জয়শ্রি মোহন তালুকার (মুনমুন): আজ সকালে আয়নায় নিজেকে দেখছিলাম আর বার বার মনে পড়ছিল সেই ফুটফুটে সুন্দর অবুঝ শিশুটির কথা। খুব মিষ্টি করে আমাকে বলেছিল একটু বসতে দেবে তোমার পাশে। তোমার পাশে ফ্যান আছে । ওরা আমাকে দেয় না এইখানে বসে খেতে। কেন জানি আমার এখন আর ইচ্ছে করে না গর্ব করে বলি আমি হিন্দু। আমি ব্রাহ্মণ। গোত্র সান্ডিল্য। আমি নিজেকে প্রশ্ন করি বার বার কেন পারলাম না সেদিন সেই শিশুটির কাছে বসে একসাথে খেতে। কেন পারিনা সিলেটের এই নিয়মগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে?
দিনটি ছিল ২২শে জুলাই শুক্রবার ২০২২।. সিলেটের মাটির সাথে আমার সম্পর্ক ২২ বছরের। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সব দিক থেকে আলাদা এখানকার মানুষ আমার জন্মস্থান নাটোর থেকে। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে পুজা বাড়িতে যেতাম প্রসাদ খেতে। কোন ভেদাভেদ ছিল না ব্রাহ্মণ-কায়স্থদের মধ্যে। ঠাকুর বাড়িতে সবাই সমান । কিন্তু এখানকার মানুষ এত কঠিন হতে পারে আমার জানা ছিলনা। নাটোরে যেমন আছে বলরামজির আখড়া, মহাপ্রভুর আখড়া, কালী বাড়ি, শিববাড়ি তেমনি সিলেটে আছে বিপদনাশিনীর বাড়ি, মনসাবাড়ি, কালী বাড়ি, লোকনাথের মন্দির, মা বগলার বাড়ি। সবাই এসব জায়গায় নিজের মনোবাসনা পূরণ করার জন্য মানসা করে নিজেদের মতো করে। কোনো এক ঠাকুর বাড়িতে ছিল আমার সেদিন নিমন্ত্রণ। খুব আনন্দ ছিল সেদিন ঠাকুরবাড়িতে যাব কিন্তু ভাবতে পারিনি সেই দিনটি আমার জীবনে স্মৃতি হয়ে থাকবে। তবে সেটা অনেক কষ্টের।
আমি ভারতের দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট, পুরি, বেলুড়মঠ গিয়েছি বাবা-মায়ের সাথে। কোথাও দেখিনি প্রসাদ খাবার সময় ব্রাহ্মণদের জন্য আলাদা সারি আর অব্রাহ্মণদের জন্য আলাদা সারি। আমাকে শুনতে হয়নি এটা বিশিষ্ট ব্রাহ্মণের বাসা এখানে মাততে নাই (সিলেটি ভাষা)। বারবার সেদিন কানে বাজছিল আমার গানের শিক্ষাগুরু স্বপন স্যানালের শেখানো নজরুল ইসলামের সেই গানটি জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছো জোয়া।
আমি দেখেছি যারা সেদিন ব্রাহ্মণ সারিতে বসে প্রসাদ গ্রহণ করছিল তাদের অনেকেই সিলেটের বিয়ের নিমন্ত্রণ খেতে কমিউনিটি সেন্টারে যায় এবং সবার সাথে এক টেবিলে বসে মুরগির রোস্ট চিবোয়। আসলে তারা আমাদের চেয়ে অনেক উপরে অবস্থান অর্থাৎ যখন যেমন তখন তেমন। আমি তো তাদের মতো নই। আমি তো ব্রাহ্মণ হিসেবে আলাদা সারি পেতে চাই না।
নরম মনের মানুষ ছিলেন আমার মণি মাসি। আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষের একজন। একমাত্র সন্তানকে ভারতে তাঁর দেবরের কাছে পড়তে পাঠিয়েছিলেন সেই আট বছর বয়সে। আশা ছিল ভারতের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হবে তাঁর সন্তান দেবু। কালীঘাট মন্দিরের পাশে মেশোর শেষ জীবনের অর্থ দিয়ে তৈরি করবে বাড়ি। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে কাটাবে জীবনের শেষ সময়। কিন্তু মানুষ ভাবে এক বিধাতা লিখেন অন্য।
ছুটির সময়ে মেসো ও মাসি যেত ভারতে ছেলের সাথে থাকবার জন্য। মেসো ছিলেন স্কুল শিক্ষক গাইবান্ধা জেলায়। গাইবান্ধার এমন কোনো লোক ছিল না যে মেসোকে চিনত না। দিন যায় বছর গড়িয়ে দেবু বড় হতে থাকে। মেসোর স্বপ্নও বড় হতে থাকে। এসএসসি এবং এইচএসসি পাশ করে দেবু ভর্তি হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সারা দিন পড়াশুনা আর কবিতা লিখা নিয়েই কেটে যেত দেবুর দিন ও রাত। সন্ধ্যার পর চলত মায়ের সাথে ছেলের ফোনে আলাপ। তখনও মোবাইলের ব্যবহারটা বেশি কেউ করত না। সবাই ফোনেই আলাপ করত বেশি। মাসির বাসার পাশে ছিল সলিল বাবুর বাসা। এখানেই দেবু ফোন করত। মাসি ও দেবুর ফোনে আলাপ ছিল অনেক মধুর। ফোন ধরেই দেবু বলত-
আসব মাগো তোমার কাছে
থাকব নাকো দূরে,
তুমি থাকবে আমার কাছে
সারাটা জীবন ধরে।।
মাসি বলত সোনা মানিক আমার। ফোন ছাড়ার সময় চলত মা ও ছেলের আদর। যাদবপুরে দেবু অর্থনীতি বিষয় নিয়ে পড়ত। দুই রুমের একটি ছোট বাসা নিয়ে দেবু থাকত।
দেবুর জীবনে নতুন একজন আসে। কে সে? কি তাঁর পরিচয়? কেউ বলতে চায় না। কিন্তু মাসি জানে। দেবু তাঁর মাকে বলেছে সুমি নামের কলকাতার একটি মেয়েকে সে অনেক পছন্দ করে। সুমি ছিল নম্র ভদ্র একটি মেয়ে। গণিতের ছাত্রী ছিল সুমি। কিন্তু একটি বিষয়ে তাদের. মধ্যে ছিল না কোনো মিল। সুমি ছিল কায়স্থ ঘরের মেয়ে। দেবু সম্পর্কের কথা তার কাকু-কাকিমা জানার পর থেকে শুরু হয় পরিবারে অশান্তি। দেবুর যাতায়াত বন্ধ হয় কাকুর বাসায়।
দিন যায় বছর গড়িয়ে দেবুর পড়াশুনা শেষ হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। রেজাল্ট বের হয়েছে। দেবু প্রথম হয়েছে। বাংলাদেশে মাসির আনন্দের শেষ নেই। সময় আসছে ছেলের সাথে বসবাস করার। সুমির সাথে দেবুর ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। একসাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে তারা। একদিন না দেখা হলে তাদের খারাপ লাগে। মণি মাসি কালিঘাটে সুমিকে আংটি পড়িয়ে দেয় নিজের পুত্র বঁধু করবে জন্য। সে অন্য রকম ভালোবাসা ছিল ছেলের ভালোবাসার মেয়ে সুমির প্রতি মণি মাসির।
মাসি চলে চলে আসার ঠিক তিন মাস পরে সবকিছু পাল্টে দিল বিধাতা। এখনও আমি বিশ্বাস করতে পারিনা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেয়েছে দেবু।১লা ডিসেম্বর দেবু সন্ধ্যায় গান শুনছিল আর মাল্টিপ্লাগ ঠিক করছিলো। কেউ বলতে পারে না কীভাবে কারেন্টে দেবুর মৃত্যু হয়। সবকিছু শেষ হয়ে যায়। দরজা ভেঙে বের করা হয় দেবুকে। আমার চেয়ে তিনবছরের ছোট ছিল দেবু। খবর পাঠানো হয় মণি মাসি ও মেসোকে। কিন্তু মণি মাসি ও মেসো যেতে পারেনি। দেবুর কাকু দাহ করে দেবুকে। সেই সময় অবরোধ চলছিল বাংলাদেশে। শেষ মুখ দেখা হলো না ছেলের। মেসো ও মাসি দীর্ঘ তিনমাস কথা বলেনি কারো সাথে। সুমি সব ছেড়ে চলে আসে তাদের কাছে। মেসো ও মাসি সুমির পৃথিবী। এখনও তারা একসাথে বাংলাদেশের গাইবান্ধা শহরের ডেভিড কোম্পানি পাড়াতে বসবাস করে।
ঈশ্বর আমাদের বিবেক দিয়েছেন সব ভালো কাজ করবার জন্য। তবে কেন এই দূরত্ব নিজ ধর্মের মানুষের প্রতি? সময় এসেছে সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের এই গোঁড়ামি থেকে বের হয়ে আসার। বর্তমান প্রজন্মকে নতুন আলোর সন্ধান দেবার।
সিলেট-২০২২