আবদুল্লাহ আল-হারুন: ২০১০ সালের মা-দিবসে এই রচনাটি আমি লিখেছিলাম। মা অদ্বিতীয়, অনন্য, অতুলনীয় ও অবিনাশী। সৃষ্টির আদি থেকেই মা প্রতিটি জাতি-প্রজাতির প্রধান সূত্রধর। তাকে নিয়ে কোনো লেখাই পুরোনো হয় না। ২০১০ বা ২০২৪ সালমাত্র, মায়ের কথা সার্বজনীন, সর্বকালিন, সময়ের বাঁধনে তাকে বাঁধা যায় না। পৃথিবীর সব ঋণ শোধ করা যায় এমনকি পিতৃঋণও। হিন্দু-পুত্ররা পিন্ড দিয়ে পিতার স্বর্গযাত্রা নিশ্চিত করে তাঁকে জন্ম দেবার পিতৃঋণ শোধ করে। কিন্ত মায়ের ঋণ এতই বিশাল, এতই তার ব্যাপ্তি যে এটা শোধ করার চিন্তাও বাতুলতা।
আমি মৃত্যুর পরে জীবনে বিশ্বাস করি। মৃত্যুর সাধারণ অর্থ, ‘সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া’ আমি স্বীকার করি না। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, পার্থিব মৃত্যুর পর, আমার সমস্ত মৃত আত্মীয়স্বজন ও নিকট বন্ধুর সাথে আমার আবার সাক্ষাত হবে। জীবনের শেষ পর্যায়ে, মরণ যখন ক্রমেই এগিয়ে আসে, সে সময় অনেক অনেক আগের পুরোনো সব স্মৃতি মনে পড়ে যায়। গতকাল কী করেছি বা এমনকি আজকের কিছু আগের করা কাজও যখন মনে করতে পারি না, আত্মীয়স্বজন, পরিচিতদের নাম মনে পড়ে না, তখন ৬০/৭০ বছর আগের বাল্য স্মৃতি পরিস্কার মনে পড়ে। মনস্তত্ববিদরা এটা স্বীকার করেছেন, মার সাথে করা যাবতীয় ভুলত্রুটি, অন্যায়, অবহেলা আজকাল কাঁটা হয়ে হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে। আমি টের পাই, আমার মৃত আত্মীয়-বন্ধুরা সবাই ওপারে আমার অপেক্ষা করছেন। এ লেখাটির মারফত আমি আমার মায়ের কাছে করোজোরে ক্ষমা চাই। আমি মৃত্যুকে মোটেই ভয় পাই না; বরং আমি পুলকিত যে মৃত্যুর মাধ্যমেই আমার সাথে মায়ের আবার দেখা হবে। পৃথিবীর সমস্ত সম্পর্ক স্বার্থের বন্ধনে বাঁধা। একমাত্র ‘মাতা-সন্তানের’ সম্পর্কে স্বার্থ নেই, আছে শুধু নিরংকুশ ভালোবাসা ও অপত্য স্নেহ। আমার মা ২০০০ সালে মারা যাবার পর এ সত্যটি আমি বহু পরে নিজের আত্মার কাছ থেকে জেনেছি। ১৯৭৭ সালে বিশেষ একটি অপ্রতিরোধ্য পরিস্থিতিতে দেশ ত্যাগ করার আগের রাতে আমার সাথে মায়ের শেষ দেখা। সে রাতে মা আমাকে বললেন, ‘বাবা, তোমার সাথে আমার আর কোনোদিনও দেখা হবে না। আয় বেটা, আজ শেষ রাতে তোকে বুকে নিয়ে শুয়ে থাকি।’ সে রাতে আমার মায়ের স্পর্শ আজও আমি ভুলিনি। আমার সময় যতই এগিয়ে আসছে, মা তার বুকে দুই হাতে জড়িয়ে আমাকে যে সান্ত্বনা ও সুখ দিয়েছিলেন, তার অশরীরি উপস্থিতি ক্রমেই আমার দেহ-মনকে আচ্ছন্ন করে। এ অপার ও অতুলনীয় সুখ আর অনুভূতি আর কখনই পাইনি। কারণ এ স্বর্গীয় আনন্দ শুধুমাত্র মার স্পর্শেই পাওয়া যায়।
গত বছর আমেরিকা প্রবাসী আমার ছোট বোন মিনার মৃত্যু হয়েছে। তার দেহত্যাগের পর আমি যে নির্মম ও নিষ্ঠুর সত্যটি উপলব্ধি করেছি, তা হলো এখন আমার প্রজন্মের আমি ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই! বাবা তো সেই ১৯৭২, বড় ভগ্নিপতি ১৯৮৩, ভ্রাতৃজায়া ১৯৮৪, মা ২০০০, বড় বোন ২০০১, ভাই ২০০৮ সালে মারা গেছেন। আমি এদের কারো মৃত্যুর সময় কাছে থাকতে পারিনি। বলাবাহুল্য দাদা-দাদি, নানা-নানি, সমস্ত খালা-খালু, মামা-মামি. ফুফা-ফুপু, সবাই ইতোমধ্যে মারা গেছেন। শুধু আমি ‘কালের সাক্ষী বটবৃক্ষ’ হয়ে বেলাশেষের গান গাইছি। সম্ভবত আমেরিকাতে এখনও ছোটবোনের স্বামী বেঁচে আছেন- আমি জানি না।
মধুর আমার মায়ের হাসি, চাঁদের মুখে ঝরে, মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে...
আমাদের সময়ে আমরা অধিকাংশ বাঙালি শৈশব ও বাল্যকালে শুধুমাত্র মায়ের কোলেই বড় হয়েছি। ন্যূনতম ভয় বা আশঙ্কায় আমরা দৌড়ে তার আঁচলের তলায় গিয়েছি। এ সব ব্যাপারে তাকে সর্বদা সহায়তা করতেন, পরিবারের তার ঘনিষ্ঠ অন্যান্য মহিলা সদস্যগণ। খালা, ফুফু, চাচি বড় বোনেরা। আর যদি দাদী বা নানী কেউ থাকতেন, সে সংসার তো ছিল শিশুর স্বর্গ রাজ্য! বাড়ির পুরুষরা (বাবা দিয়ে শুরু) কচিৎ শিশুদের আদর করতেন, শাসনই করতেন বেশি। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় কঠোর, নির্মম এবং নির্দয় কোনো ব্যক্তির কথা মনে হলে, হিটলারের কথা মনে না হয়ে প্রথম আমার মরহুম বাবার কথাই মনে হয়। আজও তার কণ্ঠর মত কারো ভরাট ও ভয়াবহ গলা শুনলে বা হঠাৎ রাস্তা-ঘাটে কাউকে তার চেহারার মত দেখে আমার বুক কেঁপে ওঠে!
আমরা যারা ইউরোপ আমেরিকায় থাকি, তারা আটলান্টিক বা প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দেবার পরই, ‘মা দিবস’ এবং ‘ভ্যালেন্টাইন দিবস ওরফে বন্ধু দিবস’ জাতীয় দিনগুলির সঙ্গে পরিচিত হই। দেশে থাকতে এ দুটি দিনের কথা কখনও কারো মুখে শুনেছি বলে মনে হয় না। এখন তো জাতিসংঘের কল্যাণে বছরের প্রায় ৩৬৫ দিনই কোনো না কোনো দিন শিগগিরই সব দিন ফিল আপ হয়ে যাবে, তখন হয়তো নতুন দিবসগুলির জন্য নতুন কিছু ভাবতে হবে। আমার প্রস্তাব: প্রতি চার বছরে ২৯শে ফেব্রুয়ারির (লিপ ইয়ার) মত ২ বছর বা চার বছরে একই দিনে দুটি করে দিবস পালা করে পালন করা যেতে পারে। গত ৫ই মে এরকমই একটি দিন গেল। ৫-৫- ‘হাত পরিস্কার দিবস’। এ তারিখটা হাত দিয়ে যদি ইশারায় দেখাতে চান, দুটি হাতই উপরে উঠিয়ে পাঁচ আঙ্গুল প্রসারিত করে দেখাতে পারেন। এটি ভেবেই জাতিসংঘের কোনো প্রতিভাবান হয়ত এ দিবসটি আবিস্কার করেছেন! পাঠক পাঠিকারা আবার ভাববেন না, বছরের এ দিনটিতেই শুধু ভালো করে হাত ধুলে বছরের কাজটি হয়ে যাবে! ধোবেন, প্রতিদিনই তবে প্রতি বছর ৫ই মে ‘বিশ্বের গুটিকতক ধনীদেশগুলির সর্বোচ্চ ক্লাব’ বিশ্ব সংস্থার সার্বিক ব্যর্থতার জন্য (বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে), হাত দুটি উপরে তুলে বিধাতার কাছে জাতিসংঘের দীর্ঘায়ু কামনা করতে পারেন!
অন্যান্য খৃষ্টান অধ্যুষিত দেশগুলির মত জার্মানিতে প্রতিবছর যীশুখৃষ্টের পুনরুত্থান দিবসটি ধরা হয় হয় ইস্টার শুক্রবারের ৪০ দিন পর। বাইবেল ও কোরানের কাহিনীগুলির যেমন অনেক মিল, তেমনি কিছু কিছু খৃষ্টান ধর্মীয় দিনগুলিও ইসলাম ধর্মের মত চান্দ্রমাসের (২৭ দিন) হিসেবে করা হয়ে থাকে। তার মধ্যে ইস্টার, যীশুখৃষ্টের পুনরুত্থান দিবস ইত্যাদি। তবে প্রতিবছর নানাসময়ে ঘুরে ফিরে এলেও, ইস্টার শুক্রবার ইস্টার ফ্রাইডেতেই পালন করা হয়। তার মানে জার্মানিতে ইস্টার শুক্রবার থেকে পরের সোমবার (হুইট মানডে) নাগাদ, শুক্র থেকে সোমবার, এই চারদিন। যা গ্রীষ্মের ছুটির (যার যার আলাদা) পর এখানে সবচাইতে বড় সরকারি ছুটির সময়। পুনরুত্থান দিবসের পর আসে যীশুখৃষ্টের স্বর্গারোহণ দিবস। এটি এবারে ১৩ই মে। তার আগের রবিবারটিই এখানে মাতৃদিবস হিসেবে পালিত হয়। অর্থাৎ আগামী রবিবার (৯-৫) এখানে মায়েরা বছরে অন্তত একটি দিন বাড়িতে সন্তান-সন্ততি ও স্বামীদের নিয়ে একটু সুখে কাটাবেন। নানা ধরনের উপহার পাবেন। কানাডা আমেরিকায় মায়ের দিনের হিবেসটা স্বতন্ত্র হতে পারে। আমার জানা নেই। আমি এখানে থাকি, এখানকার কথাই বলছি।
দেশে এসব দিনের সাথে আমাদের কোনোই পরিচয় ছিল না। স্কুলে থাকতে গরমের ও রোজার ছুটি ছিল আমাদের সর্বোচ্চ শান্তির সময়। ঐ সময়ে সারা বছর স্কুলের কারাবাসের শাস্তিপ্রাপ্ত আমরা প্যারোলে মুক্তি পেয়ে গরমের সময় আমকাঠালের স্বাদ বা নানা-দাদার বাড়ীতে গিয়ে অবাধ স্বাধীনতার স্পর্শ পেতাম। রোজার সময়ে (কমবয়সীরা এবং কিছু প্রাপ্তবয়স্করাও) দিনে ৩-৪ টি রোজা করে সন্ধ্যায় রোজাদারদের সাথে বসে ইফতারির নানা আইটেম পেটভরে খেতাম। আমাদের ধর্মীয় ও স্বাধীনতা দিবসগুলির বাইরে (এর মধ্যে ২৫শে ডিসেম্বর বড়দিন ও হিন্দুদের কয়েকটি পুজার দিন এবং বৌদ্ধ পুর্ণিমাও অন্তর্গত) এক মে দিবসকেই চিনতাম। কিছু জাতীয় নেতার জন্ম ও মুত্যু দিবসও থাকতো। এগুলি কিন্তু অমর বা অপরিবর্তনীয় নয়। দেশবদল ও সরকার বদলের সাথে সাথে পুরোনোগুলির জায়গায় নতুনের আগমন হতো। আজও তাই ঘটে। দিনবদলের পালা আর কি! কিন্ত ‘মা দিবস’ বা ‘বন্ধু দিবস’ আমরা জানতাম না। হয়তো কিছু ইংরেজি মিডিয়ামের সৌভাগ্যবান ছাত্র-ছাত্রীরা জানতো। কিন্ত আমরা তো তখন সেন্ট গ্রেগরির সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতাম, ভেতরেও ঢুকতে পারতাম না। নটরডাম কলেজ, সে তো আকাশের চন্দ্র, সবার কাছে ধরা দেয় না। এখন বিশ্বায়নের যুগ। চ্যানেল টিভি আর অন-লাইন পত্র পত্রিকার কল্যাণে বাংলাদেশেও মহা সমারোহে বন্ধু দিবস পালিত হয়। তবে ভাববেন না, সর্বত্র! ঢাকাসহ কয়েকটি শহরেই এখনও এসব সীমাবন্ধ। কিছু পত্রিকা ঢাকায় বন্ধু দিবস সংখ্যা বের করেন। প্রেম করা বা ডেটিংএর টিপসও দেন এবং ধীরে ধীরে মা দিবসও এগিয়ে আসছে।
তবে আমরা বাঙালিরা তো জন্মগতভাইে কিঞ্চিত ‘ডবল মরালের’ রোগে ভুগে থাকি। একদার ‘মা-অন্ত প্রাণ’ সন্তানটি সময়ের প্রভাবে বা চাপে, বয়ঃপ্রাপ্ত হবার পর মায়ের দিকে নজর দেবার খুব একটা সময় পান না! আমাদের একান্নবর্তী সমাজে (এখনও) শ্বাশুড়ি আর বৌয়ের সঙ্কটে বেচারি পুত্রের লেজটিই ফাঁটা বাঁশে পড়ে থাকে। ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি!’
আমার নিজের (মরহুমা) মায়ের কথা আমি আমার অনেক রচনাতেই উল্লেখ করি। আমার ‘প্রবাসে আপনজন’ বইতে রোজালিন* শীর্ষক কাহিনীতে আমি মায়ের কথা যেভাবে বলেছি, তা পাঠক পাঠিকাদের বলতে চাই: ‘হুজুর যখন দেশ ছেড়ে আসেন একটা কোরান শরীফ ও সুফিয়া বেগমের কুশিকাঁটার কাজ ‘সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে’ কাপড়খানি সাথে এনেছিলেন। সুন্দরভাবে সেলাই করে ফুল পাখি বানিয়ে তার মধ্যে এই কথাটি গাঁথা হয়েছে। এটা প্রথম থেকেই একটা ফ্রেম আর কাচে বন্দি হয়ে হুজুরের বসার ঘরের দেওয়ালে অবস্থান করছে। একদিন রোজালিন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমাকে এ বাক্যটি বুঝিয়ে দেবে? রইসের ব্যাখ্যাটি একপেশে এবং নরনারীর সমঅধিকারের বিরুদ্ধে। আমি জানতে চাইলাম হুজুর এটার কি ব্যাখ্যা দিয়েছেন? রোজালিন- ‘ঘরের স্ত্রীর যোগ্যতার উপরই একটা ফ্যামিলির যাবতীয় সুখ শান্তি নির্ভর করে।’ আামি বললাম এটাই ঐ বাক্যটিতে বলা হয়েছে। রোজালিনের মুখে মনে হল অবিশ্বাস ও দুঃখ দুটোই ফুটে উঠল। ও কিছুতেই মানতে চাইল না, পরিবারের সুখশান্তি শুধুমাত্র রমনীর একার উপর নির্ভর করে। ওর কথা হল, স্বামী স্ত্রীর সমান সমান দায়িত্ব পালনই সংসারের সমস্ত সুখের গ্যারান্টি!
হায় রোজালিন, তোমাকে কি করে বুঝাই, আমরা শুধু কাগজে কলমে বৌদের সংসারের সমস্ত সুখ-শান্তির দায়িত্ব দিয়ে রেখেছি। দৈনন্দিন জীবনে এটা সম্পূর্ণ উল্টো। ইচ্ছামত একটা শাড়ি কিনে পড়ার জন্য কোনো কোনো স্ত্রীর সারাজীবন কেটে যায়। স্বামীর ভয়ে সারাজীবন ইচ্ছাটি প্রকাশ না করেই একদিন মহাপ্রস্থান করে। ইউরোপে বৌরা তাদের যা যা পছন্দ কেনে, পরে স্বামীর মতামত নেয়, ভালো কি মন্দ। আমরা আমাদের ‘মায়ের পায়ের নীচে বেহেশত রেখে দিয়েছি’, যাতে মা তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত শরীরটি আমাদের জন্য সকাল বিকাল রান্না করা, খাওয়া-দাওয়া, কাঁপড় কাঁচা, বাসন মাজা, ঘরকন্নার সব কাজ, স্বামীর সেবা-যত্ন ও সন্তানসন্ততি, সংসারের আর সব আশ্রিতদের দাবি-দাওয়া মিটিয়ে একদিন বেহেশতবাসী হন। পায়ের নীচেইতো ওটার অবস্থান। শুধু ঢোকার অপেক্ষা। আমার মাকে আমি দিনে বা রাতে কোনোদিন ঘুমুতে দেখেছি বলে মনে হয় না। কাকডাকা ভোরে উঠে চুলায় আগুন দিতেন। আমরা ভাইবোনেরা, আশ্রিত-আশ্রিতা সব মিলিয়ে জনাবিশেক লোকের, তা ছাড়া নিয়মিত অপ্রত্যাশিত অতিথির আগমনতো ছিলই, সবার জন্য নাশতা। তারপর দুপুর, রাতের খাবার তৈরি করা। ২/৩টি চুলায় সবসময় কিছু না কিছু পাক হতোই। বাড়ির শ-দেড়শ কিলো কাপড় কেঁচে সর্বদা ব্যবহারোপযোগী রাখা। কাজের মেয়ে বা চাকর ছিল, কিন্ত তাদের তত্ত্বাবধানও ত ছিল এক মহা ব্যাপার। সন্ধ্যায় খেয়েদেয়ে, স্কুলের পড়া শেষে আমরা শুয়ে পড়ার সময়ও দেখতাম আম্মা রান্নাঘরে কিছু না কিছু করছেন বা কাজের বুয়া আর চাকরের সাথে পরদিনের খাবার কী কী হবে, বাজার থেকে কি আনতে হবে তার কনফারেন্স করছেন। কখন শুতে যেতেন জানি না। একমাত্র কঠিন অসুখে পড়লেই দেখতাম বেচারি অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিছানায় পড়ে আছেন। ঐখান থেকেই বুয়াকে, চাকরকে, আমার বোনকে সংসারের নিত্তনৈমিত্তিক কাজের ননস্টপ নির্দেশ দিতেন। অসুখ হলেও নিস্তার নেই। ঐ সময় চারিদিকে বিশৃংখলা, খাওয়ার দেরি, ধোয়া কাপড়ের অভাব এসব থেকেই বোঝা যেত ঘরের প্রধান যন্ত্রটি যা দিনে রাতে ১৫/১৬ ঘণ্টা একনাগাড়ে চলে, তা এখন অচল। আমার উচ্চশিক্ষিত নামকরা শিক্ষক পিতাকে কখনও দেখিনি খাওয়ার পর থালাটি ধুতে। এখানে দেখি স্বামীরা সপ্তাহে অন্তত ২/৩ দিন রান্না করেন, নিয়মিত রান্নাঘরে বৌকে বাসনকোসন ধুয়ে, ঘর পরিস্কার রাখতে সাহায্য করেন। এমনকি অতিথিরাও বিনা বাক্যব্যয়ে তাদের উচ্ছিষ্ট ফেলে দিয়ে প্লেটটি নিজে ধুতে কোন দ্বিধা করেন না যদি মেজবানদের পক্ষ থেকে কোনো জোর আপত্তি না আসে। এখন তো মায়ের স্থানে নবজাত সন্তানকে লালন পালনে পিতার অংশগ্রহণও আইনের আওতায় আনা হয়েছে। পালা করে মা ও বাবা এখন একজন সন্তান প্রতিপালন করেন, অন্যজন চাকরি করেন। সন্তান-পালনকালিন চাকরির গ্যারান্টি ও পুরো বেতন তারা পেয়ে থাকেন।
আমার মা ১৯৯৯ তে মারা যান এবং আমি ১৯৭৭ সালে দেশ ত্যাগ করে ত্রিশ বছর পরে দেশে যাই। অর্থাৎ মৃত্যুঅবধি তার সাথে আর আমার দেখা হয়নি। দেশত্যাগের পর কয়েকটি চিঠি ২/৩ বার টেলিফোন, ঐ পর্যন্তই। দেহত্যাগের আগের ৭/৮টি বছর দুরারোগ্য ব্যধিতে ভুগেছেন। ১৯৯৭ তে তার বাঁ চোখটি অন্ধ হয়ে যায়। ডানটি দিয়েও খুব কম দেখতে পেতেন। দেশে যারা যেতো, তাদের অনেকেই আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার (স্বর্গত আবদুল্লাহ আল মামুন) সাথে দেখা করতে তার বাসায় গেলে, আমার মা তাদের বলে দিতেন, একবার যেন আমি দেশে গিয়ে তার সাথে দেখা করি। যদিও ১৯৭৭ সালে আমার দেশত্যাগের সময় তিনি বলেছিলেন, ‘এ দুনিয়ায় আমাদের আর দেখা হবে না!’ তারা এসে বলতেন, আমি শুনতাম, কিন্ত তা নিয়ে কোনোই চিন্তা করতাম না। তবে মায়ের কথাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তিনি ২০০০ সালে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। দেশ ত্যাগের পর তার সাথে আমার আর দেখা হয়নি।
কিন্ত এখন চিন্তা করি। বিজন প্রবাসে বর্ণনাতীত একাকিত্বে শৈশবের সেই সব দিনগুলির কথা মনে হয় যখন মাই ছিলেন সর্ব দু:খ কষ্টের নিশ্চিত আশ্রয়। দেশের একদার স্ত্রী বা এখানকার বিদেশী জীবনসঙ্গীনিরা যা দিতে পারেননি, তা শুধু আমার মাই আমাকে দিয়েছেন এবং তাও কোনোরকম ফেরত প্রাপ্তির আশা না করেই। মাতৃভূমির মতই জন্মদাত্রী মায়েরও কোনো বিকল্প এ পৃথিবীতে কারো জন্যই নেই। হিন্দু ধর্মমতে গয়ায় পিণ্ড দিলে সন্তানের ‘পিতৃ-ঋণ’ শোধ হয়! কিন্ত মায়ের ঋণ শোধের কথা হিন্দু ধর্মে বলা হয়নি। এবং পৃথিবীর কোনো ধর্মেই বা শাস্ত্রে মাতৃ-ঋণ শোধ করার কোনো বিধি নেই। কারণ এই ঋণ শোধ করা কোনো সন্তানের পক্ষে একান্তই অসম্ভব। এসব চিন্তায় নিজের উপর খুবই ক্রোধ হয়, কষ্ট আরো বেড়ে যায়। কিন্ত এ জীবনে তো আর করার কিছু নেই, শুধু স্মৃতির কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে অশ্রু বিসর্জন করা ছাড়া! ইহলোক ত্যাগ করার পর আত্মার অন্য আরেকটি লোকে অবস্থানে আমি বিশ্বাস করি। আমি চাই সেই লোকে আমার মাই যেন আমাকে আবার গর্ভে ধারণ করেন এবং আমি যেন এ জন্মের কৃত সমস্ত অন্যায়ের জন্য তার কাছে ক্ষমা চাইতে পারি, মৃত্যুর পরে নতুন আরেকটি (বা একাধিক) জীবন আছে তা আমি শুধু বিশ্বাসই করি না, একান্তভাবে জানিও। এ জানাই আমার এখনকার এই পৃথিবীতে বাকি জীবনটি কাটানোর প্রধান ও একমাত্র শক্তি।
ও হ্যাঁ, ইউরোপে বছরে একবার ‘পিতৃ-দিবস’ও পালন করা হয়। বাবারা বাড়ির বাইরে বনে জঙ্গলে (এখানে ন্যাচারাল পার্ক বলে) গিয়ে, বন্ধুবান্ধবসহ আকণ্ঠ মদ্যপান করেন (বৌদের ঝামেলা নেই)। তবে সে কাহিনী, সময় সুযোগমত অন্য কোনোদিন বলব।
নয়ে-ইজেনবুর্গ, জার্মানি, ৭ই মে, ২০২৪