হাফিজুর রহমান: আইনের জগতে একটি সরল ধাঁধার বহুল প্রচলন দেখা যায়। ধাঁধাটি হল, বলুনতো এমন কোনো অপরাধ আছে যা করলে শাস্তি হয় না কিন্তু করার উদ্যোগ গ্রহণ করলে শাস্তি হয়? ধাঁধার উত্তরটি অনেকেরই জানা আবার অনেকেই হয়তো জানা নেই। এর সহজ উত্তর ‘আত্মহত্যা’। মূলতঃ এই অপরাধটি সংঘটিত হলে যিনি অপরাধী তিনি সকল আইন এবং পৃথিবীর সকল শাস্তির ঊর্ধ্বে চলে যান। অর্থাৎ যিনি আত্মহত্যা করেন তাকে পৃথিবীতে শাস্তি দেয়া যায় না। কিন্তু যিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করে সফল হতে পারেন না, তাকে শাস্তি প্রদান করে পৃথিবীতে এ ধরনের কাজকে নিরুৎসাহিত করা হয়। আপনার জীবন আপনার নিকট যেমন মূল্যবান কিংবা আপনার কোন ভ্রান্ত ধারনায় মূল্য না থাকুক অন্যদের নিকট তা অতি মূল্যবান। কবির ভাষায় বলতে গেলে ‘মানব জীবন সার, এমন পাবে না আর’।
আত্মহত্যা কি?
পৃথিবীর সুন্দর সব কিছুকে ফেলে স্বেচ্ছায় নিজ জীবনাবসানের নাম আত্মহত্যা। আত্মহত্যা মানে নিজেকে নিজে খুন করা। কোন প্রাণী নিজের জীবন নিজেই শেষ করা বা নিজ জীবন হত্যা করাকে আমরা আত্মহত্যা বলে থাকি। অনেকের মতে নিজ আত্মাকে হত্যা করার নামান্তর আত্মহত্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞানুসারে আত্মহত্যা হলো স্বজ্ঞানে এমন একটি ভয়ানক কাজ করা যা ঐ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায় এবং ব্যক্তি ঐ কাজের প্রত্যাশিত ফলাফল সম্পর্কে পূর্ব থেকেই পুরোপুরি অবগত থাকে। আবার নিজ আত্মাকে চরম যন্ত্রণা আর কষ্ট দিয়ে নিজেকে হত্যার নাম ‘আত্মহত্যা’ বলে থাকেন অনেকে। আক্ষরিক অর্থে আত্ম অর্থ নিজ, অর্থাৎ নিজেকে হত্যা করার নামই আত্মহত্যা।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আত্মহত্যা একটি প্রতিরোধযোগ্য ভয়াবহ মেডিকেল এবং সামাজিক সমস্যা। আত্মহত্যা কোন সমস্যার সমাধান নয় বরং সমস্যার কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি তিন সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যার অপচেষ্টা (Attempt to suicide) এবং প্রতি মিনিটে একজন আত্মহত্যা করে। সারা বিশ্বে বছরে ৮ লক্ষাধিক মানুষ আত্মহত্যাজনিত কারণে প্রাণ হারায়। যদিও কোরআন, বাইবেলসহ সব ধর্মগ্রন্থেই আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলা হয়েছে। এছাড়াও বর্তমান বিশ্বের প্রায় সকল দেশের প্রচলিত আইনেই আত্মহত্যার চেষ্টাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। আর এই আত্মহত্যা প্রতিরোধকল্পে জনসচেতনতা বাড়াতে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে প্রতিবছর ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস উদযাপন করে থাকে বিশ্বব্যাপী।
অন্য একটি তথ্যে জানা যায়, প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে আর আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় এর প্রায় ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি মানুষ। অর্থাৎ এদের সবার রয়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা। ৪০ লাখ টিনএজার প্রতি বছর আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। এদের মধ্যে এক লাখ সফল হয়ে চলে যায় পরপারে। যুদ্ধ, টেরোরিস্ট বা সন্ত্রাসী আক্রমণ কিংবা খুনের শিকার হয়েও আত্মহত্যার সমতুল্য এত মানুষ মারা যায়না পৃথিবীতে। বিশ্বজুড়ে বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন আত্মহত্যা করে প্রায় ৩ হাজার জন। ব্রিটেনে হৃদরোগ আর ক্যান্সারের পরেই তৃতীয় যে কারণে প্রাণহানি ঘটে তা হচ্ছে আত্মহত্যা। আমেরিকায় প্রতি ১৫ থেকে ২০ মিনিটে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে, দিনে প্রায় ৮৫ জন। আমাদের দেশেও এ হার কম নয়। মায়ের সঙ্গে অভিমান করে দূর গাঁয়ের কিশোরী মেয়ে যেমন কীটনাশককে অবলম্বন করে পালিয়ে যায় জীবন থেকে, তেমনই মেগাসিটির অভিজাত উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিও তার অন্তর্জগতের তাড়িত বোধ থেকে রেহাই পেতে বেছে নেয় আত্মহননের পথ। এ তালিকা থেকে মুক্তি পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক, চিকিৎসক, পুলিশ, প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক, অভিনয়শিল্পী, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া ছোট শিশুও।
বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের গবেষণায় দেখা যায়, যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে তাদের অধিকাংশই মানসিকরোগে আক্রান্ত থাকে। যারা অধিকাংশই পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধবের কাছে আত্মহত্যার ইচ্ছা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে প্রকাশ করে থাকে। পরিসংখ্যানে আরো পাওয়া যায় যারা আত্মহত্যা করেছে তাদের ৮০ ভাগই আত্মহত্যার পূর্বাভাস দিয়েছে কিন্তু যথাযথ গুরুত্ব পায়নি বলে কেউ প্রতিরোধের ব্যবস্থাও গ্রহণ করেনি। মানুষ যখন হতাশায় আক্রান্ত হয় এবং সেই সমস্যা থেকে বের হওয়ার আর কোন পথ খুঁজে না পায়, চারপাশে কাউকে আপন করে না পায় তখনই কেবল এই পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যার পূর্বে ব্যক্তি নানাভাবে পূর্বাভাস দেয়, একটু লক্ষ্য করলেই তাকে বাঁচানো সম্ভব। আত্মহত্যা সম্পূর্ণ মানসিক সমস্যা না হলেও একে নিয়ন্ত্রণ করে মন। যখন একজন মানুষ তার সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য কোন পথ খোলা পায়না, তখন তার মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। আর এই হতাশা তার ভিতরের আক্রমণাত্মক ভাবটাকে বাড়িয়ে দেয়। তখন যদি কেউ যুক্তি দিয়ে তাকে না বোঝায় যে তার সমস্যা সমাধানের ভিন্ন ভিন্ন পথ আছে, তখনই সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড এর মতে মানুষের ভিতর গঠনমূলক ও ধ্বংসাত্মক দুটি সত্তা কাজ করে। তবে সবার ব্যক্তিত্ব সমান নয় বলে সাধারণতঃ কোন একটা সত্তা ব্যক্তির মধ্যে বেশি দেখা যায়। তবে কখনও পরিবেশগত বা মানসিকগত কারণে এই বৈশিষ্ট্য একটা আরেকটার উপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকতে পারে। মানুষের ক্রোধ যখন তার ভিতরটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় তখনই সে সাধারণতঃ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। তবে এই সময় তার পেছনে আশাহীনতা, হতাশা, অপরাধবোধ, অপমান, প্রতিশোধস্পৃহা ইত্যাদি সক্রিয় থাকে। তখন সে জীবনটাকে অর্থহীন মনে করে, তাই সে পেতে চায় বিষন্ন জীবন থেকে মুক্তি। তবে অনেক মনোবিজ্ঞানী এর পিছনে bipolar disorder (বাই-পোলার ডিজঅর্ডার)কে দায়ী করেন। তাদের মতে যারা বিষন্নতা এবং একইসাথে হতাশায় পালাক্রমে ভোগেন তাদের মধ্যেই এই প্রবণতা অধিকহারে দেখা যায়। Neurochemist-দের মতে serotonin (যা বিপাক ক্রিয়ার একটি উপজাত) এর সাথে আত্মহত্যার একট গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যারা আত্মহত্যা করেছে তাদের মস্তিষ্ক অস্ত্রোপচার করে এই সেরোটনিনের ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। অপর কিছুসংখ্যক গবেষণায় দেখা গেছে যারা আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করতে চায় তারা সাধারণতঃ সমস্যা সমাধানের বিষয়ে অন্যদের চেয়ে বেশি অনমনীয় এবং চিন্তাধারায় তারা কম নমনীয় থাকেন। ফলে তাদের পক্ষে সমাধানের বিকল্প সুবিধাগুলো সহজে চোখে পড়েনা।
জটিল মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে থাকে। ১০ শতাংশ সিজোফ্রেনিক রোগী আত্মহত্যা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০-৪০ শতাংশ রোগী অসুস্থ থাকা অবস্থায় অন্তত একবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। সিজোফ্রেনিক রোগীদের মধ্যে যাদের বিষন্নতার উপসর্গ থাকে, তারা আত্মহত্যাপ্রবণ হতে পারে। এছাড়া আরেকটি বিষয় এদের আত্মহত্যার কারণ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সিজোফ্রেনিক রোগী ‘গায়েবী আওয়াজ’ শোনে, চিকিৎসা শাস্ত্রের পরিভাষায় যাকে ‘অডিটরি হ্যালুসিনেশন’ বলা হয়। অনেকে শোনে, কেউ তাকে উপদেশ বা আদেশ দিচ্ছে আত্মহত্যা করতে। অনেক রোগীই এই ‘গায়েবী’ আদেশটি অবশ্য পালনীয় হিসেবে গণ্য করে। অনেক সিজোফ্রেনিক রোগীর মধ্যে অস্বাভাবিক সন্দেহ ও ভয় থাকে- যা তাকে পর্যায়ক্রমে সমাজ থেকে দূরে ঠেলে দেয়, একাকি করে রাখে, যাতে রোগী এক সময় আত্মহত্যা করে। আবার কোন কোন রোগী সুস্থ হওয়ার পর্যায়েও আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকতে পারে। কারণ, এ সময়টায় অনেকের রোগটি সম্পর্কে ধারণা হয়, ফলে নিজেদের অন্যদের চেয়ে আলাদা ও অস্বাভাবিক মনে করে। সবচেয়ে যে কারণে বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে তার নাম বিষন্নতা। বিষন্নতা মানসিক রোগগুলোর মধ্যে অত্যন্ত সাধারণ এবং ধ্বংসাত্মক একটি রোগ। কারণ এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি জীবন চলার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে এবং কোন কোন রোগী অবলীলায় আত্মহত্যার মাধ্যমে মুক্তি পেতে চেষ্টা করে এবং কখনো কখনো সফলও হয়। তাই ভবিষ্যতে হয়তো বিষন্নতা রোগটি পৃথিবীতে ‘কিলার ডিজিজ’ হিসেবে পরিচিতি পাবে। যে কোনো লোক যে কোনো সময়ে বিষন্নতায় আক্রান্ত হতে পারে। তবে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে শতকরা ১০০ ভাগ রোগীই ভালো হয়ে যেতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে গেছে আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা। সাধারণতঃ দু’ভাবে আত্মহত্যা সংঘটিত হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিকল্পনার মাধ্যমে আত্মহত্যা করে আর একটি হলো তাৎক্ষণিক উত্তেজনা বা তাড়নায় করে। যাকে বলে ইমপালসিভ আত্মহত্যা। পরিকল্পনাকারীদের মনে প্রথমে আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগে, ইচ্ছার পর পরিকল্পনা করে সে, তার পর আত্মহত্যার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। বড় ধরনের বিষন্নতারোগের শেষ পরিণতি হচ্ছে পরিকল্পনার মাধ্যমে আত্মহত্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ন্যাশনাল সার্ভের রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, দেশের ৪.৬ শতাংশ অ্যাডাল্ট জনগোষ্ঠী গুরুতর বিষন্নতা রোগে ভূগছে। দেশের মোট বয়স্ক জনগোষ্ঠী ১৪ কোটি ধরা হলে, গুরুতর বিষন্নতা রোগীর সংখ্যা প্রায় ৬৪ লাখ ৮০ হাজার। অর্থাৎ এই বিশালসংখ্যক মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সমাজে। দেশে হতাশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আরো বেশি, ব্যাপক। হতাশা ও বিষন্নতা রোগ এক নয়। এ ক্ষেত্রে সশস্ত্র বিভাগের সদস্যদের জন্য এটা আরো বেশি উদ্বেগজনক। কারণ তাদের হাতে থাকে মারণাস্ত্র। আর হতাশা ওবিষন্নতায় আক্রান্ত এসব মানুষ খুব সহজেই আত্মহত্যা করার সুযোগ পায়।
এবার দেখা যাক ধর্মে আত্মহত্যা নিয়ে কি বলা হয়েছে
ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা থেকে বিরত থাকতে মহান আল্লাহ্ তা’আলা বিশেষভাবে নির্দেশ দান করেছেন এবং এর পরিণামের কথা ভাববার জন্য কঠোর ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির বর্ণনা দিয়ে মহা পবিত্র আল কুরআনে আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। সূরা নিসা ২৯-৩০ নং আয়াতে বলা হয়েছে ‘আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু এবং যে কেউ জুলুম করে, অন্যায়ভাবে উহা করবে, অবশ্য আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করবো, আল্লাহর পক্ষে উহা সহজসাধ্য।’
হাদিসে বলা হয়েছে
(ক) সাহাবা আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ঐভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে। (খ) হযরত জুনদুব ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের পূর্বেকার এক লোক আহত হয়ে সে ব্যথা সহ্য করতে পারেনি। তাই সে একখানা চাকু দিয়ে নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলে। এর পর রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে বড় তাড়াহুড়ো করে ফেলেছে। তাই আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম (বুখারি) (গ) জাবের বিন সামুরা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স.) এর নিকট এমন এক ব্যক্তির লাশ আনা হলো যে লোহার ফলা দ্বারা আত্মহত্যা করেছে, রাসূল (সঃ) তার জানাযার নামায পড়ান নি। (বুখারি ও মুসিলম)
খ্রিস্টান ধর্মে বাইবেল অনুযায়ী, আত্মহত্যা নিশ্চিত করে না যে একজন ব্যক্তি স্বর্গে প্রবেশের অধিকার পাবে কি না৷ যদি কোনো অসংরক্ষিত ব্যক্তি আত্মহত্যা করে, তবে সে শুধুমাত্র নরকের দিকে নিজের যাত্রা ‘ত্বরান্বিত’ করা ছাড়া আর কিছুই করল না৷ যদিও, যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করল সে প্রভূ খ্রিস্টকে নিজের মুক্তিদাতা হিসেবে অস্বীকার করেছে বলেই নরকে যাবে, আত্মহত্যা করার জন্য নয়৷ যে খ্রিস্টান আত্মহত্যা করে তার সম্পর্কে বাইবেলে বলা হয়েছে, বাইবেল আমাদের শেখায়, যে মুহূর্ত থেকে আমরা প্রভু খ্রিস্টকে বিশ্বাস করতে শুরু করবো, আমরা শাশ্বত জীবন পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পাবো (জন্ ৩:১৬)৷ বাইবেল অনুযায়ী, খ্রিস্টানরা দ্বিধাহীনভাবে জানে যে তারা শাশ্বত জীবনের অধিকারী (১ জন্ ৫:১৩)৷ কোনো কিছুই একজন খ্রিস্টানকে ঈশ্বরের ভালোবাসা পাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে না (রোমানস্ ৮:৩৮-৩৯)৷
আত্মহত্যা হল ঈশ্বরের বিরুদ্ধে একটি ভয়ানক পাপ৷ বাইবেল অনুযায়ী, আত্মহত্যা হল খুন; এটি সবসময়েই ভুল৷ কোনো ব্যক্তি যদি নিজেকে খ্রিস্টান বলে দাবি করা সত্তে¡ও আত্মহত্যা করে তবে তার বিশ্বাসের উৎকর্ষতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগবে৷ ষষ্ঠ শতকে খ্রিস্টধর্মে আত্মহত্যাকে খুন হিসেবে উল্লেখ করে নিজেকে হত্যা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, আত্মহত্যাকারির শেষকৃত্য না করার জন্য। ষষ্ঠ শতকে খ্রিস্টানের গির্জা আত্মহত্যাকে অনৈতিক ও খুন হিসেবে চিহ্নিত করে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের এ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়; এমনকি ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত এই ধর্মের অনুসারী কেউ আত্মহত্যা করলে তার শেষকৃত্য পর্যন্ত করত না।
সনাতন ধর্মের পূরাণে উল্লেখ করা হয়েছে, রামের মৃত্যুর পর অযোধ্যায় গণহারে আত্মহত্যা করে মানুষ। কিন্তু মহাভারতে বলা হয়েছে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর অনাহারে আত্মহত্যার চিন্তা করলে যুধিষ্ঠিরকে স্বেচ্ছামৃত্যুর পরিকল্পনা বাতিলের পরামর্শ দেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, অর্থাৎ হিন্দুধর্মেও আত্মহত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
গৌতম বুদ্ধের ‘অহিংসা পরম ধর্ম, জীব হত্যা মহাপাপ’ এই মতবাদ মতে নিজ জীবন বা অন্য কোন জীব হত্যাকে সম্পূর্ণভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
ইহুদিরাও আত্মহত্যাকে পাপকর্ম বলেই মনে করে।
এবার দেখা যাক আইন কি বলে
আইনের চোখেও আত্মহত্যার অপচেষ্টা গ্রহণকারী একজন অপরাধী। আত্মহত্যার পর যেমন থানায় খবর দিতে হয়, তেমনি আত্মহত্যার চেষ্টা করলেও থানায় খবর জানানোর কথা বলা হয়েছে। আত্মহত্যার অপচেষ্টা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
পেনাল কোড ৩০৯ ধারায় বলা আছে, যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করবার উদ্যোগ করে এবং অনুরূপ অপরাধ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে কোন কাজ করে, সেই ব্যক্তি বিনাশ্রম কারাদণ্ড যাহার মেয়াদ এক বৎসর পর্যন্ত হইতে পারে বা অর্থদণ্ড বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। অর্থাৎ আইন নিজের জীবন হরণের চেষ্টাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে এবং এ কারণে যে তার স্বাভাবিক জীবনকে ব্যহত করার অধিকার তার নেই। কারণ এতে অপরাধ সংঘটন করে নিজেকে রেহাই দিতে উদগ্রীব হবে। এতে অপরাধ বাড়বে বৈ কমবে না।
বাংলাদেশে প্রচলিত পেনাল কোড ৩০৬ ধারায় আত্মহত্যা প্ররোচনার শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি আত্মহত্যা করলে অনুরূপ আত্মহত্যা অনুষ্ঠানে সহায়তাকারী ব্যক্তির ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। ৩০৫ ধারায় বলা হয়েছে, শিশু বা পাগল বা মাতাল ব্যক্তির আত্মহত্যার প্ররোচনাদানকারীকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ক ধারায় নারীর আত্মহত্যায় প্ররোচনার শাস্তির বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোনো নারীর সম্মতি ছাড়া বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত কোনো কার্য দ্বারা সম্ভ্রমহানি হওয়ার প্রত্যক্ষ কারণে কোনো নারী আত্মহত্যা করলে ওই নারীকে অনুরূপ কার্য দ্বারা আত্মহত্যা করতে প্ররোচনা দেয়া হয়েছে বলা হবে। এ আইনেও ১০ বছর শাস্তির বিধান করা হয়েছে।
আত্মহত্যা সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের কিছু ব্যতিক্রমী তথ্য
১৯৬১ সালের আগ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা করাকেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো। আর ১৮৩০ সাল নাগাদতো আইনই ছিল কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। ১৮৩০ সাল নাগাদ কেউ যদি আত্মহত্যা করত তার লাশের বুকে পেরেক বিদ্ধ করে কবরে দেওয়া হত। ১৯৬১ সালের অ্যাক্ট অনুযায়ী আত্মহত্যার চেষ্টা করা বা এতে প্ররোচনা দেওয়া দুইটাই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
২০১১ সালে চাইনীজ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, চীনে বছরে ২ লাখ ৮৭ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। দেশটিতে শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে আত্মহত্যার হার ৩ গুণ বেশি। অর্থাৎ ৭৫ ভাগ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে প্রত্যন্ত এলাকায়। আর মাত্র ২৫ ভাগ ঘটে শহরে। ওই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটিতে পুরুষের চেয়ে নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। চীনে মানব মৃত্যুর পঞ্চম কারণ আত্মহত্যা। তবে ১৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান কারণই আত্মহত্যা। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চীনে প্রতিবছর অন্তত ২০ লাখ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। বৃটেনের ‘দ্য সুইসাইড অ্যাক্ট ১৯৬১’ অনুসারে আত্মহত্যায় সহায়তা, প্ররোচনা কিংবা আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধুকরণ একটি অপরাধ। যার শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ বছর পর্যন্ত হাজতবাস।
আত্মহত্যাসংক্রান্ত কিছু তথ্য
১. মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে তিনগুন আত্মহত্যার চেষ্টা করে- কিন্তু মরেনা। আর আত্মহত্যার হার মেয়েদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে বেশি (তবে বর্তমানে মেয়েদের আত্মহত্যার হার ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে) ২. যারা একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে তারা সাধারণত দ্বিতীয়বার আর সেমুখী হয়না। ৩. যুবক বয়সে মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা বেশি করে কিন্তু সফল বেশি হয় বয়স্করা। ৪. যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বিশ মিনিটে একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু তারপরও দেখা যায় তারা প্রতি দুইশ জনে একজন সফল হয়। ৫. বসন্ত ও শীতকালে আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়। ৬. আত্মহত্যার চেষ্টার আগে যারা দার্শনিক কথা লিখে তারা মূলত মরেনা, কিন্তু যারা স্বাভাবিক খবর লিখে যায় তারা মরে। ৭. গণমাধ্যমে প্রকাশিত আত্মহত্যার বিবরণী মানুষকে আত্মহত্যার জন্যে প্ররোচিত করে। ৮. সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে মানুষ গলায় ফাঁস নিয়ে ঝুলে পড়ার পর পরই নিজেই আবার বাঁচার চেষ্টা করে। তবে গলায় ফাঁস নিয়ে ঝুলে পড়ামাত্রই মানুষের গলার নিম্নাঙ্গসমূহ অকার্যকর হয়ে যায়। বিধায় সে মানসিকভাবে বাঁচার জন্য ইচ্ছা বা আপ্রাণ চেষ্টা করলেও সেটা আর নিজের দ্বারা সম্ভব হয় না। তবে অন্য কোনো মানুষের সামান্য সাহায্য পেলেই অর্থাৎ অন্য কোনো মাধ্যমে সে পায়ে সামান্য শক্তি পেলেই মৃত্যু থেকে রক্ষা পায়। ৯. একইভাবে মৃত্যুর উদ্দেশ্যে বিষপান করার পর মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ বাঁচার চেষ্টা করে, সে চেষ্টা সকলের ক্ষেত্রে সফল হয় না। ১০. আত্মহত্যাকারীদের হার সবচেয়ে বেশি বিশ্বের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে।
আত্মহত্যার ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিকে মনে রাখতে হবে,
(ক) আত্মহত্যা মানে, আইন লঙ্ঘন করা, অপরাধ করা। (খ) আত্মহত্যা মানে, ধর্মীয় অনুশাসন অবজ্ঞা করা। (গ) আত্মহত্যা মানে সমাজে পচনশীল ক্ষত বাড়িয়ে দেয়া, সমাজকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়া। (ঘ) আত্মহত্যা কখনো প্রতিবাদের অস্ত্র হতে পারে না- প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না। (ঙ) আত্মহত্যার ইচ্ছা, আগ্রহ জয় করতে হবে। (চ) জয় করার নামই জীবন। (ছ) জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া হচ্ছে হীনম্মন্যতা। (জ) আত্মহত্যা মানে অন্যায়ের সাথে আপস করা। (ঝ) আত্মহত্যা মানে খুব সহজে হার মানা।
বর্তমান সময়ে সমাজে আত্মহত্যা সংঘটিত হলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মিডিয়া। মিডিয়ার কারণে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহমান আত্মহত্যার নির্মম ঘটনাগুলো জানতে পারছে সকলে। কী কারণে আত্মহত্যা ঘটেছে, পারিবারিক, সামাজিক কী অবক্ষয়ের কারণে আত্মহত্যার জন্য প্ররোচিত হচ্ছে আত্মহননকারী, সব জেনেও সহানুভূতি নিয়ে আমরা দাঁড়াচ্ছি আত্মহত্যাকারীর পাশে। দরদী মনের ব্যাকুলতার কারণে এমনটি করে থাকে মিডিয়াকর্মী কিংবা সাধারণ জনগোষ্ঠী। না! আত্মহত্যার পর সহানুভূতি দেখানো যাবে না আত্মহত্যাকারীকে। যদি আত্মহত্যাকারীকে হিরো কিংবা হিরোইন বানিয়ে তোলা হয় মিডিয়াতে, যে বিশাল জনগোষ্ঠী আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছে (৪.৬ শতাংশ অ্যাডাল্ট জনগোষ্ঠী), তারা প্ররোচিত হবে আত্মহত্যার জন্য। সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে অবক্ষয়ের পাশাপাশি এটাও আত্মহত্যার হার বেড়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ।
হ্যাঁ! আসুন আমাদের দাঁড়াতে হবে আত্মহত্যা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তির পাশে। আত্মহত্যার ঝুঁকি শনাক্ত করতে হবে স্বজনদের। ঝুঁকি শনাক্ত করে আত্মহত্যার পূর্বেই ভূমিকা রাখতে হবে আমাদের। কোন বিষন্নতা বা প্রতিবাদ নয়, আসুন একসাথে সকলে পৃথিবীতে বেঁচে থেকে বিষন্নতাকে জয় করি বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি। আর কোনো আত্মহত্যা নয়, আত্মপোলব্ধি করি পৃথিবীর সকল সুন্দরের। অসুন্দরকে দূর করি মৃত্যুকে দূরে সরিয়ে। বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলি হাতে রেখে হাত। ধর্ম বর্ণ বা গোষ্ঠি নয়, আমাদের পরিচয় হোক আমরা সকলেই মানুষ। চাই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি, স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য আমরা আমাদেরকে প্রস্তুত করি। নিজেকে ভালোবাসতে শিখি, যারা আপনাকে নিয়ে ভাবছে-ভালোবাসছে তাদেরকে ভালোবাসতে শিখি, অন্ততঃ তাদের জন্য হলেও বাঁচতে শিখি। প্রতিজ্ঞা করি আর আত্মহত্যা নয়, সুন্দর সমাজ গড়তে আত্মরক্ষায় নিয়োজিত করি নিজেকে এবং সমাজকে।
হাফিজুর রহমান: প্রবন্ধকার, সাহিত্যিক ও পুলিশ কর্মকর্তা