, যেসব অঙ্গ তখনও সক্রিয় ছিল, সে সব জায়গায় তীব্র ব্যথার আবির্ভাব হলো। অমানুষিক, অসহ্য ও এতটাই তীব্র যে টমাসের একান্ত চেষ্টা সত্ত্বেও সে স্থির থাকতে পারত না। চুপ থাকার একান্ত প্রচেষ্টা করেও এক সময় প্রাণঘাতী ব্যথায় মর্মভেদী চিৎকার করত! ডাক্তাররা নানা ওষুধ দিয়ে সাময়িকভাবে ব্যথাকে দমন করতেন কিন্ত কয়েক ঘণ্টা পরেই আবার পুর্ববৎ! তারা পরামর্শ করে স্থির করলেন, যেহেতু এ ব্যথার স্থায়ী নিরাময় নেই তাই তাকে কোন হসপিসে গিয়ে প্যালিয়েটিভ চিকিৎসা নিতে হবে। প্যালিয়েটিভ রোগীর মূল রোগকে দুর করতে পারে না। এর উদ্দেশ্যও তা নয়। শুধুমাত্র নানারকম ব্যধা নিরোধ প্রক্রিয়া, ওষুধ নিয়মিত দিয়ে যতদিন সে বেঁচে থাকে, ততদিন যথাসম্ভব একটি ব্যথাহীন জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করা।

ভাগ্যক্রমে টমাসের শহরেই এরকম একটি হসপিস ও প্যালিয়েটিভ চিকিৎসার সুব্যবস্থা আছে যা সারা জার্মানিতে সর্বজনবিদিত। টেলিফোন করে তারা জানতে পারলেন ওখানে টমাস এখনি যেতে পারে, জায়গা খালি আছে। টমাসের শহরের নাম ববলিঙ্গেন। আমি সেই সময় যে শহরে থাকি শোনাইখ থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে। আমি ওখানেই ১৯৯৭ সালে পাদ্রি রবার্টের মাধ্যমে হসপিসের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। তিনি ছিলেন আমার শহরের গির্জার পাদ্রি। পাদ্রি নোয়েল ববলিঙ্গেন ক্যাথলিক গির্জার পাদ্রি এবং সেখানকার হসপিসের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আমার সাথে পরিচয় অনেক আগে থেকেই।

টমাসের নিজের শহরে এসে হসপিসে থেকে প্যালিয়েটিভ চিকিৎসাধীন থাকাটা লিজা এবং তার মেয়ে কেউই পছন্দ করেনি। হ্যানোভার এখান থেকে চারশ কিলোমিটার দূরে, ডেনমার্কের বর্ডারে উত্তর জার্মানে। আর  আমরা থাকি দক্ষিণ জার্মানে। এ রাজ্যের রাজধানী স্টুটগার্ট। লিজা অনুরোধ করেছিল হ্যানোভারেই টমাস স্থানীয় কোনো হসপিসে থাকতে পারে কি না। ডাক্তারদের অভিমত- ববলিঙ্গেনে ওর থাকাটা সবচাইতে সুবিধার। মৃত্যুর সময় পরিচিত পরিবেশে, বন্ধু-বান্ধবদের সান্নিধ্যে সবাই থাকতে চায়। টমাসের বিশেষ রোগ, প্রচন্ড ব্যথা, অর্ধাঙ্গ অবশ। তাই কোনো উপায় নেই যে সে নিজের বাসায় থাকতে পারবে। কিন্ত শহরের হসপিসে থাকলে ঘরের স্পর্শ তো কিছুটা পাবে! ডাক্তারদের নির্দেশ অবজ্ঞা করার প্রশ্ন্ই উঠে না। গ্রীষ্মকাল প্রায় শেষ। হেমন্তের আগমণ সূচিত হচ্ছে। এক উজ্ঝল বিকেলে দীর্ঘপথ হেলিকপ্টারে উড়ে টমাস ববলিঙ্গেন হসপিস ভবনে এল। পাদ্রি নোয়েল তাকে আনতে হ্যানোভার গিয়েছিলেন। বৌ লিজা কী এক অসুখের দোহাই দিয়ে তার সাথে যায়নি। মেয়ে আনা কথা দিয়েও যাওয়ার সময় তাকে নোয়েল খুঁজে পায়নি। বিশেষ হাসপাতালের একজন ডাক্তার টমাস ও নোয়েলের সাথে এল। আমরা আগে থেকেই জানতাম। আমি ও হসপিসের সেক্রেটারি ক্লারা, কর্মী আলেক্স, স্থানীয় ডাক্তার বোরিস সবাই মিলে অপেক্ষা করছিলাম। ঘড় ঘড় শব্দ করে, ধুলো উড়িয়ে হেলিকপ্টার উড়ে এল। স্ট্রেচার দিয়ে অ্যামবুলেন্সের কর্মীরা টমাসকে নিয়ে এল হসপিস ভবনে তার কক্ষে। আমরা সবাই টমাসের সাথে পরিচিত হলাম। আমার  সাথে করমর্দন করার সময় টমাস একটানা অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে হাত ধরে ছিল। চোখ চিক চিক করছে। অশ্রুর আভাস। কেন? পরে জুরিখে মারা যাওয়ার আগে তার কারণ বলেছিল কেন সে আমাকে দেখে এতটা আভিভূত হয়েছিল।

হ্যানোভারের ডাক্তার আমাদের ডাক্তার বোরিস ও আমাদেরকে টমাসের রোগের বিবরণ, সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র, রিপোর্ট, তাকে ব্যথা উপশমের জন্য কী কী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে, সে সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করে, হেলিকপ্টারে বিদায় নিলেন। আমরা তাকে নানা প্রশ্ন করে আমাদের কী করণীয় সে সম্পর্কে ওয়াকেবহাল হলাম।

টমাসকে আসার আগে হ্যানোভারে একটি কড়া ব্যথ্যানিরোধ ইনজেকশন দেয়া হয়েছিল। তার জন্য সে এতক্ষণ কোনো ব্যথাই বোধ করেনি। আশ্চর্যের ব্যাপার, লিজা বা আনা কেউ আসেনি। ভিক্টর এসেছিল। পুরোনো বন্ধুকে দেখে টমাস বেশ খুশিই হয়েছিল। তার জিজ্ঞাসার জবাবে ভিক্টর বলল, লিজা অসুস্থ, শয্যাশায়ী। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আসতে পারেনি। আনা স্টুটগার্ট গিয়েছে সকালে, এখনও ফেরেনি। পশ্চিমা সভ্যতার এই হলো অবস্থা! মরণাপন্ন স্বামী, বাবাকেও বৌ আর সন্তান দেখতে আসে না!

দু হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে আনা ধুঁকতে ধুঁকতে দরজা খুলে দিয়েই দৌড়ে চলে গেল। বাকি ঘুমটা যাতে নষ্ট না হয়। না আদাব না সালাম! আমরা দুজনেই বেকুব হয়ে গেলাম। পাদ্রি নোয়েল মনে হলো এসব ব্যবহারে অভ্যস্ত। তাকে নানা ঘরে নানা সংসারে খৃষ্টের বাণী প্রচারে যেতে হয়। অনেকে নাকি রাগে মৃদু প্রহারও করে থাকে! ‘পরকে আন্তরিকভাবে ও অকুন্ঠভাবে ভালোবাসো’- এই নীতির গোঁড়া সমর্থক পাদ্রি নেয়েল এসবের কোনো তোয়াক্কা করে না। আমরা দুজনে ঢুকে প্যাসেজে জুতা খুলে বসার ঘরে ঢুকলাম। বাড়িটি বিশাল। টমাস বড় চাকরি করত। নামকরা ইঞ্জিনিয়ার। প্রাণ খুলে মনের মত করে গৃহটি নিজেই নির্মাণ করেছেন। কিন্ত যত্ন ও দেখাশোনার অভাবে সব নোংরা হয়ে আছে।

আসবাবপত্রগুলি নিষ্প্রাণ, রংহীন ও ফ্যাকাশে। অনেকক্ষণ বসার পর লিজা এল। গায়ে পাতলা একটা গেঞ্জি। এতই ছোট যে দুই বুক উপচে আছে। বের হয়ে পড়ল বলে! পরনে আনা যে হাফ প্যান্ট পড়েছিল তার চেয়েও ছোট একটি সংক্ষিপ্ত কৌপিন! মোটাসোটা শরীর, গ্রীষ্মকাল বেশ গরম। কিন্ত তার জন্য বাইরের লোকের সামনে (প্রায়) উলঙ্গ হয়ে আসতে হবে? কোনোমতে একটা সিঙ্গল সোফায় বসে সে যখন এক পায়ের উপরে আরেক পা রাখল, মনে হলো তার মলিন ও ক্ষুদ্র প্যান্টিটির আসল কার্য এখনি সমাপ্ত হবে। ছিঁড়ে যাবে এবং গাত্রাবরণ বলে আর কিছুই থাকবে না! ঘৃণা আর ক্রোধে আমি চোখ ফিরিয়ে থাকলাম। এসব নির্লজ্জতা আমি কখনই পছন্দ করি না। কখন উঠব সেই ভাবনায় লিপ্ত হলাম। পাদ্রি আমাকে লিজার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি এই প্রথম এসেছি এবং অবশ্যই শেষবার! ও বসে বসেই হাত বাড়িয়ে দিল। আমি ভ্রুক্ষেপ না করাতে মুখটা কুঁচকে হয়ত নিরবে আমাকে গালিই দিল। পাদ্রি নোয়েল কথা শুরু করল। যে জন্য আমরা এসেছি।

হ্যানোভার থেকে টমাস এসেছে মাসখানেক হলো। অবস্থার কোনো উন্নতি তো হয়ই নি; বরং এখন ব্যথার প্রকোপ আরও প্রাণঘাতী ও সহ্যের একেবারেই বাইরে। আসার পর থেকেই তাকে ডাক্তারের নির্দেশিত মাত্রায় নিয়মিত মরফিন দেয়া হচ্ছে। প্রথমে ছিল তিনবার, এখন প্রায় ৫-৬ ঘণ্টা পর পরই দিতে হয়। টমাস খুবই বিবেচক ও ভদ্রলোক। সহ্যসীমাও তার সাধারণের চাইতে অনেক বেশি। কিন্ত এখন সে প্রায় প্রতিদিনই, প্রতিক্ষণ যখন যন্ত্রনায় কাটা মুরগীর মত ছটছট করে, বুঝতে হবে, মৃত্যু ছাড়া তার আর কোনো বিকল্প নেই। হসপিসের তিনজন ডাক্তারের কমিটি, কর্পোরেশানের প্রতিনিধি, হসপিস সেক্রেটারি এবং লিজা তাই গত সপ্তাহে একসাথে টমাসকে জিজ্ঞেস করেছে, এমতাবস্থায় সে বাঁচতে চায়, না মরতে চায়? টমাস তৎক্ষণাৎ বিন্দুমাত্র না ভেবেই, সজোরে বলেছে সে মরতে চায়। তাকে ওষুধ দিয়ে মারা হোক! এর পরের পদক্ষেপ হিসেবে জার্মান আইন অনুযায়ী, জেলা কোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চে লিজা আবেদন করেছে তার স্বামীকে অমানুষিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়া হোক ইউথেনসিয়ার মাধ্যমে। ডাক্তার তাকে বিষ ইনজেক্ট করবেন। ইউরোপের কয়েকটি দেশে, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, হলান্ডে এই ব্যবস্থা এখন আইনসম্মত। এই সব দেশে বিশেষ ক্লিনিক আছে। সেখানে মরণেচ্ছুক এবং ‘তার রোগের আর কোনোই চিকিৎসা নেই’ এই মর্মে ডাক্তারের সার্টিফিকেট নিয়ে ভর্তি হতে হয়। তারপর ডাক্তার, রোগী, তার সঙ্গী মিলে পরামর্শ করে মরণের ইনজেকশন দেবার দিন-তারিখ ঠিক করেন। খরচ গড়ে প্রতিদিন ও রাতের জন্য প্রায় ৫০০- ডয়েচে মার্ক (তখনও ইউরোর প্রবর্তন হয়নি) এবং দুই থেকে তিনদিনেই ঘটনার নিষ্পত্তি হয়ে যায়। রোগীর যেতে হয় নিজস্ব বাহনে এবং যাবার আগে ক্লিনিকের সাথে ফোনে কথা বলে কবে যেতে পারবে তা ঠিক করা হয়ে থাকে। সাধারণত রোগীর বন্ধু, ঘনিষ্ঠ কোনো আত্মীয় রোগীকে নিয়ে ক্লিনিকে যান। এমনও শুনেছি যন্ত্রণার ভয়াবহতা সহ্য করতে না পেরে, স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে গাড়িতে করে ক্লিনিকে নিয়ে গেছেন এবং মৃত্যুর পর শেষকৃত্যও সমাপ্ত করেছেন। সে ব্যবস্থাও প্রতিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে করা যায়। কবর দেয়া বা পোড়ানোর জন্য ফার্ম আছে। তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণে ফি দিলেই সব কিছু তারাই সম্পন্ন করে। সব সাঙ্গ করে সঙ্গী, বন্ধু বা স্বামী/স্ত্রী একা ফিরে আসেন। জীবিতকে গাড়িতে করে নিয়ে যান কিন্ত মৃতকে বহন করে জার্মানিতে অন্তত আনা সম্ভব নয়। এখানে এখনও ‘ ইউথেনসিয়া’ আইনত অপরাধ। ধরা পড়লে ডাক্তারের লাইসেন্স বাতিল করা হয় এবং সংশ্লিষ্ট সঙ্গীকে মোটা দাগের ফাইন করা হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই আইন চোখ বন্ধ করে রাখে!
অল্প কথাতেই লিজা আমাদের প্রস্তাব, টমাসের স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্য সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যাওয়াকে, বিশদ কোনো বিবরণ না শুনেই গ্রহণ করল। মনে হলো সে এতে খুশিই হয়েছেন। তবে তার শরীর খুব খারাপ, সে টমাসের সাথে সুইজারল্যান্ড যেতে পারবে না। আনা যাবে কি না সে বলতে পারে না। তবে সে তাকে জিজ্ঞেস করে আমাদের জানাবে। ‘শারীরিক অসুস্থতার জন্য যাবে না’, মিথ্যা কথা- তাকে দেখে তো মনে হলো গত এক বছরে তার কোনো কিছুই হয়নি। মিনিটে মিনিটে সিগারেট খেয়ে সে এক বসাতেই মনে হয় দশটি সিগারেট পান করল! এমনভাবে টমাসের স্বেচ্ছামৃত্যু সম্পর্কে কথা বলছে, যেন কোথাও তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে! তবে খরচপত্র সব বহন করার প্রতিশ্রুতি দিল। আমরা চাইলে সেদিনই সে চেক লিখে দেবে। সামনেই লক্ষ লক্ষ টাকার জোয়ার আনছে। সেজন্য কয়েক হাজার লগ্নি করতে ক্ষতি কি! পাদ্রির অনুরোধে সে ডাক্তারের সার্টিফিকেট আনার সময় সাথে থাকবে, বলল। সব ডাক্তারই এসব সার্টিফিকেট দেয় না। কিছু কৃষ্ণ-মেষ আছে যারা বিরাট একটা অঙ্কের বিনিময়ে সবধরনের সার্টিফিকেটই বিনা দ্বিধায় দেন। দুর্নীতি শুধু তৃতীয় বিশ্বেই একচেটিয়া নয়। কথা শেষ হলে বিরাট একটা স্বস্তি নিয়ে চলে এলাম। ভাবছি টমাসের মত আপাদমস্তক ভদ্রলোক, ভালো মানুষ কীভাবে এই সর্পিনীকে নিয়ে এতদিন ঘর করেছে? তারপর নিজের ইচ্ছায় মরে সে একে কোটিপতি বানাচ্ছে! বিধাতার ধরাধামে আসলেই কোন ন্যায়বিচার নেই।

ফিরে এসে টমাসকে খবরটা দিতেই সে খুব একটা আশ্চর্য হলো না। লিজা যে রাজি হবে, সে সেটা ভালো করেই জানত। সাথে যাবে না, শুনে সে আরও খুশি হলো এবং ধপ করে বলল, আর কাউকে বলার দরকার নাই। আবদুল্লাহ যাবে আমার সাথে। শুনে আমি তো সাত বাঁও পানির তলে! অনেক বলেও তার মত বদলাতে পারলাম না। মরার জন্য একজনকে এক দেশ থেকে আরেক দেশে নিয়ে যতে হবে, ভাবলেই তো গা কাঁটা দিয়ে উঠে! টমাস বলল, আবদুল্লাহ যদি তার সঙ্গী না হয়, তাহলে সে এভাবেই কষ্ট যতই হোক এখানেই থাকবে।

তখন আমি আমার বান্ধবী মার্গারেটের সাথে একত্রে থাকি। সে তো শুনেই এক কথায় না করে দিল। প্রশ্নই উঠে না! আমি গ্যাঁড়াকলে! একদিকে টমাস বেচারা প্রতি মুহূর্তে অমানুষিক কষ্ট পাচ্ছে। অন্যদিকে মার্গারেট! তার কথা ঠেলে তো কোথাও যেতে পারি না। একজন জার্মান পুরুষ, আরেকজন জার্মান রমনী! মাঝখানে আমি ভেতো বাঙালি! দুজনেই আমার প্রিয়। যাই হোক, পাদ্রি রবার্ট, মার্গারেট ও আমার দুজনেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মার্গারেটকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করালেন।

পাদ্রি নোয়েল লিজাকে নিয়ে ডাক্তারের সার্টিফিকেট যোগাড় করলেন। একটি প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স ফার্মের মাইক্রোবাস ভাড়া করা হলো পাঁচ হাজার মার্কে। শুধু জুরিখ নিয়ে যাবে। দু’শো কিলোমিটার রাস্তা। দক্ষিণ জার্মানির আমাদের প্রদেশ বাদেন-ভুর্টেমবার্গের সীমান্তের পাশেই সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহর। আন্তর্জাতিক ব্যাংকের শহর। এমন দেশ নেই যার শাখা এখানে নেই। একটা খুপরির মত ঘরে বাংলাদেশের সোনালি ব্যাংকেরও শাখা আছে! নোয়েল ক্লিনিকের সাথে দু’রাতের জন্য টমাস ও আমার জন্য দু’টি সিঙ্গল কক্ষ ভাড়া করেছে। টমাসের ঘরটি হাসপাতালের মত। নানারকম যন্ত্রপাতি দিয়ে সজ্জিত। হাসি পেয়েছিল আমার দেখে। মরতে এসেছে টমাস। কিন্ত মরা পর্যন্ত তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই ব্যবস্থা! এই জীবনে যে আরো কত প্যারোডি দেখতে হবে! আমার ঘরটি নর্মাল হোটেলের মত। ক্লিনিকটি তিন তলা। নিচের তলায় রিসেপশন, অফিস, ক্যান্টিন, কর্মীদের বসার ঘর, স্টোর রুম, ফার্মেসি। দোতালায় ছয়টি রোগীদের (মৃত্যুপথযাত্রী) ঘর। উপরতলায় রোগীদের সঙ্গীদের থাকার জন্য চারটি ঘর, রান্না ঘর, খাবার ঘর, রাতে ডাক্তার-নার্সদের বিশ্রাম কক্ষ ইত্যাদি। বিশাল ত্রিতল অট্টালিকা। আশ্চর্যের বিষয় হলো বাইরে কোনো সাইনবোর্ড নেই। দেখে মনে হয় কোনো আবাসিক ভবন। প্রশাসককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন সাইনবোর্ড নেই? তিনি বললেন, এটা হাসপাতাল নয়, ডাক্তারের চেম্বার নয়। লিখতে হলে লিখতে হবে- ‘এখানে আইনত, নিরাপদে ও আরামে মরার ব্যবস্থা আছে!’ কিন্ত এটা লেখার অনুমতি কর্তৃপক্ষ দেয় না। জনসাধারনের অস্বস্তির কারণ হবে।

গাড়ির ব্যবস্থা, সার্টিফিকেট, জুরিখে ক্লিনিকে জায়গার ব্যবস্থা হবার পর এক পড়ন্ত বিকেলে অ্যাম্বুলেন্সে টমাসকে রোগীর স্ট্রেচারে শোয়ানো হলো। আমি একটা ছোট্ট ব্যাগে আমার কিছু কাপড়চোপড়, জিনিসপত্র নিয়ে টমাসের পাশে বসেছি। পাদ্রি নোয়েল আমাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিলেন। আগেই হসপিসের সেক্রেটারি ও কয়েকজন কর্মী আমাদের শুভাশীষ দিয়ে বিদায় নিয়েছে। লিজা বা আনা কেউ নেই। শুনলাম তারা গতকাল এসে বিদায় নিয়ে গেছে, আজ শুধু একবার ভিক্টর এসেছিল। টমাসের কথাবার্তা, ব্যবহারে কোনোই পরিবর্তন নেই। সত্যি বেচারার ধৈর্য আর নির্লিপ্ততার প্রশংসা করতেই হয়। মনে হচ্ছে সে যেন কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে। গাড়ি ছাড়ার পর জানতে চাইল, আমি ঠিকমত বসতে পেরেছি কি না। অ্যাম্বুলেন্সে স্ট্রেচারে রোগী ছাড়া বেশ কিছু যন্ত্রপাতি, একজন নার্স টমাসের মাথার দিকে বসে আছে। কোণায় একটা টুলের মত আসনে আমি বসেছি। সেজন্যই টমাস জানতে চাইছিল আমি ভালোমত বসেছি কি না। এভাবেই টমাসের মরণযাত্রা শুরু  হলো। আমার জন্য সম্পূর্ণ একটি নতুন অভিজ্ঞতা। বাসা থেকে মার্গারেট আমাকে গাড়ি দিয়ে হসপিসে নিয়ে এসেছে। সারা রাস্তা একটা কথাও বলেনি। গুম হয়ে বসে সোজা রাস্তার দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালিয়েছে। একবারও আমার দিকে মুখ ফেরায়নি। গাড়িতে ও থাকলে আমাকে কখনই গাড়ি চালাতে দেয় না। আমি লাইসেন্স করেছি তিন বছর হলো। মোট পাঁচবার অ্যাক্সিডেন্ট করেছি। কোনোটাই অবশ্য মারাত্মক নয়। মার্গারেট তিরিশ বছর ধরে গাড়ি চালায়। একবারও দুর্ঘটনা হয়নি! মেয়েরা আসলেই পুরুষদের তুলনায় ভালো গাড়ি চালায়। ও চায়নি আমি টমাসকে নিয়ে জুরিখ যাই। সেজন্যই থমথমে মুখ ও খুবই বিষণ্ন। নার্স টমাসকে একটা মনে হয় কড়া ডোজের ঘুমের ইনজেকশন দিল। কয়েক মুহূর্তেই টমাস গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে গেল। গ্রীষ্মের শেষ চলছে। সূর্য এখনও শক্তিমান। আকাশে কিছু মেঘেরও আনাগোনা। কিছুক্ষণ পরেই আলো আঁধারি চারদিকে। গাড়ির হেডলাইট জ¦ালানো। গাড়ির মধ্যেও একটা ছোট্ট বালব জ¦লছে। নার্সের গায়ের একটা বিরাট ছায়ার প্রতিবিম্ব গাড়ির দেয়ালে। মনে হয় কেউ ওঁৎ পেতে বসে আছে। একটা ভূতুড়ে ভাব। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। অফিস ছুটির ভিড় বহু আগেই শেষ! টমাস গভীর ঘুমে। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। গা সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, মৃতদেহ! এখনও বেঁচে আছেন। কিন্ত অচিরেই দেহটি লাশ হয়ে যাবে। সে ব্যবস্থা করতেই আমরা ওকে নিয়ে যাচ্ছি জুরিখে। ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন হবার পর সদস্য-ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে বর্ডারের কোনোই চিহ্ন নেই। তবে মনে হয় সুইজারল্যান্ডে ঢোকার সময় একটি পুলিশের গাড়ি দেখলাম রাস্তার পাশে পার্ক করা। দু’জন পুলিশ, একজন পুরুষ আরেকজন মহিলা, খুব জমিয়ে গাড়ির গায়ে গা ঠেকিয়ে গপ্পো করছে। সুইস পুলিশ। কথার ফাঁকে আমাদের গাড়ির দিকে এক পলক তাকাল। ভাবল, অ্যাম্বুলেসন্স। নিশ্চয়ই ভেতরে রোগী। হয়ত দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছতে হবে। কাজেই কোনো কিছুই করল না। পুলিশ আসলেই জনসাধারণের বন্ধু। অন্তত এসব দেশে। আমরা সমান গতিতেই এগিয়ে গেলাম।

রাত আটটার দিকে ক্লিনিকে ঢুকল আমাদের গাড়ি। দরজায় স্ট্রেচার নিয়ে দুজন কর্মী তৈরি। নিশ্চয়ই আমাদের ড্রাইভার আগেই ফোনে বলে দিয়েছে আমরা আসছি। টমাসকে নামিয়ে স্ট্রেচারে তুলে ওরা লিফটে দোতালায় চলে গেল। ওরা জানে টমাসকে কোন ঘরে নিয়ে যেতে হবে। আমি রিসেপশনে গিয়ে কাগজপত্র দিলাম। আমার ঘরের চাবি দিয়ে সুন্দরী রিসেপশনিস্ট বললেন, আপনার ঘর তিনতালায় চার নম্বর। রাতের খাওয়ার জন্য এখনও এক ঘণ্টা সময় আছে। অর্থাৎ সান্ধ্যাহার সাতটা থেকে ন’টা। ব্রেকফাস্ট সকালে সাড়ে ছ’টা থেকে ন’টা। দুপুরের খাবার বেলা এগারোটা থেকে একটা। বিকেলে তিনটা থেকে ক্যান্টিন খোলা। আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ক্যান্টিন। একদম কোণায়। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ওখানে চা-কফি, স্ন্যাক্স খাওয়া যাবে। অবশ্য পয়সা দিয়ে!  আমি বললাম মি. টমাসের ঘর কত নম্বর যাকে নিয়ে আমি এসেছি। মহিলা বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, দোতালায় প্রথম ঘরেই এক নম্বর। ডাক্তার ওকে এখন চেক করছেন। আপনি গিয়ে বাইরে বসুন। ডাক্তার মি. টমাসকে চেক করে আপনার সাথে কথা বলবেন।

ঝকঝকে সব আসবাবপত্র। মনে হলো একটা ধুলোও কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। নানা কায়দার আলো। তিনতালাঅবধি একটা ঝরনা! পানি উপচে পড়ছে, উপরে উঠছে, নামছে এবং নানা রঙের আলো খেলা করছে। দেয়ালে সব বড় বড় সুদৃশ পেইন্টিং। ম্যুরাল। মরার জন্য এত সুন্দর জায়গা? এক রাতে ৫০০ মার্ক নেয়। ঠিকই নেয়। স্বর্গের মত পরিবেশ। একটি মোলায়েম সেন্টের হালকা গন্ধ! ঘুম পাড়িয়ে দেয়। আমি মহিলাকে ধন্যবাদ দিয়ে উপরে এসে এক নম্বর ঘরের সামনে দেয়ালে ফিক্সড করা আরামের একটি চেয়ারে বসলাম। বসার সময় মৃদু দুলুনি। ভালোই লাগল। এখানেও দেয়ালে সব নানারকম প্রাকৃতিক দৃশ্যের বড় বড় পেইন্টিং। চোখ জুড়িয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার এলেন। অল্প বয়স ২৫-২৬ হবে। এই বয়সেই মৃত্যুর সাথে বসবাস!

‘হ্যালো মি. আবদুল্লাহ’ (আমার নাম কাগজপত্রেই দেখেছে সঙ্গী হিসেবে) করমর্দন। ‘আমি ডা. এডগার। মি. টমাসকে চেক করেছি। একদম ফিট এবং বলতে হবে একেবারে তৈরি! আপনার কথা বললেন। আপনি নাকি তার মন থেকে মৃত্যুর ভয় দূর করেছেন। রিয়েলি ফ্যানটাস্টিক। আপনারা এশিয়ান। জন্ম থেকেই সবাই স্পিরিচুয়্যাল। আমাদের অপোজিট। সময় থাকলে আপনার সাথে আলাপ করে কিছু শিখে নিতাম। এসব আবার আমাদের মেডিসিনে অ্যালাউ করে না।’
‘একদিনে আলাপ করে আপনি কিছুই জানতে পারবেন না। মাঝখান থেকে কিছু ভুল বুঝাবুঝিও হতে পারে। আজকাল ইউরোপের সব জায়গাতেই যোগব্যায়ামের স্টুডিও, বৌদ্ধ মঠ, আছে। ওখানে জয়েন করলে ভালোমত সব জানতে পারবেন। এখন বলুন মি. টমাসের মুক্তির ব্যবস্থা কবে করবেন? আমরা তো মাত্র দু’দিনের জন্য এসেছি।’ আমার মুখে ‘মুক্তির ব্যবস্থা’ শুনে মনে হয় একটু মুচকি হাসলেন। আমাদের কথাবার্তা ইংরেজিতেই হচ্ছিল। মনে হয় ডাক্তার সাহেব সুইজারল্যান্ডের জার্মান ভাষার অঞ্চলের নন। পরে শুনেছি তিনি জেনেভার বাসিন্দা। যেখানে শুধু ফরাসী ভাষা চলে।

‘আগামীকাল আমার মোট চারটি কেইস আছে। আমার কলিগ অন্যত্র ব্যস্ত। আমি এখন একা। পরশু অবশ্যই ফাইনাল করে দেব। আপনি দু’দিন জুরিখে একটু ঘুরে দেখতে পারেন। এখানে অনেক ভালো ভালো স্পট আছে।’ আমার রাগ হলো। একটু চড়া গলাতেই বললাম, ‘আমি এখানে ট্যুরিস্ট হয়ে আসিনি। জুরিখে আমি ৩-৪ বার এসেছি। কী কী দেখার জায়গা আছে তা আমি জানি এবং দেখেছি। আমি বরং সময়টা মি. টমাসের সাথেই কাটাতে চাই।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে। এখন তো মি. টমাসকে নার্স ফ্রেস করছেন। তারপর খাওয়াবেন এবং একটা সিডেটিভ দিয়ে ঘুমের ব্যবস্থা করা হবে। আপনি একটু হ্যালো করতে পারেন। আগামীকাল ও পরশু দিন ওনার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। আমাদের বিল্ডিং-এর পেছন দিকটায় বিরাট একটা বাগান আছে। বসার জায়গা ও হাঁটার পথ আছে। কৃত্রিম ঝরনাও আছে। মি. টমাসকে নিয়ে ওখানে ঘুরতে পারেন। বসে গল্প করতে পারেন। যা খুশি। ওকে চিয়ার-আপ রাখারও প্রয়োজন আছে। আফটার অল সামান্য কিছু সময়ই তো ওর অবশিষ্ট আছে। আমি পরশু রাতে আটটায় ওকে অ্যাটেন্ড করব। আপনিও ইচ্ছা করলে ওই সময় থাকতে পারেন।’

‘আর কে কে থাকবেন?’
‘আমাদের পাদ্রি, আমার একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ও একজন নার্স। আপনিও ইচ্ছা করলে থাকতে পারেন।’
‘দেখা যাক। হ্যাঁ ভালো কথা, এখন কি মি. টমাসের ব্যথাটা আবার রিলাপস করতে পারে?’
‘না, না, আমরা কয়েকটি ট্র্যাংকুলাইজারের বিশেষ একটা কম্বিনেশান তৈরি করেছি। ওটা ইনজেক্ট করলে ৬-৭ ঘণ্টা ব্যথা ফিল করার নার্ভগুলি সব অফ হয়ে থাকে। এটা শুধু এই সব বিশেষ রোগীর জন্য। যারা আর মাত্র কিছুদিন অ্যালাইভ থাকবেন। আদারওয়াইজ এটা বেশি ইউজ করলে রোগী পার্মানেন্টলি ইনভেলিড হয়ে যেতে পারেন বা এক্সপায়ারও করতে পারেন। এজন্যই সাধারণ ব্যথার রোগীদের জন্য এটা নিষিদ্ধ। আশা করি মি. টমাসকে এটা ২-৩ বারের বেশি দিতে হবে না। তার আগেই ‘ড. এডগার তার বাক্য সম্পূর্ণ করলেন না।

‘ধন্যবাদ ড. এডগার। এখন আমি মি. টমাসের সাথে কথা বলে আসি।’
‘তাই করুন। সাপারের সময়ও প্রায় শেষ হয়ে এল। জানেন তো, রাত আটটা পর্যন্ত ডাইনিং রুম খোলা থাকে।’ বলে ডা. এডগার চলে গেলেন।
ঘরে ঢুকে দেখি টমাস আধা শোয়া হয়ে খাচ্ছেন। অর্ধাঙ্গ অবশ হবার পর সে আর নিজে নিজে বসে কিছু করতে পারে না। শোয়া বা হুইল চেয়ারে বসা ছাড়া তাকে কাত বা উপুর করে বা হেলান দিয়ে রাখতে হয়। এ এমন একটি বিপর্যয় যা সুস্থ মানুষ ভাবতেও পারে না।

আমাকে দেখে টমাস জোর করে একটা হাসি দিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ‘তুমি খাওয়া-দাওয়া করেছ?’
‘না, এখন খেতে যাবো। তোমাকে গুড নাইট বলতে এলাম। এখন কেমন আছো। ব্যথা নেই তো?’  
‘আর থাকা। ডাক্তার বলল, আগামীকাল কাজ হবে না। কেন যে আবার একদিন বেশির ঝামেলা! মরতে চাইলেও, ইচ্ছামত মরা যায় না। তুমি আগামীকাল চলে যেতে পারো। থেকে কী হবে? আমি একাই শেষ বিদায় নিতে পারব।’

আমার মনটা হা হা করে উঠল। বৌ, মেয়ে কেউ সাথে আসেনি। পুরোনো বন্ধুদের কেউ না। আমি নিয়ে এসেছি মার্গারেটকে কষ্ট দিয়ে। এখন বলছে, আমি কাল চলে যাই! না, আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থাকব। বললাম, ‘সে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। আগামীকাল ও পরশু আমরা কথা বলব, কত কিছু বলার আছে, শোনার আছে। আর হ্যাঁ, এখানে দালানের পেছনে একটা সুন্দর ও বড় বাগান আছে। ঝরনা আছে। ওখানে তোমাকে নিয়ে গিয়ে আমরা ঘুরব। বসে গল্প করব।’ টমাস খাওয়া থামিয়ে হা করে আমার কথাগুলি শুনছিল। নার্সের হাতে একটা সিরিঞ্জ। ঘুমের কড়া অষুধ নিয়ে তৈরি। ও বুঝেছে, আমি টমাসের কোন আত্মীয় নই। এ দেশের লোক নই। মৃত্যুসঙ্গ দিতে এসেছি। টমাস বলছে, আমাকে চলে যেতে এবং আমি যেতে চাচ্ছি না। নার্স নিশ্চয়ই জার্মানভাষী। আমাদের সব কথা বুঝতে পেরেছে। ওর হয়ত বিশ্বাস হচ্ছে না, আমি কি বলছি।

‘এখন খাওয়া শেষ করে ঘুমাও। আমিও যাই। আগামীকাল সকালে আসব।’ বলে আমি চলে আসলাম। নিচের তালায় গিয়ে খেয়ে তিন তালায় এসে চার নম্বর ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সারাদিন অনেক ঝক্কি গেছে। ভীষণ টায়ার্ড।
পরের দিন সকালে ক্যান্টিনে নাশতা করতে গিয়ে দেখলাম শুধু একটা টেবিলে দু’টি লোক বসে আছে। আমি এসেছি আটটার পরে। এর আগেই সবাই নাশতা করে ফেলেছে! সঙ্গী আর কেউ কি এখানে নেই? ডাক্তার যে বলল, চারটি কেস আছে আজ। তাদের সাথে কেউ নেই? আমি বুফেতে গিয়ে খাবার ট্রেতে নিয়ে যেখানে বসলাম তার পাশের টেবিলে সেই দু’জন বসা। আমাকে বিদেশী দেখে ভাবল, হয়ত আমি জার্মান জানি না। তারা মন খুলে কথা বলতে থাকল। একজন বলছে, (বাংলা ভাষায় তর্জমা করছি) ’গতকাল মাত্র একটা মুরগা এসেছে জার্মান থেকে।’ মানে আমার ও টমাসের কথা বলছে। আরেকজন বলল, ‘ইচ্ছা করে কে আর মরতে চায়? ব্যথায় পাছা ফেটে গেলেই এখানে আসে। আজ আছে চারটে কেস। ড. এডগার একা। আবার না সেইবার ড. বিল যেমনটা করেছিল, তেমন করে!’

‘কী করেছিল ডা. বিল?’  ‘কেন জানো না, পেসেন্টকে ভুল ইনজেকশন দিয়ে মারার বদলে চাঙ্গা করে তুলেছিল। যেটা পুশ করার করার কথা, তা না করে অন্য একটি ঢুকিয়েছিল। দোষ আসলে নার্স রেগিনার। মাগী আসল ওষুধের বদলে অন্য একটা ট্রেতে রেখেছিল। সারা বিল্ডিং হৈ চৈ! চিফ ডা. হুভার শেষমেষ ঠিক ইনজেকশন নিয়ে পুশ করে। পেসেন্ট তো নিতেই চায় না। হাউ হাউ করে চেঁচাচ্ছিল। বিষের বদলে অ্যাড্রেনালিন পুশ করলে যা হয় আর কী! নার্স রেগিনাকে তো ঐদিনই তাড়িয়ে দিয়েছে।’

আরেকজন বলল, ‘এভাবে যদি সপ্তাহে মাত্র একজন দুজন করে আসে মরতে তাহলে আমাদের চাকরির তো বারোটা?’ ‘না, না, রোজিনা (প্রশাসিকা) বলেছে সামনের সপ্তাহে সাতজন বুক করেছে। সামনের মাসেও অনেক বুকিং আছে। হে ইশ্বর, অনেক অনেক মানুষকে এমনভাবে যন্ত্রণার প্যাদানি দাও যে আমাদের ক্লিনিক সবসময় যেন ভরা থাকে! আমি গির্জায় চারটি মোমবাতি জ্বালাব।’

ভাবছি এরা কি মানুষ? একটা মানুষকে মারা হচ্ছে। সামান্য সমবেদনার বদলে অশ্লীল ভাষায় তার বর্ণনা করছে। এরা তো সাধারণ স্বাস্থ্য কর্মী। ট্রেনিং নিয়ে এসেছে ডাক্তারদের আদেশ-নির্দেশে কাজ করার জন্য। শিক্ষিত ডা. এডগার কী বলল কাল? মরার ইনজেকশন দেবে। তাকে বলে হ্যান্ডল করা। ‘মারা’কে বলে ফাইনাল করে দেবে!

নাশতা করার আর কোনো ইচ্ছাই রইল না। সামান্য নেড়ে চেড়ে উঠে গিয়ে টমাসের ঘরে গেলাম। একজন নার্স বিছানার পাশে বসে একটা বিচিত্র রঙিন ম্যাগাজিন পড়ছে। নিশ্চয়ই গসিপ-পত্রিকা। টমাস ঘুমুচ্ছে। ডা. এডগারের কথিত ব্যথা-নিরোধক কম্বিনেশানের পাওয়ার সত্যিই প্রচণ্ড। বিকেলে টমাসকে জাগ্রত পাওয়া গেল। ওকে চেয়ারে বসে লিফট দিয়ে নিচে এনে প্রথমে ক্যান্টিনে ঢুকে দুজনে কফি-কেক খেলাম। টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্ত যেমন ভেবেছিলাম, তেমন না। কী কথা হবে এমন পরিস্থিতিতে?

ওকে নিয়ে বাগানে গেলাম। আমি সকালে নাশতার পর টমাসকে ঘুমুতে দেখে একাই বাগানে অনেকক্ষণ ছিলাম। সত্যিই বাগানটি দেখার মত। অজস্র গাছপালা, অনেক রকম ফুলগাছের ঝোপ। কৃত্রিম ঝরনা, ছোট ছোট ঝিল বিরাট এলাকাজুড়ে। লক্ষ্য করলাম টমাস একবারও ওর বৌ বা মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করলো না। কিন্ত জানি ওদের কথা সে ভাবছে। আমি চাইছিলাম, কথাটা তুলুক। আমি তাকে যতটা পারি শান্ত করি। কিন্ত সে নিজের পারিবারিক কোনো কথাই বলল না। শৈশবের কথা বলল, বাবা-মায়ের কথা বলল। আমার কাছে জানতে চাইল, মার্গারেটকে আমি বিয়ে করব কি না। বিদেশে একা থাকার কোনো অর্থ নেই। জোর গলায় বলল, আমার বিদেশে আসাটা মস্ত বড় ভুল হয়েছে! এখনও সময় আছে, হয় মার্গারেটকে বিয়ে করে এখানে সংসার পাতা। নয় অনতিবিলম্বে একা দেশে চলে যাওয়া!  তার কথা বহু সময় আমি নষ্ট করেছি। আর নয়।

সাথে এলাম ওর শেষ সময়ে ওকে স্বস্তি দিতে, শান্তি দিতে উল্টো ওই আমাকে পরামর্শ দিচ্ছে। কে কাকে সঙ্গ দিচ্ছে তাহলে? টমাসের মত এতটা বুদ্ধিমান ও বিবেচক লোক আমি খুব কম দেখেছি। প্রচন্ড ব্যথাটা না থাকলে ও যে করেই হোক বেঁচে থাকত। অর্ধাঙ্গ অবশ হলেও তার মনের জোরের কমতি হতো না! কিন্ত অমানুষিক, ভয়ঙ্কর অসহ্য যন্ত্রণা। সারাটা সময় মরফিন বা কড়া সেডেটিভ বা কম্বিনেশান খেয়ে আর কতদিন বেঁচে থাকা যায়? এসব তো স্থায়ী কোনো সমাধান নয়; বরং অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়। ডোজ কমে না বরং ক্রমেই বাড়ে। অনেকের নেশা হয়ে যায়। ব্যথা না থাকলেও পেইন-কিলার খেতে চায়!

একটা সময়ে আমি টমাসকে জিজ্ঞেস করলাম, হ্যানোভার থেকে ববলিঙ্গেন হসপিসে আসার দিন ও কেন আমার হাত অনেকক্ষণ ধরে রেখেছিল। কেনই বা তার চক্ষুদ্বয় অশ্রুসজল হয়ে গিয়েছিল। উত্তরে সে একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার বলল। সে নাকি হ্যানোভার থেকে ফিরে আসার বেশ কয়েকদিন আগে স্বপ্নে আমাকে দেখেছিল। তার স্পষ্ট মনে আছে। আমাকেই সে দেখেছে। ‘কোথায়?’, আমি জানতে চাইলাম। ‘আফ্রিকা বা এশিয়ার কোনো দেশে। চাপা একটি রাস্তা, ইট বসানো। দুদিকে বাড়িঘর, ইউরোপের মত না। পাশ দিয়ে একটি শীর্ণকায়া নদী বয়ে যাচ্ছে। দু’একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে। জানো কি আবদুল্লাহ আমি তানজানিয়াতে একটি গ্রামে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানোর কাজে আমার ফার্ম থেকে দায়িত্ব পেয়ে ছয়মাস ছিলাম। ওখানে যেমন বাড়িঘর ছিল সেরকমই। টিনের, বাঁশ-কাঠের। লোকজনও ওরকমই। রাস্তায় জলকাদা। দু’পাশে ঘরগুলিতে দোকানপাট। নানারকম জিনিসপত্র। ঘরকন্নার, পাত্র, বাসন ইত্যাদি। সে রাস্তায় আমি তোমার হাত ধরে হাঁটছি। হঠাৎ একটা রিকশা আমাদের প্রায় গায়ের উপর দিয়ে চলে গেল।’ এ পর্যন্ত শুনেই আমি মহা স্তম্ভিত! এ তো আমার প্রাণের শহর জামালপুরের কথা বলছে। চাপা রাস্তা, পাশে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র, দুই পাশে দোকান! আমরা ঢাকাইয়া পট্টি বলতাম। সব দোকানই ঘরকন্নার, বাসনপত্রের, সস্তা প্রসাধনের। আমার বিশ্বাস হতে চাইল না। কিন্ত বর্ণনা তো আমার নিজের কানেই শুনলাম। যে আগামীকাল মারা যাবে, সে কেন আমাকে মিথ্যা কথা বলবে? টমাস বলল, ‘হ্যানোভারে সে একজন ভবিষ্যদ্বক্তা প্রেসব্রিটানিয়ান সাধুকে পাশের বেডে রোগী হিসেবে পেয়েছিল। তাকে এটা বলার পর সে বলেছিল, -তুমি অচিরেই এখান থেকে চলে যাবে এবং যেখানে যাবে সেটা তোমার বাসা নয়। সেখানে যাকে তুমি স্বপ্নে দেখেছ তাকে পাবে। তোমার সাথে তার সখ্যতা হবে- তখনও আমার হ্যানোভার থেকে ববলিঙ্গেনে আসার কথা উঠেনি। এক সপ্তাহ পরে ডাক্তাররা আমাকে ববলিঙ্গেন হসপিসে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সাধু যেভাবে বলেছিল, আমার বাসায় নয়, হসপিস ভবনে এবং প্রথম দিনেই আমি তোমার দেখা পেয়েছিলাম।’ আর কত বিষ্ময় আমার জন্য রয়েছে?

রাতে খাবার পর সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটবার সময় দেখলাম, শেষ কৃত্য সমাধান করার একটি ফার্মের গাড়ি এল এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে গেল। নিশ্চয়ই ডা. এডগার যে চারটি কেসের কথা বলেছিলেন, তাদের একটি। এভাবেই আগামীকাল রাতে টমাসকে নিয়ে যাবে। পাশে কেউ নেই। বৌ, মেয়ে জানলই না কীভাবে মারা গেল! কোথায় ছাইয়ের হাঁড়ি পোতা হবে! পৃথিবী এত নিষ্ঠুর কেন? দুপুরে পাদ্রি নোয়েল ফোন করেছিল। টমাস বলার পরও আমি আজ ফিরে যাইনি শুনে আমাকে অনেকক্ষণ কৃতজ্ঞতা জানাল। বলল জার্মান হলে যত নিকটাত্মীয়ই হোক ও চলে আসত। কিন্ত আমি পর হয়েও টমাসকে শেষমুহূর্ত পর্যন্ত সঙ্গ দিচ্ছি, এটা টমাসের সৌভাগ্য এবং ইশ্বরের একটি বিশেষ আশীর্বাদ। সে আমার জন্য গির্জায় বিশেষ প্রার্থনা করবে। তাকে টমাসের হ্যানোভারের স্বপ্নের কথাটা বললাম না। আমি যদি আজ সকালে চলে যেতাম তাহলে টমাসকে নিয়ে বাগানে ঘুরতাম না এবং তার আজব ও বিষ্ময়কর স্বপ্নের কথাও জানতে পারতাম না। সবই ভবিতব্য।

মার্গারেট ফোন করেনি। ওর কথা শুনিনি। সবাই আমাকে শুধু ভুলই বোঝে। আমি চাই মৃত্যুকে বুঝতে, চিনতে এবং একে সহজভাবে গ্রহণ করতে। এক একটা মৃত্যুসঙ্গ আমাকে আমার লক্ষ্যের আরো নিকটে নিয়ে যায়। কিন্ত কেবল মার্গারেটই নয় অনেকেই এটা স্বীকার করতে চায় না। জীবনে আমি বহুবার এটা প্রত্যক্ষ করেছি, আমি যেটা ভালো মনে করি, তা আমার অনেক ঘনিষ্টজনও মেনে নিতে পারেন না। দুর্ভাগ্য!


শেষ দিন:

সারাদিন টমাস আধা ঘুম আধা জাগরণে আচ্ছন্ন! কথা বলার কোনো উৎসাহই নেই। এই অবস্থাকে মৃত্যুবিদরা বলেন, ‘এই পৃথিবীর সবকিছু সম্পূর্ণ ত্যাগ করার পরিস্থিতি।’ আমাকে দেখছে কিন্ত চিনতে পারছে বলে মনে হয় না। সারা দুনিয়াটাই এখন তার কাছে অপরিচিত। দুপুরে নার্সের ঠেলাঠেলিতে খেতে যেতে হলো ডাইনিং রুমে। ফিরে এসে দেখি, দু’জন নার্স মিলে টমাসকে বাথরুমে গোছল করাচ্ছে। হাসি পেল মনে মনে। আমরা মরার পর গোছল করিয়ে কাফন পড়িয়ে কবর দেই। আর এখানে এরা মরার আগে স্নান করায়! গোছলের শান্তিতেই হয়ত টমাস বিছানায় এসে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল বা আজকের শেষ ঘুমের ইনজেকশনটি মহা কড়া ছিল!

বিকেলে বাগানে একাই বেড়ালাম। সাতটার দিকে টমাসের কাছে গিয়ে দেখি তাকে আপাদমস্তক একটা বিশেষ ঢোলা কাপড় পড়ানো হয়েছে। সবুজ-লাল রঙের। খুব ভালো দামী কাপড়ের। ঘরে ঘন নীলাভ আলো। অন্যরকম একটা মাদকতাময় সেন্টের সুরভি। টমাস খুব শান্তিতে শুয়ে আছে। তবে আমার উপস্থিতি গ্রাহ্য করল মনে হয় না। যেদিকে চেয়েছিল সেদিকেই আপনমনে চেয়ে থাকল। আমি কিছু কথা বলার জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছিলাম। বলার সুযোগ হলো না। যে শোনার সেতো বহু আগেই এ পৃথিবী ছেড়ে দিয়েছে তবুও আমি ওর বিছানার পাশে একটা চেয়ার নিয়ে বসে ডান হাতটা হাতে নিলাম। তারপরে শুরু হল ‘নিঃশব্দ-কথাবার্তা।’ সুইজারল্যান্ডের বিশ্ববিখ্যাত মৃত্যুবিদ ড. এলিজাবেথ কুবলার রসের (প্রয়াত) কাছে এই নিঃশব্দ কথা বলার টেকনিকটি শিখেছিলাম। সেবার আমি তার বাসায় তিনদিন তার আতিথ্যে ছিলাম। মৃত্যু-মৃত্যুসঙ্গ-মৃত্যুর পরে জীবন নিয়ে বহু কিছু হাতে কলমে শিখেছিলাম। খুব যত্ন করে শিখিয়েছিলেন। শর্ত ছিল, আমি অন্য কাউকে শেখাবো না। মৃত্যুপথযাত্রীর সাথে নিরবে যে কথাবার্তা হয় তা অন্য কাউকে বলব না। আমি দু’টি শর্তই আজ পর্যন্ত মেনে চলেছি। আমৃত্যু পালন করব। কাজেই টমাসকে কী বললাম, টমাস আমাকে কী বলল, তা অজ্ঞাতই থাক।

ঠিক আটটায় একজন সহকারির সঙ্গে ডা. এডগার এলেন। তার সাথে একটি নার্স ছোট্ট একটা ঠেলাগাড়িতে করে ট্রেতে তিনটি বিভিন্ন অ্যাম্পুল ও সিরিঞ্জ নিয়ে এল। তার পেছনেই পাদ্রি মশাই। তিনি এসে গলায় রুমাল পেচিয়ে ক্রস করে প্রার্থনা শুরু করলেন। নার্স, ডাক্তার ও তার সহকারি তাদের বুকে ক্রস করলেন। আমি চেয়ার ছেড়ে সরে গিয়ে ওদের জায়গা করে দিলাম। টমাসের হাতটা যখন ছেড়ে দিলাম, মনে হলো মৃদু চাপ দিল এবং দু’টি চোখই পুরো খুলে সারা মুখে একটা প্রশান্ত হাসি ছড়িয়ে দিল। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, ও বলছে, ‘ধন্যবাদ বন্ধু। আবার দেখা হবে ওপারে।’ চোখ বন্ধ হয়ে এল। ডাক্তার প্রথম অ্যাম্পুল থেকে সিরিঞ্জে ওষুধ ভরলেন। পাদ্রি মশাই প্রার্থনা শেষ করে টমাসের বুকে একটা ক্রস আঁকলেন। তারপর সরে দাঁড়ালেন। ডা. এডগার তার দিকে তাকিয়ে ইশারায় অনুমতি চাইলেন। পাদ্রি মাথা নাড়লেন। তারপর ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় আমারও অনুমতি চাইলেন। আমি মাথা নাড়লাম। সহকারি টমাসের ডান হাতটি উঁচু করে ধরলে ডাক্তার তার বাম হাতে হাতটি নিয়ে ডান হাতের সিরিঞ্জের সুঁই ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে পুশ করছেন। মনে হলো সময় থেমে গেছে। সৃষ্টির গোড়া থেকেই ডাক্তার এডগার টমাসের হাতে ইনজেকশন দিয়েই যাচ্ছেন। অনন্তকাল। এর শুরুও নেই, শেষও নেই। কখন তিনি প্রথম পুশ শেষ করে, দ্বিতীয় অ্যাম্পুল সিরিঞ্জে ভরে পুশ করলেন, দেখি নাই, বুঝি নাই, আমার বুদ্ধিমত্তার অন্ত হয়ে গেছে।

‘ইশ্বরকে ধন্যবাদ। তৃতীয় পুশের দরকার হলো না।’ কিছুটা উৎফুল্ল স্বরে ডা. এডগার বললেন। নার্সের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। মেয়ে মানুষ, কোমল প্রাণ! যাক কেউ তো শেষ মুহূর্তে টমাসের জন্য চোখের জল ফেলছে! ‘পালস নেই। মার্থা, বেস্টাটার (শেষকৃত্যকারী প্রতিষ্ঠান) কে ফোন কর।’ পাদ্রি সাহেব টমাসের আধা খোলা চোখ দু’টি তার হাত দিয়ে বন্ধ করে দিলেন। টমাস দু’টি চোখই বন্ধ করেছিল কিন্ত মনে হয় ইনজেকশনের ক্রিয়ায় আবার অর্ধেক খুলে গিয়েছিল।

টমাসের বহু প্রতীক্ষিত ইচ্ছামৃত্যু হলো। সব যন্ত্রণার হলো অবসান। আঙ্গুল দিয়ে ওর মাথার চুল নাড়িয়ে বিদায় নিলাম। আমার গালে হাত লাগতে অশ্রুর ছোঁয়া পেলাম। কান্না কখনও কখনও না জানিয়েই আসে! আমার কাজও শেষ। মৃত্যুর শেষমুহূর্ত পর্যন্ত সঙ্গ দিলাম টমাসকে। বাকি কাজ সব অন্যরা করবে। শেষকৃত্যকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আগেই চুক্তি করা হয়েছে। ওরা এসে লাশটি নিয়ে পোড়াবে এবং অজ্ঞাত, অচেনা স্থানে ছাইয়ের হাঁড়ি পুঁতে দেবে। যে টমাস এখন বিছানায় শুয়ে আছে ও একটা অচল পদার্থমাত্র। আসল টমাস তো এখন অন্তরীক্ষের পথে। ঘর থেকে বেরোনোর সময় শেষবার তাকিয়ে নিঃশব্দে বললাম, ‘প্রিয় বন্ধু, যাও তোমার এখনকার নিবাসে যাও। স্বপ্নে জামালপুরে আমাকে দেখেছিলে। আমি তোমার শেষযাত্রা দেখলাম। এবার দেখা হবে ওপারেই। তখন আর আমাদের বিচ্ছেদ হবে না।’

সন্ধ্যায় ওর ঘরে যাবার আগেই আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাগে ভরে নিচে রিসেপশনে রেখে এসেছিলাম। ওটা নিয়ে রেলওয়ে স্টেশানের দিকে রওনা হলাম। কাছেই, হেঁটেই যাওয়া যায়। ট্রেনের টিকেট বুক করাই ছিল। সান্ধ্যাহারের আর কোনো প্রয়োজন নাই। যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে এই মৃত্যু নিয়ে বাণিজ্য করার নষ্টনীড় থেকে সরে পড়তে হবে। এখানে মৃত্যুকে পণ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। অশ্লীল ভাষায় জীবন আর মৃত্যুকে নিয়ে উপহাস করা হয়। জীবনে আমি আর কোনোদিন এরকম অমানবিক মৃত্যুসঙ্গ দেব না।  


নয়ে ইজেনবুর্গ, জার্মানি ২০শে জানুয়ারি, ২০২৪


 নিউজটি পড়া হয়েছে ৬৯৮ বার  






 

পরবাস

মেকং ডেল্টা

ওয়ার মিউজিয়াম: মার্কিন নৃশংসতার দলিল

নবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানে

সায়গনের ১২১ কিলোমিটার লম্বা চুচি টানেল

হিউ ভিয়েতনাম ও হোচিমিনের জন্মস্থান

ভিয়েতনামের ট্র্যাজিক মাইলাই ও শান্ত হোইআন

হ্যালংবে

ভিয়েতনাম: দ্যা ল্যান্ড অব ড্রাগন্স

মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে...

মারিয়ার শেষ নিঃশ্বাস

পরবাস বিভাগের আরো খবর






সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি:
আবদুল্লাহ আল হারুন
প্রধান সম্পাদক:
আসিফ হাসান নবী

সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. জিয়াউল হক
বিশেষ সংবাদদাতা:
র‌বিউল ইসলাম সো‌হেল

আমাদের মানচিত্র

ঠিকানা: দেওয়ান কমপ্লেক্স (৩য় তলা), ৬০/ই/১, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়:
কক্ষ নং ১৪/সি, নোয়াখালি টাওয়ার (১৪ তলা), ৫৫-বি, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০

ফোন: ০১৯১৪-৭৩৫৮৫৮, ০১৯১৪-৮৭৫৬৪০
ইমেইল: info@amadermanchitra.news, amadermanchitrabd@gmail.com

Location Map
Copyright © 2012-2024
All rights reserved

design & developed by
corporate work