আসিফ হাসান:
এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে যাবে বলে এক গবেষণায় জানা গেছে। গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে এর বিরাট প্রভাব পড়বে সমাজের ওপর। গবেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি বলছে, জনসংখ্যার এই নিম্নগতির জন্য বিশ্ব একেবারেই প্রস্তুত নয়। এদিকে গত ১১ জুলাই ‘কোভিড-১৯ কে প্রতিরোধ করি, নারী ও কিশোরীর সুস্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করি’ স্লোগানে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালিত হয়েছে। এর কয়েকদিন না যেতেই শোনা যাচ্ছে এমন অবাক করার মতো একটি গবেষণার ফল।
বিবিসি বাংলা তাদের এক প্রতিবেদনে বলছে, যেভাবে জন্ম হার কমছে, তার ফলে এই শতাব্দীর শেষে বিশ্বের প্রায় সব দেশের জনসংখ্যা কমে যাবে। এর মধ্যে জাপান এবং স্পেনসহ ২৩টি দেশের জনসংখ্যা ২১০০ সাল নাগাদ একেবারে অর্ধেক হয়ে যাবে। এর পাশাপাশি প্রায় সব দেশেই জনসংখ্যার অনুপাতে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা অনেকগুন বেড়ে যাবে। যত নতুন শিশু জন্ম নেবে, ৮০ বছর বা তদুর্ধ মানুষের সংখ্যাও হবে প্রায় তার সমান।
বিশ্বের জনসংখ্যা: কি ঘটছে?
একজন নারী গড়ে যত শিশু জন্ম দেয়, তাকে বলে ফার্টিলিটি রেট বা সন্তান জন্ম দানের হার। এই ফার্টিলিটি রেট অনেকদিন ধরেই কমছে। যখন কোন দেশে ফার্টিলিটি রেট ২.১ এর নিচে নেমে যায়, তখন সেই দেশের জনসংখ্যা কমতে থাকে। ১৯৫০ সালে বিশ্বে ফার্টিলিটি রেট ছিল ৪ দশমিক ৭। অর্থাৎ একজন মা গড়ে ৪ দশমিক ৭টি শিশু জন্ম দিতেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস এন্ড ইভালুয়েশনের গবেষকরা বলছেন, ২০১৭ সাল নাগাদ বিশ্বে এই ফার্টিলিটি রেট প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। তখন ফার্টিলিটি রেট ছিল ২ দশমিক ৪। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে মেডিকেল জার্নাল ‘ল্যান্সেটে’। গবেষকরা বলছেন, এই শতকের শেষে ২১০০ সালে ফার্টিলিটি রেট আরও কমে ১ দশমিক ৭ এ নেমে আসবে। গবেষকরা হিসেব করে বলছেন, বিশ্বের জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে ২০৬৪ সালে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে। তখন বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৯৭০ কোটি। এরপর এটি কমতে শুরু করবে। কমতে কমতে ২১০০ সালে এটি হবে ৮৮০ কোটি। এ ব্যাপারে গবেষকদের একজন প্রফেসর ক্রিস্টোফার মারে বলেন, ‘এটা এক বিরাট ঘটনা। বিশ্বের বেশিরভাগ অংশেরই এখন উত্তরণ ঘটছে কম জনসংখ্যার দিকে। এটি কত বড় একটা ঘটনা হতে যাচ্ছে সেটা নিয়ে চিন্তা করাও আসলে কঠিন। এটা একটা অসাধারণ ঘটনা। আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থাকেই এর জন্য ঢেলে সাজাতে হবে।’
কেন জন্মহার কমছে?
জন্মহার কমে যাওয়ার কথা শুনলে প্রথমেই আমরা যেটা ভাবি- যেমন শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যাওয়া বা এরকম অন্যান্য বিষয়। সত্যিকার অর্থে সেসবের কোন সম্পর্ক আসলে নেই। এর মূল কারণ হল- শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ। এর পাশাপাশি জন্মনিরোধকের সহজলভ্যতা। এসব কারণে মেয়েরা এখন কম সন্তান নিতে আগ্রহী। বিশ্বজুড়েই জন্মহার যে কমছে, তাকে কিন্তু অনেকদিক থেকেই একটি সাফল্য হিসেবে গণ্য করা হয়।
যেসব দেশের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে
জাপানের জনসংখ্যা ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। সে বছর দেশটির জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৮০ লাখ। এরপর থেকেই কমতে শুরু করে জাপানের জনসংখ্যা। এই শতাব্দীর শেষে এসে জাপানের জনসংখ্যা কমে দাঁড়াবে ৫ কোটি ৩০ লাখের নিচে। ইতালির জনসংখ্যাতেও এরকম নাটকীয় ধস নামবে। এই শতাব্দীর শেষে ৬ কোটি ১০ লাখ থেকে তাদের জনসংখ্যা কমে দাঁড়াবে ২ কোটি ৮০ লাখে। অর্থাৎ অর্ধেকেরও কম। এই তালিকায় আরও রয়েছে- স্পেন, পর্তুগাল, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়াসহ মোট ২৩টি দেশ। এসব দেশেরও জনসংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে যাবে। প্রফেসর ক্রিস্টোফার মারে বলেন, ‘এসব শুনলে আসলে বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে যায়।’
বিশ্বে এখন সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন। চার বছর পর তাদের জনসংখ্যা সর্বোচ্চ ১৪০ কোটিতে গিয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু এরপর থেকেই চীনের জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে। কমতে কমতে ২১০০ সাল নাগাদ দেশটির জনসংখ্যা ৭৩ কোটি ২০ লাখে নেমে আসবে। আর চীনের জায়গায় বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশের জায়গা নেবে ভারত। অন্যদিকে ব্রিটেনের জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে ২০৬৩ সাল নাগাদ সর্বোচ্চ ৭ কোটি ৫০ লাখে পৌঁছাবে। কিন্তু ২১০০ সাল নাগাদ তা কমে দাঁড়াবে ৭ কোটি ১০ লাখে। একটা সময় ১৯৫টি দেশের ১৮৩টিতেই জন্মহার এতোটাই নিচে নেমে যাবে যে, জনসংখ্যা আগের অবস্থায় ধরে রাখা যাবে না। আর এই ব্যাপারটি সারা বিশ্বের জন্যই এক বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
কেন এটাকে সমস্যা বলে মনে করা হচ্ছে?
আপনি হয়তো নিজ থেকে মনে করতে পারেন, জনসংখ্যা কমে যাওয়ার ব্যাপারটি বিশ্বের পরিবেশের জন্য খুব ভালো হবে। এর ফলে কার্বন নির্গমনের হার কমবে। বনাঞ্চল উজাড় করে কৃষিকাজে ব্যবহার করা হবে না। কিন্তু প্রফেসর মারে বলছেন, ‘সেটা হয়তো সত্যি। কিন্তু জনসংখ্যার পুরো বয়স কাঠামোটাই এর ফলে উল্টে যাবে। তরুণ বয়সীর তুলনায় বয়স্ক মানুষের সংখ্যা হবে বেশি। আর এ কারণে নানা রকম নেতিবাচক পরিণতির মুখোমুখি হবে সমাজ।’ এই গবেষণায় ভবিষ্যতের দুইটি দিক তুলে ধরা হয়েছে। তাতে বলা হচ্ছে-
১. ২০১৭ সালে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা যেখানে ৬৮কোটি দশ লাখ, ২১০০ সালে তা কমে দাঁড়াবে ৪০ কোটি দশ লাখে।
২. ২০১৭ সালে যেখানে ৮০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ১০ লাখ, ২১০০ সালে তা দাঁড়াবে ৮৬ কোটি ৬০ লাখে।
প্রফেসর মারে বলেন, ‘এটি এক বিশাল সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। আমি এ নিয়ে ভিষণ চিন্তিত। কারণ আমার আট বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে। আমি চিন্তা করছি তখনকার পৃথিবীটা কেমন হবে।’ ‘এরকম এক বৃদ্ধদের দুনিয়ায় ট্যাক্স দেবে কে? বয়স্কদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ কে যোগাবে? কারা প্রবীণদের দেখাশোনা করবে? তখন কি মানুষ আর কাজ থেকে অবসরে যেতে পারবে?’ যোগ করেন তিনি। প্রফেসর মারে বলছেন, ‘এই সংকট এড়াতে হলে একটা ধারাবাহিক উত্তরণের দরকার হবে।’
এই সমস্যার কি কোনো সমাধান আছে?
ব্রিটেন এবং এরকম কিছু দেশ তাদের জনসংখ্যা বাড়াতে অভিবাসনকে ব্যবহার করছে। যাতে করে জন্মহার কমে যাওয়ায় জনসংখ্যায় যে ঘাটতি, তা পুষিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু যখন সব দেশের জনসংখ্যাই কমতে শুরু করবে, তখন আর এতে কাজ হবে না। প্রফেসর মারে বলেন, ‘সীমান্ত খোলা রাখা হবে কি হবে না, এটা এখন একটা দেশের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। কিন্তু এই অবস্থা থেকে আমরা এমন একটা পরিস্থিতির দিকে যাব, যখন কিনা অভিবাসীদের পাওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হবে। কারণ তখন আর যথেষ্ট অভিবাসীও থাকবে না।’
এদিকে এর মধ্যেই জনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য কিছু দেশ নানা রকম ব্যবস্থা নিচ্ছে। এর মধ্যে আছে- মাতৃত্ব এবং পিতৃত্ব ছুটি বাড়ানো, বিনামূল্যে শিশুদের যত্ন ও দেখাশোনার ব্যবস্থা, আর্থিক প্রণোদনা এবং কর্মক্ষেত্রে বাড়তি অধিকারের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এই সমস্যার কোনো সুস্পষ্ট সমাধান এখনো নেই। সুইডেন নানা চেষ্টা করে তাদের জন্মহার ১ দশমিক ৭ হতে ১ দশমিক ৯ পর্যন্ত বাড়াতে পেরেছে। কিন্তু অন্য অনেক দেশ বহু চেষ্টা করেও জন্মহার বাড়াতে রীতিমত হিমসিম খাচ্ছে। সিঙ্গাপুরে জন্মহার এখনো ১ দশমিক ৩ এ আটকে আছে। প্রফেসর মারে বলেন, ‘অনেক মানুষ এই বিষয়টিকে হেসে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু তারা আসলে কল্পনাই করতে পারে না যে এটা সত্যি ঘটতে চলেছে। তারা মনে করে মহিলারা হয়তো আরও বেশি করে সন্তান নেবে। কিন্তু আপনি যদি একটা সমাধান খুঁজে বের না করেন, তাহলে কিন্তু মানবজাতিই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তবে সেটা এখনো কয়েক শতাব্দী দূরের ব্যাপার।’ তবে এই গবেষণায় নারীর শিক্ষা এবং জন্মনিরোধক সুলভ করার ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হয়েছে, সেটা যেন নষ্ট করা না হয়, সেজন্যে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।
জন্মহার ২ দশমিক ১ এর সীমা কেন গুরুত্বপূর্ণ
স্বাভাবিক গাণিতিক হিসেবে মনে হতে পারে, একটি দম্পতির যদি দুটি সন্তান হয়, তাহলেতো সেটিই জনসংখ্যাকে একই পর্যায়ে রাখার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা যত ভালোই হোক, সব শিশু পরিণত বয়স পর্যন্ত বাঁচে না, স্বাভাবিক আয়ু পায় না। আর দ্বিতীয় ব্যাপার হচ্ছে, জন্ম নেয়া শিশুদের মধ্যে ছেলেদের হার সামান্য বেশি থাকে। এ কারণেই উন্নত বিশ্বে জনসংখ্যা সমান পর্যায়ে রাখতে জন্মহারের সীমা ২ দশমিক ১ নির্ধারণ করা হয়েছে। আর যেসব দেশে শিশু মৃত্যুর হার বেশি, সেসব দেশে জনসংখ্যা একই পর্যায়ে রাখতে হলে জন্মহার এর চেয়েও বেশি হতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা কি বলছেন?
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রফেসর ইব্রাহীম আবুবকর বলছেন, ‘এসব ভবিষ্যদ্বাণীর অর্ধেকও যদি সঠিক হয়, তাহলে অভিবাসন সব দেশের জন্য অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠবে, এটিকে তখন আর একটি বিকল্প হিসেবে দেখলে চলবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদেরকে সফল হতে হলে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে নতুন করে মৌলিক ভাবনা-চিন্তা করতে হবে। মানব সভ্যতার সমৃদ্ধি বা পতনের ক্ষেত্রে কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে কিভাবে বন্টন করা যায়, সেই প্রশ্নটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।’
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা