লিয়াকত হোসেন, সুইডেন থেকে:
ওয়ার মিউজিয়াম
ভিয়েতনাম-আমেরিকান যুদ্ধকে জানতে হলে ওয়ার মিউজিয়াম বা যুদ্ধ যাদুঘর দর্শন জরুরি। যে সব যুদ্ধসামগ্রী দিয়ে আমেরিকা অসমযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে ভিয়েতনামকে পিষে মারতে চেয়েছিল সেগুলো স্তরে স্তরে সাজানো আছে। আছে মাইলাইয়ে গণহত্যার ছবি। মিউজিয়ামে কর্তব্যরতরা আমাদের এজেন্ট অরেঞ্জ নামে একটি কক্ষে যেতে বিশেষভাবে সতর্ক করে দিলেন। উচ্চ রক্তচাপ ও হার্টের রোগীদের ঐ কক্ষে না যাওয়াই ভালো। ঐ কক্ষে ক্ষতিকারক বিষাক্ত এজেন্ট অরেঞ্জ দ্বারা আক্রান্ত এমন কিছু বিকলাঙ্গ নারী-পুরুষ ও শিশুর ছবি আছে যা দেখে অনেকেই মূর্ছা যেতে পারে।
এজেন্ট অরেঞ্জ একপ্রকার বিষাক্ত লালচে বাদামী তরল পদার্থ, যা হেলিকপ্টারের মাধ্যমে স্প্রে করে ছিটিয়ে দেয়া হতো গাছ ও বনজঙ্গলের ওপর। এতে করে গাছের পাতা ঝড়ে যেত, গাছ বৃদ্ধি বাঁধাপ্রাপ্ত হতো। এভাবে মার্কিন সামরিক বাহিনী ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ অবধি ভিয়েতনামের বন জঙ্গল ধ্বংস করে দিয়েছিল, যাতে ভিয়েতকং গেরিলারা বন-জঙ্গলে আশ্রয় নিতে না পারে। এজেন্ট অরেঞ্জ নদী নালা খাল বিলের জলে মিশে যেত ও সেই জল পান করার পর পশু পাখি মানবদেহে বিকৃত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়ে ক্যান্সার ছাড়াও বিকলাঙ্গ ও বিভৎস শিশুর জন্ম হতো। এজেন্ট অরেঞ্জ প্রকৃতি ও মানবজাতিকে ধ্বংস করার বিশ্বয়কর এক অমানবিক আবিস্কার। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ এই দশবছরে ভিয়েতনামে প্রায় ৮০ মিলিয়ন লিটার এজেন্ট অরেঞ্জ ছিটিয়ে বৃক্ষ, পশুপাখি ও এখানকার মানুষকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছিল। এজেন্ট অরেঞ্জ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ৩ মিলিয়ন মানুষ ও ১ মিলিয়ন শিশু। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পরবর্তীতে এজেন্ট অরেঞ্জ বিষয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেও ভিয়েতনামের যা ক্ষতি তাতো হয়েই গিয়েছে।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট বা রিউনিফিকেশান প্যালেস
ওয়ার মিউজিয়ামের পর এলাম ইন্ডিপেন্ডেন্ট বা রিউনিফিকেশান প্যালেসে। যুদ্ধের পর বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের সংযুক্তি হয়েছিল এই প্যালেসেই, যার জন্য একে বলা হয় রিইউনিফিকেশান প্যালেস। যুদ্ধের সময় এটি ছিল সিআইয়ের আস্তানা ও তথাকথিত আমেরিকা সমর্থিত পাপেট প্রেসিডেন্টের প্যালেস। প্যালেসটির বহিরাঙ্গন সুউচ্চ পামবৃক্ষ দ্বারা শোভিত। ভবনের প্রথম তালায় ছিল অভ্যর্থনা ও আলোচনা কক্ষ, বিদেশী গণ্যমান্য ও রাষ্ট্রদূতেরা এখানেই অভ্যর্থনা পেতেন। পাশেই পাপেট প্রেসিডেন্টের কোয়ার্টার। কিন্তু পাপেট প্রেসিডেন্ট ঘুমাতেন বেইজমেন্টে সিআইয়ের অফিস কক্ষের পাশে সাধারণ এক লোহার খাটে। সিআইয়ের কক্ষ থেকে নিয়মিত যোগাযোগ করা হতো হোয়াইট হাউস ও পেন্টাগনের সাথে। বেইজমেন্টে ছিল ওয়ার রুম, টেলিকমিউনিকেশান সেন্টার ও পালিয়ে যাওয়ার টানেল। ভবনের দ্বিতীয় তালায় দাবা খেলার ঘর, তরল পানীয় সজ্জিত বার, সিনেমা হল, নাইট ক্লাব ইত্যাদি।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর ভিয়েতনামে অবস্থিত জাপানী সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করার জন্য ২ লক্ষ সৈন্য নিয়ে চিয়াং কাই সেক ভিয়েতনামে প্রবেশ করেন। চিয়াং কাই সেকের অভিপ্রায় ছিল হোচিমিন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে পুনরায় ভিয়েতনামকে চীনের অধীনে নিয়ে আসা। হোচিমিন দেখলেন ঘরে রাইরে শত্রু। তিনি ক্ষুব্ধ হলেন, ক্ষুব্ধ হলেও তিনি তার অনুসারীদের চিয়াং কাই সেকের সৈন্যদের সঙ্গে বিবাদ ও বিরোধে না জড়াতে আদেশ দেন। যদিও তিনি জানতেন চিয়াং কাই সেকের সৈন্যরা গোলযোগ সৃষ্টি করতেই এসেছে। এসেছে জনগণের খাদ্যের ওপর ভাগ বসাতে। তিনি কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চাইলেন। জাপান ও ফরাসিদের আধিপত্য ঠেকাতে তিনি জনগণকে আত্মরক্ষামূলক শিক্ষা ও গেরিলা হিসেবে গড়ে তোলার ওপর জোর দেন। এইসময় চিয়াং কাই সেক হোচিমিনকে ১৮ মাস জেলে বন্দি করে রাখেন। তখন জাপান-ফরাসি আধিপত্য ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে গিয়েছিল। নদীর বাঁধ ভেঙ্গে ৩,৫০,০০০ হেক্টর জমির ধান বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল। জাপানিদের অধিকৃত কলকারখানায় কোনো উৎপাদন ছিল না। মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে অচিন্তনীয়। হোচিমিন বললেন, ‘আমাদের অবশ্যই অভাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। অভাব আধিপত্যোর চেয়েও ভয়ানক। অভাব ও আধিপত্য দুটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমাদের জয়ী হতে হবে।’ হোচিমিন যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে ভিয়েতকং গেরিলাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। তিনি জনগণকে জানতেন, তিনি যুদ্ধকে জানতেন। তিনি উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামকে একত্র করে এক অখন্ড ভিয়েতনাম চেয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৫শে এপ্রিল ভিয়েতকং গেরিলারা সায়গনে প্রবেশ করে এবং এর পাঁচদিন পর ৩০শে এপ্রিল সায়গন আত্মসমর্পণ করে। হোচিমিনের স্বপ্ন পূরণ হয়।
অবশেষে এই প্যালেস থেকেই ভিয়েতনামের পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষিত হয়।
যুদ্ধের মূল্য
দীর্ঘ ৩০ বছরের আমেরিকান-ভিয়েতনাম অসমযুদ্ধে উভয় পক্ষকে দিতে হয়েছিল অভাবনীয় মূল্য। প্রতিটি যুদ্ধেই জনগণকে তা পরিশোধ করতে হয়। চরম মূল্যে স্বাধীনতা পেয়েছিল ভিয়েতনাম। যুদ্ধে মারা গিয়েছিল ৫ মিলিয়ন ভিয়েতনামী। উত্তরে মৃত্যুর সংখ্যা ২ মিলিয়ন আর দক্ষিণের ২ মিলিয়ন, ১ মিলিয়ন সৈন্য। এখনো ৩ লক্ষ জনের কোনো খোঁজ নেই। আহত ১.৪ মিলিয়ন। এজেন্ট অরেঞ্জ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ৩ মিলিয়ন মানুষ ও ১ মিলিয়ন শিশু। সমগ্র দেশের ২৪ শতাংশ জমি বোমার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত। সমগ্র দেশে বোমা ফেলা হয়েছে ৮ মিলিয়ন টন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বিগুন। ৩,৫০,০০০ লক্ষ টন বোমা ও মাইন এখনো মাটির নীচে ঘুমন্ত অবস্থায়। পলায়নপর ১০ মিলিয়ন অভিবাসীর মধ্যে ২,৫০,০০০ মানুষ সাগরে ডুবে মারা গেছে।
অপরদিকে এই যুদ্ধে মারা গিয়েছে ৫৮,০০০ আমেরিকান। স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়েছে ২১,০০০। যুদ্ধশেষে আত্মহত্যা করেছে ৭০,০০০ হাজার আমেরিকান। আত্মপীড়নের শিকার হয়েছে ৮ লক্ষ ৩০ হাজার সেনা। যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়েছিল ৫০ হাজার সার্ভিস ম্যান। কতজন যে নিখোঁজ ও কতজন যে মানসিক ভারসাম্যহীন তা এখনো অপ্রকাশিত। যুদ্ধের খরচ মেটাতে আমেরিকাকে ব্যয় করতে হয়েছিল ১১১ বিলিয়ন ডলার। বাজেটে দেখা দিয়েছিল ঘাটতি।
এই অসমযুদ্ধে আমেরিকার সাহায্যকল্পে দক্ষিণ কোরিয়া পাঠিয়েছিল ৩ লক্ষ ২০ হাজার সেনা। তারা ৪১ হাজার ভিয়েতকং যোদ্ধাকে হত্যা করেছিল। অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়েছিল ৬০ হাজার সেনা, ফিলিপাইন প্রেরণ করেছে ১০,৪৫০ সেনা। তবে পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ডের ভূমিকা ছিল ন্যাক্কারজনক। তারা পাঠিয়েছিল ‘কুইন কোবরা ব্যাটেলিয়ন।‘ থাই সেনারা বেশির ভাগ ছদ্মবেশী যোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছে। এছাড়া বিপুলসংখ্যক থাই স্বেচ্ছোসেবী পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সিআইএ’র পৃষ্ঠপোষকতায় ভিয়েতনামের বিপক্ষে রণযজ্ঞে শামিল হয়েছে।
আমেরিকা এমন এক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল যাদের সম্পর্কে তাদের কোনো ধারনা ছিল না। ধারনা ছিল না হোচিমিন সম্পর্কেও। হোচিমিন বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাদের ১০জনকে হত্যা করলে আমরা তোমাদের একজনকে হত্যা করব। এই অসঙ্গতির পরও তোমরা পরাজিত হবে, জয়ী হবো আমরা।‘ হয়েছিলও তাই।
বেনথান বাজার
ইন্ডিপেন্ডেন্ট বা রিউনিফিকেশান প্যালেস দেখার পর আমরা এলাম বেনথান বাজারে।
হোচিমিন সিটির ভেতরই বাজার। এই বাজারে পাওয়া যায় না এমন কোনো জিনিষ নেই। তের হাজার স্কয়্যার মিটারজুড়ে প্রায় দেড় হাজার স্টল। বেনথান দেখে ইস্তামবুলের গ্র্যান্ড বাজারের কথা মনে হলো। তিন লাখ বর্গফুটের গ্র্যান্ড বাজারে ছিল ৩ হাজার দোকান। বেনথান গ্র্যান্ড বাজারের চেয়ে ছোট হলেও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। বাজারের প্রবেশ মুখে এক ভারতীয় পরিবার একটু অস্বস্তিতে পরলে এগিয়ে গেলাম। পরিবারে স্বামী-স্ত্রী ও ছোট এক মেয়ে। গতকালই তারা বেড়াতে এসেছেন। পরিবারের কর্তা বাজারের মুখেই মুচির কাছে জুতা পালিশ করিয়ে নিয়েছেন। মুচি চেয়েছিল দুই ডলার কর্তা কিছু বলেননি। কিন্তু দাম পরিশোধ করতে যেয়ে স্ত্রীর মুখ শুকিয়ে গেল। কর্তা নতুন পালিশ করা জুতায় এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পালিশটা চকচক করছে কি না বারবার তাকিয়ে দেখছেন। গাইড শুনে বললেন, যেহেতু দাম ঠিক করে নেয়া হয়নি, মুচিকে দুই ডলারই দিতে হবে। স্ত্রী পার্স খুলতে ইতস্তত করছেন দেখে রেহানা তার থেকে দুই ডলার মুচির দিকে এগিয়ে দেয়। মুচি চলে যাবার পর স্ত্রী পরলেন আরো বিপাকে। এবার তাকে পার্স খুলতেই হলো। বেনথান থেকে আমরা ডলারেই বেশ কিছু কেনাকাটা করে নিলাম। গাইড জানালেন বেনথান নিম্ন ও মধ্যবিত্তকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
বাজারের পাশেই পোস্ট অফিস। ভেতরটা খুবই সুন্দর, সাজানো গুছানো বেশ কয়েকটি দোকান তবে বেনথানের মত সস্তা নয়। আমি একটি লাইব্রেরি খুঁজছিলাম ভিয়েতনামের ওপর কয়েকটি বই কেনার জন্য। কিন্তু পোস্ট অফিসের পাশেই যে ছিল তা আর খুঁজে পাইনি। বিকেল হয়ে গেছে, সারাদিনের ঘুরাঘুরিতে আমরাও ক্লান্ত। গাইড আমাদের হোটেলে নামিয়ে দিয়ে টিপস নিয়ে চলে গেলেন। তার সঙ্গে আর দেখা হবে না। আগামীকাল ভোরে মেকং ডেল্টা যাবার প্রোগ্রাম। নতুন গাইড ও গাড়ি আসবে।
স্টকহোম, সুইডেন
১০-৯-২০২৪