ঢাকা, বাংলাদেশ  |  বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪



  বিভাগ : পরবাস তারিখ : ২৬-০১-২০২৪  


মারিয়ার শেষ নিঃশ্বাস


  আবদুল্লাহ আল-হারুন



আবদুল্লাহ আল-হারুন: উত্তর গোলার্ধের ইউরোপের দেশগুলিতে শীতকালে দীর্ঘ রাতের অবসান ঘটে অতি ধীর গতিতে, অনেক দেরি করে। দিনের শুরুতে প্রবল পরাক্রান্ত সূর্যদেব নিতান্তই অসহায় ও দুর্বল। ঘন ও গভীর একটি ধোঁয়ার চাদরে তার কিরণ ঢাকা পড়ে থাকে অনেকটা সময়। মৃদু ও ধুসর এবং একটি অতি সামান্য ম্লান সূর্যালোকের আভাস কুয়াসার সাগরে হাবুডুবু খায়। জানালার কাচ ভেদ করে এই ফ্যাকাসে আলো ঢোকার চেষ্টার সময় আজ প্রত্যুষে, রাতের প্রস্থান আর দিনের আগমনের সময়টিতে মারিয়া (৭২) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। শেষমুহূর্তঅবধি সে আমার হাতটি তার হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছিল। বহুবার মৃত্যুসঙ্গ দিয়ে আমার এ ধরনের অভিজ্ঞতা অনেক হয়েছে। তাই বিচলিত হই না। আকুলতা বা ব্যকুলতা হসপিস কর্মীদের দায়িত্ব পালনের জন্য নিতান্তই অনভিপ্রেত। কিন্ত আমরা আর দশজনের মতই এই সব মুহূর্তে শোকাকুল হই, আমাদের চোখেও অশ্রু ঝরে। মারিয়া আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও একান্ত বন্ধু। সে এই শহরের (নয়ে-ইজেনবুর্গ) হসপিসের প্রতিষ্ঠাতা-সেক্রেটারি। ১৯৯৫ সালে এখানে হসপিসের প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে দু’জন রোগী নিয়ে এর কাজ শুরু হয়েছিল। সেই প্রথম থেকেই মারিয়া এর  সেক্রেটারি। সে তার বাবা মা দুজনকেই মৃত্যুর সময় সঙ্গ দিয়েছিল। কয়েক মাসের ব্যবধানে বাবা-মার অকাল মুত্যুর পর সে পড়াশুনা বাদ দিয়ে একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে করণিকের চাকরি নিয়ে একমাত্র ছোট বোনটিকে লালন পালন করা ও তার  পড়াশুনার দায়িত্ব নেয়। এই চাকরি করার সময়ই সে বাবা-মায়ের মৃত্যুর সময় একাকি মৃত্যুপথযাত্রীদের অসহায়তা ও মৃত্যুকালীন সঙ্গের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। এরপর এই শহরে কিছু সমমনা ব্যক্তিকে নিয়ে হসপিস ভবন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। এক বছরের মধ্যেই ভালো একটি অংকের চাঁদা উঠে যায়। মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন নিয়মিত অর্থ প্রদানের অঙ্গীকার করে। ফ্রাঙ্কফুর্ট হসপিস ভবনের একজন অভিজ্ঞ মহিলা কর্মী এক বছরের জন্য এখানে হসপিস ভবনে পূর্ণকালীন কাজকর্মের ভার নেন। স্থানীয় দু’জন চিকিৎসক বিনা বেতনে নিয়মিত রোগীদের রোগের খোঁজখবর নেবার প্রতিশ্রুতি দেন। মারিয়া তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে যতটা সময় পেত, হসপিসের জন্যই ব্যয় করত। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে, শনি ও রবিবার, দুই দিনই সে হসপিস ভবনেই থাকত। দু’বছরের মধ্যে হসপিসের নিজস্ব ত্রিতল অট্টালিকা নির্মিত হবার পর, রোগীদের সংখ্যাও বেড়ে গেল। সব সময় গড়ে বিশ-বাইশজন মুমূর্ষু রোগী থাকত। মোট ত্রিশজনের থাকার ব্যবস্থা ছিল। নিজস্ব অফিস কক্ষ, ডাক্তারের ঘর, রান্নাঘর, খাবার ঘর, আত্মীয়স্বজনদের রাত কাটাবার জন্য দু’টি অতিথি কক্ষ, স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মীদের জন্য বিশ্রামের ঘর, খেলাধুলার ঘর, পড়াশুনার জন্য ছ্ট্টো গ্রন্থাগার ইত্যাদি মিলিয়ে স্বয়ংসম্পুর্ণ এই হজপিস ভবনটি একটি আদর্শ হজপিস ভবন হিসেবে শুধু জার্মানেই নয়, সারা ইউরোপে এর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এক তলার ডান দিক পুরোটাই ছিল একটি বিরাট মিলনায়তন। ৫০-৬০ জন বসতে পারত। এখানে নিয়মিত হসপিসের প্রশিক্ষণ, কর্মশালার আয়োজন করা হতো। তিনটি কক্ষ ছিল প্রশিক্ষক, অতিথি ও বক্তাদের বসার জন্য। এই ভবনের স্বয়সম্পূর্ণতার জন্য এককভাবে মারিয়াকে কৃতিত¦ দেয়া হতো। শীঘ্রই শহরের গণ্যমান্যরা বোধ করলেন, মারিয়াকে তার এই অভুতপুর্ব অবদানের জন্য পুরস্কৃত করা উচিৎ এবং তাকে যথাযোগ্য সম্মাননা দিতে হবে। সেক্রেটারির চাকরি একটি উচ্চস্তরের সরকারি কাজে রূপান্তরিত করা হল এবং যথোপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করে মারিয়াকে সেই পদে নিযুক্ত করা হলো। নির্লোভ ও নির্মোহ মারিয়া প্রথমে এই সরকারি চাকরিটা করতে চায়নি। অনারারি সার্ভিস দিয়েই সে সন্তুষ্ট। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামান্য চাকরির রোজগারই তার জন্য যথেষ্ট। ছোট বোন ইতিমধ্যেই লেখাপড়া শেষ করে ফ্রাঙ্কফুর্টে বন্ধুর সাথে থেকে ভাল চাকরি করে। নিজেদের বাড়িতে থেকে মারিয়া এত বেতন নিয়ে কী করবে? শেষপর্যন্ত পরিচিত মহল, বন্ধুবান্ধবদের চাপে সে রাজি হলো। কিন্ত একটি শর্তে- তার বেতনের অর্ধেক প্রতিমাসে হসপিস ভবনের তহবিলে জমা করা হবে। এসব কারণে অনেকেই তাকে ইশ^রের দেবদূত বলত!

২০০৬ সালে আমি নয়ে-ইজেনবুর্গে দক্ষিণ জার্মানি থেকে আগমণ করার পর থেকেই হসপিসের মাধ্যমে মারিয়ার সাথে পরিচিত হই। ধীরে ধীরে একটি একান্ত বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠে আমাদের মধ্যে। আমি হসপিস ভবনে নিয়মিত প্রশিক্ষণ-কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে নতুন কর্মীদের মৃত্যুসঙ্গ সম্পর্কে অবহিত করেছি। আকস্মিকভাবে এই সময়ে মারিয়ার ছোট বোন একটি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে সন্তান ধারন ক্ষমতা হারিয়ে ফেরে! মারিয়ার জন্য এটি একটি বিরাট আঘাত ছিল। বছরখানেক পরে বোনের সংসার ভেঙ্গে যায়। দু’বোন আবার একসাথে পিতৃভিটায় বসবাস করতে থাকে। এসব কারণে এবং হজপিস ভবনের বিবিধ আমলাতান্ত্রিক বেড়াজালের উৎপাতে মারিয়া পশ্চিমা জগতের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। এখানকার বৈভব, সমৃদ্ধি, বিলাসিতা এবং মানবতার উৎখাত সব মিলিয়ে সে খৃষ্টান ধর্ম, জগত, সমাজের উপর এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে যে স্বধর্ম ছেড়ে সে একদিন বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে। এরপর নেপালে লুম্বিনি গ্রামে বুদ্ধদেবের জন্মস্থানের নিকটে একটি আশ্রমে বাকি জীবনটা কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। আমাকেও উদ্বুদ্ধ করেছিল। ইউরোপে জীবন কাটানো মানে সময় ও জীবন দু’টিরই অপচয়। এই হলো তার দেশত্যাগের মূল কারণ। আমি সেই সময়ে (২০১৩) জন ও মেলির বিয়োগে (বিটবুর্গ রহস্য) দিশাহারা, বিভ্রান্ত ও বিক্ষিপ্ত! তাছাড়া একবছর আগেই দেশে নতুন সংসার পেতেছি! এসব কারণে মারিয়ার আহ্বানকে উপেক্ষা করি। এসব ঘটনা না ঘটলে, হয়ত আমিও মহান বুদ্ধদেবের চরণে নিজেকে সমর্পণ করতে লুম্বিনি চলে যেতাম!

মারিয়া নেপালে চলে  যাবার পর, স্বভাবতই তার সাথে আমার সম্পর্ক আস্তে আস্তে কমে আসে। হঠাৎ কখনও দুই-তিন মিনিটের টেলিফোন, ই-মেইল বা ম্যাসেজ। মারিয়ার একটা পুরোনো ধাঁচের ল্যাপটপ ছিল। আমিই জোর করে সাথে নিয়ে যেতে বলেছিলাম। আমাদের সাথে যোগাযোগের নিমিত্তে। কিন্ত নেপালের গ্রামাঞ্চলে এসমস্ত সোস্যাল মিডিয়ার অবস্থা বাংলাদেশের চাইতেও খারাপ। চিাঠ লেখালেখি তো কবেই উঠে গেছে। মারিয়ার বোন জোহানা একবার বোনকে দেখতে লুম্বিনি গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল, নেট দিয়ে নেপালিরা মাছ ধরে ঠিকই। কিন্ত ই-মেল, ম্যাসেজ এসব নেটে ঠিকমত ধরা দেয় না! ফোনে কথা ২-৩ মিনিটের বেশি করা যেত না। সারা গ্রামে একটি মাত্র স্যানিটারি ল্যাট্রিন, তাও মারিয়াদের আশ্রমে। সেখানে ও ছাড়াও আরো ৮-১০ জন ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান রমনী বসবাস করেন। সবাই মারিয়ার মতই বয়স্কা! সংসার ত্যাগী ও পশ্চিমি জীবনে বিরক্ত। শুনে একধরনের স্বস্তি অনুভব করলাম। মারিয়ার সাথে আমিও নেপালে যাইনি বলে! মাঝে মাঝে দৈনন্দিন অভ্যস্ত সুখ-শান্তি বন্ধুত্বকে ছাড়িয়ে যায়।

মাসখানেক আগে হঠাৎ একদিন জোহানা আমাকে টেলিফোন করে বলল, মারিয়া দেশে ফিরে এসেছে। খুবই অসুস্থ। তোমাকে অবিলম্বে আসতে বলেছে। নেপাল থেকে আসার পরই বিছানায়! কথাবার্তা বলতে, নড়াচড়া করতে একবারেই অনীহা! শারীরিকভাবেও অক্ষম। ওদের বাসাটি এখান থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে একটি অফেনবাগ ছোট্ট উপশহরে। আমি সেদিনই গেলাম। মারিয়া আমাকে দেখে খুব খুশি! বিছানায় উঠে বসল। অনেক্ষণ কথাবার্তা বললাম। ওর কোনো ক্রনিক রোগ ছিল না। জরা (বয়স বাহাত্তর) ও লুম্বিনি গ্রামের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পাকস্থলী আক্রান্ত হয়েছে। হার্টেরও কিছু সমস্যা আছে। স্পষ্ট বুঝলাম ও দেহত্যাগ করতেই মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছে। আসন্ন মৃত্যুর ছাপ মুখে ও চোখে। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে সে আর দুর্বল শরীরের সাথে কোনো সমঝোতা করতে পারছে না। ওর কথাবার্তাতেও তাই বোঝা গেল। বলল, ‘তোমাদের দেখতে ইচ্ছা হলো তাই কষ্ট করে চলে এলাম। ‘আমি বলতে চাইলাম, ‘শেষ দেখা’ করতে এসেছ, তাই না? কিন্ত মুখ ফুটে বলতে পারলাম না। বুঝতে পারছি, সে এ কারণেই চলে এসেছে। শেষমেষ বলল, ‘যদি এখানে মারা যাই, তুমি কি আমাকে শেষ সঙ্গটি দেবে না বন্ধু? এসে শুনলাম অনেকেই মারা গেছে যারা আমার নিকটের ছিল। অনেকদিন তোমার সাথে যোগাযোগ নেই। জোহানাও ফোনে সব কথা বলার সময় পেত না। তুমি তো তার সাথেও কোনো যোগাযোগ করো না! আমি ভালো করেই জানি, এটাই তোমার স্বভাব। কিন্ত এসে যখন শুনলাম, আবদুল্লাহ এখনও বেঁচে আছে। আগের মতই একা একা জীবন যাপন করে! খুব শান্তি বোধ করলাম। মরার সময়ে এরকম একজন বন্ধু পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। তুমি তো মৃৃত্যুকে মানোই না। কাজেই তুমি পাশে থাকলে আমিও নিশ্চিন্ত হয়ে দেহটি ত্যাগ করতে পারি।’ আমিও হেসে হেসে বললাম, ‘নিতান্তই যদি দেহটি ত্যাগ করে অন্য লোকে যেতে চাও, আমি অবশ্যই সে সময়ে তোমার পাশেই থাকব। কিন্ত তুমি যদি আবার নেপাল চলে যাও, সেটি তো হবে না। ডাক্তার আমাকে প্লেনে চড়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে! তার নির্দেশ অবজ্ঞাও যদি করি, কিন্ত সেটাও তো এক বিশাল ব্যাপার। খবর পেয়ে তোমার কাছে সময়মত কখনই পৌঁছাতে পারব না। আমি যেতে যেতে তোমার দেহটি নিশ্চয়ই মাটির নিচে বা আগুনে দগ্ধ হয়ে যাবে। ওখানে গিয়ে এসব খবর শুনে লাভ কী? বরং তুমিই আত্মা হয়ে এখানে আমাদের সাথে দেখা করতে এসো। আত্মারা তো আলোর মত দ্রুতগামী এবং ইচ্ছা করলে সবখানেই যেতে পারে!’ ‘না তোমার নেপাল যেতে হবে না। এখানেই আমি সবকিছু শেষ করতে চাই। কথা দাও, জোহানা খবর দিলে, তুমি আসবে।’

এসব আলাপ খুবই অস্বস্তিকর, বিব্রতকর, দুঃখ আর কষ্টের। কিন্ত আমি এইসব অনুভুতিকে মোটামুটি জয় করতে পেরেছি। কারণ তো মারিয়াই বলল। আমি তো মৃত্যুকেই স্বীকার করি না। কথা দিয়ে ফিরে এলাম। এরপর আরেকবার গিয়েছি। খুবই অসুস্থ ছিল। কথাবার্তা ফ্যাসফেসে, বোঝা যায় না। চোখও বেশিক্ষণ খোলা রাখতে পারছিল না। একসময়ে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘কথা দিয়েছ, মনে থাকে যেন। জোহানা খবর দিলেই চলে আসবে, ঠিক তো?’ বুঝলাম, এখনও শেষ সময় আসেনি। ও আরও কিছুটা দিন এই পরিচিত পৃথিবীতে থাকতে আগ্রহী। আরো কিছুক্ষণ থেকে, ওর ডান হাতে একটা মৃদু চাপ দিয়ে বললাম, ‘এখন আসি। আবার অবশ্যই একবার তোমার সাথে দেখা হবে।’ বলে চলে আসলাম। আমরা দুজনেই দীর্ঘদিনের হসপিস কর্মী, বহুবার বহুজনকে মৃত্যুসঙ্গ দিয়েছি। আমাদের মধ্যে কিছু কথা হয়, ‘কিছু কথা না বলি।’ 

জোহানার ফোন এল গত শনিবার রাত ন’টার দিকে। বলল, ‘মারিয়া একবারেই নিস্তেজ হয়ে গেছে। গতকাল থেকেই আর কিছু খেতে চায় না! কথাবার্তাও বলে না। শুধু আজ সন্ধ্যা থেকে কয়েকবার বলেছে, ‘আবদুল্লাহকে বল আজ রাতেই আসতে। ও বুঝতে পারবে, কেন আসতে বলছি।’  জোহানা ইতস্তত করে বলেছিল, ‘পাদ্রী মশাইকে খবর দেবে কি না।’ মারিয়া আর খৃষ্টান নয়, বৌদ্ধ। তাই জোহানার দ্বিধা! মারিয়া শুধু বলেছে, ‘পাদ্রি নয়, আবদুল্লাহকে বল আসতে।’

আমি স্থানীয় হসপিস কর্মী, ফিলিপকে ফোন করলাম। খুবই বন্ধুবৎসল ও উৎসাহী লোক। এর আগেও দু’বার ওই আমাকে মারিয়ার বাসায় নিয়ে গিয়েছিল ওর গাড়িতে। ও বলল সে এখনি আসতে পারে। সে নিজেও মারিয়ার খুবই ভক্ত। আমি জানালাম, টুকটাক জিনিসপত্র গোছাতে হবে। একটি মেইল লিখতে হবে। আধঘণ্টা পরে আসলেই চলবে। ফোনে কথা শেষ করে একটা ব্যাগে আমার ওষুধপত্র, দু’একটা কাপড় গুছিয়ে নিয়ে আসিফ ও গল্পকারের মহিউদ্দিনকে মেইল লিখে পাঠানোর পরই নিচে থেকে ফিলিপের কলিং বেলের শব্দ এল। নেমে গিয়ে সামান্য সৌজন্য বিনিময় করে আমি গাড়িতে বসলাম। সারা রাস্তা কেউ কিছু বললাম না। কী বলব? এই সব মুহূর্তে শুধুই মনে মনে স্মৃতিচারণ হয়! মারিয়ার বাড়ি পৌঁছার পর ফিলিপ বলল, ‘আমি যখন ফিরব, ওকে ফোন করলেই চলে আসবে। যদি মারিয়ার কিছু একটা হয় তাকে যেন জানানো হয়।’ বলে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল। আমি শুস্ক একটা ধন্যবাদ জানিয়ে ঘরে ঢুকলাম। জোহানাকে আসার আগে ফোন করেছিলাম। ও দরজা খুলে অপেক্ষা করছিল। মারিয়ার পাশে কর্পোরেশানের নার্স বসেছিল। আমি গিয়ে ওকে বললাম ও এখন যেতে পারে। আমি সারা রাতই মারিয়ার কাছে থাকব। নার্সটি মোটামুটি খুশি হয়ে স্মিত হাসি দিয়ে চলে গেল। এসব তাদের রুটিন কাজ। যন্ত্রের মত সেবা করে। কারণ ওটাই তাদের চাকরি। মন লাগিয়ে, সহানুভূতির সাথে, মমতা-স্নেহ, এসব মেকি! ও যাবার পর আমি জোহানাকেও বললাম, ‘তুমিও এখন গিয়ে রেস্ট নিতে পারো। খাওয়া-দাওয়া করেছ কি?’ সে বলল, ‘তুমি কিছু খাবে?’  আমি বললাম, ‘আজ আমার বাসায় এক প্রিয় স্বদেশী তার বৌয়ের হাতের রান্না করা মাছের তরকারি এনেছিল। ভাত রেঁধে তাই দিয়ে পেট পুরে খেয়েছি। জানোই তো আমরা ভেতো ও মেছো বাঙালি!’ এই শব্দগুলি আমাদের খাদ্যাভাসের কথা উঠলে আমি এতবার এখানে ব্যবহার করি যে জার্মান অনুবাদটি এদের কাছে একেবারেই সোজা ও বোধগম্য। ‘আহা, একা একাই খেলে? আমার জন্য একটু আনতে। তোমাদের মাছ-ভাত তো একেবারে অমৃত- জোহানা বলল। ‘আনলে আমিও খেতাম, নেপালে তো মাছ-ভাত প্রায় প্রতিদিনই খেতাম ’। মারিয়ার গলা স্পষ্ট ও পরিস্কার। আমরা দুজনেই আশ্চর্য হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বেশ হাসিখুশি মুখ। ‘আসলে আমার ডাকে কিন্ত এসে তো আমাকে এখনও একটা কথাও বললে না, সম্ভাষণ জানানো তো দূরের কথা!’ আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, ‘ভুল হয়ে গেছে। আমি মনে করলাম, তোমার চোখ বন্ধ, হয়ত ঘুমিয়ে আছো। আর আমি যে আজ আসব, তাতো ঘণ্টাখানেক হলো জানি। আগে জানলে অবশ্যই মাছের তরকারি সাথে নিয়ে আসতাম।’ মারিয়া বলল, ‘নেপাল থেকে আসার পর থেকে তো ঘুমিয়েই আছি। আজ তোমার সাথে গল্প করব।’ আমি আশ^স্ত ও উদ্বিগ্ন দুইই হলাম। এ তো প্রদীপ নেভার আগে একবার উজ্জলভাবে জ¦লার মতা! সে এত স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে যে, বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেহের সমস্ত জমিয়ে রাখা শেষ শক্তি সে এখন খরচ করছে। ভাঁড়ার শেষ হবে এবং তারপরই পাখি উড়ে যাবে। আমি জোহানাকে আবার বললাম, সে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুতে যেতে পারে। জোহানা বোনকে রাতের শুভেচ্ছা জানিয়ে এবং রাতে কিছু একটা হলে বা তার প্রয়োজন হলে আমি যেন তৎক্ষণাৎ তাকে ডাক দেই বলে ও ডাক্তারের ফোন নম্বর লেখা কাগজটি দেখিয়ে চলে গেল ঘুমুতে।

সে রাতে কথাবার্তাই হলো অনেক। স্মৃতিচর্চা, নেপালের কাহিনি, আমার ঘর সংসার, অসুখ-বিসুখ, নানা কিছু। জিজ্ঞাসা করলাম, শরীরে কোনো ব্যথা আছে কি না। ক্ষুধা লেগেছে কি না। জোহানা আগেই ফোনে বলেছিল, গতকাল থেকে মারিয়া কিছুই খায়নি। শেষ যাত্রার এটা একটা বড় লক্ষণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যারা দেহত্যাগ করেন তাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা লোপ পায়। তবে ব্যতিক্রমও আছে, অনেকেই আবার এ সময়ে খালি তাদের প্রিয় খাদ্যবস্তু খেতে চান। হজম শক্তি নেই, পাকস্থলি রিটায়ার করছে। কাজেই যা খান তা আবার উগরে দেন। যে কাছে থাকে, তার জন্য একটা বিরাট ঝামেলা। মারিয়া মাথা নেড়ে বলল, ‘না, তার কোনো ব্যথা নেই এবং ক্ষুধাও নেই।’ কিছুক্ষণ থেমে থেকে বলল, ‘তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই। আজ রাতে টিকে থাকব। আগামীকালও হয়ত। তবে তারপরের কথা বলতে পারছি না। আসল কথাটা হলো আমি যেদিন জার্মানি থেকে নেপালে গিয়েছি, সেদিনই মনে মনে দেহত্যাগ করেছি। বুদ্ধদেবের বাড়িঘর দেখার একটা আকাক্সক্ষা ছিল। তাই নেপালে গেলাম। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়, লোকজন সবই আকর্ষণীয়। কিন্ত ধনী-দরিদ্রের প্রভেদ ইউরাপের চাইতে অনেক বেশি। অভাব, ক্ষুধা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অনাচার, সামাজিক অন্যায়, আর কত বলব? এসব দেখে দেখে মৃত্যুকেই সমাধান বলে মনে হতো। কিন্ত তুমি তো জানো, আমি স্বেচ্ছামৃত্যুতে বিশ^াসী নই। যখন সময় আসবে, তখনি মৃত্যু হবে। প্রকৃতির এই বিধানের বিরুদ্ধে যাবার কারো কোনো অধিকার নেই। তাই আজও, আমি এই মুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচে আছি। এবারে এসে যখন শুনলাম, তুমিও বেঁচে আছে। খুব স্বস্তি পেয়েছিলাম। ভাবলাম, আবদুল্লাহর সাথে কথা বলতে বলতে তিরোধান করার মজাই আলাদা!’ সবগুলি কথা আস্তে আস্তে বলতে তার বেশ কষ্টই হচ্ছে। আমি বললাম, ‘পানি খাবে? একটু বিশ্রাম নাও। পরে কথা হবে।’ ও মাথা নাড়তেই আমি গ্লাসে পানি ভরে এনে দিলাম।’ বলল, ‘তুমি একটা ঝানু প্রফেশনাল হসপিস সঙ্গী। কিছুই ভুলোনি দেখছি। কখন কী কথা বলতে হবে, কী করতে হবে, সব এখনও জানো।’

ঘণ্টাখানেক পরে ক্লান্ত হয়ে ও ঘুুমিয়ে পড়ল। আমিও চেয়ারে হেলাম দিয়ে ‘না ঘুম-না জাগা’ একটা অবস্থায় কাটিয়ে দিলাম। কোনো কিছু কানে এলেই চোখ খুলে দেখি, ওর কিছু হলো কি না। না খুব ভালোমতই প্রশান্তির সাথে ঘুমুচ্ছে ও। বরাবরই ও শীর্ণ, পাতলা শরীর। এখন জরাক্রান্ত। নিয়মিত খাওয়া দাওয়া করে না। শুকিয়ে আরো কুঁচকে গেছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় একটা দুগ্ধপোষ্য শিশু। অসহায়, নির্বিকার। এ জগতের নয়, ভিন্ন গ্রহের। তবে চেহারার দৃশ্যমান ব্যক্তিত্বটি ঠিকই আছে। আপোষহীন, নির্লোভ আর সচেতন, সেবার প্রবৃত্তি, স্নেহশীলা, সব আগের মতই আছে। আমার সঙ্গে কথা বলে মরার ইচ্ছা ব্যক্ত করে ও আমাকেই উদভ্রান্ত করে ফেলেছে। ও কি আমাকে বিশেষ কিছু বলবে? কী আছে ওর মনে? সময় যে বেশি নেই, তা আমরা দুজনেই জানি। যা কিছু বলার, যা কিছু শোনার, তার জন্য হয়ত শুধু আগামী ২-৩ দিনই রয়ে গেছে। এর বেশি সময় আর নেই। 

সকাল সাতটায় জোহানা এসে আমাকে বলল, ‘যাও আবদুল্লাহ, ডাইনিং টেবিলে নাশতা তৈরি। নাশতা করে ঘুমুতে যাও। গেস্টরুম রেডি করাই আছে। তোমার ব্যাগও ওখানেই রেখেছি। দুপুরে ক’টার সময় ডাকব তোমাকে লাঞ্চ করার জন্য? বিশেষ কিছু কি খেতে চাও?’ আমি বললাম, ‘ডাকতে হবে না। আগে নাশতা তো করি। ক্ষুধা লাগলে আমি নিজেই উঠে যাবো। তোমাকে ডাকতে হবে না। টানা ঘুম দিলে একবারে বিকালে উঠে দিন আর রাতের খাওয়া একবারেই সারব। যা আমি আজকাল প্রায়ই করি।’ আমি মারিয়ার দিকে একবার তাকালাম। শিশুর মত শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। জোহানা বলল, ‘তোমার কথার মধ্যে যাদু-টাদু আছে নাকি? মারিয়া আসার পর এরকম শান্ত হয়ে কখনও ঘুমায়নি। ঘুমালেও সবসময় অস্থির থাকে। ছটফট করে। আজ দেখছি খুব আরামে ঘুমাচ্ছে।’ আমি বললাম, ‘ওকে আর ডেকো না। যখন খুশি উঠবে। রাতে পানি ছাড়া কিছু খায়নি। খেতে চাইলে স্যুপ দিও। অন্য কিছু এখন আর হজম করতে পারবে না।’

সারা দিন জোহানা আর নার্স মারিয়াকে দেখাশোনা করবে। মৃত্যুসঙ্গ দিনে তেমন কঠিন বা জটিল নয়। ইমারজেন্সি- ডাক্তার, পাদ্রী হাতের কাছেই। পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, কেউ না কেউ খবর নিতে আসে। বিষ্ময়ের ব্যাপার হলো সংখ্যাতাত্ত্বি¡কদের মতে দিনের চাইতে রাতেই বেশি মৃত্যু ঘটে। এর একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও আছে। এখন নয়, অন্য সময় বলা যাবে। যারা নিরোগ কিন্ত জরাক্রান্ত হয়ে যারা মারা যান, তাদের বেশির ভাগ ঘুমানোর সময়ই দেহত্যাগ করেন। প্রশান্ত মৃত্যু একেই বলা হয়। তবে আমাদের মত দরিদ্র দেশে রোগ এত বেশি যে এরকম মৃত্যু একেবারেই কম। এখানে রাতে মৃত্যুসঙ্গ সাধারণত একজন আত্মীয়, বন্ধু বা হসপিস কর্মী দিয়ে থাকে। বাড়িতে আর কেউ যদি থাকেন, সে হয়ত দিনে কাজ করে বা দিনের বেলায় রোগীর কাছে ছিল। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই সে রাতে ঘুমায়। এজন্য হসপিস কর্মীকে সবসময় সতর্ক থাকতে হয়, কোনো কিছু হলে, প্রথমে তাকে একাই সব কিছু সামলাতে হবে। বাড়িতে যদি আর কেউ না থাকে, ইউরোপে এটা খুবই একটি বাস্তব সমস্যা, সাহায্য চেয়ে ফোন করলেও, অন্য কারো আসতে সময় লেগে যায়। ঝড়-বৃষ্টি, দুর্যোগ, বরফপাত হলে তো সমস্যা আরও প্রকট! এসব বিবেচনায় রাতের সঙ্গীর দায়িত্ব অনেক বেশি ও ঝুঁকিপূর্ণ।

বিকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গার পর, গোছল করে চাঙ্গা হলাম। তারপর পেটপুরে খেয়ে মারিয়ার ঘরে এসে দেখি, জোহানা ছাড়াও ওর একজন পুরোনো অফিস-সহকর্মী এসেছে দেখা করতে। নার্সকে দেখলাম না। বোধহয় জোহানা ছুটি দিয়েছে। মারিয়ার চেহারা ফ্যাকাসে। দেহটি লম্বা করে চিৎ হয়ে শুয়ে উপরে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কী দেখছে, কেন দেখছে, তা বলা মুশকিল। আসন্ন মৃত্যুর এও একটা লক্ষণ। রোগী কী দেখছে একদৃষ্টিতে, তার চোখের সমান্তরালে কোনো কিছুই নেই, তাহলে তাকিয়ে আছে কেন? ঘরে যে আরও কেউ আছে এটা তার ধর্তব্যই নয়। আমি ঘরে ঢুকলাম, সম্ভাাষণ জানালাম। কোনো উত্তর নেই। অনেক মৃত্যুবিদ বলেন, এই সব মুহূর্তে মৃত আত্মীয়স্বজন, বন্ধুরা, স্বামী বা স্ত্রী, যে মারা যাচ্ছে, তার দৃষ্টিগোচরে আসে। সেজন্যই সে একদৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। অন্য কিছুতে মনোনিবেশ করে না। অনেকে বিড় বিড় করে অস্ফুটস্বরে কথাও বলেন। বোঝা যায় না কি বলছেন। আমি নিজেও অনেকবার এইরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। কিছুই বুঝিনি। আজও মারিয়ার অবলোকনে কিছুই বুঝতে পারলাম না। জোহানা বলল, ‘আমরা তো আছি। তুমি বাইরে গিয়ে একটু ঘুরে আসো। ওয়েদার ভালো।’ ‘বেশি দেরি করো না আবার। তাড়াতাড়ি ফিরবে,’ ছাদের দিকে চোখ রেখেই মারিয়া বলল। স্পষ্ট স্বর। মানে সে সব কিছুই, যে যা বলছে, শুনতে পাচ্ছে। কিন্ত ওর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আমরা সবাই হতভম্ব। পরে জোহানা  বলেছে, সারা দিনে ওটাই তার প্রথম কথা ছিল। দু একজন প্রতিবেশী এসেছিল, ডাক্তার এসেছিল, পাদ্রি মশাইও একবার ঘুরে গেছেন। সারাদিন ধরেই জোহানা, নার্স কাছে ছিল। ওরা অনেক কিছু বলেছে। প্রত্যুত্তরে মারিয়া কিছুই বলেনি। আমি বললাম, ‘না না, আমি দেরি করব না। বড়জোর আধা ঘণ্টা। শুভ বিকাল, মারিয়া। আমি আসছি।’ উত্তরে তো কিছু বললই না। একবার ফিরে তাকালও না। সবকিছু প্রত্যাখ্যান ও পরিত্যাগ করার এটাই সবচাইতে বড় ইঙ্গিত। কোনো কিছুতেই আর কোনো আগ্রহ নেই। কারো প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই। শুধু আমাকে (হয়ত) কিছু বলার অপেক্ষায় আছে। এটা হয়ে গেলেই, ‘বিদায় পৃথিবী!’

বাইরে থেকে ফিরে এসে মারিয়ার কাছে গেলাম। আগের মতই নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে। তবে এবারে কাত হয়ে। চিৎ হয়ে নয়। আমি সম্ভাষণ জানালাম। মনে হলো মৃদু মুখে একটা স্মিত হাসি। ঘরে জোহানা ছিল। বলল, ‘তোমার রাতের খাবার কি এখানে এনে রাখব? না টেবিলেই খাবে? আমি আজ নটা-দশটা পর্যন্ত মারিয়ার কাছে থাকতে পারি। এখন তো সবে সন্ধ্যা। তুমি ইচ্ছা করলে, কিছুক্ষণ টিভি দেখতে পারো। খবরের কাগজও তো আজ পড়োনি বোধহয়। বসার ঘরে রাখা আছে।’ জানি, টিভিও ওই ঘরেই। কিন্ত আমি তো টিভি দেখতে বা খবরের কাগজ পড়তে এখানে আসিনি। আমার কৌতূহল ক্রমেই বাড়ছে। মারিয়া কী কথা আমাকে বলতে চায়? আমি বললাম, ‘না, আমি আজ রাতে ভারি কিছু আর খাবো না। বিকেলে প্রচুর খেয়েছি। আজকাল আমি বেশির ভাগ একবারই খাই। তাই যথেষ্ট আমার জন্য। সামান্য ক্ষুধা লাগলে এখানে তো আপেল, নাশপাতি রাখা আছেই। ওই একটা খেয়ে নেব। তুমিই বরং টিভি দেখে একটু রিলাক্স কর। তারপর খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমি এখন থেকেই মারিয়ার কাছে থাকব।’ হঠাৎ দেখি, নির্র্নিমেষ চোখে মারিয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দু’টি চিক চিক করছে। মুখে মৃদু উত্তেজনার ছাপ। কারণ কি? জোহানা দেখেনি। সে উঠে এটা সেটা একটু গুছিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে তুমি যখন বলছ, আমি আজ একটু আগেই মারিয়াকে তোমার কাছে ছেড়ে যাচ্ছি। এমনিতেও ও শুধু তোমার সাথে থাকলেই আনন্দ পায়’ বলে চলে গেল। আমি চেয়ারটা টেনে মারিয়ার বিছানার পাশে নিয়ে গিয়ে বসলাম। ডান হাতটি ধরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজ কেমন আছো?’ ও কোনো উত্তর দিল না। অনেকক্ষণ চুপ। আমিও বলার মত কিছুই খুঁজে পেলাম না। হঠাৎ খুবই স্পষ্ট ও স্বাভাবিক স্বরে বলল, ‘আবদুল্লাহ, তুমি কি ভালো আছো? তুমি কি সুখী? দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে সেই বারো-তেরো বছর আগে, তা তোমার বৌ এদেশে এসে তোমার সাথে থাকে না কেন? আমি নেপাল যাবার আগে তোমার কাছে কয়েকবার বিটবুর্গের কিষাণী মেলির সাথে তোমার অন্তরঙ্গতার কথা শুনেছি। এখন তো বিটবুর্গ পানির নিচে। মেলি কোথায়?’

এখন বুঝতে পারলাম, মারিয়ার কাছে আমার আসাটা চরম ভুল হয়েছে। আমার অতীত এতটাই ঘিঞ্জি, ঘটনায় কণ্টকাকীর্ণ যে মারিয়া যার আয়ুু হয়ত আর কয়েক ঘণ্টা, সব তার কাছে বলতে গেলে এক রাতে তো শেষ হবেই না বরং তাকে মরার আগে বিরাট একটি কষ্ট দেয়া হবে। আমি এসেছি তার কাছে তার মৃত্যুর আগের মুহূর্তগুলিকে সহনীয় করে তুলতে। সেখানে আমার মহাভারত শোনাতে গেলে তো হিতে বিপরীত হবেই; উপরন্তু মৃত্যুর আগে তার কাঁধে এক বিরাট অপস্মৃতির জঞ্জাল তুলে দেয়া হবে। এই সব দুঃসহ ঘটনাগুলির কথা আমি নিজেই সবসময় ভুলে থাকতে চাই। সেখানে মারিয়াকে এখন এই সময়ে এসব বলা একটি অক্ষম অপরাধ হবে। না, কোনোমতেই এসব কথা তাকে বলা যাবে না।

আমি তার ডান হাত এবার আমার দুই হাত দিয়ে ধরলাম। ‘মারিয়া, তুমি আমার একজন হিতৈষী, শুভানুধ্যায়ী ও খুবই ভালো বন্ধু। তুমি যেমন সব সময় আমার ভালো চাও, আমিও চাই তোমার শেষ মুহূর্তগুলি সুখের হোক। তুমি শুধু ভালো ভালো স্মৃতি নিয়ে ওপারে যাও। দ্যাখো আমি তোমার চাইতে ৬-৭ বছর বড়। তুমি এখনি যাচ্ছ ‘না-ফেরার দেশে।’ অনেক আগে থেকেই পূর্ণভাবে প্রস্তুতি নিয়েছ এ মহাযাত্রার জন্য। তোমার কোনোই আপত্তি নেই এ পৃথিবী ত্যাগ করে অন্য একটি মাত্রায় যেতে। এজন্য তুমি যেমন এই পৃথিবীকে সেই নেপাল যাবার সময় পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে যা এখন বাস্তবায়িত হতে চলেছে, আমিও তেমনি এই পৃথিবীকে বহু আগেই বিদায় জানিয়েছি। আমার এখানে আর কিছু করার নেই, চাওয়ার নেই, পাওয়ারও নেই। কোনো লক্ষ্য নেই, কোনো গন্তব্য নেই, কোনো উদ্দেশ্যও নেই। আমি কারো অপেক্ষায় নেই এবং এই ধরাধামে আমার জন্যও কোথাও কেউ অপেক্ষা করে নেই। আমি বহু আগেই এ পৃথিবীতে বাড়তি, অতিরিক্ত, মূল্যহীন, অপদার্থ, অকর্মণ্য হয়ে গেছি। জীবন আমার সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তাই দয়া করে, অতীতের আমার সমস্ত কালিমালিপ্ত ইতিহাস, যে সব অপকর্ত্যব্য-অকর্তব্য আমি সম্পাদন করেছি, সেই সব কথা আমার কাছে শুনতে চেও না। আমি বলব না, তুমি যদি এতে দুঃখ পাও, আমি এজন্য করজোরে ক্ষমা চাইছি। আমি সব ভুলে যেতে চাই। কারো প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই, অনুযোগ নেই।’

মারিয়া বুদ্ধিমতী এবং নিঃসন্দেহে আমার শুভাকাক্সিক্ষ ও সুহৃদ। সে বুঝল, আমার ব্যথাটি কোথায় এবং কেন? সে রাতে এই প্রসঙ্গ আর উঠেনি। এরপর প্রায় দুই তিন ঘণ্টা আমরা দুজনেই নিরব, নিশ্চুপ ছিলাম। ও আর কিছু জানতে চাইল না। ‘রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে-’ সঙ্গীতের মতই রাত শেষ হয়ে গেল। শীতের মলিন সকালের আবির্ভাবে আলো-আঁধারির খেলা শুরু হয়ে গেছে।

সকালে জোহানা আসার পর আমি আমার ঘরে গেলাম। সারারাত খুবই উত্তেজনায় কেটেছে। মারিয়া এমন কিছু  প্রসঙ্গ তুলেছিল যেসব আমি বহুদিন ধরে ভুলে ছিলাম। মারিয়ার কৌতূহল পুরোনো ক্ষতে আবার ঘা দিয়েছে। বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার পর কিছুতেই ঘুম এল না। দৈনিক পত্রিকা, একটা বই পড়ে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পর দেহের শ্রান্তি জোর করে পলাতক নিদ্রাকে ফিরিয়ে আনল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না। জোহানার ডাকে ঘুম ভঙ্গল। ‘উঠো, আবদুল্লাহ, সন্ধ্যা ছ’টা বাজে। সারাদিন কিছুই খাওনি। সারারাত মারিয়াকে সঙ্গ দিতে হবে। পারবে তো?’ আজ রাতে না হয় তুমি রেস্ট নাও। আমিই মারিয়ার পাশে থাকব। আমি রাজি হলাম না। মন বলছিল আজ রাতই শেষ রাত! উঠে প্রাতঃকৃত্য ইত্যাদি সেরে, সামান্য কিছু খেয়ে মারিয়ার কাছে গেলাম। ও যেভাবে খুশি হয়ে আমার দিকে তাকাল, বুঝতে দেরি হলো না ও সারাদিন ধরে আমার অপেক্ষা করেছে। নিশ্চয়ই জোহানার কাছে শুনেছে, আমি আমার ঘরে টানা ঘুম দিচ্ছি! হয়ত ওর মনে হয়েছিল, আজ রাতে ওর কাছে আমি আসতে পারব না। ঘুমিয়েই থাকব!

শেষ রাত:

তেমন কিছু কথাবার্তা আজ হচ্ছে না। সময়ের গতিতে রাত গভীর হবার পর যথারীতি আমি ওর বিছানার পাশে বসে আছি। ওর চোখে চোখ পড়তেই সে অপরিচিতের মত দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে। কী ব্যাপার? ওর দ্বিধার কারণ কী? ওর দিকে ভালো করে তাকিয়ে আমি নিশ্চিত হলাম, গতরাতে ও শুধু আমার কথা শুনতে চায়নি, ওর নিজেরও কিছু কথা আমাকে বলার আছে। আমি এবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই মনে হলো দেহ ও মনের অবশিষ্ট সব শক্তি একসাথে করে ও আমার দিকে সোজা চোখ মেলে রেখে বলল, ‘আমার জন্য একটি কাজ করবে? একটা কাজ, যার বোঝা আমি গত পনেরো-ষোলো বছর যাবত বয়ে বেড়াচ্ছি। যেন আমার কাঁধে একটা লাশ, টেনে বেড়াচ্ছি সব জায়গায়। না, ফেলতে পারছি নিজে, না, অন্য কাউকে ফেলার জন্য বলতে পারছি! আজ পর্যন্ত কারো সাথে এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলারও সাহস পাইনি। আজ এই শেষ সময়ে তোমাকে বলব। তুমি এর একটা সুরাহা করতে পারবে। কারণ তোমার একটা প্রচন্ড ইচ্ছা শক্তি আছে। তুমি সত্যিই আমার একজন প্রকৃত হিতাকাঙ্ক্ষি।’

কী কথা? শোনার পর আমার মনে হয়েছিল, খুব সাধারণ এবং এই মহাদেশের প্রায় সব দেশের সমাজে নিতান্তই একটি ক্ষুদ্র ও নগণ্য ব্যাপার। অনবরত ঘটছে। ঘরে ঘরে, প্রায় সব দম্পতিই এর শিকার। ‘বিয়ের বাইরে নারী সংসর্গ!’ আমি নিজেই অন্তত পনেরো-বিশটি ঘটনার কথা জানি। অনেক সংসার এজন্য ভেঙ্গে যায়। সবাই জেনে যায়। কিন্ত ব্যতিক্রমও আছে। কখনও কখনও সত্য অগোচরেই থেকে যায়। মারিয়াও এরকমই একটি অপ্রত্যাশিত অপঘাতী দুর্ঘটনার নিতান্তই অনিচ্ছুক একটি দুর্বল ও অসহায় চরিত্র। আমরা জানতাম, মারিয়ার বোন জোহানা মর্মান্তিক একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় গর্ভধারণের ক্ষমতা হারায়। গাড়ির চালক ছিল জোহানার স্বামী। লাইসেন্সপ্রাপ্ত কারো গাড়িতে চাপা পড়ে কেউ নিহত হলেও সেটা মার্ডার কেস নয়, এটাকে বলা হয় ‘অনিচ্ছাকৃত একটি দণ্ডযোগ্য অপরাধ।’ ঘটনা বিশেষে (হয়ত) কিছুদিন জেল খেটে ও জরিমানা দিয়ে নিহতের পরিবারকে আদালত নির্ধারিত অর্থ প্রদান করে থাকে। এরপর একটা সময় পর্যন্ত লাইসেন্স জব্দ থাকার মেয়াদ পেরিয়ে ‘হত্যাকারি-চালক’ পুনরায় যথারীতি আবার গাড়ি চালাতে পারেন। কিন্ত চালক যদি লাইসেন্সপ্রাপ্ত না হন, তার সর্বোচ্চ শাস্তি হয়ে থাকে (যাবজ্জীবন জেল, কোনোদিনও ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবে না)। এরকমই হয়েছিল, জোহানার দুর্ঘটনায়। সেদিন জোহানা ও তার স্বামী এবং মারিয়া গাড়ি চালিয়ে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছিল। মারিয়া আগে লাইসেন্স করেনি। হসপিসে ভালো চাকরি পেয়ে যাবার পর তার গাড়ি চালানোর শখ হয়েছিল। সে শিখছিল এবং সুযোগ ও সময় পেলে নির্জন রাস্তায় জোহানার স্বামীর গাড়ি চালিয়ে মকশ করত। সেদিন সেই গাড়ি চালাচ্ছিল। কিন্ত পুলিশ আসার পর জোহানার স্বামী বলে, সে নিজে গাড়ি চালাচ্ছিল। দুর্ঘটনায় জোহানা আহত হয়েছিল এবং পথচারি একজন গুরুতরভাবে আহত হয়ে পরে হাসপাতালে মারা যায়। আইনমাফিক চালক (!) জোহানার স্বামীকে বিরাট একটি অঙ্কের জরিমানা করা হয়েছিল এবং এক বছর তার লাইসেন্স বাতিল ছিল। যেহেতু জোহানারও দুর্ঘটনায় একটি বিরাট ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল সেজন্য আদালত অনুগ্রহ করে তার স্বামীকে কারাদন্ডের আদেশ দেননি।

ঘটনার এখানেই শুরু। জোহানার স্বামী সুযোগ সন্ধানী। বৌ গর্ভধারন ক্ষমতা হারিয়ে প্রায় মানসিক রোগী! স্বামীর শারীরিক চাহিদা মেটাতে তার আগ্রহ কম। মারিয়াকে এর মূল্য দিতে হলো। বোনের স্বামীর চাহিদা তাকে মেটাতে হলো এবং তা নিয়মিত। যখন তখন এবং যত্র তত্র। পরিণাম? অপারগ হয়ে মারিয়া সত্য উদঘাটনের হুমকি দিলে জোহানার স্বামী স্ত্রীর দৈহিক মিলনের অক্ষমতার কথা তুলে আইনত বিবাহ বিচ্ছেদ করে। আসল ব্যাপারটি হলো মারিয়া তার অসৎ ইচ্ছা পূরণে অস্বীকার করায় জোহানাকে পরিত্যাগ করে তার ‘প্রতিশোধ’ নিল! এও একটা কারণ ছিল যে মারিয়া এই সমাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে দেশত্যাগ করে নেপাল চলে গিয়েছিল। জোহানাকে দেখলে তার একটা অপরাধবোধ জাগ্রত হতো। সেজন্যই সে নিরবে দেশ ছেড়ে সুুদুর নেপাল চলে গেল। বহুবার সে চেষ্টা করেছে জোহানাকে সত্য কথাটি বলতে। কিন্ত পারেনি। নেপালে লুম্বিনি গ্রামে ফোনে জার্মানির সাথে বেশিক্ষণ কথা বলা যেত না। ল্যাপটপ নেটের দুর্বলতায় প্রায় অচল থাকত। এসব কারণেই নেপাল থেকেও যে জোহানাকে সত্যি কথাটা বলতে পারেনি। শুধু বললেই তো হবে না। বিস্তারিত একটা ব্যাখ্যারও দরকার হবে। অতটা সময় ফোনে কথা বলার সময় থাকত না।

এবারেও সে নেপাল থেকে ফিরে এসে জোহানাকে কথাটা বলতে পারেনি। আর পারবেও না। সে বুঝে ফেলেছে তার সময় শেষ হয়ে এসেছে। তাই তার দেহত্যাগের পর আমাকে কথাটা জোহানাকে বলে এবং তার পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইতে হবে। এই হলো আমার সঙ্গে তার কথা। যে কথাটি বলার জন্য জোহানাকে জানানোর জন্য সে আসার পর থেকেই চেষ্টা করছে। জোহানার স্বামীকে জোহানা খুব ভালোবাসত। সে মনেপ্রাণে বিশ^াস করত, স্বামী তার খুবই উদার আর দয়ালু। তা না হলে সে মটর দুর্ঘটনার দায় নিজের কাঁধে নিয়ে মারয়িাকে কেন চরম শাস্তি থেকে বাঁচাল? তাদের বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ সে তো নিজেই। স্বামীকে দৈহিক সুখ দিতে অপারগ ছিল। কেন একজন সুস্থ-সবল লোক এই রকম একটি বৌ নিয়ে ঘর করবে? তাই বিচ্ছেদ সে মেনে নিয়েছিল। মারিয়ার সাথে তার ম্বামীর অবৈধ সম্পর্কের কথা সে জানতে পারলে তার যে বিশ^াসভঙ্গের কষ্ট হবে, তা মারিয়া জেনেশুনে তাকে দিতে চায়নি। সে খুবই কোমলপ্রাণ সহজ সরল মানুষ। জীবনের এসব দৈনন্দিন কৌটিল্য-নীতি সে জানে না। তাই আমিও তার অনুরোধ শোনার পরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কোনোদিনও আমি কথাটি জোহানাকে বলব না। এরকম আরও কিছু ‘শেষ কথা’ আমি মৃতের আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের বলিনি। দরকার মনে করিনি। স্বামী ও মারিয়ার উপরে জোহানার যে ধারণা, সেটাই অবিচল থাক। দুজনেই জোহানার কাছে ছিল ‘খুব ভালো আর দেবতুল্য মানুষ।’ এই পৃথিবীতে সে যতদিন বেঁচে আছে, সেই বিশ^াসই জোহানার থাকুক। যেদিন মারিয়ার সাথে ওপারে আবার তার দেখা হবে, তখন মারিয়াই জোহানাকে বলবে। আমি মনে করি, সেখানকার রীতিনীতিতে অন্তত পৃথিবীর কূটনীতি অনুপস্থিত। তাই আমি এই পৃথিবীতে জোহানাকে মারিয়ার কথাটি কখনই বলব না। 

আস্তে আস্তে, থেমে থেমে, লম্বা লম্বা শ^াস নিয়ে মারিয়া যখন তার কাহিনীটি বলে শেষ করল, জানালা দিয়ে তখন শীতকালিন দীর্ঘ কালো রাতের সমাপ্তির পর ঘন কুয়াশার বন্ধনে আবৃত সূর্যোদয়ের যৎকিঞ্চিত আভা সামান্য উঁকি দিচ্ছে। একটানা অনেকক্ষণ কথা বলতে বলতে ও খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্ত চোখে মুখে একটা তৃপ্তি ও সেেন্তাষের জ্যোতি। শেষ পর্যন্ত আমাকে সে যে কথাটি বলতে পেরেছে সেই সাফল্যে সে অত্যন্ত খুশি। তবে মনে যাই হোক, তার শরীর দ্রুত পুরোপুরিই অক্ষমতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এক পা, দু’পা করে মৃত্যু এগিয়ে আসছে। এখন জীবনের ঋণটি শোধ করার সময় এসে গেছে। জীবনের মূল্য দিতে হবে মৃত্যু দিয়ে। ধনী-দরিদ্র-সুস্থ-অসুস্থ-রাজা-প্রজা-ক্ষমতাশালী-দুর্বল কারো রেহাই নেই। সবার বেলায় একই নিয়ম।

মারিয়ার কথা থেমে গেছে। চিরদিনের মত নিশ্চুপ হয়ে যাবার ইঙ্গিত। দৃষ্টিতে আবার সেই হারিয়ে যাবার মত ভাব। চেয়ে আছে কিন্ত কোনো কিছু দেখার কোনোই মনোযোগ নেই। আমি যে পাশেই বসে, মনে হয় সে তা ভুলে গেছে। তবে আমার হাতটি আগের মতই শক্তভাবে ধরে আছে। চোখেমুখে মৃত্যুকালিন যন্ত্রণার আভাস। প্রসবের সময় গর্ভধারিণী মায়ের যে যন্ত্রণা তার ঋণ শোধ হয় মৃত্যুকালিন এই যন্ত্রণায়। অসহ্য নয় তবে কষ্টকর। যার কোনোই রোগ নেই, সুস্থ শরীরে, জরা ও বায়োলজিক্যাল কারণে যে দেহত্যাগ করে, তারও কিছটা সময় এই যন্ত্রণা সইতে হয়। আমি দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মরণকালিন ক্যান্সার রোগীর যন্ত্রণা, অন্যান্য রোগের অসহনীয়, মর্মান্তিক যন্ত্রণা চোখে দেখলেও দর্শকের কষ্ট হয়। এই সব কষ্টের সময় আমিও কামনা করেছি, দ্রুতই প্রাণটি বিয়োগ হোক। তবে শেষ মুহূর্তে সমস্ত রকমের, সবধরনের রোগের কষ্ট একসময়ে নিবারণ হয়। মৃত্যু এসে অমানুষিক ও অবর্ণনীয় সব ক্লেশ থেকে দেহকে মুক্তি দেয়। যে গন্ডদু’টি কিছুক্ষণ আগেও মহা যন্ত্রণায় কুঁচকে গিয়েছিল, তা আবার সমান ও সমান্তরাল। সামান্য গোলাপী আভা। মনোযোগ দিয়ে দেখলে মনে হবে, দুই ঠোঁটে খুবই সূক্ষ্ম ও কিঞ্চিত একটি স্মিত হাসির রেখা। শান্তির প্রলেপ। দেহের কোথাও আর কোনোও খিঁঁচুনি নেই। ঘরেও যেন একটি অদৃশ্য স্বর্গীয় পরিবেশের দোলা লাগে। আত্মা যখন দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, কান পেতে শুনলে একটি ‘নিশ্চুপ কিন্ত মহা বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ’ আন্দাজ করা যায়। একটা কিছু কী যেন  জানালা, দরজা বা দেয়াল ভেদ করে বেরিয়ে শূন্যে মিলিয়ে গেল। এদেশে একা যারা মৃত্যুসঙ্গ দেন, তাদের এই সব অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে মৃত্যুর বহু আগে থেকেই রোগী আত্মীয়স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে থাকেন। কান্নাকাটির জোয়ার লেগে যায়। সারা জীবনে কোলাহল এবং মরার সময়ও নিরবতা নেই। তাই এই সব মৃত্যুকালিন বিশেষ দৃশ্য-অদৃশ্য পরিমণ্ডল দেখা সম্ভব হয় না। ‘নিঃশব্দ-শব্দ’ শোনার জন্য শুনশান নীরবতা প্রয়োজন। কারণ এসবই বিশুদ্ধ অনুভূতির ব্যাপার। আমাদের মত শব্দদূষণের দেশে এই ধরনের পরিবেশ অচিন্তনীয়। সর্বোপরি হসপিসের প্রেক্ষিতে ‘মৃত্যুসঙ্গ’ আমাদের সমাজের আচার-আচরণের বিরোধী। ধর্মের বিধিনিষেধ তো আছেই।

স্মিত হাসির রেখায় উদ্ভাসিত মুখে মারিয়া নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেও যে আমার সাথে কথা বলছিল, পার্থিব অর্থে তার দেহটি আছে কিন্ত তার ভেতরে আত্মা বা সত্ত্বা যে নামই হোক,এখন আর নেই। শুধু দেহটি পড়ে আছে। যার কোনোই মূল্য নেই। পাখি উড়ে গেলে খাঁচার যে দশা হয়। পায়ের কাছে চাদরটি টেনে সারা গা ঢেকে দিলাম। মাথার চুলে আঙ্গুলের সামান্য ছোঁয়া দিয়ে বিদায় জানালাম। ‘যাও বন্ধু তোমার নতুন নিবাসে যাও। ওখানে রাস্তায় কোন গাড়ি চলে না, দরকার হয় না। কেউ কারো উপরে নিজের করা অন্যায় চাপা দেবার খেলা খেলে না, দুর্বলতার সুযোগ নেয় না, ইন্টারনেটের দরকার হয় না। শুধু মুক্তিই আর মুক্তি!’

জোহানা কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে জানি না। সেও বুঝে গেছে, মারিয়া আর নেই। তাকে বুকে জড়িয়ে সমবেদনা জানালাম। ও বলল, ‘আবদুল্লাহ, আমি তোমার উপরে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। মারিয়া নেপাল থেকে আসার পর তাকে আজ সকালের মত এতটা সুন্দর, এতটা তৃপ্ত আর কখনও দেখায়নি। এটা তোমার কৃতিত্বÑ যা এক মাসে হয়নি, তুমি দু’-তিন দিনেই সম্ভব করেছ। তোমার সাথে কথা বলে মারিয়া অনন্য সুখ পেয়েছে। তুমি সত্যিই কথার যাদুকর। ইশ^র তোমার মঙ্গল করুন।’

ব্যাগ গুছিয়ে ফিলিপকে ফোন করলাম। পাদ্রি সাহেব এসে গলায় বিশেষ স্কার্ফ বেঁধে মৃত মারিয়ার শবদেহকে খ্রীষ্টিয়মতে তেল দিয়ে প্রার্থনা করছেন। বেঁচে থাকলে মারিয়া এই বিশেষ কৃত্যে সম্মত হতো কি না জানিনা। দুই-এক জন করে প্রতিবেশী, প্রাক্তন সহকর্মী যারা এখনও বেঁচে আছেন এমন কয়েকজন বন্ধুবান্ধব আসছেন শেষ বিদায় জানানোর জন্য।

মারিয়ার শেষকৃত্য হবে গোপনে। একটি অলাভজনক (নন-প্রফিট) সংস্থার সাথে জীবদ্দশায় চুক্তি করলে, মারা যাবার খবর পেয়ে এসে আত্মীয়-স্বজনরা অনুমতি দেবার পর শুধু ওরাই মৃতদেহটি সরকারি ‘চুল্লিভবনে’ নিয়ে পোড়ায়। ছাই একটি তামার পাত্রে রেখে শহর থেকে দূরে একটি বিস্তীর্ণ এলাকায় গর্ত খুঁড়ে হাড়িটি পুঁতে দেয় অজ্ঞাত-অজানা ভাবে। কোথায় কার হাড়ি কোনো চিহ্ন নেই। কোনো কিছু লেখা নেই। কোনো প্ল্যাকার্ডও নেই। এই সব করার সময় বাইরের কেউ থাকতে পারে না শুধু সংস্থার ২-৩ জন ছাড়া।

আমি এরকম কিছু অজ্ঞাত গোরস্তান দেখেছি। একটি-দু’টি ফুটবল মাঠের মত বিশাল তৃণভূমি। অনেক রকম গাছ, ফুল গাছ লাগানো। ঝোপঝাড়ও আছে। এগুলি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। চারদিকে নিচু দেয়াল। হাড়ি গর্তে পোতার সময় শুধু প্রবেশদ্বারটি বন্ধ রাখা হয়, যাতে অন্য কেউ ঢুকতে না পারে। অন্যথায় সর্বদা উন্মুক্ত থাকে। অনেকেই এখানে নিয়মিত বেড়াতে আসেন। কবরের কোনো চিহ্ন নেই। দৃশ্যমান শুধু গাছপালা ও পুষ্পরাজি। মাঝ দিয়ে সরু হাঁটার রাস্তা। অনেক জঙ্গলেও এসব ব্যবস্থা আছে। মরার আগে ইচ্ছা করলে যে কেউ এই সব জঙ্গলে তার পছন্দমত গাছ কিনতে পারে। যার তলায় তার মৃতদেহের ছাইসহ হাড়িটি পোঁতা হবে। মারিয়া নেপাল থেকে এসে প্রথমেই এই চুক্তিটি সমাধা করেছিল। সে জানত এবারে তার আর কোথাও যেতে হবে না। এখান থেকেই তাকে অন্তরীক্ষে গমন করতে হবে। ভাবছি, এরকম একটা চুক্তি আমিও করব কি না। আমি তো বহুদিন ধরেই প্রস্তুত। আমার প্রজন্মের পরের দুই-তিন প্রজন্মে ইতোমধ্যেই মৃত্যুদূত হানা দিয়েছে। আমার পালা আসে না কেন?

 

নয়ে-ইজেনবুর্গ, জার্মানি,

মঙ্গলবার ২৩-১-২৪  

 


 নিউজটি পড়া হয়েছে ৪৬৭ বার  






 

পরবাস

মেকং ডেল্টা

ওয়ার মিউজিয়াম: মার্কিন নৃশংসতার দলিল

নবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানে

সায়গনের ১২১ কিলোমিটার লম্বা চুচি টানেল

হিউ ভিয়েতনাম ও হোচিমিনের জন্মস্থান

ভিয়েতনামের ট্র্যাজিক মাইলাই ও শান্ত হোইআন

হ্যালংবে

ভিয়েতনাম: দ্যা ল্যান্ড অব ড্রাগন্স

মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে...

ইউথানেসিয়া: মৃত্যু নিয়ে বাণিজ্য!

পরবাস বিভাগের আরো খবর






সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি:
আবদুল্লাহ আল হারুন
প্রধান সম্পাদক:
আসিফ হাসান নবী

সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. জিয়াউল হক
বিশেষ সংবাদদাতা:
র‌বিউল ইসলাম সো‌হেল

আমাদের মানচিত্র

ঠিকানা: দেওয়ান কমপ্লেক্স (৩য় তলা), ৬০/ই/১, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়:
কক্ষ নং ১৪/সি, নোয়াখালি টাওয়ার (১৪ তলা), ৫৫-বি, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০

ফোন: ০১৯১৪-৭৩৫৮৫৮, ০১৯১৪-৮৭৫৬৪০
ইমেইল: info@amadermanchitra.news, amadermanchitrabd@gmail.com

Location Map
Copyright © 2012-2024
All rights reserved

design & developed by
corporate work