আবদুল্লাহ আল-হারুন, জার্মানি থেকে: আজ সকালে ঘুম থেকে উঠার পর কেন জানি না মনটায় এক অজানা উথাল-পাতাল ভাব! ঘুম ভেঙ্গে আমার প্রথম ভাবনা, আজ কি বার, কত তারিখ? মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট। মনে হবার পরই শিঁউরে উঠলাম। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে আমি ছিলাম জামালপুরে। সদ্য সরকারি চাকরিচ্যুত হয়ে বিধবা মায়ের কাছে থাকি। স্ত্রী বাপের বাড়ি। রেডিওতে ঘোষক একই ব্যক্তি, যিনি পাকিস্তান আমলেও কয়েকবার সরকার-পরিবর্তন, মিলিটারি শাসন প্রবর্তন ইত্যাদি ঘোষণা করেছেন।
একটা পুরো জাতিকে কি ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বিভ্রান্ত করে দেয়া যায়? সমস্ত বোধ, সহানুভূতি নিষ্ক্রিয় ও নির্জীব করে তাকে বিস্মৃতির তলে নিক্ষিপ্ত করা যায়? যার জন্য সে বিবেকবর্জিত, অকৃতজ্ঞ ও অমানবিক হয়ে যায়? সেদিন বাড়ির বাইরে রাস্তায় গিয়ে একটি লোককেও দুঃখ বা অনুতাপ করতে শুনলাম না। পরিচিত একজন রাজনীতিক (আওয়ামী লীগার নয়) রিক্সায় স্যুটকেস রেখে গ্রামের দিকে যাচ্ছেন। মুখে ভয়, শঙ্কা। যেন কেউ তাকে হত্যা করার জন্য খোলা ছুঁড়ি নিয়ে পেছনে আসছে! রিক্সা একটু থামিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, এই রাস্তায় হাঁটছ কেন? এখনি বাড়ি যাও অথবা কোথাও পালিয়ে যাও। আমাদের কেউ রক্ষা পাবে না। বলেই রিক্সাওয়ালাকে চিৎকার করে বললেন, চালাও যত জোরে পারো।
আমি ভাবলাম, আমাকে কে মারবে? এই নেতাকেই বা কে মারবে? তিনি তো শেখ মুজিবকে কথায় কথায় ধুয়ে দেন? সেদিন রাজনীতির সঙ্গে যার সামান্যতম সম্পর্কও ছিল এবং যে রাজনীতি বাঙলাদেশের পক্ষে, তারা সবাই ভীষণ ভীতসন্ত্রস্ত, ঘাতকের ভয়ে পলাতক। অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে প্রাণ বাঁচাতেই ব্যস্ত!
চারদশকের স্বেচ্ছানির্বাসনে স্মৃতিশক্তির খুবই অবনতি ঘটেছে। বয়সওতো আর কম হল না! বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এই মহাসত্য কথাটি কে বলেছিলেন? ‘বাঙালিদের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মত নেতা, প্রতি পাঁচশ বছরে একজন জন্ম নেন।‘ কথক বাংলাভাষার একজন স্বনামধন্য পণ্ডিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে দীর্র্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। পরে বিভাগীয় প্রধান হন। চাকরি জীবনের শেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ অলংকৃত করেন। এখন প্রয়াত। আমি এই মহামণিষীর কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে তার এই ব্রহ্মবাক্যটির সংশোধন করতে চাই। পদার্থবিদদের মতে পৃথিবীর আয়ু আরও ১০ বিলিয়ন বছর। সংখ্যাটি আপনার আমার সাধারণ মাথায় ঢোকানো অসম্ভব। আমি নিশ্চিত নই, একের পর ৬০/৭০টি শূন্য বসালে হয়ত এটা একটা ফুলস্ক্যাপ কাগজে আড়াআড়িভাবে পুরো লেখা যেতে পারে। আমার অঙ্ক জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। একটা তথ্যই যথেষ্ট। স্কুলে ক্লাস থ্রি থেকে টেন নাগাদ, বছরে দু’টি পরীক্ষার হিসেবে, মেট্রিক ও টেস্টসহ মোটমাট ১৮/২০টি পরীক্ষায় একবারও আমার অঙ্কে পাশ করার সৌভাগ্য হয়নি। মেট্রিক পরীক্ষায় আমার এক সহৃদয় ক্লাসফ্রেন্ড, যিনি সামনের বেঞ্চে বসে তার খাতাটি কড়া ইনভিজিলেটরদের দৃষ্টি এড়িয়ে আমাকে বারকয়েক দেখতে দেন। সেই বদান্যতায় উৎরে যাই। যাক আমি পদার্থবিদ্যা বা অঙ্কশাস্ত্র নিয়ে গবেষণার জন্য এ লেখাটি লিখতে বসিনি। আমার কথা হল, পাঁচশ নয়, আগামী ১০ বিলিয়ন বছরেও আমাদের এই হতভাগ্য বাংলাদেশে শেখ মুজিবের মত নেতা আর জন্মাবে না। যতদিন পৃথিবীর অস্তিত্ব আছে বা যে পর্যন্ত বিধাতার কৃপায় বাঙলাদেশ নামের দেশটি এ ধরাধামে টিকে থাকবে, ততদিনই, আমাদের বাঙালির আগত প্রতিটি প্রজন্মে শেখ মুজিবের মত কোন রাষ্ট্রনেতার আবির্ভাবের আশাটি বিড়ালের শিঁকা ছেড়ার মত অপূর্ণই থেকে যাবে। অগস্ত্যযাত্রার মত শেখ মুজিব আমাদের ও সমস্ত উত্তরসূরীকে চিরকালের মত পিতৃহীন করে চলে গেছেন। সেখানেও তার খুব একটা বাঙালি-সঙ্গের সৌভাগ্য হবে বলে মনে হয় না। কারণ তিনি যেখানে আছেন, সেখানে তো বিশ্বাসঘাতক, স্বার্থপর আর অকৃতজ্ঞদের স্থান নেই। বাঙালিদের মধ্যে স্বাধীনতার পঁয়তাল্লিশ বছর পরেও এদের সংখ্যার কমতি নেই। হয়ত অধিকাংশই কৃষ্ণমেষ!
ধর্ম সম্পর্কে আমি নিরপেক্ষ। তবে মুসলিম পরিবারে জন্ম বলে, বাল্যে কায়দা-কোরান শরিফ পড়তে হয়েছে। স্কুলে আরবির ক্লাস। পরে বামপন্থি রাজনীতির খাতিরে ধর্মের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক শুনেছি, জেনেছি। ইউরোপের মানবিক এবং উদার পরিবেশে মাঝে মাঝে আমি পবিত্র কোরানের বাংলা, ইংরেজি (পরে জার্মান) অনুবাদ পড়ি। মূল কারণ বর্তমানে মুসলমানদের নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের একতরফা ঢালাও সমলোচনা ও একপেশে অভিযোগ। পড়ে আমার যে ধারণা মৌলবাদী ও চরমপন্থিদের সাথে প্রকৃত সংস্কারমুক্ত ও শান্তিবাদী মুসলমানদের কোন সম্পর্ক হতে পারে না। তবে যতটুকু বুঝেছি, তাতে মৌলবাদী বা অমৌলবাদী কোন রাস্তাতেই আজকের বাঙালি মুসলমানদের অধিকাংশই আখেরাতে পুলসেরাতের পুল পার হবার সম্ভাবনা খুব একটা দেখি না।
আত্মার মৃত্যু নেই। আত্মা অবিনশ্বর। বর্তমানে বাঙালিদের স্বেচ্ছাচারিতা, অবিমৃষ্যকারিতা ও বাবা-মা অভিভাবকদের যেন-তেন প্রকারে সন্তানদের সৎ-অসৎ পথে টাকা রোজগারের জন্য চব্বিশ ঘণ্টায় বারো-তেরো ঘণ্টা কোচিং করানো। লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে তাদের জন্য চাকরির ব্যবস্থাকে ‘সন্তান মানুষ’ করার উদ্যোগ প্রত্যক্ষ করে বঙ্গবন্ধুর আত্মা নিশ্চয়ই পরলোকেও সুখে নেই। বাঙালির প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথের রচিত জাতীয় সঙ্গীতকে পরীক্ষায় স্টার পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা অকুন্ঠচিত্তে বলেন এটা নজরুল ইসলামের রচনা! শুনে বঙ্গবন্ধু কি একবারেও ভাবেন, কাদের জন্য আমি ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছি। যার পরিণামে আমার পরিবারের প্রায় সবার অকাল মৃত্যুও ঘটেছে? কাজটা কি ঠিক হয়েছিল? তার এপারেও দুঃখ ছিল অনন্ত। ওপারেও শান্তি নেই। প্রেমিক মাত্রই অন্ধ, বঙ্গবন্ধুর মত বাঙালি প্রেমিক তার ব্যতিক্রম হবেন কেন? প্রকৃত ভালোবাসা ছাড়ানো বড়ই কঠিন। তবে আমরা অন্য সব বাঙালি বোধহয় প্রেম ভুলে গেছি। প্রেমিকতো হত্যাকারী হতে পারে না। তাহলে ৭৫ এর ১৫ আগস্টের নিশীথ রাতে ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারে ওরা কারা ঢুকেছিল?
পলাশী থেকে বত্রিশ নম্বর তো বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। মিরজাফর, জগৎশেঠদের উত্তরসূরিই তো মোস্তাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। মিরজাফরই তো নবাব সিরাজদ্দৌলার সেনাপতি ছিল। জেতা যুদ্ধ তার ষড়যন্ত্রের কারণে হেরে গেল। ক্লাইভের সৈন্যদের বিরুদ্ধে মিরমদন-মোহনলালের নেতৃত্বে নবাবের সৈন্যরা যখন জয়ের সম্মুখীন, তখন বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর বিরাট সৈন্যদল নিয়ে পলাশির এক কোনায় পুতুলের মত দাঁড়িয়ে ছিল! ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রেও বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর একটি অংশ এক জেনারেলের নেতৃত্বে জাতির পিতার হত্যায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি!
কাজেই ১৫ আগস্ট ‘শোক দিবস’ নয়, এটা বাঙালির ‘লজ্জা দিবস’। আসুন অন্ততঃ আজ একটি দিনের জন্য হলেও আমরা আমাদের লোভ-লালসা, চুরি-চামারি, ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, ফাঁকিবাজি, অসত্যচর্চা, অমানবিকতা, নারী-নির্যাতন, অবিচার, অত্যাচার আর দুর্নীতির জন্য পরস্পর পরস্পরকে ঘৃণা করি! আজকে ‘লজ্জা দিবস’ পালন করি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক ইতিহাস, বাংলাদেশের অভ্যুত্থানে তার অবদান ইত্যাদি লেখার জন্য আমার এ রচনাটি নয়। এর জন্য মহাপণ্ডিত ঐতিহাসিক, গবেষকদের অভাব নেই। এসব ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতাও প্রশ্নসাপেক্ষ। এখানে বলে রাখা ভালো, আমি কোনদিনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দলের সমর্থক ছিলাম না। এখন তো দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন যাপনের পর বাঙলাদেশের রাজনীতির কথা ভুলেই গেছি। কোন দলকে সমর্থন-অসমর্থনের প্রশ্নই উঠে না। ছাত্রজীবনে আমার রাজনৈতিক দলটি (পকিস্তান আমলে) বঙ্গবন্ধু শেখ মুিজবের রাজনৈতিক মতাদর্শের পক্ষে ছিল না।
তবে শেখ মুজিবের বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের ঘোষণার ইতিহাস নিয়ে যে যাই ব্যাখ্যা দিক বা বিকৃত করুক, যার মাথায় একটু ঘিলু আছে, সেই জানে, ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে রেসকোর্সে তাঁর ভাষণেই পুর্ব বাংলা আর পশ্চিম পাকিস্তানের তালাকটি সুসম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। ওটিই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। পরে যদি কোন পাকিস্তানি ট্রেনিংপ্রাপ্ত মেজর নিরাপদে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেডিওকক্ষে তা শেখ মুজিবের নামে পড়ে থাকেন এবং পরে বলা হয় তিনিই স্বাধীনতার ঘোষক, তখন না হেসে কি পারা যায়? যেমন হাসি আসে ভাড়াটিয়া ওইসব গবেষকের হাস্যকর যুক্তিতে, যে ‘সেক্সপিয়ারের নাটকগুলো তিনি লেখেননি। ঐ সময়কার ইংল্যান্ডের রানীর এক প্রেমিক লিখেছিলেন’, বা ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনয়েম খান, (কুখ্যাত আয়ুব খানের প্রধান বাঙালি চামচা) তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগীয় প্রধান ড. আবদুল হাইকে বলেছিলেন: আপনারা রবীন্দ্রসংগীত লিখেননা কেন, তাহলেইতো ঐ হিন্দু কবির গান আর আমাদের পাক ভূমিতে (!) গাইবার বা রেডিওতে বাজানোর দরকার হয় না! মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে রাজনৈতিকভাবে মতভেদ থাকলেও, মুক্তিযুদ্ধের সময়তো ‘দেশ স্বাধীন করা’ ছাড়া অন্য কোন রাজনীতিতে স্বাধীনতাকামী কোন বাঙালির সমর্থন থাকার প্রশ্নই উঠে না। আমারও ছিল না কমপক্ষে তখনকার শতকরা ৯৯ জনের মতই।
বাঙালির সামগ্রিক অস্তিত্ত্ব, তার ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের চিরস্থাপনা ও নিরাপত্তা, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব, শাপলা ফুল, কালচে সবুজের উপর সদা উজ্জ্বল সিঁদুরলাল সূর্যের পতাকা, আমরা যারা বিদেশে থাকি তারা আমাদের পাসপোর্টের মলাটে ঐ প্রতীকটি প্রতিনিয়ত দেখি। এ সবইতো বাঙালি জাতির জন্মদাতা বঙ্গবন্ধু তার সন্তানদের প্রতি আমৃত্যু সুখ ও শান্তিতে থাকার মহান অঙ্গিকারের নিকশিত হেম। এ সত্য সূর্যোদয়-সুর্যাস্তের মতই অবিনশ্বর। চাঁদের কলঙ্কের মত ‘ধর্ম নিরপেক্ষতাকে’ শাসনতন্ত্র থেকে কৌশলে সরিয়ে একটা গোঁজামিল দেয়া হয়েছে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে দেশ-বিদেশের অনেক মুরুব্বীকে খুশি রাখতে হয়। এটা অপ্রিয় হলেও সত্য। তৃতীয় বিশে^ ক্ষমতায় থেকে যারা দেশ শাসন করতে চান, জনগণের কল্যাণ চান, তাদের মাঝে মাঝে এরকম তেঁতো ওষুধ গিলতেই হবে!
বাঙালি জাতির লজ্জাবোধ আছে কি? ১৯৭১ এ সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম চলার সময় তথাকথিত কিছু বামপন্থি দল ভারতবর্ষের মাটিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে ও ভারত সরকারের সাহায্যে স্বাধীনতা অর্জনকে দেশদ্রোহিতা আখ্যা দিয়েছিল। তাদের কয়েকজন নেতা একসময় দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে হাসিনা ওয়াজেদের ‘জোট’ সরকারে মন্ত্রীও হয়েছিলেন!
রাজনীতিতে ভোল পাল্টানো নতুন কথা নয়। তবে বাঙলাদেশে এর মাত্রা সমস্ত শালীনতা ও ন্যায়বোধের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। লাখ লাখ নিরপরাধ বাঙালির হত্যাকারী রাজকারদের একজন স্বাধীনতার পর মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে বাঙলাদেশের পতাকা উড়িয়ে বুক উঁচিয়ে চলেছে, তাও আমরা নিরবে দেখেছি। স্বাধীনতা বিরোধী জামাত নেতার মৃত্যুর পর প্রায় জাতীয় কায়দায় তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানও আমরা সহ্য করেছি! এটা সহ্য করা, না নির্লজ্জতা? সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যার কিছুদিন পরেই তার দীর্র্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীরা হত্যা ষড়যন্ত্রের নেপথ্য মহানায়ক মোস্তাকের খুনী সামরিক বাহিনীর তৈরি পুতুল সরকারে দলে দলে যোগদান করা আমরা দেখেছি। চার নেতার জেলে নির্মম হত্যাও নির্বিবাদে মেনে নিয়েছি।
পরিবারের সবাইকে হত্যা যারা করেছে, তাদের বিচার করার জন্য হাসিনা ওয়াজেদ ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেন-দরবার করে একক প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ইতোমধ্যে বেশ কিছু খুনীকে বাঙলাদেশের আইনে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। নিষ্ঠুর হলেও সত্যি, তার এই উদ্যোগে অধিকাংশ বাঙালির সমর্থন থাকলেও নিজের দলেই অনেকে এটা সমর্থন করেন না। হয়ত তারা এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিলেন। তাদের ভয় একসময় বিচারের হাত তাদের দিকেও প্রসারিত হতে পারে!
আমাদের নির্লজ্জতার আরও কিছু উদাহরণ হচ্ছে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও আমরা তর্ক করি, বাঙলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট কে ছিলেন? স্বাধীনতার ঘোষণা কে প্রথম দিয়েছিলেন? বঙ্গবন্ধু হত্যার কিছুদিন পর আওয়ামী লীগের এক সিনিয়র নেতা বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়া প্র্রসঙ্গে লন্ডনে সংবাদিকদের বললেন- ‘ফেরাউনের পতন হয়েছে!’
যে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার এখন উন্নতিশীল রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অন্যতম। অবিশ্বাস্যভাবে হাজার হাজার কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ের অধিকারি। শতকরা ৭০ জন লিখতে-পড়তে পারেন (মেয়েদের হার আরও অনেক বেশি) নারী-শিক্ষার প্রসার, বাল্যবিবাহ রোধ, নিজস্ব আর্থিক ক্ষমতায় পদ্মা সেতুর মত একটি অবিশ্বাস্য বৃহৎ প্রকল্প সমাপ্ত করার প্রতিজ্ঞা, যাকে জার্মানির রাজনীতিকরা তাদের সফল মহিলা চ্যান্সেলার মিসেস মার্কেলের সাথে তুলনা করেন। যখন দেখি ফেসবুকে এক নির্লজ্জ বাঙালি পোস্ট করেছে- ‘যদি সকালে উঠে শুনি হাসিনা ওয়াজেদ মারা গেছেন, তাহলে খুশি হব এই ভেবে এখন একজন পুরুষ আমাদের নেতা হবেন!’ কত বড় জঘন্য কথা! অকৃতজ্ঞ, বেইমান, ক্রিমিনাল আর মোনাফেক না হলে কি এ মন্তব্য করা যায়? এদের প্রকাশ্যে পাথর নিক্ষেপ করে মারলে বা বিশেষ অঙ্গে বাঁশ ঢুকালে কেউ দুঃখ পাবে বলে মনে হয় না।
আমরা গ্রামের অসহায় ও দরিদ্র মেয়ে যারা শহরে এসে গার্মেন্টস-এ কাজ করে তাদের প্রকাশ্যে লাঠি দিয়ে মেরে মাটিতে শুইয়ে ফেলি। আর চারপাশে গোল হয়ে মজা দেখি! একজনও প্রতিবাদ করি না। গ্রামের তথাকথিত মুরুব্বীরা চেয়ারে বসে হাত পাখার বাতাস খান। তারাই এ বিধান দিয়েছেন। বাঙলাদেশের গ্রামেগঞ্জে এখনও বহু নূরজাহান এ ধরনের অত্যাচারের মর্মান্তিক শিকার। কিন্ত আমার বিশ্বাস হাসিনা ওয়াজেদের শাসনে নারীমুক্তির দুয়ার খুলে গেছে। তার শাসনে বাঙলাদেশের নারী তার অধিকারের পথ দেখেছে। বাঙলাদেশের রাস্তাঘাটে দেখা যায় বইপুস্তক হাতে ছাত্রের চেয়ে ছাত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি। হাসিনা ওয়াজেদের সরকার যদি গত ১২ বছর বাঙলাদেশের হাল না ধরতেন, তাহলে বাঙলাদেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ ভারতকেও ছাড়িয়ে যেত। নারী যে এককভাবে পুরুষের সম্পত্তি নয়, বাঙলাদেশের নারীরা এটা অন্ততঃ বুঝে গেছেন। ধর্মের দোহাই দিয়েও আর এ ডাল কখনই গেলানো যাবে না! তাদের চোঁখ খুলে গেছে।
আমি এ লেখাটি লিখছি, দুটি ব্যক্তিগত বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি আমার আমরণ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য। ’৭৫ এর জুনে তৎকালিন রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবের স্বাক্ষরে আমার ঐ সময়কার একটি জেলা সদরের ক্ষুদ্র আমলার চাকরিটি (তৎকালীন সরকারি কর্মচারি প্রশাসন আইন: পিও-৪০) মাত্র ৪ মাস পরেই চলে গেল। সঙ্গত কারণেই তখন খুব ক্রুদ্ধ ও অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম। আমার মরহুম বড় ভাই আবদুল্লাহ আল মামুন তখন বাংলাদেশে সংস্কৃতির আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বঙ্গবন্ধুর পরিবার তার সাপ্তাহিক টিভি নাটকের ভক্ত ছিলেন। একবার রামপুরায় টিভি সেন্টার পরিদর্শন করার সময় বঙ্গবন্ধু নিজেই এ কথাটি সকলের সামনে বলেছিলেন। কাজেই তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, একবার বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করলেই আমার চাকরিটি পুনর্বহাল হবেই। বঙ্গবন্ধুর একজন একান্ত ব্যক্তিগত সুহৃদ ভাইয়েরও পরম বন্ধু। তাকে দিয়ে যোগাযোগ করার পর বঙ্গবন্ধু নাকি বলেছিলেন, এখন তিনি জেলা গভর্নরদের নিযুক্তি নিয়ে ব্যস্ত। মাসখানেক পরে অবশ্যই তিনি আমার ভাইয়ের সাথে দেখা করবেন ও তার কথা শুনবেন। একথাও নাকি বলেছিলেন, অধিকাংশ সময়েই তিনি ফাইল সই করার সময় দেখেন না। সচিবরা নিয়ে আসে। তিনি সরল বিশ্বাসে সই করেন। এধরনেরই হয়ত কিছু একটা হয়েছিল আমার বরখাস্তের আদেশে সই করার সময়। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তিনি বলেছিলেন, ‘এটা নিয়ে ভাইকে এবং আমাকে চিন্তা না করতে। ব্যাপার খুব একটা গুরুতর কিছু নয়।‘ এক মাস পরেই বঙ্গবন্ধু নৃশংসভাবে সপরিবারে নিহত হলেন। বাঙলাদেশের সৌভাগ্য, তার দুই কন্যা বেঁচে গেলেন। দুজনই তখন দেশের বাইরে। আমার সরকারি চাকরি করা আর হল না! ঢাকায় এ ফার্মে ও ফার্মে ৩-৪টি চাকরি করে ’৭৭ এ দেশ ছাড়তে হল মেজর জিয়ার রাজত্বকালে। ’৭৫-এর ঘটনার জের। আমার প্রথম কৃতজ্ঞতাটি, দেশত্যাগ করার সুযোগটি বঙ্গবন্ধুর অজান্তে আমার বরখাস্তের ফাইলে স্বাক্ষর করার জন্যই পেয়েছিলাম।
আমি আজন্ম ঘরকুনো ছিলাম। শহরেই কারো বাড়িতে যেতে দ্বিধা বোধ করতাম। সরকারি চাকরি যাবার পর ও বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষিতে পরে এমন কিছু ঘটনা ঘটল যে আমি নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও দেশ ছাড়াতে বাধ্য হয়েছিলাম। তারপর প্রায় ৪৫ বছর হয়ে গেছে। ১৯৯২ সাল থেকে আমি জার্মানির নাগরিক। এখানেই ২০১০ সালে অবসর নিয়েছি। অর্ধেক দুনিয়া ঘুরেছি। কিছু লেখালেখি করি। কয়েকটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কয়েকজন মহান ব্যক্তিত্বের সাথে স্বল্পকালীন সাক্ষাতের স্মৃতিও জমা হয়েছে। গত ২০০৮ সালে থেকে আমি নিয়মিত দেশে যাই। ২০১১ সাল থেকে নতুন সংসারও হয়েছে দেশে। আমি খুবই সুখী এখন। কারো বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। সবই বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরের কৃপা! অন্যথায় বাঙলাদেশে সরকারি আমলা হয়ে এতদিনে চাকরি এবং দুনিয়া দুটি থেকেই রিটায়ার হয়ে যেতাম এবং তা বহু আগেই! কবরের উপরে ঘাস গজাতো। হয়ত আর খুঁজেই পাওয়া যেত না। আমার দীর্ঘায়ু ও সুস্থ জীবন সবই বঙ্গবন্ধুর দান!
শেখ মুজিবের প্রতি আমার দ্বিতীয় কৃতজ্ঞতা, তৎকালিন জার্মান সরকারের সাথে তার ’৭৩ সালে করা সাংস্কৃতিক চুক্তি। এই চুক্তির অন্যতম ধারা অনুযায়ী আমি গ্রিসে দেড়মাস থাকার পর ভিসা ছাড়াই জার্মানে আসি। আজও ইউরোপেই আছি। বাঙালিদের জন্য এ বিশেষ সুযোগটি ’৮০ সালে উঠিয়ে দেন জার্মান সরকার। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত জার্মানিতে থাকব কিনা জানিনা। দেশে বাকি জীবনটা কাটানোর একটা তীব্র তাগিদ সর্বদা অনুভব করি। মাতৃভূমির কোন বিকল্প নেই।
ভাগ্যিস ’৭৫ এর জুনে শেখ মুজিব অজান্তে ফাইলে সই করে আমার চাকরিটি খতম করেছিলেন। তা না হলে আমাকে দেশে আমলা হয়ে মিকি মাউস জিয়া আর ক্লাউন এরশাদ সরকারের সেবা করতে হত। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের পদসেবা করতে হত।
হয়ত বেঁচে থাকলে বঙ্গবন্ধু আমার চাকরি ফিরিয়ে দিতেন। এরকম লাখ লাখ উপকার তিনি আজীবন বাঙালিদের জন্য করে গেছেন। আমাকে দেশত্যাগ করতে হতো না। বাঙালি হিসেবে তার অকাল মৃত্যুতে আমি খুবই দুঃখী। আবার জার্মান জীবনের দিকে তাকিয়ে আমি তার প্রতি চিরকৃতজ্ঞও বটে।
মিসেস জেনারেলের (আরেক মহিলা!) রাজত্বের সময় স্বাধীনতার শত্রু, আলবদর, রাজাকার আর জামাতিদের দখলে আমার পরম প্রিয় বাংলা মা যেভাবে অপমানিত ও অপদস্থ হয়েছে, স্বৈরাচারের অপচ্ছায়ায় সে লাঞ্ছিত আর বেআব্রু রূপ, তা নিজের চোখে দেখার অমানসিক যন্ত্রণা থেকে তো পরিত্রাণ পেয়েছিলাম। এটা পলায়ন মানি। আমার দারিদ্র্য, সমস্যাক্লান্ত কোটি দেশবাসীর কোন কাজেই তো আমি আসছি না। বিধাতাকে ধন্যবাদ ঐ ডাকিনীর হাত থেকে আরেক মহিয়সী মহিলা বাঙলাদেশকে রক্ষা করেছেন। অঘটন ত ঘটেই। কে জানে হয়ত সামনের কোনো এক দিনে আমার কোনো এক দুঃখিনী মায়ের গর্ভে দেশের শত্রু ও বলাৎকারীদের সমূলে উৎপাটিত করতে আবার সত্যিই আরেক শেখ মুজিব জন্ম নেবেন-
‘দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি।’
আজকের বাংলাদেশে কিছু অভিশপ্ত, দূষিত ও বারাঙ্গনা রাজনীতিক, তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবি যত যাই বলুক, তাদের ভাঁড় ও ভণ্ড সমর্থকরা যতই চেঁচাক বা গলাবাজি করুক- যতদিন চন্দ্র-সূর্যের উদয়-অস্ত হবে, জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মহান অবদান ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাঙলাদেশ’ মহাবিশ্বের ধ্বংসঅবধি পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। যেমন আমেরিকায় জর্জ ওয়াশিংটন, দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতে গান্ধি, চীনে মাও সেতুং এবং ভিয়েতনামে হো চি মিন।
জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বাঙলাদেশ।
নয়ে-ইজেনবুর্গ, জার্মানি