লিয়াকত হোসেন, সুইডেন থেকে:
আজ ঐতিহাসিক হ্যালংবে ভ্রমণ।
পুরো দু‘দিন দু’রাত জাহাজ ভ্রমণ। সারারাত জাহাজ লাইমস্টোন পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে জল কেটে এগিয়ে যাবে, দিনের বেলা ক্যানো চালানো, গুহা পরিদর্শন ও সাঁতার। আবার সারারাত জাহাজ যাত্রাশেষে দুপুরে ফিরে আসা। হ্যালংবে ভ্রমণকে বলা হয় Once in life time জীবনে একবার এই জলপথে যাত্রা নতুবা জীবন অসম্পূর্ণ। জীবন ও ভ্রমণপূর্ণতায় আমরা এগিয়ে গেলাম। আর ভিয়েতনামে এসে হ্যালংবে না দেখা ভ্রমণের অপূর্ণতা।
ব্রেকফাস্ট শেষে তৈরি হতে হতেই গাইড চলে এলেন। আজ লুসি নেই, নতুন গাইড, নতুন গাড়িসহ ড্রাইভার। হ্যালংবের পর আমরা যেহেতু আবার এই হোটেলে ফিরে আসবো তাই চেকআউট করে লাগেজ হোটেলে জমা রেখে হ্যান্ডব্যাগ নিয়েই বেরিয়ে এলাম। লবিতে গাইড এসে অভ্যর্থনা জানালেন। স্মার্ট গাইড অনর্গল ইংরেজি বলেন, দেখতে অনেকটা কোরিয়ান ফিল্মের নায়কের মত। জানালেন হ্যালংবে ভ্রমণের পর হোটেলে নামিয়ে দেয়াঅবধি তিনি আমাদের সঙ্গী। হোটেল থেকে হ্যালংবে দীর্ঘ পথ, প্রায় ১৮০ কিলোমিটার। আমাদের গাড়ি ছুটে চলল। প্রশস্ত রাস্তার দুপাশে দোকানপাট, গাছে গাছে মৌসুমি ফুল। রাস্তার এক পাশ দিয়ে স্কুটার লেন। ছেলে-মেয়েরা কেউবা পুরো পরিবার নিয়ে স্কুটারে চলেছেন, কোনো রিক্সা বা টুকটুক নেই। রাস্তাঘাট পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। যেতে যেতে হাইওয়েতে দুজায়গায় টোল দিতে হলো। অ্যাজেন্সিই সব ব্যবস্থা করেছে।
যদিও ভূতাত্ত্বিকভাবে হ্যালং উপসাগর ২৬০ মিলিয়ন বছর ধরে গঠিত হয়েছিল। তবে উপকথা বলে, মাদার ড্রাগন এই উপসাগরের ২,০০০ দ্বীপ একদিনে তৈরি করেছিলেন। ক্রমাগত উত্তর আক্রমণকারীদের থেকে নিজেদের রক্ষা ও সমুদ্র থেকে আগ্রাসী আক্রমণ সম্পর্কে গ্রামবাসীদের রক্ষার জন্য মাদার ড্রাগন তার সন্তানদের ডাকলেন। তারা স্বর্গ থেকে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে নৌ আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে রত্নপাথর দ্বারা দুর্ভেদ্য বাধা তৈরি করেন। আক্রমণকারীদের অনেক জাহাজ পাহাড়গুলোয় ভেঙে পড়ে, অবশিষ্ট বাহিনী শেষপর্যন্ত বিতাড়িত হয়। রত্নপাথরগুলি এখনও উপসাগর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অগণিত অত্যাশ্চর্য দ্বীপ হিসাবে রয়ে গেছে। হ্যালং-এর আক্ষরিক অর্থ ‘ডিসেন্ডিং ড্রাগন’ ভিয়েতনামের সমগ্র ড্রাগন এই ড্রাগনের বংশধর যারা হাজার বছর আগে হ্যালংবের জন্ম দিয়েছিল।
হ্যালংবে ১৫৫৩ বর্গ কিলোমিটারজুড়ে
জলের গভীরতা মাত্র ১০ মিটার, তাই বড় বড় জাহাজ চলতে পারে না। জলে দাঁড়িয়ে থাকা হ্যালংবের লাইমস্টোন পাহাড়ের গুহায় বন্যপাখী, বানর ও বাদুরের বাস। বাদরগুলো সর্বভূক, খায় না এমন কিছু নেই। সাগরের গুল্ম, শেওলা ও মাছ প্রধান খাদ্য। বেশ কয়েকটি গুহায় মানুষের অভিযানের পর বানরেরা সরে অন্য গুহায় আশ্রয় নিয়েছে। হ্যালংবের চারটি ভাসমান গ্রামে প্রায় দেড় হাজার জেলের বাস। প্রতিবছর প্রায় ৩ মিলিয়ন ভ্রমণকারি হ্যালংবে পরিভ্রমণে আসেন। রহস্যময় অপ্রতিরোধ্য হ্যালংবের দ্বীপগুলো টনকিং উপসাগরের জল থেকে উঠে এসেছে।
একটি সেতু পার হবার পর ডানদিকের ধানের খেতের পাশে দুটি ভিন্ন ভিন্ন কবরস্থান। একটি মাটি দিয়ে ঢাকা অপরটি বাঁধানো। গাইড জানালেন এখানে দু’বার মৃতের কবর দেয়া হয়। মারা যাবার পর প্রথম কবরস্থানে মৃতদেহ কফিনে মাটি চাপা দেয়া হয়। এর তিন থেকে চারমাস পর কফিন থেকে মৃতদেহ উঠিয়ে সাগরের জলে ধুয়ে হাড় মাংস আলাদা করা হয়, এই কাজটি করা হয় রাত একটা থেকে চারটার মধ্যে। এরপর হাড়গুলো সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো কবরস্থানে কবর দেয়া হয়। এতে মৃতের পূর্ণ স্বর্গবাস হয় বলে বিশ্বাস। মানুষের বিশ্বাসের শেষ নেই।
এইভাবে চার ঘণ্টা চলার পর হ্যালংবে সিটিতে পৌঁছালাম।
অপূর্ব স্থাপত্যশৈলিতে তৈরি এই শহর। গাড়ি এসে থামল এক শপিং এরিয়ায়, কিছুক্ষণ বিরতি। চা-কফি-আইসক্রিমের পর আমরা আরো বিশ মিনিট এগিয়ে জাহাজ ঘাটে পৌঁছালাম। আধুনিক জাহাজ ঘাট, লোকে লোকারণ্য। এখান থেকে ভ্রমণকারিদের নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির জাহাজ ছাড়ে। আমাদের হলরুমে বসিয়ে গাইড টিকেট আনতে গেলেন। টিকেট নিয়ে ফিরে আসার পর আমরা আমাদের জন্য নির্ধারিত জাহাজে যেয়ে উঠলাম। গাইড আমাদের ডিলুক্স রুমের চাবি এগিয়ে দিলেন। রুমটি আধুনিক আসবাবে সাজানো, চেয়ার টেবিল, সোফা আর পরিপাটি বেড। রুমসংলগ্ন বাথরুমে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলাম, লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে।
ডাইনিং রুমে অনেক টুরিস্ট
বিভিন্ন অ্যাজেন্সির মাধ্যমে এসেছেন। দু’জনের জন্য সাজানো একটি টেবিলে বসার পর বেয়ারা লাঞ্চের প্রথম পর্বের প্লেট দিয়ে গেলেন। ইতোমধ্যে জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে। জলে দাঁড়িয়ে থাকা লাইমস্টোনের পাহাড়গুলোর ফাঁকে ফাঁকে জল কেটে চলছে জাহাজ। মনে পড়লো নরওয়ের স্টাভাগনারের গভীর সরু ও দীর্ঘ প্রসারিত সামুদ্রিক জলপথের কথা। যার তিনদিকেই সুউচ্চ পাথরের পাহাড়, মাঝে সরু ৪২ কিলোমিটার নীল জলপথ। উপরের দিকে তাকালেই মনে হতো পাহাড় ভেঙ্গে পরবে মাথায়। সে পথ ভয়ংকর ও রোমাঞ্চকর। হ্যালংবের লাইমস্টোন পাহাড়গুলো জলের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে, ভয়ংকর নয় তবে রোমাঞ্চকর। হালকা নীল জল কেটে এগিয়ে চলেছে জাহাজ। গাইড এসে সবার খাবারের খোঁজ খবর নিচ্ছেন, কিছু লাগবে কি না জানতে চাচ্ছেন আর জানালেন বিকেলে জাহাজ ডেকে রান্নার ক্লাস। ভিয়েতনামি রান্না শেখানো হবে, আগ্রহীদের চারটার মধ্যেই আসতে হবে। রান্নার ক্লাসের পর ডিনার। সব ব্যবস্থা করেছেন অ্যাজেন্সি। উপাদেয় লাঞ্চের পর ডেকে এসে দাঁড়ালাম। জলে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলোয় গাছপালা গজাতে শুরু করেছে। সবুজ গাছে পুরোটা ঢেকে যায়নি মাঝে মাঝে সাদা। জলের ধাক্কায় পাহাড়গুলোর নিচে সরু সুরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে, ওখান দিয়েই মনে হয় বানর ও সরিসৃপরা আশ্রয়ের সন্ধানে গুহায় প্রবেশ করে।
স্নানের পর ডেকে এলাম।
রান্না ক্লাসের তোড়জোর চলছে। লম্বা টেবিলের উপর গ্যাসের চুলা, হরেকরকমের তাজা শাকসবব্জি, মসলাপাতি ইত্যাদি। অনেকেই এসেছেন তারমধ্যে কন্যাকুমারি থেকে এক ভারতীয় পরিবার লাওস, কম্বোডিয়া, হোচিমিন সিটি হয়ে হ্যানয় এসেছেন। জাহাজের প্রধান বাবুর্চি ভিয়েতনামি রান্নার কলাকৌশল শিখাচ্ছেন। রাইস পেপার দিয়ে সেদ্ধ শাকসবব্জি ও মাছ পরিবেশন করা হলো। সঙ্গে জল ব্যাতিরেকে পাকা আমের জুস। ভিয়েতনামি আমের মিষ্টি স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয়। রান্নার ক্লাসের পর গাইড জানালেন কিছুক্ষণের মধ্যে ডিনার পরিবেশন করা হবে। আর ভোর ছয়টায় সিগং ব্যায়ামচর্চায় আগ্রহীদের যোগ দিতে আহ্বান জানালেন। হ্যানয় অঞ্চলে চীনা প্রভাব প্রকট। হ্যানয় থেকে চীন সীমান্ত দূর নয়, একেবারে লাগোয়া। প্রায় একহাজার বছর আগে চীনারা এই পথেই প্রবেশ করে ভিয়েতনামের মধ্যাঞ্চলে রাজ্য স্থাপন করে। শুধু তাই নয় পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম নিষিদ্ধনগরী স্থাপন করে একহাজার বছর ভিয়েতনাম শাসন করে। ডিনারের পর ডেকে উঠে এলাম। সূর্য ডুবতে বসেছে। লাইমস্টোনের পাহাড়গুলোকে সূর্যের আবছা আলোয় দানবের মত লাগছে।
ভোর ছয়টা।
সারাদিন ক্লান্তির পর রাতে ভালোই ঘুম হয়েছে। কেবিনের জানালা দিয়ে তাঁকিয়ে দেখলাম জাহাজ এগিয়ে চলেছে। পাহাড়ের মাথায় আলোর ছটা। ফ্রেস হয়ে দুজনে বেরিয়ে এলাম। ডেকের উপর চেয়ার টেবিলগুলো সরিয়ে জায়গা ফাঁকা করা হয়েছে। এখানেই মনে হয় সিগং শেখানো হবে। সিগং চাইনিজ ব্যায়াম, ব্যায়ামের প্রতি রেহানার বরাবর আগ্রহ। ভারতীয় পরিবারটি চলে এসেছেন। আরো কয়েকজন এলেন, পুরো সিগং পোশাকে সজ্জিত হয়ে এলেন আমাদের গাইড, তিনিই সিগং শেখাবেন। তিনটি লাইনে সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন। গাইডের দেখানো পদ্ধতিতে আমাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে মুভ করতে শুরু করে। সিগং শরীরের রোগ নিরাময়ে সহায়তা করে এবং এই পদ্ধতি চীনে হাজার বছর ধরে অনুশীলন করা হচ্ছে। শরীরের মাংসপেশী সুগঠিত করতেও সহায়তা করে সিগং। প্রায় আধাঘণ্টা অনুশীলনশেষে দেখা গেল শরীর ব্যথা করছে। অবশ্য নতুনদের হবার কথা, যেমন আমার।
সিগংশেষে ব্রেকফাস্ট
জাহাজ সারারাত চলার পর গন্তব্যে এসে দাঁড়িয়েছে। গাইড এসে জানালেন ব্রেকফাস্টের পর আমরা ক্যানো রাইড ও বিচে সূর্যস্নান ও সাঁতার কাটতে যাবো। স্পিডবোট এসে থামে উপসাগরের উপর ভেসে থাকা ক্যানো স্টেশানে। অনেকগুলো ক্যানো জলের উপর সারিবদ্ধ হয়ে ঢেউয়ের তালে দুলছে। ক্যানো একপ্রকার লম্বা ডিংগি নৌকা। একা অথবা দু’জনে মিলে চালানো যায়। তবে হাতের শক্ত পেশী ও সাঁতার জানা থাকলে ভালো। উৎসাহীরা বুকে ভেস্ট বেঁধে এক একটি ক্যানো নিয়ে চলে গেলেন। ভারতীয় পরিবারের একজন একা ক্যানো ভাসালেন। আমরা দু’জন ছাড়া আরো কয়েকজন ঝিরঝিরে হাওয়ায় বোটে থেকে গেলাম। বোট এগিয়ে চলে। উপসাগরের এক চত্বর ঘুরে এসে দেখা গেল ভারতীয় ভদ্রলোক একই জায়গায় ক্যানো নিয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। এই দেখে ভারতীয় পরিবারটি হৈ চৈ করে উঠলেন। স্ত্রী প্রায় কেঁদেই ফেললেন কারণ ভদ্রলোক ক্যানো চালানো বা সাঁতার কোনোটাই জানেন না। অবশেষে স্পিডবোট তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। প্রায় জ্ঞানহারাকে টেনে হিঁচড়ে বোটে তোলা হলো। তবে ভদ্রলোককে ধন্যবাদ কিছু জানা না সত্বেও তিনি যে সাহস দেখিয়েছেন যা আমরা দেখাতে পারিনি। অন্যরা ক্যানো চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে বিচে রৌদ্রস্নান করে নিচ্ছেন। এভাবে দুপুর গড়িয়ে যাবার পর জাহাজে ফেরা। সাওয়ার নিয়ে ফিরে এসে দেখা গেল ডাইনিং টেবিলে পরিপাটি করে লাঞ্চ সাজানো।
রাতে এজেন্সির বিশেষ ডিনারে আপ্যায়ণ
কাল আমরা বিখ্যাত এক গুহা দর্শনশেষে হ্যানয় ফিরবো। সন্ধ্যায় সবাই পরিপাটি পোশাক পরিধান করে ডিনারে এলো। ডিনার টেবিল ফুল, ধবধবে সাদা ন্যাপকিন ও ঝকঝকে প্লেট গ্লাস কাঁটা চামচ দিয়ে সাজানো। প্রবেশ পথে লম্বা টেবিল পাতা। প্রধান শেফ একটি মাঝারি বল ও তিনটি পাথর নিয়ে এলেন। সঙ্গে সাগর থেকে ধরা গলদা চিংড়ি। গাইড এসে ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিলেন, তিনটি পাথর দিয়ে বিশেষ কায়দায় গলদা চিংড়িগুলো সেদ্ধ করে পরিবেশন করা হবে। পাথর দিয়ে চিংড়ি সেদ্ধ? বিষয়টি কৌতূহলের। শেফ উপুর করে বল বা গামলাটি দেখালেন। ভেতরে কিছু নেই। এরপর গামলায় তিনটি পাথর রাখা হল, সঙ্গে রাখা হলো অনেকগুলো চিংড়ি। এবার গামলায় স্টিম ভরে হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখা হলো। স্টিমের ঘূর্ণিতে বিকট শব্দে পাথরগুলো ঘুরতে থাকে। গামলার ঢাকনার ফাঁক দিয়ে সাদা স্টিম বেরিয়ে এসে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। পাথরগুলো গামলার ভেতর ঘুরতে ঘুরতে একসময় থেমে গেলে শেফ গামলা থেকে সেদ্ধ গলদা বের করে নিয়ে আসেন। পরিবেশনকারীরা সেগুলো পরিবেশন করলেন আমাদের। সস ও হালকা পাপড়িকার গুড়ো দিয়ে খেতে অতুলনীয়। ডিনার ও গানের আসরের পর গভীর রাতে কেবিনে ফেরা।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি নতুন আর একটি স্থানে জাহাজ দাঁড়িয়ে।
চারপাশে ঘন হয়ে জলের উপর দাঁড়িয়ে লাইমস্টোনের বিশাল পাহাড়গুলো। ব্রেকফাস্টের পর গুহা দেখার কর্মসূচি। জাহাজের প্রবেশ মুখে স্পিডবোট অপেক্ষা করছিলো। আমরা একে একে স্পিডবোটে উঠে এলাম। সবাইকে একটি করে ভেস্ট দেয়া হলো, স্পিডবোট ডুবে গেলে অসুবিধে নেই জলে ভেসে থাকা যাবে। এখানে জলের গভীরতা কম, জাহাজ যাবে না, যেতে হবে স্পিডবোটে। উপসাগরের ঝির ঝিরে বাতাসে উঁচু ছাউনি দেয়া স্পিডবোটে ভালোই লাগছিলো। একটি শানবাঁধানো ঘাটে বোট নোঙ্গর করে। সিঁড়ি বেয়ে উঁচুতে উঠতে হবে। উঁচুতে সিমেন্ট বাঁধানো পাটাতন। আমরা পাটাতনের উপর এসে দাঁড়ালাম। প্রচন্ড গরম পরছে, রোদের তাপ বেড়ে গেছে। পাটাতনের পাশ দিয়ে সিমেন্ট বাঁধানো পায়ে চলা পথ। এই পথে একটু এগিয়ে গেলেই গুহামুখ। তবে গুহামুখে যেতে পাথরের সিঁড়ি পেরিয়ে উঁচুতে উঠতে হবে। রেহানা তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। আমি ধীরে ধীরে অর্ধেক সিঁড়ি উঠে এলাম। গরম ও ঘামে জামা ভিজে গেছে, চোখের উপর দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝড়ছে। ভাবলাম আমার কি গুহা দেখার প্রয়োজন আছে? গুহা দেখেছি সুইডেনে, গুহা দেখেছি নেপালে। সব গুহা প্রায় একই, তবে বৈশিষ্ট্যে আলাদা। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ গুহা ভিয়েতনামে, যা প্রায় ৫ কিলোমিটার লম্বা ও নিচে খরস্রোতা নদী। বানর ও বাদুরের যাতায়াতের পথ অনুসরণ করে গুহাগুলো খুঁজে পায় স্থানীয় জনসাধারণ ও কৃষক। ভিয়েতনামের স্বাধীনতায় স্থানীয় কৃষকদের অবদান অনন্য।
ভিয়েতনামের স্বাধীনতায় হ্যানয়, হোচিমিন ও গুহাগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
গুহাগুলো আশ্রয় দিয়েছে যোদ্ধাদের, ভিয়েতকংদের। আর এই হ্যানয়তেই হোচিমিন গণতান্ত্রিক ভিয়েতনাম রাষ্ট্রের ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সে থাকার সময় ভিয়েতনামের স্বাধীনতার পক্ষে একজন স্পষ্টভাষী কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হন হোচিমিন। বলশেভিক বিপ্লব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করেন। তিনি ১৯৩০ সালে ইন্দোচাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি এবং ১৯৪১ সালে ভিয়েতনামের স্বাধীনতার জন্য লীগ বা ভিয়েতনিম প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে, ভিয়েতমিন বাহিনী হ্যানয় শহর দখল করে এবং ভিয়েতনামকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ঘোষণা করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হন হোচিমিন। ‘আঙ্কল হো’ নামে পরিচিতি পেয়ে তিনি পরবর্তী ২৫ বছর একই পদে দায়িত্ব পালন করে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের একত্রিকরণ সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেন।
জাহাজ ধীরে ধীরে হ্যালংবে সিটির জেটিতে এসে নোঙ্গর করে।
জেটিতে অনেক ভিড়, একদল নামছে আরেকদল যাচ্ছে। আমরা গাইডের দেখানো পথে অপেক্ষামান গাড়িতে এসে বসলাম। নতুন এক হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলে গাড়ি। যেতে যেখানে চার ঘণ্টা লেগেছিল, ফেরার পথে লাগলো আড়াই ঘণ্টা। গাইড হোটেলে নামিয়ে দিয়ে অভিবাদন জানিয়ে বিদায় নিলেন।
সুইডেন
৪-৬-২০২৪