লিয়াকত হোসেন, সুইডেন থেকে:
ড্রাগন ভিয়েতনামীদের জনজীবনে বিশাল প্রভাব বিস্তার করে আছে।
ভিয়েতনামীদের চিন্তা চেতনায়, সাহিত্য সংস্কৃতিতে ড্রাগনের প্রাধান্য। ভিয়েতনামীদের কাছে ড্রাগন শক্তি আভিজাত্য এবং অমরত্বের প্রতীক। ড্রাগনের নখর শক্তির ভারসাম্য বহন করে। যেহেতেু ড্রাগন শক্তির প্রতিনিধি তাই এটি ভিয়েতনামী সম্রাটদের বিশেষ প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পাঁচ নখরবিশিষ্ট ড্রাগন রাজকীয় ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত। চার নখরবিশিষ্ট ড্রাগন রাজকীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং উচ্চপদস্থ আদালতের কর্মকর্তাদের ব্যবহাররে জন্য। আর জনসাধারণের ব্যাবহারের জন্য তিন নখরবিশিষ্ট ড্রাগন।
ভিয়েতনামী ড্রাগন কুমির, সাপ, বিড়াল, ইঁদুর ও পাখির সাদৃশ্য বহন করতে পারে। ভিয়েতনামী কিংবদন্তি বলে, বিশ্ব-বিখ্যাত প্রাকৃতিক ঐতিহ্যবাহী স্থান, উত্তর ভিযেতনামের হা লং বে ড্রাগনের সৃষ্ট। ঐধহড়র এর পূর্ব নামের অর্থ ‘ড্রাগন থেকে উঠে আসা’। ভিয়েতনামের ম্যাপের দিকে তাকালে দেখা যায় উত্তর থেকে দক্ষিণঅবধি বিশাল এক ড্রাগন দাঁড়িয়ে আছে। উত্তরে হ্যানয়, হা করা এক ড্রাগনের মাথা, মধ্যাঞ্চলে গলাটি সরু হয়ে সেন্ট্রাল হাইল্যান্ড পার হয়ে দক্ষিণের সাইগন বা হো চি মিন সিটি পর্যন্ত হাত পা ছড়িয়ে পুচ্ছ বিস্তার করেছে। ড্রাগন থেকেই আধ্যাত্মিক ও মানসিক শক্তি অর্জন করে জনগন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে একহাজার একশত পনের বছর। প্রায় তিন লাখ বত্রিশ হাজার বর্গ কিলোমিটারের দেশটির জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে দশ কোটি। স্বাধীনতার জন্য চীনের আধিপত্যোর বিরুদ্ধে তাঁরা যুদ্ধ করেছে ১০০০ হাজার বছর। ৮০ বছর ফরাসি শাসন, ৫ বছর জাপানি শাসন, ১৯৪৫ সালে হো চি মিনের ক্ষমতা দখল ও গণপ্রজাতন্ত্রী ভিয়েতনাম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও অবশেষে ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫ সালঅবধি ৩০ বছর আমেরিকান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর উত্তর ও দক্ষিণের একত্রিকরনের মাধ্যমে পূর্ণ স্বাধীনতা।
Forbidden city বা নিষিদ্ধ নগর রয়েছে চীনের পিকিংএ
কিন্তু চীনের একহাজার বছর ভিয়েতনাম শাসনে দ্বিতীয় বৃহত্তম নিষিদ্ধ নগর স্থাপিত হয় ভিয়েতনামের মধ্যাঞ্চল হিউ শহরে। এই জন্য এই শহরটিকে বলা হয় The Imperial City বা রাজকীয় শহর। দুই কিলোমিটার দীর্ঘ ও ছয় মিটার উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা নিষিদ্ধ নগরে বাস করতেন রাজ পরিবার। নিষিদ্ধ নগরের প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করার অধিকার ছিল মাত্র ৫ জনের। একজন দূত, একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও বাকি তিনজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী।
যে দেশটি একহাজার একশত পনের বছর যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে ও তড়িৎ গতিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে সেই দেশটি দেখার আগ্রহ জাগা অস্বাভাবিক নয়। তাই দেশটি দেখার আগ্রহ জাগে। আগ্রহ থেকে অনুসন্ধানে এগিয়ে যাই। বিভিন্ন দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপর নির্ভর করে কোন মাসটি ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। ভিয়েতনামের উত্তর-দক্ষিণ ও মধ্য প্রদেশের একেক সময় একেক রকম আবহাওয়া। তবে মার্চ-এপ্রিল মোটামুটি ভালো সময়। বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি যে যদি কোনো এজেন্সির মাধ্যমে যাওয়া যায় তা’হলে অনেক ছোটখাট স্থানও দেখা হয়। ব্যক্তিগত ভ্রমণে বড় বড় স্থানগুলোই প্রাধান্য পায়। এজেন্সির মধ্যে যদি স্থানীয় এজেন্সি হয় তা’হলে আরো ভালো, কারণ তারা স্থানীয়ভাবে অনেক কিছুর সাথে পরিচিত। ভিয়েতনামের স্থানীয় টুরিস্ট এজেন্সির সন্ধান করতে যেয়ে কয়েকটি এজেন্সির মধ্যে দুটি এজেন্সিকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো। ওদের ওয়েবসাইট পরিদর্শন করে প্রোগ্রাম দেখে দুটি এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখা গেল একই প্রোগ্রামে দুটি এজেন্সির দু’রকম প্রাইস। একটির প্রাইস জনপ্রতি হাজার ডলারের কম অন্যটির হাজার ডলারের উপরে। দুটো এজেন্সিই হ্যানয় থেকে হো চি মিন সিটিঅবধি পনের দিনে পুরো দেশ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাবে। হিসেব করে দেখলাম যদি নিজে ব্যবস্থা করে ঐ স্থানগুলো দেখতে যাই হয়তো ওদের দেয় প্রাইসের থেকে কিছুটা কম পরবে তবে ঝামেলা হবে। অনেক দর্শনীয় স্থানে আগে থেকেই টিকেট বুক করে রাখতে হয় হয়তো কাক্সিক্ষত দিনে নাও পাওয়া যেতে পারে। দুটি এজেন্সির মধ্যে একটিকে বেছে নিয়ে যোগাযোগ করতেই হ্যানয় এজেন্সি থেকে জেনি পাম নামে ট্রাভেল কন্সালন্টে যোগাযোগ করলেন। জেনি পামের কথা উল্লেখ করলাম এজন্য যে তিনি আমাদের পনের দিনের ভিয়েতনাম ভ্রমণটি সততা ও একাগ্রতার সাথে প্রোগ্রাম করে ভ্রমণটি সফল করেছেন। ভ্রমণের বিষয়ে জেনির সাথে যোগাযোগ হয় ভ্রমণ শুরুর প্রায় ছয় মাস আগে। একনিষ্ঠভাবে তিনি দীর্ঘ ছয় মাস যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন এবং ভ্রমণশেষে সুইডেন ফেরাঅবধি খোঁজ খবর নিয়েছেন।
ভ্রমণসূচি ঠিক করার পর স্টকহোম টু হ্যানয় ফ্লাইট টিকেট খোঁজার পালা
এক এক বিমান কোম্পানির এক এক মূল্য। ভ্রমণের অন্তত এক মাস আগে টিকেট নিয়ে রাখলে সহনীয় মূল্যে পাওয়া সম্ভব। জেনিকে জানালাম স্টকহোম-হ্যানয় ও হো চি মিন-স্টকহোম বিমান টিকেট কনফার্ম হবার পর তোমাকে জানাবো। সে সঙ্গে তোমার দেয় প্রাইস সম্পর্কে বিবেচনা করবে আশা করি, কারণ অন্য এজেন্সি আরো কমে দিচ্ছে। একথা জানানোর পর জেনি ধরে নিল ওদের সঙ্গে ডিল হচ্ছে না। ফিরতি মেইলে জেনি জানালো, প্রাইস তারা কমাতে পারবে না তবে সার্ভিস গ্যারান্টি দেবে। প্রোগ্রাম অনুযায়ী আমরা যেখানেই যাই ড্রইভার-গাইডসহ একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ি আমাদের দুজনের সঙ্গে থাকবে।
যাত্রার দেড় মাস আগে বিমান টিকেট পাওয়া গেল
কিন্তু জেনিকে পাওয়া গেল না। ডিল হবে না ভেবে জেনি হাল ছেড়ে দিয়েছে। মেইলে জেনিকে টিকেটের বিষয়ে জানানোর পর সাড়া না পেয়ে এজেন্সির সিও-র সাথে যোগাযোগ করার পর জেনির মেইল পেলাম। দু’একদিনের মধ্যে জেনি পুরো পনের দিনের ভ্রমণসূচি পাঠালো। আর জানালো ভ্রমণসূচি নিশ্চিত করার জন্য ডিপোজিট হিসেবে সাড়ে ছয়শত ডলার কার্ডের মাধ্যেমে এজেন্সির অ্যাকাউন্টে পাঠাতে হবে। এই ডলার আবার মূল হিসাব থেকে বাদ যাবে। বিষয়টি যুক্তিযুক্ত মনে হওয়ায় কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করার পর দেখা গেল ১৯ ডলার আরো বেশি নিয়েছে। কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করলে যে ৫ থেকে ৬ পার্সেন্ট অতিরিক্ত দিতে হয় সেটি জানা ছিল না। ইউরোপে এটি নেই। তাই কার্ডে পেমেন্টে আরো উনিশ ডলার বেশি পরিশোধ করতে হলো।
বিষয়টি জেনিকে জানাতেই উত্তর পেলাম। অতিরিক্ত উনিশ ডলার এজেন্সি নয় নেবে ব্যাংক। বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হলো। কারণ মূল অংকের অবশিষ্ট অংশ কার্ডের মাধ্যমে পে করতে গেলে আরো অতিরিক্ত ৬৪ ডলার পরিশোধ করতে হবে। তাই জেনিকে জানালাম মূল পেমেন্টের অবশিষ্ট অংশ কার্ডের মাধ্যমে নয়, ক্যাশ পে করতে চাই। যেদিন হ্যানয় পৌছাবো সেদিন এজেন্সির অফিসে যেয়ে অথবা হোটেল লবিতে তুমি এসেও নিয়ে যেতে পারো। যদিও এজেন্সির নিয়ম অনুযায়ী ভ্রমণ শুরুর একমাস আগেই সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে হয়। অনেক ভেবে চিন্তে এজেন্সির নিয়ম ভেঙ্গে হলেও জেনি সম্মতি দিলো এবং হ্যানয় পৌঁছার পরদিন হোটেল লবিতে এসে বিল নিয়ে গেল। এরপর জেনির কাছ থেকে আমরা যে সার্ভিস পেয়েছি তা ভোলার নয়।
হ্যানয়
আঠারই এপ্রিল ভোর ছয়টা পঁচিশে হ্যানয় এসে পৌঁছুলাম।
স্টকহোম থেকে খুবই লম্বা ভ্রমণ, সতেরই এপ্রিল সকাল সাতটা পচিঁশে রওয়ানা হয়ে বেলা দশটায় প্যারিস। প্যারিস থেকে দুপুর দুইটায় রওয়ানা হয়ে একটানে স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে ছয়টায় হ্যানয়। ফ্রান্সের দ্বারা আশি বছর শাসিত হলেও প্যারিসের সর্ম্পক ছিন্ন করেনি ভিয়েতনাম। প্যারিস দ্য গ্যল এয়ারপোর্ট ঝামেলাচ্ছন্ন। এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে দূরত্ব ও যাতায়াতে সময় নেয়। সময় অপচয় না করে আমাদের নির্ধারিত টার্মিনালে চলে এলাম। কাচের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম বিশাল তিমি মাছের আকৃতি নিয়ে ভিয়েতনাম এয়ারের বিমান দাঁড়িয়ে। ভিয়েতনাম এয়ারে এর আগে যাইনি, সার্ভিস কেমন জানা নেই তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে থাই এয়ারের কাছাকাছি। ১০১০ থেকে ১৮০৩ সালঅবধি হ্যানয় ছিল ভিয়েতনামের রাজধানী। মাঝে রাজধানীর স্থান পরিবর্তন হলেও ১৯৪৫ সাল থেকে আবার রাজধানীর মর্যাদা ফিরে পায়।
সারারাত বিমান ভ্রমণে ক্লান্ত হয়ে হ্যানয় ইমিগ্রেশানে এসে দাঁড়ালাম। সুইডেন-ভিয়েতনাম সদ্য চুক্তি অনুযায়ী ভিসা ব্যাতিরেকে পঁয়তাল্লিশ দিন থাকার নিয়ম হলেও ভিসার ফর্ম তৈরি করে নিয়ে এসেছিলাম। ইমিগ্রেশানে সেগুলো কিছুই লাগলো না। ইমিগ্রেশান অফিসার একটি প্রশ্ন না করে পাসপোর্টে ভিসার সিল দিলেন। এতো সহজ ইমিগ্রেশানে খুবই অবাক হলাম। ঘুরন্ত বেল্ট থেকে লাগেজ উঠিয়ে টার্মিনালের বাইরে এসে দেখি নেমপ্লেট হাতে নিয়ে ড্রাইভার দাঁড়িয়ে। হোটেল চেকইন যদিও বেলা বারটায় তবে জেনি ভোরেই চেকইনের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। বেলা দশটাঅবধি ব্রেকফাস্ট, ক্লান্ত শরীরে যেতে ইচ্ছে করলো না। তবে একজন এসে রুমেই হালকা ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেলেন।
প্রোগ্রাম অনুযায়ী আজই হ্যানয় স্ট্রিট ফুডের সাথে পরিচিত হবার কথা
হ্যানয়ের স্ট্রিট ফুড পৃথিবী বিখ্যাত খাবারের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। বিশেষ করে তিনটি খাবার বানমী, ফো আর চাফেদা খাবারগুলোর স্বাদ না নিলে নাকি জীবনই বৃথা। হোটেল লবিতে লুসি নামে একজন গাইডের আসার কথা, তিনি আমাদের হ্যানয় স্ট্রিট ফুডের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন। রুম থেকে বের হয়েই গরম বাতাসের ধাক্কা খেলাম। লিফ্ট থেকে লবিতে পা রাখা মাত্রই একটি মেয়ে এসে লুসি বলে পরিচয় দিয়ে যেতে আহ্বান জানালেন। সিঁড়ির নিচেই ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে, গাড়িটি এতো ঝকঝকে পরিস্কার যে উঠে বসতে লজ্জা হলো, কারণ দীর্ঘ পরিভ্রমণে আমার পায়ের জুতাও পরিস্কার নয়। লুসি চমৎকার ইংরেজি বলেন। কোথায় কী বুঝিয়ে বলছিলেন। রাস্তার ধারে পরিপাটি একটি খাবারের দোকানে এলাম। দোকানগুলো সাধারণত মেয়েরাই পরিচালনা করে। খাবারও তারাই পরিবেশন করে। দোকানের সামনে দুটি গ্যাসের চুলা। লুসি দেখালেন কিভাবে গ্যাসের চুলায় ভাতের পাতলা মন্ড থেকে রাইস পেপার তৈরি করা হচ্ছে এবং রাইস পেপারের ভেতর বিভিন্ন সবজি দিয়ে পুরির মত বানিয়ে পরিবেশন করা হচ্ছে। রাইস পেপারের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না কিন্তু পুরি উপাদেয়। এরপর আমাদের দু’টি সিরামিকের বাটিতে বিখ্যাত ফো পরিবেশন করা হলো।
বিভিন্ন তাজা সবজির সেদ্ধ করা ঝোল। ঝোলের ভেতর সেদ্ধ রসুন বিভিন্ন মসল্লা আর নুডল্স। স্বাদে মন্দ নয়। ফো হ্যানয় তথা ভিয়েতনামের জাতীয় খাবার। হ্যানয়বাসীরা প্রতিদিন ভোরে নিচু ছোট টুলে বসে ফো দিয়ে নাস্তার পর্ব শেষ করে কাজে ঝাপিয়ে পরেন।
লুসিকে আমরা আমাদের খাবারের সঙ্গী হতে আহ্বান জানালাম।
লুসি কিছুতেই রাজি হলেন না। কারন গাইড ও ড্রাইভাররা কখনই ভ্রমণকারীদের সঙ্গে টেবিলে বসেন না। মনে হলো ভারতীয় গাইডদের কথা। এরা এতোই নৈতিক ও মানসিক অবক্ষয়শূন্য যে কোনো আহ্বান বা আমন্ত্রণ ছাড়াই পাশে বসে পড়বে। নিজ পছন্দমত খাবারের অর্ডার ও পেটপুর্তী করে বিলটি ভ্রমণকারীর উপর চাপিয়ে দিয়ে সরে পরবে। পড়ন্ত বিকেলে লুসি আমাদের হোটেলে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর এলেন জেনি।
পরদিন উনিশে এপ্রিল সারাদিন হ্যানয়ের বিশিষ্ট স্থান গুলো ঘুরে দেখার কথা।
প্রাত:রাশের পর ঠিক সময় লুসি গাড়ি নিয়ে চলে এলেন। আমরা এলাম শিক্ষামন্দির বা টেম্পেল অব লিটারেচারে। সম্রাট লিথান ১০৭০ সালে শিক্ষামন্দিরটি স্থাপন করেন এবং দার্শনিক কনফুসিয়াসকে উৎসর্গ করেন। এটি ভিয়েতনামের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় রুপে আত্মপ্রকাশ করে। এই শিক্ষামন্দিরে শিক্ষা নিতে পারতেন শুধু রাজপরিবার ও পরিবারসংলগ্ন ছাত্ররা। জনগণের প্রবেশ একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল। কনফুসিয়াসের দর্শন ছিল ৫টি। বদান্যতা, ধর্মপ্রাণতা, উপযুক্ততা, বিজ্ঞতা ও বিশ্বস্ততা। ঐ পাঁচটি দর্শন একটি পরিপূর্ণ মানুষ সৃষ্টি করতে পারে বলে ধারনা করা হতো। কিন্তু ঐ পাঁচটি দর্শনের মধ্যে মানুষের স্বাধীন সত্ত্বার কোনো স্থান ছিল না। একজন শিক্ষার্থী শিক্ষকের প্রতি অনুগত থাকবেন আবার শিক্ষক অনুগত থাকবেন রাজার প্রতি। এই অনুগত থাকার নীতিটি পরবর্তী সময়ে হো চি মিন ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। শিক্ষা মন্দির কমপ্লেক্সটি অনেক পুরানো, পুরানো গাছের ছায়ায় ঘেরা। অতিত ঐতিহ্য বহন করে আছে। লুসি সবকিছু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখালেন।
আমরা শিক্ষামন্দির চত্বরে প্রবেশ করলাম।
প্রশস্ত টালির রাস্তা, দুধারে ফুলের বাগান। চারদিক ঘেরা পদ্মপুকুর। স্কুলের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা রংবেরঙ্গের জামা পরে ছবি তুলছে। আমরাও ওদের সাথে ছবি তুলে এগিয়ে গেলাম। সামনে সেগুন কাঠের তৈরি বিশাল এক ঘর। সম্রাটদের উপাসনা কক্ষ। ভেতরে জ্বলন্ত ধুপের গন্ধ। আগে সম্রাটরাই শুধু এই ঘরে প্রবেশ করতে পারতেন এখন জনসাধারনের জন্য উন্মুক্ত। দুতলা যাবার কাঠের সিড়ি ধরে উপরে উঠে এলাম। শিক্ষামন্দির চত্বরে কনফুসিয়াস ও শিক্ষার্থীদের পাথরের মূর্তি। ১৪৪২ সালে শিক্ষামন্দিরের বিধিব্যবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। সেসময় থেকে দেশের আনাচে-কানাচে থেকে প্রতিভাধর শিক্ষার্থীদের কনফুসিয়াসের দর্শন, সাহিত্য ও কবিতা পড়ার সুযোগ দেয়া হয়। শিক্ষাশেষে শিক্ষার্থীরা রাজ অনুগ্রহে জমি ও ঘরবাড়ি লাভ করতেন। কিন্তু শিক্ষাজীবন এতই সময়সাপেক্ষ ছিল যে প্রসংশাপত্র পেতে পেতে সত্তর আশি বছর পেরিয়ে যেত। জীবনের পড়ন্ত বিকেলে শিক্ষার্থীরা ঐটুকু প্রাপ্তি নিয়ে বাকিটা সময় কাটিয়ে দিতেন।
শিক্ষামন্দিরের পর আমরা এলাম ছোট একটি কফির দোকানে।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কফি উৎপাদনকারী দেশ ভিয়েতনাম। লুসি জানালেন এখানে আমরা এগ কফি বা ডিমের কফি পান করব। কফির অনেক নাম শুনেছি কিন্তু ডিম কফির নাম শুনিনি। একটু কৌতূহল নিয়ে কফি সপে প্রবেশ করলাম। কফি সপে ছোট ছোট টুলের উপর বসে তরুণ তরুণী বৃদ্ধ আর বৃদ্ধারা আয়েশে ডিম কফি পান করছেন। ভেবেছিলাম কফিতে ডিমের গন্ধ পাওয়া যাবে কিন্তু লুসি আশ্বাস দিয়ে বললেন এই কফির স্বাদ জীবনে ভোলার নয়। ডিমের কুসুম, চিনি, কনডেন্সড মিল্ক এবং রোবাস্টা কফি দিয়ে তৈরি হ্যানয়ের খুব জনপ্রিয় পানীয়। ১৯৪৬ সালে ফরাসি যুদ্ধের সময় দুধের ঘাটতি দেখা দিলে মেট্রোপোল হোটেল বারটেন্ডার নুগুয়েন ভ্যান গিয়াং দুধের পরিবর্তে ডিম দিয়ে প্রথম কফি তৈরি করেন। কফিতে ডিমের গন্ধতো নেই তবে অপূর্ব স্বাদে পূর্ণ। ধীরে ধীরে ডিম কফি পানপ্রিয়তা পেলে নুগুয়েন ভ্যান গিয়াং কফির সঙ্গে অমর হয়ে রইলেন। কফির স্বাদ ও সুগন্ধের কথা জানালে লুসি উৎকৃষ্টমানের এক কেজি কফি সংগ্রহ করে দিলেন।
কফি পানের পর দোকান থেকে বের হলে দেখা গেল গায়ের জামা কাপড় গরম ও ঘামে ভিজে গেছে। শীতের দেশের জামা কাপড় হয় স্বাধারণত মোটা, যাতে ঠান্ডা প্রতিহত করতে পারে। সঙ্গে মোটা জামা কাপড় থাকায় অস্বস্তি বেড়ে গেল। হালকা পাতলা শার্ট প্যান্ট না কিনলেই নয়। লুসি নিয়ে এলেন এক অভিজাত দোকানে। পিওর সিল্কের জামা কাপড়। ভিয়েতনামের সিল্ক বিখ্যাত। পারিবারিক দোকান নিজেদের উৎপাদিত সিল্ক ও ডিজাইনের পোশাক। দোকানের স্বত্তাধীকারিনী এগিয়ে এলেন। কয়েক সেট হালকা পোশাক কেনার পর লাঞ্চের সময় হয়ে এল। বেশ কয়েক কোর্সের উপাদেয় লাঞ্চের ব্যবস্থা করেছেন এজেন্সি। লাঞ্চের পর হোটেলে নামিয়ে দিয়ে লুসি বিদায় নিলেন। লুসির সঙ্গে আর দেখা হয়নি।
(চলবে)
২৫ মে ২০২৪
স্টকহোম, সুইডেন