(পূর্ব প্রকাশের পর)
আবদুল্লাহ আল-হারুন, জার্মানি থেকে: কত বয়স তখন? ৮ বা ৯? বা কম। একটা স্বপ্ন সে সময় থেকেই আমাকে তাড়া করত। জামালপুরের পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের তীর দিয়ে মিনার সাথে হাঁটছি। মাঝে মাঝে ফালি রাস্তার পাশে এ লতা সে পাতা টানাটানি করছে মিনা। হঠাৎ আমাকে একটা খোঁচা দিয়ে দৌড় দিল। এটা ওর খুব প্রিয় খেলা ছিল। আশেপাশে কেউ ছিল না। বা থাকলেও লক্ষ্য করতাম না। আকষ্মিকভাবে সামনে একটা জোড়াপাহাড় দেখতাম! জামালপুর থেকে আকাশ পরিস্কার থাকলে মহেন্দ্রগঞ্জ-আসাম সীমান্তে গারো পাহাড়ের একটা নীল ঝাপসা ছবি দেখা যেত। এটা ছাড়া তো পাহাড় বা টিলার কোন অস্তিত্বই আমাদের এ শহরের দূর সীমানার মধ্যে ছিল না। শহরের বাইরে একটা উঁচু দেয়াল ছিল। আনসারদের বন্দুক চালানো প্র্যাকটিসের জন্য চানমারি। কিন্ত সেটা তো আদৌ কোন জোড়াপাহাড় নয়! একবার ঢাকায় বাসে টাঙ্গাইল হয়ে যাবার পথে মধুপুরের গড়ে মনে হয় টিলার মত কিছু একটা দেখেছিলাম। কিন্ত সেটাও তো কোন জোড়াপাহাড় নয়। তবে স্বপ্নে এরা কোথা থেকে আসে? স্পষ্ট দুটি পাহাড় পাশাপাশি। খুব একটা খাড়া নয়। প্রতিবার স্বপ্নে দেখার পরেই ওখানে গিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠার একটা তীব্র ইচ্ছা হতো। কিন্ত মিনার ভীষণ আপত্তি। সে ভয় পেয়ে যেত। নারে ভাই, পাহাড়ে বাঘ ভাল্লুক থাকে। ভূতপ্রেতও নাকি থাকে। ঐ বয়সেই আমি পাবলিক লাইব্রেরি থেকে নিয়মিত ছোটদের নানা রকমের বইপুস্তক পড়ার জন্য বাসায় এনে খালা, বোনদের গল্প শোনাতাম। কলেজের লাইব্রেরি থেকেও পড়ার জন্য নিয়মিত বই বাসায় নিয়ে আসতাম। বিভূতি ভূষণের একটা শিশুতোষ বইয়ে (নাম মনে নেই) এ ধরনের একটি পাহাড়, ভূত আর নানা রকমের হিংস্র জন্ত জানোয়ারের কথা ছিল। মিনার মনে হয়ত ঐ বইটার কাহিনীই দোলা দিত। অনেক রাতে এই জোড়া পাহাড়ের স্বপ্ন দেখে আমি দৌড়ে কাছে যাবার চেষ্টা করতাম। স্বপ্নে দৌড়ালে কখনই গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না। এ অভিজ্ঞতা সবারই কমবেশি আছে। আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত। সারা গা ঘামে ভিজে গেছে। ঘুম ভাঙ্গার পরই মনে হতো জোড়া পাহাড় আমার বাসার পাশেই আছে। এখনি দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকবে। পাহাড়দুটি আমার কাছে জীবন্ত মনে হতো। কোনোদিনই এ স্বপ্নটি আমি একা দেখিনি। সাথে মিনা থাকত। পরে ব্যাপারটি যখন এখানকার সাইকোলজিস্টদের সাথে আলাপ করেছি, তারা ব্যাখ্যা দিতেন, যেহেতু সে সময়ে আমার খেলার সঙ্গী একমাত্র ছোটবোনই ছিল, তাই আমার স্বপ্নেও সে আমার সাথেই থাকত। বিশেষ করে যে সব স্বপ্নে আমরা দিনের বেলার একসাথে খেলাধুলা, বেড়ানো বা দৌড়াদৌড়ির ছবি দেখতাম। স্বপ্নবিদদের মতে সারা দিনে আমরা যা করে থাকি, রাতে স্বপ্নে তাই কমবেশি ভিন্ন রূপে পুনরায় আমাদের চিন্তায় আসে। মস্তিস্কের ভাবনাগুলোই স্বপ্নে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। কিন্তু জোড়া পাহাড়ের ব্যাপারটির অর্থ কি? টাইম ট্র্যাভেলে যারা বিশেষজ্ঞ তারা বলেন, স্বপ্নে ভবিষ্যতও আসতে পারে। ভ্রমণ যেমন শারীরিক তেমন মানসিকও হতে পারে। এর প্রমাণ পেলাম আমি ষোলো বছর পরে দেশত্যাগ করে জার্মানিতে আসার পর।
১৯৬১ সালে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে আমি জামালপুর ছেড়ে কলেজে পড়ার জন্য প্রথমে ময়মনসিংহ, তারপর সুনামগঞ্জ যাই। কিছুদিন ঢাকায় তারপর ১৯৬৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পড়তে গেলাম। ১৯৭০-৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলন, সশস্ত্র সংগ্রাম, কলেজের চাকরি এরপর কিছুদিন সরকারি চাকরি করে ১৯৭৭ সালে দেশত্যাগ করে ইউরোপে পাড়ি জমালাম। জামালপুর ছেড়ে আসার পর জোড়া পাহাড়ের স্বপ্ন আর দেখিনি। জীবন নানারকম ঘটনার ঘনঘটায় জড়িয়ে গেল। দেশ স্বাধীন হল ’৭১-এ বাবা মারা গেলেন। দুঃস্বপ্নের মত একটা বিয়ে, সংসার, দু’টি সন্তানের জন্ম এবং পরিস্থিতির শিকার হয়ে ’৭৭-এ দেশত্যাগ।
জার্মানিতে প্রথম আমি দক্ষিণের স্টুটগার্ট অঞ্চলে ২০০৬ পর্যন্ত থাকি। এর মধ্যে জার্মান সঙ্গিনীর সাথে আঠারো বছর বসবাস, বিচ্ছেদ। সুইজারল্যান্ডে চার বছর। আবার জার্মানিতে ফিরে দু’বছরের মাথায় ফ্রাংকফুর্টের পাশের শহর বর্তমানে যেখানে আছি নয়ে-ইজেনবুর্গ চলে এলাম। জোড়া পাহাড়ের স্বপ্ন কবেই ভুলে গিয়েছিলাম। আর মনে হতো না। কিন্ত এ শহরের পাশের গ্রাম তিন কিলোমিটার দূরে, বিটবুর্গে যেদিন প্রথম গেলাম, জোড়া পাহাড় আবার বাস্তবে দেখলাম। স্বপ্নে নয়। এখানে এর নাম ছুইলিংসবার্গ (জমজ পাহাড়)। ঠিক জামালপুরে যেমনটি ৬০-৬৫ বছর আগে স্বপ্নে বহুবার দেখেছি, ঠিক সেরকম।
কালের যাত্রার ধ্বণী
অবলোকন আর অনুধাবনের মধ্যে যে পার্থক্য তা দেহ ও মনের মতই। দৃষ্টিপাত ও মনোনিবেশ এ দুইয়ে মিলে জ্ঞানের ক্রমবিকাশ। এ দুটির মধ্যে অনুভূতি বন্ধনের কাজ করে থাকে। বলা হয়ে থাকে মানুষ তার কর্মের জন্য নিজেই দায়। পৃথিবীর তিনটি প্রধান একেশ্বরবাদি ধর্ম (অনুসারিরা বিশ্বসংখ্যার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ) ইহুদির বিধাতা যেহোবা, খৃষ্টানদের গড ও তার পুত্র যীশু, ইসলামের আল্লাহ- বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা, সর্বপ্রধান এবং সর্বশ্রেষ্ঠ। এদের প্রত্যেকেই ভাগ্যবিধাতা। আমরা জন্মাবধি শুনে আসছি, ‘আল্লাহর হুকুম ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না’, ‘আমরা যাই যখন করি তিনি তা প্রত্যক্ষ করেন’, তাকে লুকিয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়।’ বিশ্বাসী মুসলমানরা এসব বিশ্বাস করেন। বাল্যকাল থেকে পিতা-মাতা, মুরুব্বী, শিক্ষক, সমাজপতি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে আমরা এসব শুনে আসছি এবং কোন তর্ক বিতর্ক ছাড়াই আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছি। মানুষ যাই করে তার পেছনে রয়েছে একটি অদৃশ্য মহাশক্তির নির্দেশনা, তত্ত্বাবধান এবং নিয়ন্ত্রণ। তবে কথা উঠে, সবই যদি পুর্ব নির্ধারিত (Pre-destined), তাহলে জীবন সংগ্রাম, সাধনা, প্রতিযোগীতা, শিক্ষা, রুচি, কামনা-বাসনা, রাজনীতি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, হিংসা, যুদ্ধ, স্বাধীনতার আন্দোলন, গুম, অ্যানকাউন্টার, প্রেম, বিবাহ, ভালোবাসা এসবের অর্থ কি? প্রয়োজনটাই বা কি? সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাই যেখানে সার্বভৌম, সেখানে মনুষ্য-রচিত সংবিধানের কি প্রয়োজন? আমি নিরীশ্বরবাদ (নাস্তিকতা) এবং ইশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস (আস্তিক্য)-এর মধ্যে কোন বিতর্কে যেতে চাই না। এ কাহিনীটি বর্ণনার পেছনে কোন ধর্মকে সমালোচনা করার ইচ্ছা আমার নেই। আমি যা বলতে চাই সেটা হলো মানুষ ভাগ্য বা নিয়তির হাতে কতটা অধীন? বিশ্বের সবচাইতে পুরাতন ধর্ম সনাতন হিন্দু ধর্মে তিনজন প্রধান দেবতা, ত্রিদেব- ব্রহ্মা বিষ্ণু, শিব (মহাদেব)- ব্রহ্মান্ডের যাতীয় কর্মকান্ডের জন্য দায়ী। প্রথমজন সৃষ্টিকর্তা (ভাগ্যবিধাতাও, কারণ জন্মের পরই তিনি স্বহস্তে সবার ভাগ্য একাই রচনা করে থাকেন), দ্বিতীয়জন পালনকর্তা (পালনহার) এবং তৃতীয়জন একাধারে শীর্ষদেব, উদার, ভোলাবাবা এবং ধ্বংসকর্তাও বটে। বিশ্বের আয়ু শেষ হলে তিনিই সব ধ্বংস করে নতুন ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির পথ খুলে দেন। তার তৃতীয় নয়ন খুলে গেলে ধ্বংসের অবতারণা হয়ে থাকে। এই ধর্মে ’অভিশাপ’ এবং যে কোন মুল্যে ‘বচন (প্রতিজ্ঞা)’ রক্ষা করা দু’টি প্রধান অনুসঙ্গ। দেবতা, মুণি-ঋষি থেকে শুরু করে, ঘরের গৃহস্ত বধূরাও যে কাউকে শাপ দিতে পারেন। দেবতারাও এ শাপ থেকে রেহাই পান না। ব্রহ্মা নির্বিবাদে তপ-সাধনা করে সন্তুষ্ট হলে দৈত্য-রাক্ষসদের যে কোনো বর এমনকি মানব ধ্বংসের বরও দিয়ে থাকেন। এবং এসব কারণেই রামায়ন মহাভারতের এত যুদ্ধবিগ্রহ, সৃষ্টির বিনাশ ইত্যাদি সংঘটিত হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, বিভিন্ন সিরিয়ালে দেখা যায়, এ সব ঘটনার প্রধান দর্শক হলেন সস্ত্রীক ত্রিদেব, দেবতারা এবং অগণিত অসহায় মানুষ! বালক অভিমুন্যকে কৌরবদের সব বীর (এমন কি ভিষ্মও) একসাথে নির্মমভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করলেন, দেবতারা আকাশে দাঁড়িয়ে তা দেখলেন! সীতা হরণের বেলাতেও তাই। বেচারা বৃদ্ধ জটায়ুু তাকে বাঁচাতে গেলে রাবন তার পক্ষ কেটে দিলেন। মজার ব্যাপার হলো, এই সব অবিচার-অনাচার-অন্যায় স্বচক্ষে দেখে শিব গম্ভীর কন্ঠে প্রায়ই মন্তব্য করেন, ‘আমাদের কিছুই করার নেই, এ সবই নিয়তি!’ নিয়তি হলে ব্রহ্মা মানুষের কোন ভাগ্যটি লিখেন? যে শিব তৃতীয় চক্ষু খুলে হতভাগ্য কামদেবকে ভষ্ম করে দিলেন, ইন্দ্র যখন ঋষি গৌতম পত্নি অহল্যাকে তার স্বামীর ছদ্মবেশ ধরে ধর্ষণ করলেন, তিনি কি তখন ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন? আজ মানুষ দেড় লাখ কিলোমিটার দূরে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ পাঠাচ্ছে, চাঁদে কতবার কতজন গেলেন। আর লংকায় যে ভ্রাতা রাম রাবনের হাতে বন্দি সীতাকে উদ্ধারের জন্য কোটি কোটি বানর সৈন্য (অক্ষৌহিনি) নিয়ে রক্তাক্ত যুদ্ধ করছেন, অযোধ্যায় ভরত (লংকা-অযোধ্যার কতই দূরত্ব হবে?) তা জানতই না। আকাশপথে হিমালয় থেকে পর্বত ঘাড়ে নিয়ে হনুমান যখন লক্ষণের জন্য জড়িবুটি আনছিল সে সময় ভরতের তীর খেয়ে ভূপাতিত হয়ে সে রাম-রাবনের যুদ্ধটির খবর ভরতকে দিয়েছিল! আমি মনে করি, আজ ভারত যে নারী ধর্ষণের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন তার একটি প্রধান কারণ হলো দেবরাজ ইন্দ্রের পাশবিক কামলীলা! তার শাস্তি হয় না কেনো? স্বর্গ থেকে তার বহিস্কার হয় না কেনো? তবুও একবার এক ঋষি তাকে শাপ দিয়ে পুরো দেহে তার যন্ত্রটির(!) স্থাপনা করেছিল! অনেকেই বলবেন, এসবই কিংবদন্তি। কিন্তু রামায়ণ মহাভারত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দু’টি মহাকাব্য এবং ধার্মিক হিন্দুরা এদের সসম্মানে ধর্মীয় পবিত্র গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করে। তাদের একটি লাইনও বিশ্বাসী হিন্দুরা অবিশ্বাস করে না। সারা পৃথিবীতে নানা ভাষার অনুবাদে এরা বহুল পঠিত। ’৮০ দশকে মহাকাব্য দু’টির টিভি-সিরিয়াল ভারতবর্ষে তথা পৃথিবীর সর্বত্র যেখানে পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশের লোক বাস করে, সে সব দেশে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মহা আদৃত হয়েছিল। তখন আমরাও ইউরোপে থেকে সাগ্রহে প্রতিটি পর্ব উপভোগ করেছি! কাজেই এদের প্রভাব তো অমøান! মহাভারতের যুদ্ধের সময়, অর্জুনের সারথী (পরামর্শদাতা) হিসেবে শ্রী কৃষ্ণ যুদ্ধে অনুৎসাহি অর্জুনকে স্বজন হত্যার (যুদ্ধের পরিণতি) জন্য প্ররোচিত করে যে সব যুক্তি দেন, আধুনিক যুদ্ধের দর্শনেও তা গ্রাহ্য। গীতার সমস্ত পর্বে তার এই সব সারগর্ভ বাণী লিপিবদ্ধ। সেখানে একটি কথা যা খুবই জনপ্রিয় এবং ধর্মবিশ্বাসীদের জন্য একটি অমোঘ অস্ত্র, তা হল, ‘তুমি কাজ করে যাও, ফলের জন্য ভেবো না, সেটা আমার দায়িত্ব (মা ফলেষু কদাচন)’। তাহলে তো আমার এত বক্তৃতা বৃথাই গেল! আমার একমাত্র কর্তব্যটি হল, চক্ষু বুঁজে, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে, বিনাবাক্যব্যয়ে, বিনা প্রতিবাদ ও অনুযোগ ছাড়াই- যে কাজ আমাকে করতে বলা হয়- তা যেই বলুক না কেন- ইশ্বর, বিগ ব্রাদার, স্বামী, রাজা, মন্ত্রী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, সীমান্ত রক্ষী, কাস্টমস বিভাগ, এসডিও-ডিসি বাহাদুর, টিএনও স্যার, রাজনীতিক নেতা, ইউপি চেয়ারম্যান, ধনী ব্যবসায়ী, ঐশ্বর্যশালী- অর্থাৎ যে কোন ক্ষমতাবান ব্যক্তি, আমি তা মেনে নেব, পারি বা না পারি করার চেষ্টা নেব। পরিণতি, পুরস্কার, ফলাফল সব তো স্বয়ং বিধাতার হাতে আর দুনিয়াতে ক্ষমতাবান ও ধনবানদের হাতে! এই দর্শনটি মেনে নিলে অনেক দ্ব›দ্ব-তর্ক-বিতর্কেরই অবসান হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দল যদি বলে, আমাদের আবার ভোট দাও, রেজাল্ট আমরা দেব, তাহলে তো ওদের ভোট দেয়াই উত্তম, কোন ঝঞ্ছাট নেই! এরকম আরও বহু উদাহারণ দেয়া যায়।
আজ ছিয়াত্তর বছর বয়সে যখন পেছনে ফিরে তাকাই, দেখি এই দর্শনটি আমি খুব কমই মেনেছি। পরিণতি- বিশ্ব বাউন্ডেলাপনা! হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোন কথা! সেই যে ১৯৭৭ সালে দেশত্যাগ করে এখানে সেখানে যাচ্ছি, ফিরছি, এই জার্মানিতেই ২০১০ এ অবসর নেয়া পর্যন্ত ১৪টি চাকরি, আটবার বাসা বদল, একবার দেশ বদল (সুইজারল্যান্ড), প্রায় ৫০টি দেশ ভ্রমণ, রাজদর্শন থেকে শত শত সাধারণ মানুষের সাথে সাক্ষাত, অনেকের সাথে বন্ধুত্ব, কত কিছু! কত বই পড়লাম, বেশ কিছু বই নিজেও লিখেছি। অনেকে বলে, ভালোই হয়েছে! কিন্তু একটি সর্বজনীন প্রশ্নের উত্তর আমি আজও পাইনি, পাবোও না হয়ত। বাল্যকালে জামালপুরে ছোট বোনকে নিয়ে সেই জোড়া পাহাড়ের স্বপ্নই কি আমাকে দেশ থেকে টেনে বের করে এনে গ্রিস (ওখানে ’৭৭-এ পাঁচ মাস ছিলাম), দক্ষিণ জার্মানি, সুইজারল্যান্ড এবং অবশেষে মধ্য জার্মানির বিটবুর্গের পাশে নিয়ে এসেছে? সবই কি হয়েছে এই কারণে যে ‘আমি কখনই শ্রীকৃষ্ণের- মা ফলেষু কদাচন- কথাটি মানিনি?’ যদি আমি দেশে, ’হ্যাঁ হুজুর’, ’ইয়েস স্যার’, ’অবশ্যই স্যার’, ’আপনার আদেশ শিরোধার্য’ বচনগুলি পুংখনাপুংখরূপে মেনে চলতাম তাহলে আমার সরকারি কাজটি কখনই চলে যেত না। অবশ্য দেশে আমার বয়স ৭৬ হতোই না। কারণ সরকারি কাজে যে দুর্নীতি, চোরাপথে অর্থোপার্জনের (সবাই মিলেমিশে খাওয়া) যে অলিখিত নিয়ম ও বিধি বিরাজমান, তাতো মানতেই হতো। ভুঁড়ি দিন দিন আরও মোটা হতো। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ (এখানেও হয়েছে, তবে সুনিয়ন্ত্রিত) জাতীয় রোগে অপচিকিৎসায় বহু আগেই পটল তুলতে হতো। এতদিনে সমাধির উপরে বহুবার গজিয়ে উঠা ঘাস কাটতে হতো (যদি কেউ যতœ নেবার থাকত!)। বই লেখা তো দূরের কথা, অন্যের বই পড়ার সময়ও হতো না। দেশের যে সব কাহিনী শুনি, দেশে সরকারি চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করলে, সেসবে অবশ্যই সক্রিয় না হলেও নিষ্ক্রিয় ভুমিকা তো নিতেই হতো। জলে বাস করে তো আর কুমিরের সাথে শত্রুতা করা যায় না। এবং ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের হত্যার পর, কয়েকটি মিলিটারি ক্যুতে সামরিক বাহিনী ছাড়াও বেসামরিক বহুজনই নিহত হয়েছেন। তাদের একজন আমিও হতে পারতাম। সরকার উৎখাতের, ব্যারাকে, সেনানিবাসে কত ষড়যন্ত্র হয়েছে। সব সময় কি এসব এড়ানো যেত? কাজেই বেঘোরে মরে যাবার সম্ভাবনা থাকত প্রচুর। এখন যাই হোক বেঁচে তো আছি!
(চলবে)
নয়ে-ইজেনবুর্গ, জার্মানি ২০ ডিসেম্বর, ২০২১