লিয়াকত হোসেন, সুইডেন:
সায়গন বা হোচিমিন সিটি
শেষ বিকেলে হোচিমিন সিটিতে এসে পৌঁছালাম।
কোনো অসুবিধে হলো না। এয়ারপোর্টে ড্রাইভার নেমপ্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
রাস্তায় রাস্তায় রংবেরঙ্গের ঝলমল আলো জ্বলে উঠেছে। আলোর বন্যা পাড়ি দিয়ে আমরা হোটেলে পৌঁছালাম। বিশাল বড় হোটেল। হোটেলের পাশেই আরো কয়েকটি বড় হোটেল। চেকইন করার পর আমাদের বড় এক রুম দেয়া হল। এখানে আমরা চারদিন থাকবো। পরদিন ভোরে ব্রেকফাস্টের পর গাড়ি নিয়ে গাইড এলেন। আজ আমাদের বিখ্যাত চুচি টানেল দেখার কথা। সায়গনের ফরাসি শাসকদের শায়েস্তা করতে ভিয়েতকং যোদ্ধারা ১৯৪৮ সালে এই চুচি টানেল তৈরি শুরু করেন। এই টানেলের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায় আমেরিকা যুদ্ধের সময়। ভিয়েতকং গেরিলাদের গোপন আশ্রয়স্থান ছিল ১২১ কিলোমিটার লম্বা চুচি টানেল। এই দীর্ঘ টানেলের একটা অংশ বর্তমানে টুরিস্টদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।
আমাদের নুতন গাইড বেশ জাতীয়তাবাদী।
হোচিমিন সিটি থেকে তার সায়গন নামটাই বেশি পছন্দ। সায়গনে আগে স্কুলের শিক্ষা ফ্রি ছিলো এখন আর নেই। উত্তরের অধিবাসীরা দক্ষিণে জাঁকিয়ে বসেছে। এমনকি সায়গন নামটিও পাল্টে ফেলেছে। তিনি উত্তরাবাসীদের উপর বেশ ক্ষুব্ধ। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৫ অবধি সায়গন ছিল ভিয়েতনামের রাজধানী। ১৯৬০ ও ’৭০ দশকের প্রথম দিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় সায়গন ছিল মার্কিন সামরিক অভিযানের সদর দফতর। যুদ্ধে শহরের কিছু অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। আমাদের গাইড যুবক হলেও ফরাসি শাসনের অধীনে থাকা সায়গনকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
গাড়ি ছুটে চলেছে। শহর থেকে চুচি টানেলের দূরত্ব অনেক। মেকং নদীর কোল ঘেঁসে টানেল। যুদ্ধের সময় রাতে টানেল থেকে বের হয়ে ভিয়েতকংরা আমেরিকান সৈন্যদের আক্রমণ করতো। আক্রমণ শেষে আবার আশ্রয় নিত টানেলে। টানেল যুদ্ধে প্রায় ৪৫,০০০ হাজার ভিয়েতনামী পুরুষ ও নারী মৃত্যুবরণ করেন। ভিয়েতনামী জনগণ দেশের কৃষকদের খুব সম্মান দিয়ে থাকেন। কৃষকদের কথা উঠলেই তারা মাথা নিচু করে সম্মান জানান। কারণ কৃষকরাই যুদ্ধের ইতিহাস সৃষ্টিকারী। এই কৃষকরাই জীবন-মৃত্যুর মায়া ত্যাগ করে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে দু’কাঁধে ঝুলানো টুকরির ভেতর অস্ত্রশস্ত্র, খাবার ও অনান্য সামগ্রী ভিয়েতকং গেরিলাদের পৌঁছে দিয়েছেন। আর আমরা নয় মাসের যুদ্ধে গ্রামবাসীদের আত্মত্যাগকে পাশ কাটিয়ে নিজেরাই চেতনার ঝান্ডা তুলে ধরেছি।
ঘণ্টাতিনেক চলার পর আমরা চুচি টানেলের প্রবেশমুখে এলাম।
বিশাল জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পায়ে চলা পথ। গাড়ি থেকে নেমে আমরা বনের ভেতর শক্ত মেঠো পথে এগিয়ে গেলাম। পথের নীচে মাটির গভীরে টানেল। যেতে যেতে গাইড গাছের গোড়ায়, জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট হোল দেখাচ্ছিলেন, ওগুলো ভেন্টিলেশান, ঐ সরু ছিদ্র দিয়েই টানেলের ভেতর বাতাস যাতায়াত করে। ছিদ্রগুলো এতো সরু যে সাধারণ চেখে দেখা যায় না। বলে না দিলে বোঝার উপায় নেই। এই জঙ্গলের ভেতর ভিয়েতকং গেরিলারা বন্দুকের গুলি নয়, ফাঁদে ফেলে আমেরিকানদের হত্যা করতো। কারণ গুলির শব্দে ঝাঁকে ঝাঁকে আমেরিকান হেলিকপ্টার ছুটে এসে বম্বিং করে টানেলের ক্ষতিসাধন করত। বেশ কয়েকটি ফাঁদ দেখলাম। যেগুলোতে পা ফেলা মাত্রই আমেরিকান সৈন্যরা তাদের ভারী দেহ নিয়ে মাটির নীচে পেতে রাখা লোহার শলাকায় বিদ্ধ হয়ে পরে থাকতো, এভাবেই রক্তপাতের ছয় ঘন্টার মধ্যেই মারা যেত।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা ছোট এক শেয়ালের গর্তের কাছে এলাম।
গর্তটি দেখতে অনেকটা শেয়ালের যাতায়াতের পথের মত। কিন্তু ঐ ছোট গর্তটাই মাটির নীচে টানেলে যাবার পথ। ভিয়েতনামী নারী-পুরুষদের শারীরিক গঠন প্রকৃতিগতভাবেই সরু। ঐ সরু গর্ত দিয়ে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে টানেলে নেমে যেতে পারতেন। কিন্তু ভারী দেহ ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমেরিকানদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বোম্বিং করে টানেলের ক্ষতি করা সম্ভব, গেরিলাদের মাটি চাপা দিয়ে হত্যা করা সম্ভব কিন্তু ধরা সম্ভব হতো না। কাজেই এই অসম যুদ্ধে হতাশ হতো আমেরিকানরাই। আর এই হতাশা থেকেই ভিয়েতনামের আনাচে কানাচে মাইলাইয়ের মত গণহত্যা ঘটিয়েছিল আমেরিকান সৈন্যরা। টানেলের ভেতর ভিয়েতকং গেরিলারা কিভাবে বাস করতেন, কিভাবে খাদ্য আহরণ করতেন, কিভাবে যুদ্ধ করতেন সবই প্রতীকিভাবে দেখানো হয়েছে। গেরিলারা কিভাবে জীবন মৃত্যুর সূক্ষ্ম সুতোর উপর দিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন তা এক বিস্ময়। টানেলের কাছে এমনই কয়েকজন বিস্ময়কর গেরিলার সঙ্গে দেখাও হলো। যারা টানেলের ভেতর থেকে আমেরিকান সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। এখন যুদ্ধশেষে টানেলের রক্ষাণাবেক্ষণে নিযুক্ত। ত্রিশ বছর যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধা আর নয় মাস যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মনমানসিকতায় বিস্তর পার্থক্য। ত্রিশ বছর যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধারা দেশ গঠনে নিবেদিত আর নয় মাসের মুক্তিযোদ্ধরা দেশ ও বিদেশের আনাচে কানাচে অলিতে গলিতে মুক্তিযুদ্ধ চেতনার দোকান খুলে ইতিহাস সৃষ্টিতে ব্যস্ত। সময়ের প্রেক্ষাপটে নয় মাসের মুক্তিযোদ্ধারা নামধারী এক সুবিধাবাদী প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে।
স্টকহোম, সুইডেন
১৬-৭-২০২৪