কামরুল ইসলাম, সুইডেন থেকে: তার মানে সেখানে বদলি আর প্রমোশন বাণিজ্যও নেই! এমন দেশ আবার আছে নাকি? হ্যাঁ, আছে। উত্তর গোলার্ধের গণতান্ত্রিক দেশ সুইডেনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা এমনই। এখানে কেন্দ্রীয়, বিভাগীয়, স্থানীয় প্রশাসন, এমনকি সশস্ত্র বাহিনীতেও অনেক ক্ষেত্রে পদন্নোতি বা বদলি চলে না। তাহলে উদাহরণ দিয়ে এবং আমাদের দেশের সাথে তুলনা করে আলোচনা করা যাবে বদলি আর প্রমোশন ব্যবস্থার ভালো বা খারাপ দিকগুলো।
ধরুন, আপনার পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালীর মাইজদীতে। আপনি সেখানে স্কুল, কলেজ শেষ করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন চট্টগ্রামে। এরপর চাকরি খুঁজতে গিয়ে দেখলেন সরকারি চাকরির জন্য আপনাকে ঢাকায় গিয়ে আবেদন করতে হবে, লিখিত পরীক্ষা এবং ইন্টারভিউ সবই হবে ঢাকায়। এ পর্যায়ে আপনি জানেন না চাকরি পেলে কোথায় আপনার নিয়োগ হবে। কোথায় আপনাকে নতুন করে বাসস্থান খুঁজে নিতে হবে, নুতন করে আবার গোড়াপত্তন করতে হবে। দেখা গেল আপনি অবশেষে চাকরি পেয়েছেন কিন্তু আপনার পোস্টিং হয়েছে রাজশাহীতে। তার মানে আপনাকে নোয়াখালী থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে অনেক খরচ সামলিয়ে এবং বিস্তর চোখের পানি ফেলে মা, বাবা, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবাইকে ফেলে ঢাকা হয়ে রাজশাহী চলে যেতে হলো। তারপর দুবছর চাকরির মাথায় বিয়ে করলেন এবং তিন বছর শেষে আপনাদের সংসারে এলো আদরের সন্তান। চার বছরের মাথায় আদেশ এলো বদলীর। আপনাকে যেতে হবে রাঙ্গামাটি। আর আপনার স্থানে আসবেন সাতক্ষীরা থেকে একজন। আপনার ডিপার্টমেন্ট আপনাদের যাতায়াতের কিছুটা খরচ বহন করবে। তার মানে সে খরচটা জনসাধারণের ট্যাক্স থেকে যাবে। উপরন্ত আপনার নিজস্ব খরচটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। অনেকেই সে খরচের বোঝাটা কোন কন্ট্রাকটারের কাঁধে চাপিয়ে দেন। আর কন্ট্রাকটার তো সেটা নিজ পকেট থেকে দিচ্ছেন না। সেটা সে তার বিলের সাথে যোগ করে পুষিয়ে নেবে। সেটা আবার অনিচ্ছাকৃতভাবে জনগণের ট্যাক্সের ঘাড়েই চড়বে। তাই নয় কি?
এরপর আপনার ছেলে মেয়ে বড় হচ্ছে আর আপনার চিন্তা বাড়ছে তাদের ভবিষ্যৎ ভেবে। কোথায় তাদের ভালো লেখাপড়া হবে। ভালো স্কুল আর সেটা যদি ইংলিশ মিডিয়াম হতে হয় তাহলে আর সবার মত আপনিও ঢাকার দিকে তাকাবেন। ঢাকাতেই মনে হবে যেন রয়েছে সব ভালো স্কুল! ঢাকার পাশাপাশি বিভাগীয় অন্য শহরেও রয়েছে ভালো স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়। তবে সামাজিকতা বলেওতো একটা কথা আছে। আপনার বন্ধু বান্ধব আর আত্মীয়স্বজন সবার ছেলে মেয়ে ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করবে আর আপনার সন্তানেরা অন্য শহরে, সেটা স্ট্যাটাসে প্রভাব ফেলে। এটা ছাড়া আরোও একটি প্রাশাসনিক বিশেষ ব্যাপার আছে। আপনার প্রমোশনের সাথে সাথে ঢাকার বাইরে থাকার পরিকল্পনা থাকলেও আপনি ঢাকায় আসতে বাধ্য। কারণ ঢাকা ছাড়া আপনার জন্য কোন পোস্ট অন্য কোথাও নেই। ঢাকাতেই তো রয়েছে প্রধান কার্যালয়।
তাহলে কি দাঁড়ালে ব্যাপারটা! একটু ক্যারিয়ার করতে চাইলে, মেধাকে প্রমাণ করতে চাইলে এবং ছেলে মেয়েদের ভালো লেখাপড়া করাতে চাইলে আপনাকে অনিচ্ছা সত্বেও ঢাকা মুখি হতে হচ্ছে। অথবা ঢাকার মত বড় কোন শহরে। আপনি চাইলেও আপনার নিজ শহর, যেখানে আপনি বড় হয়েছেন, যেখানে আপনার অনেক বন্ধুবান্ধব রয়েছে, সর্বপরি আপনার পিতা মাতা রয়েছেন সেখানে আপনি ঢাকায় বড় হওয়া কলিগের মত একই সুযোগ সুবিধে নিয়ে থাকতে পারছেন না। আপনাকে বৈষ্যমতায় পড়তে হবে, কিছুটা হলেও।
এবার দেখা যাক আমাদের দেশের এ ব্যবস্থার ভালো এবং খারাপ দিকগুলো।
ভালো দিকগুলোঃ
১. প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে, বিভিন্ন স্থানে চাকরি করে এবং বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সাথে কাজ করে প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারা।
২. দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এবং তার ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য দেখা।
৩. সকল পর্যায়ের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য পর্যালোচনা।
৪. শ্যালক নীতি অর্থাৎ পরিচিতজনের প্রতি বৈষম্য নীতি কম পরিলক্ষিত হওয়া।
খারাপ দিকগুলোঃ
১. জন্মস্থান বা রুট থেকে বিচ্ছিন্ন।
২. পরিবার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে বসবাস করা এবং তাতে করে সন্তানদের লেখাপড়ায় স্থায়ীত্ব নষ্ট হওয়া।
৩. নিজ এবং সরকারের বিস্তর খরচ বাড়া।
৪. সরকারি এবং বেসরকারি কাজে সবাইকে বড় শহরে আসতে বাধ্য হওয়া।
৫. সাধারণ অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়া।
৬. প্রমোশন এবং বদলি নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির প্রকোপ।
৭. থানা, মহকুমা, উপজেলা, জেলা, বিভাগ এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সাথে দূরত্ব বেড়ে যাওয়া আর প্রতিযোগিতমূলক সম্পর্ক তৈরি হওয়া।
৮. প্রশাসনের সাথে সাধারণ মানুষের দূরত্ব বেড়ে যাওয়া।
সুইডেন
এখানে প্রতিটি প্রশাসন সেটা সরকারি, কেন্দ্রীয় কিংবা স্থানীয় বা বেসরকারি হোক না কেন, সেখানে বদলি বলে কোন কথা নেই। চাকরির প্রতিটি স্থানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার নিয়ম এখানে। প্রশাসনের ভেতর থেকে যেমন বাইরে থেকেও তেমন যে কেউ আবেদন করতে পারেন। আবেদনকারী যদি বৈষম্য’র শিকার হন তাহলে তিনি প্রশাসনিক আদালতে যেতে পারেন। এখানে প্রায়ই প্রশাসনকে বৈষম্যতার জন্য দন্ডিত করে জরিমানা করা হয়।
প্রমোশন বলেও কোন কথা নেই এখানে। রাজনৈতিক পর্যায়ে নিয়োগ আছে বৈকি। ম্যানেজেমেন্টের উপর দিকে কোন পদ খালি হলে একইভাবে সে পদের জন্যও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হয়। যে কোন পদে অভিজ্ঞতা এবং অ্যাকাডেমিক যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেবার নিয়ম রয়েছে। এর ব্যতিক্রম বা বৈষম্য হলে ভুক্তভোগী আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন।
প্রশাসনিক বিভিন্ন বিভাগের প্রধান কার্যালয় সুইডেনের বিভিন্ন শহরে স্থানান্তর করা হয়েছে আজ থেকে কয়েক যুগ আগে। এখনও মাঝে সাঝে কোন কোন বিভাগের প্রধান কার্যালয় রাজধানী স্টকহোম থেকে অন্য শহরে স্থানান্তর করা হয়ে থাকে। তখন কার্যালয়ের সবাইকে বিকল্প ব্যবস্থায় সুযোগ দেয়া হয় বাসস্থান পরিবর্তন করে নতুন কার্যালয়ে সরে আসার জন্য। যারা এ সুযোগ নেয়না তাদেরকে আইন অনুযায়ী ছয় থেকে এক বছরের বেতন দিয়ে চাকরি থেকে বিদায় করে দেয়া হয়। এরা পরবর্তীতে নতুন চাকরি খুঁজে নেয়।
বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বিস্তর অমিল সুইডেনের
সুইডেনে শিক্ষা নীতি, স্বাস্থ্য নীতি এবং প্রশাসনিক বিধি ব্যবস্থা সারা দেশে, সকল পর্যায়ে একই মাপকাঠিতে চলে। তার অর্থ স্কুল যেখানেই থাকুক না কেন তার মান একইভাবে বিচার করা হয়। হাসপাতাল যেখানেই স্থাপিত হোক না কেন তার মান এবং ব্যবস্থা সারা দেশে একই রকম। তারতম্য যখনই ধরা পড়ে তখনই সেটা নিয়ে রাজনৈতিক পর্যায়ে বিতর্ক হয় এবং সেটা প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া হয়। স্থায়ী সমাধান না হলে পরবর্তী নির্বাচনে সেটার প্রভাব স্থানীয়, প্রাদেশিক বা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে পড়বেই।
সাধরনতঃ নিয়োগ নিয়ে সচরাচর কোন দুর্নীতির কথা শোনা যায় না। রাজনৈতিক নিয়োগ নিয়ে মাঝে মাঝে বিতর্ক ওঠে। যদিওবা রাজনৈতিক নিয়োগে যার যার নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী সব দলের কোটা থাকে। কোনো বিতর্কিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়োগ দিলে সচরাচর বিতর্কের ঝড় ওঠে।
সুইডেনের একটি বড় সাফল্য হলো, সাধারন মানুষকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা ন্যায়বিচারের জন্য দূরে যেতে হয় না। প্রতিটি জেলায় রয়েছে এগুলোর সুব্যবস্থা। নিজ এলাকায় চাকরি পাওয়া গেলে সাধারনত কেউ অন্য শহরে পাড়ি দেয় না। অনেকেই আবার মাঝ-বয়সে নিজ শহরে ফিরে যায়, স্বল্প বেতনের চাকরি হলেও। কারণ সেখানে হয়তোবা তার পৈতৃক বাড়ি রয়েছে এবং বাড়ি ভাড়ার মত বড় একটি খরচ সংকুলান হবে বলে।
রাজনৈতিক এবং প্রাশাসনিক কাঠামোর মত উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থাও এখানে বিকেন্দ্রীভ‚ত। নিজ শহরে ডাক্তারি পড়তে না পারলেও নিকটবর্তী শহরে সেটার ব্যবস্থা থাকবে। সেখানে বাসস্থান ব্যবস্থার দায়িত্ব কিছুটা হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি নিয়ে থাকে।
বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে আরো মজবুত করে তৃণমূল মানুষের দ্বারে পৌঁছানোর প্রয়োজন রয়েছে। সুইডিশ ব্যবস্থাকে পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে এ থেকে কতটুকু বাংলাদেশে কার্যকর করা যাবে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সে দিকে নজর দেয়া দরকার।
এক নজরে সুইডেন
আয়তন ঃ ৪৪৭ ৪২৫ বর্গ কিলোমিটার
জনসংখ্যা (আগস্ট ২০২১): ১০ ৪২৭ ২৯৬ জন
জনসংখ্যার ঘনত্ব: ২৩,৩ জন, প্রতি বর্গ কিলোমিটারে
জিডিপি (২০১৯): ৫৬৩ ৮৮২ বিলিয়ন ডলার, মাথাপিছু ৫৪৬২৮ ডলার
কাউন্টি: ২১ টি
পৌরসভা/জিলা: ২৯০ টি
মন্ত্রণালয়
দেশ পরিচালনার জন্য সুইডিশ সরকারের অধীনে ১২টি মন্ত্রণালয় রয়েছে। সেগুলো রাজধানী স্টকহোমেই অবস্থিত। একজন মন্ত্রীসহ একাধিক সহকারি মন্ত্রী মন্ত্রণালয় পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন।
অন্যান্য প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান
দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়গুলোকে ক্রমান্বয়ে রাজধানী স্টকহোম থেকে সরিয়ে সুইডেনের বিভিন্ন শহরে স্থানান্তর করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের এ দাবী ছিল বহুদিন থেকে। তাই ৯০ শতকের প্রথম থেকেই স্থানান্তর শুরু হয়ে এখনো চলছে। স্থানান্তরিত কয়েকটি প্রশাসনের উদাহরণ নিচে দেওয়া হলোঃ
সুইডিশ সমুদ্র প্রশাসন এবং সুইডিশ মাইগ্রেশন অ্যাজেন্সির প্রধান কার্যালয় নরসপিং শহরে। জাতীয় খাদ্য প্রশাসন এবং জাতীয় মেডিকেল পণ্য সংস্থা উপসালা শহরে। সুইডিশ জাতীয় আদালত প্রশাসন ইয়ংশপিং শহরে। সুইডিশ পরিবহন প্রশাসন বোরলেংগে শহরে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বহু কোম্পানি এবং সংস্থার প্রধান কার্যালয় রাজধানীর বাইরে স্থাপিত হয়েছে।
স্টকহোম, সুইডেন
২০২১-১১-০১