জয়শ্রী মোহন তালুকদার (মুনমুন): হরিপদ চক্রবর্ত্তীর ঘরে আজ আলো নেই। অন্ধকার ঘরে হরিপদ বাবু ও তার স্ত্রী মালতি বসে আছে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মুখে তাদের কোন কথা নেই আজ এক সপ্তাহ যাবৎ।
শত চেষ্টা করেও তাদের কেউ কিছু খাওয়াতে পারছে না।তারা শুধু একটা কথাই বলছে বড় ভুল হয়ে গেছে। ভগবান যদি একটা সুযোগ দিত আমাদের তবে...।
একমাত্র সন্তান গোপাল ছোটবেলা থেকে অনেক ভালো ছাত্র ছিল। এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করার পর গোপাল ভর্তি হয়েছিল রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। ডাক্তারি পড়া অবস্থায় রিয়ার সাথে গোপালের পরিচয়। তারা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসতো। গোপাল মানসিকতার দিক থেকে ছিল অনেক উদার।
ব্রাহ্মনের সন্তান হয়েও বিধবার সাদা শাড়ী পড়া, নিরামিষ খাওয়া, স্বামী মারা গেলে স্ত্রীর কপাল থেকে স্বামীর পা দিয়ে সিঁদুর তুলে নেওয়া, স্বামী মারা যাবার পর পাথর দিয়ে অন্য মহিলা কর্তৃক হাতের শাখা ভেঙে ফেলা এগুলো সে মন থেকে মেনে নিতে পারত না। স্কুল জীবন থেকেই সে এগুলোর তীব্র প্রতিবাদ করত। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো আর বলতো কতোদিন এ সমাজ মা জাতিকে অপমান করবে।
দেখতে খুব সুন্দর ছিল গোপাল।
রিয়া প্রতিদিন তার হোস্টেল থেকে বিকালে খাবার তৈরি করে আনতো গোপালের জন্য। গোপাল রাতে খেত আর পরদিন রিয়ার হাতের তৈরি করা খাবার খেয়ে ক্লাসে যেত। রিয়া ও গোপাল দুজনেই সিলেটি। তবে মানসিকতার দিক থেকে তারা দুজনেই ছিল প্রায় একরকম। গোপাল ছিল ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান আর রিয়া ছিল দত্ত বাড়ির মেয়ে। তাদের ভালোবাসাকে সিলেটি সংস্কৃতিতে মেনে নেওয়া ছিল অনেক কঠিন। রাজশাহী বরদা কালী মন্দিরে গোপাল রিয়ার হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছিল যদি বাঁচতে হয় তবে একসঙ্গে বাঁচবো আর যদি মরতে হয় তবে মরবোও একসঙ্গে। তারা দুজনেই বুঝতো একজন ছাড়া অন্যজন বাঁচতে পারবে না।
পরমা সুন্দরী ছিল রিয়া। ক্লাসের সব বান্ধবী বলত ঈশ্বর তোকে নিজ হাতে তৈরি করেছে, একটুকুও খুঁত রাখেন নি। গোপাল খুব ভাগ্যবান যে তোর মতো মেয়েকে স্ত্রী হিসাবে পাবে।
দ্বীপ ছিল গোপালের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাড়ি রাজশাহীতে। দ্বীপ জানতো গোপাল আর রিয়ার সম্পর্কের কথা। দ্বীপ মনে মনে খুব ভয় পেত আর বলতো তার মাকে কি যে লিখা আছে এদের কপালে।
দ্বীপের মা জয়ন্তী দেবী প্রায়ই তাদের বাসায় ডেকে এনে রান্নাকরা খাবার খাওয়াত। সিলেটী ও রাজশাহী রান্নার মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। তবে গোপাল সব ধরনের রান্নাই খুব মজা করে খেত।
২০২০ সালের ১ জানুয়ারি জয়ন্তী দেবী ফোন করলেন হরিপদ বাবু বাসায়। হরিপদ বাবু তখন পুজা করছিলেন। মালতী রানী ফোন ধরলেন জয়ন্তী দেবীর। দুজন দুজনের কুশল বিনিময়ের পর জয়ন্তী দেবী বললেন দিদি গোপাল কেমন আছে? আজ আট মাস যাবৎ গোপালের সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ নেই। ওরা পাশ করে যাবার পর আমি অনেকটা একা হয়ে গিয়েছি।
মালতী রানী একটু গম্ভীর কন্ঠে জয়ন্তী দেবীকে বললেন ওরা কে গো দিদি? জয়ন্তী দেবী বললেন গোপাল আর রিয়া। বড় ভাগ্যবানগো দিদি। রিয়ার মতো একটি ভালো মেয়ে আপনার ছেলের বউ হবে। মালতী রানী এটা শুনার পর থেকে তেমন একটা কথা বলতে পারছিলেন না। মালতী রানী বললেন দিদি গোপাল এখন বিসিএস-এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে আর সিলেটের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করেছেন। আর্শীবাদ রাখবেন দিদি আমার একমাত্র সন্তানের জন্য। ভালো থাকবেন এটা বলে মালতী রানী ফোন রেখে দিলেন।
হরিপদ বাবু পূজা শেষ করে স্ত্রীর পাশে এসে বসলেন। প্রশ্ন করলেন কে ফোন করেছিল। মালতী রানী বললেন দ্বীপের মা। বলল আমি খুব ভাগ্যবান যে রিয়ার মতো মেয়ে আমার ছেলের বউ হবে। আমাদের গোপাল কেন বলল না রিয়ার কথা। আজ গোপাল রাতে আসলে তুমি জিজ্ঞেস করবে রিয়ার কথা।
রাত ৯টা। গোপাল বাসায় ফিরে প্রথমে স্নান করল, তারপর খাবার টেবিলে বসার আগে কিছুক্ষণের জন্য টিভিতে খবর দেখার জন্য বসার ঘরে যাচ্ছিল এমন সময় হরিপদ বাবু জিজ্ঞেস করলেন গোপাল এদিকে আয়তো বাবা।
গোপাল কাছে এসে হরিপদ বাবুকে জড়িয়ে ধরে বলল বলো বাবা কি বলতে চাও? মালতী রানী হাসতে হাসতে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন রিয়া কে বাবা? গোপাল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল মা আমার বান্ধবী। একসঙ্গে মেডিকেল কলেজে পড়েছি রাজশাহীতে। সিলেটের বাগবাড়িতে তার বাসা। দত্ত বাড়ির মেয়ে।
মৌলভীবাজারের ধনী ও বনেদী কালাচাঁদ ভট্টাচার্য হরিপদ বাবুর বাল্যকালের বন্ধু। তার মেয়ে সুচন্দা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ পাশ করছে। হরিপদ বাবুর ইচ্ছে তার মেয়েকে বধু হিসেবে ঘরে আনা। এ ব্যাপারে অবশ্য তাদের মধ্যে রসিকতার ছলে দু একবার কথা হয়েছে। দুই পরিবারের মধ্যে যোগাযোগও চলছে নিরবধি।
গোপাল একটা দিনও রিয়াকে ছাড়া থাকতে পারেনা। সে তার বাবা মাকে সরাসরি বলেছে রিয়ার কথা।
হরিপদ বাবুর এক কথা জীবিতকালীন সময়ে বিয়ে দেবেনা হরিপদবাবু। কোন যুক্তিই আজ রাজী করাতে পারছেনা গোপালকে। জানা যায় অনেক সুর্দশন ব্রাক্ষণ পাত্রীর পরিবার গোপালের সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্য হরিপদ বাবুর কাছে এসেছে প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু গোপালের মন প্রাণ অন্তর যে রিয়াকে নিয়ে।
দেখা যায় সিলেটে ব্রাহ্মণের মধ্যে অনেক শ্রেণি আছে।
যেমন দাসের ব্রাহ্মণ, নাথের ব্রাক্ষণ, কটার ব্রাক্ষণ। উঁচু শ্রেণির কায়স্থ ব্রাহ্মণদের সাথে এদের বিবাহ হয় না। যেমন ভট্টাচার্যরা দাসের বা নাথ সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণদের সাথে বিবাহ দেবেনা। নিজেরা পছন্দ করে অনেকেই কায়স্থের ব্রাহ্মণের মেয়ে অব্রাহ্মণ ছেলেকে বিয়ে করেছে। ভট্টাচার্য মেয়ে বিয়ে করেছে হিন্দু ধর্মের নিচু সম্প্রদায়ের ছেলেকে। তবে এদের কারো বিয়ে পারিবারিক সম্মতি ছিল না। তবে দু’একটি পরিবার অনানুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে দিলেও তাদের সন্তানরা সিলেটের মাটিতে থাকে না।
দিনটি ছিল শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন। সবারই ছিল উপবাস। গোপালের সকাল থেকেই মনটা খারাপ। কোনভাবেই নিজেকে স্থির করতে পারছে না। একদিকে রিয়া অন্যদিকে বাবা মার আদর্শ, সমাজ ধর্মীয় রীতিনীতি। কোনোভাবেই রিয়াকে বাদ দিয়ে অন্য মেয়ের সাথে সংসার করা গোপালের পক্ষে সম্ভব নয়।
গোপালের বাড়ি ছিল তিন তলা। গোপাল ছাঁদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে আর চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় এ জীবন আর নয়।
সেই রাতেই গোপাল একসাথে ৩০টি ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিজের জীবনকে সঁপে দেয় ঈশ্বরের হাতে। মৃত অবস্থায় গোপালকে প্রথমে নেয়া হয়েছিল সরকারি মেডিকেল কলেজ। সেখানে তাকে দেখতে এসেছে শত শত ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয়, মাসিরাসহ তাঁর সহকর্মীরা। রিয়া খবরটা পায় বেশ কিছুক্ষণ পরে। তার এক সহকর্মীর কাছ থেকে। রিয়া গোপালকে দেখে কিছু বলতে পারেনি। শুধু এক কোণায় দাঁড়িয়ে থেকেছে। জানা যায় গোপালের দাহ না হওয়া পর্যন্ত রিয়া নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। রিয়ার মৃত্যুটাও ছিল অস্বাভাবিক। এইভাবেই দুইটা জীবন শেষ হয়ে যায়। তারা বাঁচতে চেয়েছিলো একসঙ্গে। তাদের ভালোবাসা ছিল পবিত্র। মন ছিল এক সুতোয় বাঁধা। কিন্তু সমাজ আর অতীতের নিয়ম কেড়ে নিল ওদের জীবন।
লেখক হিসাবে সমাজের কাছে আমার প্রশ্ন?
এই নিয়মগুলো কি আমরা কখনো ভাঙ্গতে পারবো না? বিশ্বায়নের এইযুগে আমাদের মানসিকতা আমরা একটু উন্নত করতে পারি না? যাতে করে আমাদের সন্তানরা গর্ব করে বলতে পারে আমরা হিন্দু।
আমরা নিজ ধর্মের মানুষকে গ্রহণ করি বর্জন করি না। সতীদাহ, বাল্যবিবাহ যদি বন্ধ হয় তবে আসুন আমরা একসঙ্গে কাজ করি এধরনের নিয়ম থেকে বেরিয়ে আসতে যাতে গোপাল ও রিয়ার মতো দুটো জীবন সুন্দরভাবে এই পৃথিবীতে বাঁচতে পারে।