লিয়াকত হোসেন, সুইডেন: ড. ইউনূসের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল নবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানে। সালটা ২০০৬।
চারদিকে এক গুঞ্জন ছড়িয়ে পরেছিল যে ড. ইউনূস নবেল পুরস্কার পাচ্ছেন। এরকম গুঞ্জন আগেও ছড়িয়েছিল। প্রতিবছর নবেল পুরস্কার ঘোষণার আগেই অনেক গুঞ্জন ছড়ায়। কখনো গুঞ্জন সত্য হয়, কখনো হয় না। এবারও গুঞ্জন সত্য হবে কিনা শংকায় ছিলাম। প্রতিবছর কে কোন ক্যাটাগরিতে নবেল পুরস্কার পাচ্ছেন তা কখনো আঁচ করা যায় না কিংবা পুরস্কার প্রাপকরাও ঘোষণার পূর্বমুহূর্তেও জানতে পারেন না। এমনই গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। সুইডিশ বিজ্ঞানী ও আবিস্কারক আলফ্রেড নবেলের টেস্টামেন্ট অনুযায়ী নবেল পুরস্কারের সবগুলো পুরস্কার দেয়া হয় স্টকহোম থেকে। শুধু শান্তি পুরস্কার দেয়া হয় নরওয়ে থেকে। শুধু শান্তি পুরস্কার দেবার জন্য নরওয়েতে আলাদা একক নবেল কমিটি রয়েছে।
দিনটা ২০০৬ সালের ১৩ই অক্টোবর।
এই দিনটিতে নরওয়ে থেকে নবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণা করা হবে। ১৩ সংখ্যায় শঙ্কা ছিল।এবারও ফসকে যায় কিনা? সকাল থেকেই সুইডিশ টিভি ও বাংলাদেশ টিভির উপর দৃষ্টি রাখছিলাম। অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয়ে দীর্ঘতর, অবশেষে ঘোষণা এল। নরওয়ে নবেল কমিটির চেয়ারম্যান প্রফেসর ওলে ডানবল্ট মোস ঘোষণা করলেন ২০০৬ সালের শান্তি পুরস্কার প্রাপক গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূসের নাম। শান্তি পুরস্কারটি দুভাগে ভাগ করে দেয়া হলো, ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে। পুরস্কারের নাম ঘোষণার পর পরই প্রফেসর ডানবল্ট নবেল কমিটির মোটিভেশানটিও পাঠ করেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ঘটে গেছে এক অভাবনীয় ঘটনা, অভাবনীয় জাগরণ। বাংলাদেশ থেকে দেয়া ড. ইউনূসের ইন্টারভিউ ভেসে এল টিভির পর্দায়। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পরলো ড. ইউনূসের নাম, বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশ একলাফে পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো।
সুইডিশ বিজ্ঞানী ও আবিস্কারক আলফ্রেড নবেলের জন্ম স্টকহোমে ১৮৩৩ সালের ২১শে অক্টোবর আর মৃত্যু ১০ই ডিসেম্বর, ১৮৯৬ সালে। তাঁর মৃত্যু দিবসটি স্মরণ করে বিরাট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ১০ই ডিসেম্বর দেয়া হয় নবেল পুরস্কার। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই দুমাসের মধ্যে নেয়া হয় অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। শান্তি পুরস্কার অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেয় নরওয়ের নবেল কমিটি। অনান্য পুরস্কারের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেয় স্টকহোম নবেল কমিটি। দুটি অনুষ্ঠনেই সারা পৃথিবী থেকে বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। হঠাৎ করেই শুনতে পেলাম শান্তি পুরস্কারের মূল অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট কয়েকজন প্রবাসীকেও আমন্ত্রণ জানানো হবে। বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ে নরওয়ের নবেল কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করি। দিনকয়েক পরে মূল অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য নরওয়ের নবেল কমিটি থেকে আমন্ত্রণ পাই। আমার জানা মতে স্টকহোম থেকে আরো তিনজন আমন্ত্রণ লাভ করেন।
নবেল পুরস্কারের মূল অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার বিষয়টি ব্যাপক।
ধীরে ধীরে ১০ই ডিসেম্বর উপস্থিত হলো। ডিসেম্বরে নরওয়ের শীতের প্রকোপ মন্দ নয়। প্লেন থেকে নেমে সাট্ল ট্রেনে উপস্থিত হলাম নরওয়ের সিটি হলে। সিটি হলে যাবার রাস্তাটি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে, এই পথ দিয়েই ড. ইউনূস আসবেন। রাস্তার অপর পাশে টেলিনর বিরাট এক সাদা তাবু টানিয়ে দিয়েছে। তাবুর ভেতরটা গরম ও প্রচুর গরম কফি ও খাবারের ব্যাবস্থা। যারা মূল অনুষ্ঠান সিটি হলে আমন্ত্রিত নন তাদের জন্য বিশাল তাবু, চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা। পাশেই বিরাট টিভি, ঐ টিভিতে মূল অনুষ্ঠান দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ড. ইউনূস পৌঁছার আগেই রাস্তার অপরপাশে সিটি হলে আমন্ত্রিতদের আহ্বান জানান হলো। সিটি হলের দিকে যেতে যেতে বার বার শিহরিত হচ্ছিলাম। মূল অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্যে শিহরিত হলাম। নওয়েজিয়ন নবেল কমিটি আমন্ত্রণ না জানালে হয়তো এই অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্যই হতো না।
লাল গালিচায় মোড়ানো সিঁড়ি। সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে সিটি হলের ভেতর চলে এলাম। একজন এগিয়ে এসে আমন্ত্রণলিপিটা চেক করে বসার আসন দেখিয়ে দিলেন। ভেতরটা বেশ বড়। সম্মুখে উঁচু পাটাতন। ড. ইউনূস এই পাটাতনেই এসে দাঁড়াবেন।
পাটাতনের নিচের প্রথম সারিতে নরওয়ের মহমান্য রাজা, রানী, প্রিন্স, প্রিন্সেস ও রাজ পরিবারের সদস্য ও নিকটআত্মীয়রা। দ্বিতীয় সারিতে পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নবেল লরিয়েটদের বসার আসন। তৃতীয় সারিতে দেশের মন্ত্রী পরিষদ ও রাষ্ট্রদূতদের বসার আসন, চতুর্থ ও পঞ্চম সারিতে আমন্ত্রিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আমার আসন ছিল চতুর্থ সারিতে। তাই পুরো অনুষ্ঠানটি খুব নিকট থেকেই দেখেছিলাম। হলটি ছিল দোতলা। দোতালাজুড়ে ছিল বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা সংবাদপত্রের প্রতিনিধি, টেলিভিশন ক্যামেরা ও অনান্য আমন্ত্রিত ব্যক্তি। বাংলাদেশ থেকে আগত সংবাদ ও টিভি প্রতিনিধিরা দোতালায়ই ছিলেন।
ড. ইউনূস তখনো এসে পৌঁছাননি। তবে আগমণের বার্তা টিভি স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছিল। রাস্তা থেকে অনুষ্ঠান হলঅবধি লাল কার্পেট বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে ঐ পথ দিয়ে হেঁটে আসবেন ড. ইউনূস। টিভি পর্দায় ভেসে উঠলো ড. ইউনূসের আগমণ বার্তা। নরওয়ের রাজপরিবারসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা উঠে দাঁড়ালেন। লালগালিচা পেরিয়ে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাঙ্কের অতিথিসহ হলে প্রবেশ করলেন। হলে পিনপতন নিরবতা। ড. ইউনূস আসন গ্রহণ করার পর রাজপরিবারসহ সবাই আসন গ্রহণ করলেন। ড. ইউনূসকে এই প্রথম সামনা-সামনি দেখা।
অনুষ্ঠান শুরু হলো।
নবেল কমিটির চেয়ারম্যান প্রফেসর ওলে ডানবল্ট মোস এগিয়ে এসে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পুরস্কার প্রাপ্তির মটিভেশান পাঠ করার পর ড. ইউনূসের হাতে নবেল পুরস্কার তুলে দিলেন ও গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষে নবেল পুরস্কার গ্রহণ করেন নূরজাহান বেগম। পুরস্কার গ্রহণের পর পরই ভাষণ দিতে এগিয়ে এলেন ড. ইউনূস। হলের ভেতর তাঁর ভরাট কন্ঠ ছড়িয়ে পরল। তিনি ভাষণ শুরু করেন:
Your Majesties, Your Royal Highnesses, Honorable Members of the Norwegian Nobel Committee, Excellencies, Ladies and Gentlemen,
Grameen Bank and I are deeply honoured to receive this most prestigious of awards. We are thrilled and overwhelmed by this honour. Since the Nobel Peace Prize was announced, I have received endless messages from around the world, but what moves me most are the calls I get almost daily, from the borrowers of Grameen Bank in remote Bangladeshi villages, who just want to say how proud they are to have received this recognition.
এরপর একে একে ব্যাখ্যা করলেন কিভাবে দারিদ্রতা শান্তিকে বাঁধাগ্রস্থ করে, কিভাবে দারিদ্রতা মানবাধিকারকে এগিয়ে যেতে বাঁধা দেয়। তিনি তুলে ধরলেন গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম, ভিক্ষুক থেকে স্বাবলম্বি হয়ে ওঠা, দারিদ্রের দ্বারে তথ্য প্রযুক্তি পৌঁছে দেয়া, মুক্ত বাণিজ্য, গ্রামীণ সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে দারিদ্রকে যাদুঘরে পাঠিয়ে দেয়া।
তিনি ভাষণ দিলেন বাংলা ও ইংরেজি দু’ভাষাতেই। এই প্রথম নবেল অনুষ্ঠানে কেউ বাংলায় ভাষণ দিলেন। ভাষণশেষে করতালিতে মুখর হলো হল ঘর। ভাষণশেষে তিনি একটু বিশ্রামের জন্য সিটি হলের একটু দূরেই গ্র্যান্ড হোটেলে যেয়ে উঠলেন। ঐ হোটেলেই উঠেছিলেন তিনি। হোটেল পথে রাস্তার দুধারে অগণিত জনতা দাঁড়িয়ে। রাজ পরিবারের কয়েকজনও গ্র্যান্ড হোটেলে উঠেছিলেন বলে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়ে একই হোটেলে চলে এলাম। কালাম ভাই আগে থেকেই একটা রুম বুক করে রেখেছিলেন বিশ্রামের জন্য।
বিকেলে সিটি হলে ছিল প্রেস কনফারেন্স, সেখানেও সামনাসামনি দেখা হলো ড. ইউনূসের সঙ্গে। ক্লান্তিহীন একজন একের পর এক বিশ্বের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার প্রতিনিধিদের প্রশ্নের সাবলিল কন্ঠে উত্তর দিয়ে গেলেন, জানালেন তাঁর কর্মপদ্ধতি। সন্ধ্যা হয়ে এল, আমাদের স্টকহোম ফেরার ফ্লাইটের সময় ঘনিয়ে এলে ড. ইউনূসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
এর দুদিন পর ১২ই ডিসেম্বর, ২০০৬
সুইডেনের স্টকহোমে ফল্কেত হাউসে ড. ইউনূসকে বিরাট সংবর্ধনা দেয়া হয়।
সেদিনও দেখা হয়। ফল্কেত হাউস সেদিন লোকে লোকারণ্য। কানায় কানায় হল ভরে গিয়েছে। দুভাগ করা চেয়ারের সারির মাঝেই আসন পেলাম। এই পথ দিয়েই ড. ইউনূস মঞ্চে যাবেন। ড. ইউনূস হলে প্রবেশ করামাত্রই আমন্ত্রিতরা দাঁড়িয়ে গেলেন। পাশ দিয়ে যাবার সময় চোখাচোখি হলো, কী উজ্জ্বল দু’টি চোখ, হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলাম। তিনি মঞ্চে আসন গ্রহণ করলেন। এবার প্রশ্ন-উত্তরের পালা। অনুষ্ঠানে সঞ্চালক প্রশ্নের পর প্রশ্ন করলেন, নবেল পুরস্কার পাবার পর ড. ইউনূসের কার্যক্রম কী? তিনি কি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টর জন্য দাঁড়াবেন? ইউনূস হেসে উত্তর দিলেন, প্রেসিডেন্ট সিস্টেম নেই, প্রাইম মিনিস্টার আছেন। তখন মনে হয়েছিল ড. ইউনূসকে দেশের বৃহত্তর কাজে লাগানো যেতে পারে।
এর কয়েকবছর পর ২০১১ সালের ১৮ই জুন ড. ইউনূস সুইডিশ সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের আমন্ত্রণে অতিথি হয়ে আবার স্টকহোম আসেন। সে সময় তিনি সরকারের নোংরা আক্রমণের শিকারে আক্রান্ত। সন্ধ্যায় স্টকহোম প্রবাসী বাঙালিদের পক্ষ থেকে সিস্তায় এক ডিনারের আয়োজন করা হয়। ডিনার টেবিলে মুখোমুখি বসেছিলাম আমরা। সে সময় তাঁর নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের এমডির পদ থেকে জোর করে তাঁকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। মুখোমুখি বসে প্রশ্ন করেছিলাম, আদালতে গেলেন কেন? ইউনূস মুচকি হেসেছিলেন, কিছু বলেননি। হয়তো দেশের বিচার ব্যবস্থাকে যাচাই করতে চেয়েছিলেন।
মাঝে ড. ইউনূস রাজনীতিতে নামতে চেয়েছিলেন।
অনেকে বলেন সেটি ছিল তাঁর ছোট্ট ভুল সিদ্ধান্ত। আমি বলি, না। রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে। রাজনৈতিক ময়দান কারো ব্যক্তিগত ইজারার ক্ষেত্র নয়।
ড. ইউনূসের প্রতি বিচার ও অবিচার নিয়ে অনেক কথা হয়েছে।
তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য অনেক অহেতুক মামলা দেয়া হয়েছে। এজলাসে যাবার পথে লিফ্ট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দেশের একশতটি কোর্টে একশতটি মামলা দেয়া হয়েছে। তাঁকে ধরে পদ্মা সেতু থেকে জলে চুবানোরও অভিপ্রায়ের কথা বলা হয়েছে। আর স্বৈরাচারসহ স্বৈরাচারের দোসররা মুচকি হেসেছে। দেশ তাঁকে যথাযথ সম্মান না দিলেও বিদেশ ভুল করেনি। অবশেষে দীর্ঘদিন পর দেশের যুগসন্ধিক্ষণে ছাত্র-জনতার দাপটে স্বৈরাচার পালিয়ে গেলে ড. ইউনূসই ধরলেন দেশের হাল।
সুইডেন
৩১/৮/২০২৪