আসিফ হাসান: ১৪ জুন, আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস। এ বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য ''Give blood and make the world a healthier place.' অর্থাৎ ‘রক্ত দিন এবং বিশ্বকে একটি স্বাস্থ্যকর স্থানে পরিণত করুন।’ করোনাকালীন বিশ্বে আজ স্বাস্থ্যকর স্থানের বড় বেশি প্রয়োজন।
যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছেন তাদেরসহ সাধারণ জনগণকে রক্তদানে উৎসাহিত করাই এ দিবসের উদ্দেশ্য। ১৯৯৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস পালন এবং ২০০০ সালে ‘নিরাপদ রক্ত’-এই থিম নিয়ে পালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৪ সালে প্রথম পালিত হয়েছিল বিশ্ব রক্তদান দিবস। ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনের পর থেকে প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ দিবস পালনের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছে।
উইকিপিডয়ার তথ্যমতে প্রতিবছর প্রায় ৯ কোটি ইউনিট রক্ত স্বেচ্ছায় দান হয়, অথচ এর মাত্র ৩৯ শতাংশ সংগ্রহ হয় উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে, যেখানে বাস করে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া এখনো বিশ্বের অনেক দেশে মানুষের রক্তের চাহিদা হলে নির্ভর করতে হয় নিজের পরিবারের সদস্য বা নিজের বন্ধুদের রক্তদানের ওপর, আর অনেক দেশে পেশাদারি রক্তদাতা অর্থের বিনিময়ে রক্ত দান করে আসছে রোগীদের। অথচ বিশ্বের নানা দেশ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে জানা যায়, ‘নিরাপদ রক্ত সরবরাহের’ মূল ভিত্তি হলো স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে দান করা রক্ত। কারণ তাদের রক্ত তুলনামূলকভাবে নিরাপদ এবং এসব রক্তের মধ্য দিয়ে গ্রহীতার মধ্যে জীবনসংশয়ী সংক্রমণ, যেমন এইচআইভি ও হেপাটাইটিস সংক্রমণের আশঙ্কা খুবই কম।
প্রত্যেক রক্তদাতাই একজন নায়ক। এ নায়ক চলচ্চিত্রের নয়, নাটকের নয়, সাহিত্যের নয়, রাজনীতির নয়। এ নায়ক মানবিকতার, মনুষত্বের, মহানুভবতার। এ নায়ক তারা, যারা নিরবে ও স্বেচ্ছায় একটি নির্দিষ্ট সময় (প্রতি চারমাস) পর মানুষকে নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে সহযোগিতা করেন।
রক্তদান আন্দোলনের জনক ডা. কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার। রক্তদান আন্দোলনের এই প্রবাদপুরুষ ১৮৬৮ সালের ১৪ জুন অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। উনবিংশ শতাব্দীতে রক্ত সঞ্চালনের ফলে মানুষের জীবন রক্ষার পাশাপাশি বহু মানুষ মারা যাওয়ার ফলে মহামান্য পোপ রক্ত সঞ্চালন এবং এ ব্যাপারে সকল প্রকার গবেষণার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ফলে বহুদিন রক্ত সঞ্চালন বন্ধ থাকে। কিন্তু ডা. ল্যান্ডস্টেইনার গবেষণা থেকে বিরত থাকেননি। তিনি এই মৃত্যুর কারণ আবিষ্কারের গবেষণা চালিয়ে যান। ভিয়েনা শহরে ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজিক্যাল অ্যানাটমিতে গবেষণারত এই বিজ্ঞানী তার নিজের সহকর্মীদের শরীর থেকে রক্ত সংগ্রহ করে বিভিন্ন পরীক্ষার পর আবিষ্কার করলেন যে, মানুষের শরীরে রক্তের তিনটি শ্রেণি বা গ্রুপ আছে। যাদের তিনি ‘এ’, ‘বি’, ‘ও’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। পরে তার সহকর্মীদের সাহায্যে আরও একটি গ্রুপের আবিষ্কার করেন যা ‘এবি’ হিসেবে চিহ্নিত। ডা. ল্যান্ডস্টেইনার প্রমাণ করেন, একই গ্রুপের রক্ত সঞ্চালনে রক্তগ্রহীতার মৃত্যু হয় না। ১৯০১ সালে তার এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য তাকে ১৯৩০ সালে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে সম্মান জানানো হয়। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অত্যাশ্চর্য উন্নতির ফলে মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তো অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে স্বেচ্ছায় রক্তদানে অন্য মানুষের মূল্যবান জানপ্রাণ রক্ষা পায় এবং নিজের জীবনও ঝুঁকিমুক্ত থাকে; তাই রক্তদানের ব্যাপারে ইসলামে কোনো বিধিনিষেধ নেই। অথচ দেশের হাজার হাজার মানুষ প্রতিবছর রক্তের অভাবে মৃত্যুবরণ করছে। রক্তদাতার এক ব্যাগ মূল্যবান রক্তদানের মাধ্যমেই মৃত্যুপথযাত্রী অন্য মানুষের জীবন বাঁচানো যেতে পারে। কেউ যদি স্বেচ্ছায় রক্ত দান করেন, তাহলে এতে একজন বিপদগ্রস্ত মানুষের বা মুমূর্ষু রোগীর জীবন যেমন বাঁচবে, তেমনি রক্তদাতা ও রক্তগ্রহীতার মধ্যে গড়ে উঠবে রক্তের বন্ধন। স্বেচ্ছায় রক্ত দিলে শুধু অন্যের জীবন বাঁচানো নয়, বরং নিজের জীবনও ঝুঁকিমুক্ত রাখা সম্ভব হবে। বিপন্ন মানুষের মহামূল্যবান জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে প্রাণে রক্ষা করল।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৩২)
রক্তের পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা নিরাপদ করতে ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদে একটি আইন করা হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে জাতীয় নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন বিধিমালা। এ বিধিমালায় দেশে রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র স্থাপন, পরিচালনা ও রক্তদাতার বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনা অমান্য করলে রয়েছে শাস্তির ব্যবস্থাও। বিধিমালা অনুযায়ী, রক্ত সঞ্চালন কেন্দ্র স্থাপন করতে হলে আগে ওষুধ প্রশাসন থেকে অনুমোদন নিতে হবে। এর জন্য ডাক্তার, টেকনিশিয়ান থাকতে হবে। রক্ত সংগ্রহের আগে দাতার রক্ত স্ক্রিনিং বা ক্রসম্যাচিং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার যন্ত্র থাকতে হবে। এ ছাড়া হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া ও এইচআইভি রোগের পরীক্ষা অবশ্যই করতে হবে। রক্ত সংগ্রহের পর তা স্বাস্থ্যসম্মত ও দূষণমুক্ত পরিবেশে সংরক্ষণ করতে হবে। এ জন্য থাকতে হবে বিশেষ ধরনের ফ্রিজ।
এখন প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ লোক রক্তদান করে থাকে। কিন্তু রক্তের প্রয়োজন আরও বেশি। কেউ যখন স্বেচ্ছায় নিজ রক্ত অন্যকে দান করে, তাকে রক্তদান বলে। রক্তদাতার অবশ্যই সম্মতির প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৮ থেকে ৯ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। কিন্তু ব্লাড ব্যাংকগুলোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৫ থেকে ৬ লাখ ব্যাগ সংগ্রহ করা হয়। অর্থাৎ ৩ থেকে ৪ লাখ ব্যাগ ঘাটতি থেকে যায়। এ ঘাটতি পূরণ হয় পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা রক্তের মাধ্যমে, যার বড় অংশই কোনো না কোনোভাবে দূষিত থাকে। অবৈধ রক্ত ব্যবসা জরুরিভিত্তিতে বন্ধ করা উচিত। এর মাধ্যমে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। আর রোগীর আত্মীয়স্বজনকেও সচেতন হতে হবে, যাতে তারা পেশাদার রক্তদাতাদের রক্ত গ্রহণ না করেন।
রক্ত দান করা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
যদিও বা সব ধরণের দানকেই মহান দান বলে গণ্য করা হয়৷ কিন্তু রক্তদান সবথেকে মহান এবং পূণ্যের কাজ৷ কারণ এতে কারও প্রাণের রক্ষা হয়৷ জীবন ফিরে পায়৷ রক্তদান করলে স্বাস্থ্য বা শরীরের কোনও হানী হয় না৷ যেকোনও সুস্থ মানুষই রক্তদান করতে পারেন৷ ১৮-৬০ বছর বয়স পর্যন্ত যারা তারাই রক্ত দিতে পারেন৷
বলা হয়, প্রতিবছর দেশে রক্তের প্রয়োজন চার লাখ ব্যাগ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সা¤প্রতিককালে দেশে রক্তের চাহিদা কত এ নিয়ে রেফারেন্স হিসেবে উলেখ করা যায় এমন কোন গবেষণা হয়নি। ১৯৮৭ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা দল এ গবেষণা চালায়) দেখা যায়, প্রতিবছর রক্তের প্রয়োজন প্রায় আড়াই লাখ ব্যাগ। ২০ বছর পর এখন আনুমানিক হিসাব ধরে এটিকে তিন লাখ বলা হয়।
প্রতিদিনই শত শত রোগীর অপারেশন হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে। প্রয়োজন পড়ছে শত শত ব্যাগ রক্তের। দুর্ঘটনায় রক্তক্ষরণ, প্রসবকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, রক্তের ক্যান্সার, রক্তশূন্যতা, হিমোফিলিয়া, থ্যালাসেমিয়া, ডেঙ্গুসহ রক্তের স্বল্পতাজনিত অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় রোগীর দেহে রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন পড়ে। থ্যালাসেমিয়ার রোগীরা তো বেঁচেই থাকে কিছুদিন পর পর শরীরে রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে।
রক্তদান সম্পর্কে অহেতুক ভীতি, অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের ফলে স্বেচ্ছায় রক্তদানের হার আমাদের দেশে এখনও অনেক কম। এক জরিপে দেখা যায়, রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে কি কি রোগ ছড়ায় ৬২% মানুষই তা জানেন না, ৫৩% জানেনই না তাদের রক্তের গ্র“প কি, অবশ্য ৬৬% মনে করেন, রক্তদান সম্পর্কে তারা যতটুকু জানেন, তা যথেষ্ট নয়।
এখনও স্বেচ্ছায় রক্তদান প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে অনেক কম হলেও এটা ঠিক যে আগের চেয়ে আমাদের দেশে স্বেচ্ছায় রক্তদানের হার বেড়েছে। দশ বছর আগেও পেশাদার রক্তদাতারাই ছিল আশিভাগ রক্তের যোগানদাতা। বিভিন্ন সংগঠনের সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, সন্ধানী, রেডক্রিসেন্ট, সরকারি উদ্যোগ, নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় ১০০টি সেন্টার চালু করা, রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে নির্দিষ্ট পরীক্ষা করার ব্যাপারে কড়াকড়ি ইত্যাদির ফলে পেশাদার রক্তদাতাদের দাপট কমেছে। নিজের আত্মীয়স্বজনের প্রয়োজনে রক্ত দেয়ার মানসিকতা বেড়েছে আগের চেয়ে। তবে এখনও তা বাৎসরিক রক্তচাহিদা পূরণের লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে। তাই অনেককেই পেশাদার রক্তদাতাদের রক্তই ব্যবহার করতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে।
ওপেন হার্ট সার্জারি, কিডনি পরিবর্তন, লিভার পরিবর্তন প্রভৃতি এখন সাধারণ ঘটনা। যে কোনো কারণে শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হলে, প্রয়োজনীয় রক্ত যদি লোকটির শরীরে সঞ্চালন করা না হয় তবে মানুষটির মৃত্যু হতে পারে। এ রক্ত কেবল মানবদেহ হতেই সংগ্রহ করা হয়। এর কোনো কৃত্রিম বিকল্প নেই। বাংলাদেশের প্রায় সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখন ব্লাড ব্যাংক স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু স্বেচ্ছায় রক্তদানের ব্যাপারে গণসচেতনতা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। শিক্ষিত, অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি স্বাস্থ্য পরিসেবার সঙ্গে যুক্ত লোকেরাও রক্তদান করতে ভয় পান। শিক্ষার অভাব, কুসংস্কার, অনিচ্ছা, অপ্রতুল প্রচারব্যবস্থা সর্বোপরি সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাবই এর মূল কারণ। ফলে পেশাদারি রক্ত বিক্রি বেআইনি হলেও প্রয়োজনে এদের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ রক্ত সঞ্চালনে বিভিন্ন মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এটা অনস্বীকার্য যে, ত্রুটিপূর্ণ ব্লাড ব্যাংকিংয়ের ফলে ও কর্তৃপক্ষের আন্তরিক উদ্যোগ না থাকায় রক্তের চাহিদার তুলনায় জোগান অনেক কম।
পেশাদার রক্তদাতা কারা?
যারা টাকার বিনিময়ে রক্ত দেয়। আমাদের দেশে পেশাদার রক্তদাতাদের বেশিরভাগই মাদকাসক্ত বা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত। মূলত মাদকাসক্তরাই নেশার টাকা যোগাড়ের জন্য রক্ত বিক্রি করে। এরা ভোগে রক্তবাহিত নানান রোগে। এদের রক্ত গ্রহণ করায় রোগী সাময়িকভাবে সুস্থ হলেও দীর্ঘমেয়াদে রক্তবাহিত জটিল কোন রোগ যেমন-এইডস, হেপাটাইটিস-বি ও সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, ফাইলেরিয়া ইত্যাদিতে আক্রান্ত হতে পারেন। এক জরিপে দেখা গেছে, পেশাদার রক্তদাতাদের মধ্যে শতকরা ২৯% হেপাটাইটিস-বি ও ২২% সিফিলিসে রোগে আক্রান্ত। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া রোগীকে রক্ত দেয়ায়, পরবর্তীতে ৬০.১% রোগী হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়েছেন। আরেকটি ব্যাপার, পেশাদার রক্তদাতাদের বেশিরভাগই পুষ্টিহীনতায় ভোগে এবং চার মাসের বিরতির ব্যাপারটি না মেনেই রক্ত বিক্রি করে বলে রক্তের অন্যতম উপাদান হিমোগ্লোবিন এদের দেহে কম থাকে। ফলে, এক ব্যাগ রক্তে যতটুকু হিমোগ্লোবিন রোগীর পাওয়ার কথা, তা সে পায় না। আর পেশাদারদের রক্ত বিক্রির মাধ্যম হিসেবে অলিতে-গলিতে গড়ে ওঠা ব্লাড ব্যাংকগুলোও যথাযথ পরীক্ষা ছাড়াই রোগীদের সরবরাহ করছে এসব রক্ত।
দেশের জনসংখ্যা প্রায় চৌদ্দ কোটি। অর্ধেক বাদ দিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক ধরি সাত কোটির মতোই। অসুস্থ, অক্ষম বা রক্তদানের শারীরিক যোগ্যতা নেই বলে আমরা এরও যদি অর্ধেক বাদ দেই- সাড়ে তিন কোটি। সাড়ে তিন কোটি মানুষের মাত্র এক শতাংশও যদি বছরে মাত্র একবার রক্ত দান করেন, বাৎসরিক রক্তদান হয় সাড়ে তিন লাখ ব্যাগ। সংখ্যাতত্তে¡ খুবই সহজ এই ব্যাপারটিই এদেশে ঘটে না বলে রক্তের জন্য এখনও প্রতিনিয়ত মরছে মানুষ।
উন্নত দেশে বেশিরভাগ রক্তদাতাই হলেন স্বেচ্ছায় রক্তদাতা, যারা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে রক্তদান করেন। দরিদ্র দেশগুলোতে এ ধরণের প্রতিষ্ঠিত স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা বেশ কম, বেশিরভাগ রক্তদাতাই কেবল তাদের পরিচিতজনদের প্রয়োজনে রক্তদান করে থাকেন। বেশির ভাগ রক্তদাতাই সমাজসেবামূলক কাজ হিসেবে রক্তদান করেন, তবে কিছু মানুষ পেশাদার রক্তদাতা, অর্থাৎ তারা অর্থ বা কোন ভাতার বিনিময়ে রক্তদান করে থাকেন।
রক্তদাতা তার ভবিষ্যত প্রয়োজনে রক্ত পেতে পারেন। এ বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। একজন রক্তদাতা তার রক্তদানের মাধ্যমে শুধু একজন মুমূর্ষু রোগীরই জীবন বাঁচলোনা একইসাথে তিনি তাঁর নিজের অথবা তাঁর পরিবারের দুঃসময়ের জন্যও রক্ত সংগ্রহ করে রাখলেন্ যা তাঁর যে কোন প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৮ সালের তথ্যে বলা হয়, পৃথিবীর ১৫৯টি দেশে আট হাজার রক্তকেন্দ্র রয়েছে। উন্নত দেশের রক্তকেন্দ্র থেকে গড়ে প্রতিবছর ৩০ হাজার ব্যাগ রক্ত সংগৃহিত হয়। সেখানে উন্নয়নশীল দেশে আট ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ গড়ে তিন হাজার সাতশ ব্যাগ সংগৃহিত হয়। ১০৬টি দেশে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন নীতিমালা থাকলেও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে মাত্র ১৩ ভাগ দেশে এ নীতিমালা বিদ্যমান। সমগ্র পৃথিবী থেকে প্রায় ৯ কোটি ২০ লাখ ব্যাগ রক্ত প্রতিবছর সংগ্রহ করা হয় এবং এর মধ্যে অর্ধেকই উন্নত দেশ থেকে।
একটি দেশের তিন ভাগ মানুষও যদি নিয়মিত রক্তদান করে তবে সে দেশের রক্তচাহিদা পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দুর্ঘটনাপ্রবণ দেশে কখনও কখনও তার চেয়ে বেশি পরিমাণ রক্তের দরকার হয়। মূলত সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত মানুষের জন্য বেশি পরিমাণ রক্ত প্রয়োজন। এছাড়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের অপারেশন করার জন্যও রক্তের দরকার। থালাসেমিয়া রোগে আক্রান্তদের নিয়মিতই রক্ত নিতে হয়।
পৃথিবীর ৬২টি দেশে বর্তমান প্রয়োজনীয় রক্ত স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের কাছ থেকে সংগৃহিত হয়। অবশ্য যার অধিকাংশই উন্নত দেশ। এক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রয়োজনীয় রক্তের জন্য স্বেচ্ছা রক্তাদাতাদের পাশাপাশি পারিবারিক সদস্যদের উপর নির্ভর করতে হয়, যাদের অধিকাংশই নিয়মিত ও স্বেচ্ছা রক্তদাতা নয়। বাংলাদেশে মূলত তরুণরাই স্বেচ্ছায় রক্তদান করে। শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরাই প্রায় ৭০ ভাগ রক্ত দান করে।
রক্তদাতারা প্রধানত তিন রকম:
১. স্বেচ্ছা রক্তদাতা: স্বেচ্ছা রক্তাদাতা তারা, যারা কোনরূপ সুবিধা (আর্থিক বা অন্যান্য) ছাড়াই কারও প্রয়োজনে রক্তদান করে। উন্নত দেশগুলোতে প্রায় শতভাগ রক্তই স্বেচ্ছা রক্তাদাতাদের কাছ থেকে সংগৃহিত হয়। মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ৭৩ ভাগ রক্ত এবং বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায় ৬৪ ভাগ রক্ত স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের কাছ থেকে সংগৃহিত হয়।
২. পারিবারিক রক্তদাতা: যারা সাধারণত নিয়মিত ও স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন না, কিন্তু পারিবারিক কোনো সদস্যের প্রয়োজনে রক্তদান করেন তাদের বলা হয় পারিবারিক রক্তদাতা। উন্নত দেশে পারিবারিক রক্তদাতা ১ ভাগেরও কম হলেও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে এ হার ২৫ ভাগের বেশি। আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ হার ৩০ ভাগের মতো।
৩. রক্ত বিক্রেতা: উন্নত বা উচ্চ আয়ের দেশে পেশাদার কোনো রক্তদাতা নেই বললেই চলে। কারণ তাদের প্রয়োজনীয় রক্ত স্বেচ্ছ রক্তদাতাদের কাছ থেকেই সংগৃহিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে রক্ত বিক্রি হয়। বাংলাদেশে রক্ত বিক্রেতার সংখ্যা অনেক। তবে পেশাদার রক্তদাতাদের অনেকেই মাদকসেবী। সাধারণত বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠা ব্যঙের ছাতার মতো ক্লিনিকে পেশাদার রক্তদাতারা রক্ত বিক্রি করে। অথচ খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে ওইসব ক্লিনিকের রক্ত সংগ্রহ করার অনুমতি নেই। কারণ রক্ত সংগ্রহ করার জন্য বেশ কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। এসব ছোট ছোট ক্লিনিকে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই রক্ত সংগ্রহ করা হয়। ছোট ছোট এসব ক্লিনিক মাদকসেবীদের কাছ থেকে জেনেশুনেই রক্ত সংগ্রহের পর তা উচ্চমূল্যে বিক্রি করে।
রক্তদাতা বিশেষ করে যারা তরুণ প্রজন্ম তাদের মনে রাখা দরকার, প্রতি তিনমাস পর পর একজন সুস্থ্য মানুষের রক্তের সেল পরিবর্তন হয়। তাই চারমাস পর পর যে কোনো সুস্থ্য মানুষ রক্ত দিতে পারে। বাংলাদেশের তরুণদের অর্ধেকও যদি নিয়মিত রক্ত দেয় তবে বাংলাদেশে কোনো রোগীকেই রক্ত স্বল্পতাজনিত কারণে মরতে হবে না।
১৪ জুন ২০২০