জয়শ্রি মোহন তালুকদার (মুনমুন):
পল্লবী জানে না আগামী দিনগুলোতে সে কেমন থাকবে। বয়স তার সবেমাত্র ১৩ বছর। মা বাবা মারা যাবার পর পল্লবী বড় বোনের শ্বশুর বাড়িতে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত দেন কাকু সৌরভ চক্রবর্ত্তী। সৌরভ বাবু ভাইয়ের মেয়ের দায়িত্ব নিতে কোনভাবেই রাজি নন। তাঁর এক কথা দরকার পড়লে টাকা দেব তবু মেয়ের দায়িত্ব নেব না। বোন ও ভগ্নিপতি আছেন তারাই নেবে দায়িত্ব।
চৈত্র মাস দারুন গরম পড়েছে। বড় বোন অহনা পল্লবীকে নিয়ে রওনা হয় তার শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। সে নিজেও জানে না কেমন থাকবে তাঁর বোন সেই বাড়িতে। অহনার মতামতকে এখানে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়না। অনেক সকালে তাকে ঘুম থেকে উঠতে হয়। সবার জন্য রুটি তরকারি তৈরি করতে হয়। ললিতা মাসি কাজে তাকে সাহায্য করে। তবে সে অনেক দেরীতে আসে সকালে। তখন অহনার প্রায় সব কাজ শেষ হয়ে যায়। ললিতা মাসিকে অহনা মনে মনে ভয় পায়। সবসময় মেজাজ তার গরম থাকে। অহনার শ্বাশুড়িকে সে পরিচালনা করে। প্রায় ১৮ বছর যাবৎ ললিতা মাসি অহনাদের বাসায় কাজ করে।
পল্লবীকে নিয়ে অহনা যখন বাড়িতে ঢুকে তখন বাসার সবার মুখে তেমন একটা হাসি ছিল না। ব্যতিক্রম ছিল অহনার ভাসুর নরেন বাবু। নরেন বাবু ছিলেন অবিবাহিত। অহনার স্বামী নিবারন বাবু শুধু পল্লবীকে দেখে বললেন কেমন আছো পল্লবী? পল্লবী মাথা নেড়ে উত্তর দিল ভালো।
বাড়ির পাশে অগ্রগামী স্কুলে পল্লবীকে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হলো। প্রতিদিন সে স্কুলে যায়। পল্লবী দেখতে এতটাই সুন্দর ছিল যে সবাই তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। পাড়ার ধনী মুসলিম ঘরের সন্তান ছিল সাইফুল। বয়স তার আঠার বছর হবে। সবেমাত্র এসএসসি পাশ করেছে। মুদির দোকানে প্রথম পল্লবীকে দেখে সাইফুল। পল্লবী তার বোনের ছেলের জন্য স্কুল থেকে ফেরার সময়ে চকলেট আনতে গিয়েছিল।
পল্লবীকে প্রথম দেখেই সাইফুল প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কে এই মেয়ে? সাইফুল প্রশ্ন করে কার্তিক বাবুকে। সাইফুলদের পাড়ায় কার্তিক বাবুর দোকানই সবচেয়ে বড়। সব রকমের জিনিস পাওয়া যায় এখানে। রাত ১২ টা সাইফুলের চোখে ঘুম আসে না। শুধু মনে পড়ে পল্লবীর মুখ। মনের অজান্তেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে পল্লবীকে নিয়ে।
পাড়ায় গণিতের শিক্ষক ছিলেন বিধান স্যার। তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র পড়াতেন। সকাল ৮ থেকে ১০টা পর্যন্ত পড়াতেন মাধ্যমিক। বিকাল ৫টা থেকে ৭টা পর্যন্ত পড়াতেন উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র-ছাত্রী। সাইফুল ও পল্লবী দুজনই পড়তো এখানে। বিধান স্যার খুব অল্প টাকা নিতেন ছাত্র-ছাএীদের কাছ থেকে। খুব উদার মনের মানুষ ছিলেন তিনি। প্রতি শুক্রবারে সকল ধর্ম নিয়ে মতামত শুনতেন ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে। এক শুক্রবারে বিধান স্যার প্রশ্ন করেছিল পল্লবীকে, কি খারাপ লাগে তোমার নিজ ধর্মে। সে বলেছিল পাঠা বলি দেওয়া। প্রশ্ন করেছিল সবাই কেন? সে অতি বিনীতভাবে মাথা নিচু করে বলেছিল, সমাজের বেশির ভাগ মানুষের ইচ্ছে থাকে বলির মাংস নিজেরা আহার করা। যদি বলির মাংস গরীব দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দেবার বিধান করা হয় তবে দেখা যাবে কেউ পুজোতে বলি দিতে উৎসাহী হবে না। এই কথা পল্লবীর বান্ধবী কনার খুব ভালো লেগেছিল। কনা বলেছিল অপ্রিয় সত্য হলেও কথাটা সত্য। রায়হান বলল স্যার রমজান মাস সংযমের মাস কিন্তু এই মাসে আমরা অতিরিক্ত খরচ করি যেটা তার ভালো লাগে না। সকল ছাত্র-ছাত্রীর এই ক্লাসটি খুব ভালো লাগত। এখানেই সাইফুল ও পল্লবীর সবসময় দেখা হতো।
সাইফুলের বাসা ও পল্লবীর বাসার মধ্যে দুরত্ব ছিল খুব কম। সাইফুলের বাড়ি ছিল রাধাগোবিন্দ মন্দিরের পাশে আর পল্লবীর বাড়ি উপরপাড়া। রিক্সায় যেতে সময় লাগত প্রায় ৫/৭ মিনিট। পল্লবীর বাড়ির উপর দিয়ে সাইফুলের বাড়িতে যেতে হতো। পল্লবীকে সাইফুল পছন্দ করে এটা পল্লবী জানে না। সেজন্য সাইফুল অনেক সময় পল্লবীকে বলত আজ তো বৃষ্টি হচ্ছে তুমি বাড়িতে যাবে কীভাবে? এসো আমি তোমাকে ও কনাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যাব। তারা বলত ঠিক আাছে ভাইয়া। সাইফুল সবসময় গাড়িতে যাতায়াত করত। অহনার ভাসুর এটা সহজভাবে নিতে পারেননি। তিনি বলেছেন সাইফুলের গাড়িতে না উঠার জন্য। নরেন বাবু ছিলেন সাইফুলের বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
পল্লবী এখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। ইদানিং নরেন বাবুর অতিরিক্ত আগ্রহ পল্লবীর ভালো লাগে না। স্কুল থেকে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত না খেয়ে বসে থাকেন। পল্লবী ঘুমিয়ে থাকলে মাথায় হাত দেন। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন যেটা অহনারও ভালো লাগে না। দিনের পর দিন নরেন বাবুর আচরণ অশোভন হতে থাকে। পল্লবী বাড়িতে একলা কোনো স্থানেই থাকতে পারে না শান্তিতে। পল্লবীর দিন চলে যায় নিরানন্দে। অহনার বুকে মাথা রেখে বলে দিদিরে কেন আমার জীবনটা এমন হলো? বাবা মা চলে গেলেন আমাকে ছেড়ে। দুই বোন অঝোরে জড়াজড়ি করে কাঁদতে থাকে।
এদিকে সাইফুল সবসময় খেয়াল রাখে পল্লবীর। অংক বুঝতে অসুবিধা হলে তাকে বুঝিয়ে দিত বিধান স্যারের বাড়িতে প্রতি শুক্রবার ক্লাসের পর। অনেক সময় তারা পড়াশুনা নিয়ে আলোচনা করত। ধীরে ধীরে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে থাকে পল্লবী।
দিন যায় কিন্তু পল্লবীর জীবনে সুখ আসেনা। পল্লবী খেয়াল করে তার জন্য তার বোনকে অনেক ছোট হয়ে থাকতে হয় পরিবারে। সবাই যখন তখন তাকে নিয়ে তাঁর বোনকে খোটা দেয়। পল্লবীকে আপদ ডাকে অহনার শ্বাশুড়ি। যে কারণে অজানা পথে পা দিয়ে ছিল পল্লবী সেই দিনটি ছিল ১ অক্টোবর শনিবার। অহনার পাশের বাড়িতে বড় করে শনি পূজা চলছে। সবাই সেখানে গেছে গেছে পুজা দেখতে। পল্লবী আর নরেনবাবু রয়েছে বাসায়। পল্লবীর খুব ইচ্ছে ছিল পূজা দেখতে যাবার। কিন্তু আগামী সোমবার থেকে এসএসসি পরীক্ষার কারণে তার যাওয়া হয়ে উঠেনি।
পল্লবীর ঘর ছিল বাড়ির দক্ষিণ দিকে পুকুরের পাশে। পল্লবীর পাশের ঘরটি ছিল ড্রয়িং রুম। নরেন বাবু ঐ রুমে বসে সেদিন টিভি দেখছিলো। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যায় সেই রাতে। মোমবাতি জ্বালিয়ে পল্লবী একলা ঘরে পড়ছিল। ঠিক এমন সময় পিছন থেকে কি যেন একটা আওয়াজ আসে পল্লবীর কানে। পিছনে তাকিয়ে দেখে নরেন বাবু ঘরের দরজা লাগিয়ে এগিয়ে আসছে পল্লবীর দিকে। মানুষের চেহারা যে কতটা কুৎসিত হতে পারে পল্লবী দেখেছিল সেটা নরেন বাবুর মধ্যে। বড়দা আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনার বোনের মতো, আমি আপনার পায়ে পড়ি। কোন কথাই সেদিন নরেন বাবুর মনকে নাড়া দেইনি। সবকিছু দিতে বাধ্য হয় পল্লবী সেই রাতে। সবকিছু কেড়ে নেবার পরও নরেন বাবু শান্ত হয়না। পল্লবীকে বলে একথা যদি কাউকে সে বলে তবে তার বোনের ছেলেকে মেরে ফেলবে। বোনকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে।
পল্লবীর বান্ধবী কনার মা কুষ্টিয়া শহরের নামকরা গাইনির ডাক্তার। নাম সেজুতি রায় মিলি। একনামে তাকে চেনে সবাই। রোগীদের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করেন তিনি। তার মেয়ে কনার প্রিয় বান্ধবী যে পল্লবী তিনি এটা জানেন এবং মাঝে মধ্যে পল্লবীকে বাসায় ডেকে এনে নিজে রান্না করে নিমন্ত্রণ খাওয়ান। সেই রাতের পর থেকে পল্লবী বেশির ভাগ সময় একলা থাকে। কারো সাথে তেমন একটা কথাও বলে না।
এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ব্যবহারিক পরীক্ষার তারিখ জানিয়েছে স্কুল থেকে। পল্লবী অনেক ব্যস্ত ব্যবহারিকের খাতা লিখা নিয়ে। বিকালে কনার বাড়িতে তারা দুজন মিলে খাতা লিখছিল। হঠাৎ করে পল্লবী মাথা ঘুরে পড়ে যায় মাটিতে।
কনার মা প্রথমে বুঝতে পারেননি। পরে অবশ্য অনুমান করেছিলেন বিষয়টি। সবকিছু জানার পরে কনার মা মিলি ম্যাডাম একলা ডেকে বলেছেন পল্লবীকে তুমি তো মা হতে চলেছো। তুমি কি বাচ্চাটিকে পৃথিবীতে আনবে? পল্লবী বলেছিল সে জন্ম দিতে চায় সন্তানকে। এটা যদিও অনেক কঠিন হবে তবুও ঈশ্বর চাইলে সে পারবে। কাঁদতে কাঁদতে কনার মায়ের বুকে মাথা রেখে সব ঘটনা খুলে বলেছিল পল্লবী সেদিন।
ডা. মিলি ভাবছেন কি করা যায় মেয়েটির জন্য। অনেক ভেবে মিলি পল্লবীকে বললেন কলকাতায় তার বিধবা মা দুর সম্পর্কের এক বোনকে নিয়ে থাকেন। তার বোন বিয়ে করেননি। তাদের দেখাশুনা করার জন্য মানুষ আছে। ডা. মিলির বাপের বাড়ি ভারতবর্ষে। পল্লবী ইচ্ছে করলে সারাজীবন তাদের সাথে থাকতে পারবে। ডা. মিলি পল্লবীকে বলল শোন মা জীবনে এমন কিছু কষ্ট আছে যেটা কাউকে বলা যায় না। নিজের মধ্যে রাখতে হয়। তোমার বিষয়টিও ঠিক সেইরকম। আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব কীভাবে চলতে হবে তোমাকে। কী করতে হবে জীবনে বড় হতে গেলে।
প্রায় দুই মাস পরে ডা. মিলি নিজ প্রচেষ্টায় পল্লবীকে রেখে আসেন কলকাতায় তার মায়ের কাছে। এই ঘটনা গোপন রাখেন তার নিজের মেয়ে কনার কাছেও। সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে মা ও বোনের কাছে পল্লবীকে রেখে কনার মা মিলি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। কিন্তু তার মন পড়ে থাকে পল্লবীর কাছে। প্রতিদিন গোপনে খবর নেন তিনি পল্লবীর। পল্লবীকে অনেক খোঁজাখুজি করে অহনা ও তার পরিবার। নরেন বাবু অবশ্য কিছুটা খুশি হন পল্লবীর নিখোঁজ সংবাদ শুনে।
দিনটি ছিল বুধবার। ডাক্তার মিলির কাছে ফোন আসে কলকাতা থেকে। পল্লবীর একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। মিলির মা শিশু সন্তানটির নাম রেখেছেন দিবাকর। পল্লবীর শিশু সন্তানটিকে নিয়ে মিলির মা ও বোন খুব আনন্দে থাকেন। বাংলাদেশী ছাত্রী হিসাবে ডাক্তার মিলি উচ্চমাধ্যমিকে পল্লবীকে ভর্তি করেন কলকাতার একটি কলেজে। কনা ও পল্লবীর মধ্যে তিনি কোন তফাৎ খুঁজে পান না তিনি। নিজের অজান্তেই পল্লবী লাল শাড়ি পড়ে কপালে লাল টিপ পড়ে ছবি তোলে। ভুলে যায় তার অতীত। স্বপ্ন দেখে নতুন একজন মানুষের, নতুন একটি সংসারের।
দিন যায় দিবাকরের বয়স বাড়ে। এক পা দুই পা করে পুরো বাড়ি হেঁটে বেড়ায়। পল্লবীকে প্রচন্ড ভালোবাসে তার ছেলে। পল্লবী উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। এখন সারাটা দিন ছেলের সঙ্গে থাকে। নতুন নতুন রান্না করে সবাইকে আনন্দে খেতে দেয়। পল্লবী তার ইচ্ছের কথা জানিয়েছে কনার মাকে। সে জীবনে সেবিকা হতে চায় এবং উচ্চতর লেখাপড়া করতে চায় এই বিষয়ের উপর। ডাক্তার মিলি বলেছে রমজানের বন্ধে ভারতে এসে ভালো একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেবে এই বিষয়ে পড়ালেখা করার জন্য।
দুই বান্ধবী দুই প্রান্তে। যাদের সম্পর্ক ছিল আত্মার। কনা জানে না পল্লবী কেমন আছে, কোথায় আছে? সময়ের খাতায় যুক্ত হয়েছে আরো ৫টি বছর। কনা বাংলাদেশের রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শেষবর্ষের ছাত্রী। আর পল্লবী নার্সিং এর উপর পড়ালেখা শেষ করে চাকরির চেষ্টা করছে কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে। দিবাকরকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। মায়ের হাত ধরে স্কুল যায় ও। গলা জড়িয়ে ধরে গান গায় মিষ্টি সুরে। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে পল্লবী।
সারাদিন কাজ করার পর রাতে ঘুমাতে গেলে অহনার মনে পড়ে তার বাবা মা হারানো ছোট্ট বোন পল্লবীর কথা। সে জানে না তার আদরের বোন কেমন আছে। ৭টি বছর কেটে গেছে। অহনা আজও খোঁজে তার বোনকে। শান্তিতো সেই কবেই উঠে গেছে অহনার পরিবার থেকে। নরেন বাবু দূরারোগ্য বøাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। বাংলাদেশের ডাক্তারা বলেছে সে আর বাঁচবে না। পাড়া প্রতিবেশী দলে দলে আসে তাকে দেখতে। নিবারন বাবু বড় ভাইকে বাঁচানোর জন্য প্রচুর অর্থ খরচ করছেন। সাইফুল এসেছে তার বাবাকে নিয়ে দেখতে। নরেন বাবুর বাল্যকালের বন্ধু ছিল সাইফুলের বাবা। শেষ চিকিৎসা করার জন্য ভারতে নেয়ার অনুরোধ করলেন সাইফুলের বাবা। নিবারন বাবু সম্মতি জানালেন। ঠিক হলো নরেন বাবুকে সাইফুল ও নিবারন বাবু নিয়ে যাবেন ভারতে।
দিবাকর আজ অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠে গেছে। কোন কিছুতেই যেন তার আজ শান্তি নেই। পল্লবী খুব চেষ্টা করছে ছেলেকে শান্ত করতে। কিন্তু কান্নাজড়িত কন্ঠে মায়ের কাছে তার এক আবদার সে আজ বাড়িতে থাকবে না। স্কুলেও যাবে না। মায়ের সঙ্গে যাবে। দিবাকর কান্নাজড়িত কন্ঠে মাকে বলে আমি আর কখনও তোমাকে কবিতা শোনাব না তুমি যদি আমাকে আজ নিয়ে না যাও। অবসর সময় পল্লবী তার ছোট্টো ছেলেকে কবিতা শেখাত। যখন পল্লবীর মন খুব খারাপ লাগত তখন দিবাকরকে বলত বাবা আমার একটা কবিতা শোনাও না। দিবাকর মায়ের বুকে মাথা দিয়ে শোনাত কবিতা। সব কষ্ট ভুলে যেত পল্লবী।
কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছে নরেন বাবুকে। কিন্তু তার অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। এখনকার ডাক্তাররা বলেছেন একদম শেষ সময়ে তাকে আনা হয়েছে। সে আর বাঁচবে না। কৃত্রিমভাবে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। নিবারন বাবুর মুখে কোন কথা নেই। বড় ভাই পৃথিবীতে থাকবে না এটা তিনি মানতে পারছেন না। বড় ভাইয়ের অনেক স্মৃতি সামনে আসছে বার বার।
দিনটি ছিল সম্ভবত ১১ জুলাই সোমবার ২০২০। পল্লবী নীল রঙের একটি শাড়ী পড়ে ছোট্ট ছেলে দিবাকরের হাত ধরে যায় অ্যাপোলো হাসপাতালে ডাক্তার কৃষান বেদীর সঙ্গে দেখা করতে। ডাক্তার মিলি পল্লবীকে বলেছিলেন চাকরির ব্যাপারে তাঁর সাথে কথা বলতে। কথা শেষ করে পল্লবী যখন বের হয়ে আসছে তখন পিছন থেকে একটা পরিচিত কন্ঠস্বর পল্লবীকে নাম ধরে ডাকে। পল্লবী তাকিয়ে দেখে তার বোনের বর নিবারনবাবু। সাথে সাইফুল দাঁড়িয়ে আছে সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা একটি লাশ নিয়ে। সঙ্গে আছে হাসপাতালের কিছু মানুষ। পল্লবী কাছে গিয়ে জানতে চায় কে মারা গেছেন? নিবারন বাবু বলেন বরদা। পল্লবী নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে লাশটির দিকে। তারপর কিছু সময় পরে ছেলের হাত ধরে নরেন বাবুর কাছে যায়। সাইফুলকে অনুরোধ করে মুখ থেকে সাদা কাপড় তোলার জন্য। দিবাকর মুখটা দেখবে। দিবাকরের হাত দিয়ে পল্লবী নরেন বাবুর তাকিয়ে থাকা চোখটা বন্ধ করে দেয়। দিবাকর প্রশ্ন করে মা তিনি আমার কে? পল্লবী বলে, বাবা তুমি যখন বড় হবে তোমাকে সব বলব।
ছেলের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলে পল্লবী। পিছন থেকে শোনা যায়-পল্লবী দেশে ফিরে চলো।
পল্লবী ছেলের কাছে একটি কবিতা শুনতে চায়। মিষ্টি গলায় শোনা যায় কবিতা।
শূন্য থেকে জীবন শুরু
শূন্য দিয়েই শেষ,
মৃত্যু দিয়েই মিলবে হিসাব
থাকবেনা ভাগশেষ!
ফিরবো সবাই সময় হলে
আজ কিংবা কাল,
শরীরটা নয়,
কর্মগুলোই বাঁচবে হাজার সাল!
সিলেট ২০২১