নূরুল আমিন রোকন: বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হচ্ছে চর্যাপদ। খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে সিদ্ধাচার্যগণের রচিত এসব চর্যাগীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল আধ্যাত্মিক রহস্যময় সাধনার মাধ্যমে সত্যকে লাভ করা। অর্থাৎ এগুলো ছিল আধ্যাত্মিক সাধন সংগীত। বিষয়বস্তুর দিক থেকে এসব সাধন সংগীত পুরোপুরি আধ্যাত্মিক হওয়া সত্তে¡ও এতে তৎকালীন সমাজ জীবনের যে বাস্তব রূপ চিত্রিত হয়েছে, জীবনরসিক কাব্য পাঠক এবং ঐতিহাসিকগণের কাছে তা হয়ে উঠেছে অত্যন্ত মূল্যবান ও চিত্তাকর্ষক সামগ্রী।
যদিও সমাজচিত্র অঙ্কন করাই চর্যাকারদের আসল উদ্দেশ্য ছিলনা, বৌদ্ধ সহজিয়া সাধক স¤প্রদায়ের গুহ্য সাধন পদ্ধতির গোপন কথা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে কাজ করাই ছিল এসবের মূল লক্ষ্য। তথাপিও এসব রচনায় সমকালীন লোক জীবনের একান্ত খুঁটি-নাটি বাস্তব চিত্রই ফুটে উঠেছে। যা আধ্যাত্মিক সাহিত্যে তো বটেই; সম্ভবত প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের খুব কম নিদর্শনেই পাওয়া যায়। এদিক থেকে বিবেচনা করলে নির্দ্বিধায় বলা চলে চর্যাপদগুলো বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের প্রায় একক এবং অদ্বিতীয় নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন।
যদিও সবধরণের সাহিত্যেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমাজের রীতি নীতি আচার অনুষ্ঠানের প্রতিফলন ঘটে এবং কোন বিশেষ যুগের সাহিত্যে সে যুগের সামাজিক পরিবেশ খুঁজে নাও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আধ্যাত্মিক সাধন সঙ্গীতের ক্ষেত্রে কবিকে যেখানে সর্বদা তত্ত¡ ব্যাখ্যা ও বিন্যাসে ব্যস্ত থাকতে হয় সেখানেও কবির দৃষ্টি এত বেশি করে বাস্তবমুখী হতে পারে একথা ভেবে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না।
অবশ্য চর্যার সাধকেরা ছিলেন সহজ সাধক। সে কারণে জীবনের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলো সম্পর্কে তারা যে মত পোষণ করতেন তা নিরোধের নয়। তবে একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, সহজ সাধনার ভিত্তিটি সাধারণত মায়াবাদীই-হয় এবং চর্যাগীতিগুলোর দার্শনিক ভিত্তিও ছিল মায়াবাদী। এ অবস্থায় নিজেদের ধর্মতত্ত¡ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চর্যাগীতির কবিগণ তৎকালীন সমাজের বাস্তব জীবনের যে রূপকল্প চিত্রিত করেছেন তা বিস্ময়েরই বটে।
চর্যাপদের প্রায় সমসাময়িককালে বাংলাদেশে যে সব সংস্কৃত-প্রাকৃত-অপভ্রংশ সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল, সেগুলো প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের প্রত্যক্ষ উপকরণ হিসেবে বিবেচ্য নয়। বৌদ্ধ সহজিয়া সিদ্ধাচার্যদের রচিত চর্যাপদগুলোই বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন- ১৯০৭ সালের পূর্বে এ তথ্যও জানা যায়নি। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর তিনবার নেপাল ভ্রমণের শেষবার (তৃতীয়বার) ১৯০৭ সালে নেপালের রাজ দরবারের গ্রন্থাগার থেকে বাংলা সাহিত্যের মহা মূল্যবান সম্পদ চর্যাগীতির কতগুলো পদ উদ্ধার করেন। উদ্ধারকৃত চর্যাপদের এই পুঁথিতে ৫১টি গান ছিল। তন্মধ্যে একটি (১১সংখ্যক) পদ টীকাকার কর্তৃক ব্যাখ্যায়িত হয়নি। তাছাড়া পুঁথির কয়েকটি পাতা নষ্ট হওয়ায় তিনটি সম্পূর্ণ (২৪, ২৫, ৪৮সংখ্যক) পদ এবং একটি পদের (২৩ সংখ্যক) শেষাংশ পাওয়া যায়নি, তাই পুঁথিতে সর্বমোট সাড়ে ৪৬ টি পদ পাওয়া গেছে। এর লিপিকাল ১২ বা ১৪ থেকে ১৬ শতকের মধ্যে বলে অনুমান করা হয়। তবে ১১৯৯ সালে লিপিকৃত ‘পঞ্চাকার’ নামের পুঁথির লিপির সাথে এর সাদৃশ্য বিবেচনা করে কেউ কেউ এর লিপিকাল ১২ শতক বলে মনে করেন। পরে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ১৯১৬ সালে (১৩২৩ সনে) ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ নামে সেসব পদ এবং সরহপাদ, কৃষ্ণপাদের দোহা, ও ডাকার্ণব এ চারটি পুঁথি একত্রে ‘হাজার বছরের পুরাণ বাংলা ভাষার বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এগুলোর মধ্যে একমাত্র ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ই প্রচীন বাংলা ভাষায় লেখা। অপর তিনটি রচিত অপভ্রংশ ভাষায়। তাই একমাত্র ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ই বাংলার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য সম্পদ। এটি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে বিরাট শূন্যস্থান পূরণ করে দিয়েছিল।
বিজয়চন্দ্র মজুমদার ১৯২০ সালে প্রথম চর্যাপদের ভাষা নিয়ে আলোচনা করেন। ড. সুণীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ঙৎরমরহ ধহফ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ ঃযব খধহমঁধমব (ঙউইখ) নামক বিখ্যাত গ্রন্থে ১৯২৬ সালে সর্বপ্রথম এগুলোর ভাষাতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যাপদের ধর্মমত নিয়ে ১৯২৭ সালে প্রথম আলোচনা করেন এবং ১৯৪২ সালে চর্যাপদের সঠিক পাঠ নির্ণয় করে আলোচনার পথ সহজতর করেন। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক ১৯৩৮ সালে চর্যার তিব্বতি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ড. শশীভূষণ দাসগুপ্ত ১৯৪৬ সালে চর্যাগীতির অর্ন্তনিহিত তত্তে¡র ব্যাখ্যা প্রকাশ করেন। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য, বৌদ্ধ সহজযান ও চর্যাগীতিকা নিয়ে বিহারের প্রখ্যাত পÐিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন ইংরেজি ও হিন্দিতে প্রচুর গবেষণা করেন। ড. তারাপদ মুখোপাধ্যায় চর্যাপদ থেকে বিশেষ্য, সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের রূপ এবং বাক্য গঠনরীতির স্বরূপ দৃষ্টান্তসহ দেখিয়েছেন।
সমাজ চিরকালই শ্রেণিবিভক্ত। আর শ্রেণিবিভক্ত সমাজের বিভিন্ন স্তরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক মতপার্থক্য থাকাও নতুন কিছু নয়। চর্যাপদের যুগেও যে সমাজে এই শ্রেণি বিভাগ ছিল চর্যাপদে সন্নিবেশিত পদগুলোই তার বাস্তব নিদর্শন। সমকালীন দরিদ্র বাঙালির নিত্যদিনের অভাব, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, আক্ষেপ, বেদনা-পীড়িত জীবনের করুণ বাস্তব চিত্রের নিদর্শন হিসেবে চর্যাপদ যথেষ্ট। চর্যার বিভিন্ন পংক্তিতে করুণ বেদনার আর্তি, দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ের, নিরানন্দের ব্যথাময় সুর অনুরণিত। তখনকার সমাজ ছিল দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতিহীন, অসাম্য, অনিয়ম,অত্যাচার ও অনাচারে জরাজীর্ণ। মানব জীবনের সদা কাক্সিক্ষত সুখ ও আনন্দ থেকে সে সময়ে মানুষ ছিল বঞ্চিত।
চর্যাপদে বিধৃত কবিতাগুলোতে ঐশ্বর্য ও দাম্ভিক রাজা উজিরের কথা নেই। এতে আছে সেকালের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সরল সহজ বর্ণনা। এ বর্ণনায় লোকের জীবন, জীবিকা, শ্রম ও বিশ্রাম, সঙ্গীত উপকরণের শিল্পসম্মত বিবরণ পাওয়া যায়। এখানে উলেখ্য যে, অতি প্রাচীনকালে আর্য শাসন আমলে বর্ণাশ্রম প্রথার জন্ম নেয়। এই বর্ণাশ্রম প্রথা জাত বর্ণ বিন্যাসের ভিত্তি হিসেবে মর্যাদা পায়। বর্ণাশ্রমভিত্তিক সমাজ বিন্যাসের সংস্কার আজও ভারতবর্ষের সমস্ত মানুষের মনে সুদৃঢ়। সেন ও বর্মণ শাসন আমলে আর্য পূর্ব বাঙালি লোকসংস্কৃতি আর্য ব্রাহ্মণ্য বর্ণাশ্রম প্রথার কাছে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। স্পর্শ বিচারে নানাবিধ বিধি নিষেধ ব্রাহ্মণ শাসিত সমাজে উগ্রতর প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে থাকে।
ব্রাহ্মণ্যবাদঃ বহুকাল পূর্ব থেকেই আর্য ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের দোষে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি ছিল ঘৃণিত ও পরিত্যক্ত। প্রাচীন জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু কালক্রমে উত্তর ভারতীয় আর্যদের সাথে বাংলাদেশ ও বাঙালির পরিচয় নিবিড়তর হয়ে উঠে। আর্য-বাঙালির মিলন মিশ্রণের ফলে বাংলাদেশের তৎকালীন সামাজিক গড়নের মধ্যে এক নয়া উদ্দীপনার সঞ্চার করে। তবে আর্য সংস্কৃতির ধারক ব্রাহ্মণদের স্থান নির্ধারিত হয় সবার উপরে।
চর্যাপদের যুগেও নিম্ন শ্রেণির সমাজ তথা কোটির শ্রমিক লোকেরাই সমাজে ছিল অবহেলিত। আর্থিক দিকেও তারা ছিল রীতিমত বিপর্যস্ত। অন্ত্যজ অস্পৃশ্য হিসেবে তাদের বাসস্থানপর্যন্ত সমাজে উচ্চশ্রেণির লোকদের বসতির আশ-পাশে হতে পারতো না। দূরে নগরের বাইরে নির্জন অরণ্যে কিংবা পর্বতের গাত্রে কিংবা বস্তিতে ছিল তাদের বসবাস। বেশ কয়েকটি চর্যায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ১০ নং চর্যায় পদকার কৃষ্ণপাদানাম (কাহ্নপাদানাম) লিখেছেনঃ
নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহোরি কুড়ি আ।
ছোই ছোই জাসি বামহণ নাড়ি আ
আলো ডোম্বি তোএসম করিব মই সাঙ্গ।
নিঘিণ কাহ্ন কাপালি জোই লাঙ্গ
‘ওগো ডোম্বি তোমার কুড়েখানি নগরের বাইরে। তুমি সে ব্রাহ্মণ নেড়েকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাও। ওগো ডোম্বি আমি তোমাকে সাঙ্গা করব। আমি কানু কাপালিক, নির্ঘৃণ এবং উলঙ্গ যোগী।’
২৮ নং চর্যায় পদকার শবরপাদানাম লিখেছেনঃ
উঞ্চা উঞ্চা পাবত তহিঁ বসই সবরী বালী।
মোরাঙ্গ পীচ্ছ পরিহাণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী
‘উচুঁ উচুঁ পর্বত,সেখানে বাস করে সবরী বালিকা। ময়ূরের পুচ্ছ পরিধান করে সবরী, গলায় গুঞ্জার মালা।’
৩৩ নং চর্যায় পদকার ঢেণ পাদানাম লিখেছেনঃ
টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী।
হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী
বেঙ্গসঁ সাপ চঢ়িল জাই।
দুহিল দুধু কি বেল্টে সামাই
বলদ বিআএল গবি আ বাঁঝে।
পীঢ়া দুহিঅই এ তীনি সাঝে
জো সো বুধী সোহি নিবুধী।
জো সো চোর সোহি সাধী
নিতি নিতি সিআলা সিহে সম জুঝই।
ঢেণ্টণ পাএর গীত বিরলে বুঝই
‘বস্তিতে আমার ঘর, প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে ভাত নেই, (অথচ) প্রেমিক (ভিড় করে)। ব্যাঙ কর্তৃক সাপ আক্রান্ত হয়। দোয়ানো দুধ কি বাঁটে প্রবেশ করে? বলদ প্রসব করল, গাই বন্ধ্যা, পাত্র ভরে তাকে দোয়ানো হল এ তিন সন্ধ্যা। যে বুদ্ধিমান, সেই নির্বোধ, যে চোর সেই সাধু। নিত্য নিত্য শৃগাল যুদ্ধ করে সিংহের সঙ্গে। ঢেল্লাপাদের গীত অল্পলোকেই বুঝে।’
উপরে উল্লিখিত পদগুলোর বর্ণনা থেকে এ কথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তখনকার দিনে দরিদ্র ডোম, সবর প্রভৃতি নীচ শ্রেণির বাসস্থান ছিল নগরের বাইরে, পর্বতগাত্রে কিংবা টিলায়। তবে উচ্চশ্রেণির লোকদের সাথে তাদের একেবারেই সম্পর্ক ছিলনা এমনটি বলা যাবেনা। অনেক সময় অভিজাত শ্রেণির লোকদের মনোহরণের জন্যে ডোম্বিদের চেষ্টাও ছিল বেশ প্রকট। তদুপরি সার্বিক বিবেচনায় এসব বিষয় সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ছিল অশ্রদ্ধেয়।
জীবিকাঃ এই সমাজবহির্ভূত ডোম, সবর প্রভৃতি নীচ জাতের লোকদের জীবিকা নির্বাহের উপায়গুলোও ছিল অত্যন্তনিম্নমানের এবং চরম অসম্মানজনক। অন্ত্যজ শ্রেণির এসব লোকের দৈনন্দিন কাজকর্মও ছিল হীন ও নিম্নমানের। তাদের প্রাত্যহিক কর্মের মধ্যে ছিল জুয়াখেলা, শিকার করা, মাছ ধরা, নৌকা বাওয়া, চাঙ্গারি বোনা, বনে বনে আহার্য গ্রহণ করা, মদ পান করে মাতাল হওয়া ইত্যাদি। ২৬ নং চর্যায় বাঙালি তাঁতীদের শিল্পচাতুর্যের কথা এবং ডোম জাতির নারীদের তাঁত বুনন ও তুলো ধুনার কথা বর্ণিত হয়েছে একাধিক চর্যাপদে। ২১ নং চর্যায় ইঁদুরের উপদ্রবে কৃষি বিপর্যস্ত হওয়া এবং ৪৫ নং চর্যায় কুঠারের সাহায্যে গাছ কাটার কথা বর্ণিত হয়েছে।
সমাজের এই অসংগতি, অসম বিধি ব্যবস্থা এবং অনাচার-অত্যাচার, দুঃখবোধ এর স্বরূপ অনুধাবন করেই সিদ্ধাচার্যগণ সহজ সাধনায় সমতার ক্ষেত্রে মানবতাকে আহবান করেছিলেন। সামাজিক অবক্ষয়, অবিচার, সংঘাত ও স¤প্রীতির প্রত্যক্ষ অভাব বোধই তাদের কাব্যে মনোময় শূন্যতাবোধ সৃষ্টি করেছে। চর্যাগীতি অনুসারে তাদের জীবিকার যে কয়টি উপায় ছিল প্রধানতম, তা হলো তাত বুনা, তুলো ধুনা, চাঙ্গারি তৈরি করা। যেমনঃ ১০ নং চর্যার শেষাংশে বর্ণিত হয়েছেঃ
তান্তিবিকণহ ডোম্বি অবর মো চাঙ্গিড়া।
তোহোর অন্তরে ছাড়ি নড়-পেড়া
‘ডোম্বি তুমি তন্ত্রী বিক্রয় কর,আর আমাকে (বিক্রয় কর) চাঙ্গারি। তোমার জন্যই নলের পেটরা পরিত্যাগ করলাম।’
সম্ভবত এই নীচ শ্রেণির লোকদের অন্যতম জাতীয় বৃত্তি ছিল নৌকা বাওয়া বা মাছ ধরা। তাই অনেকগুলো চর্যাতেই ব্যবহৃত হয়েছে নৌকার উৎপ্রেক্ষা। বিভিন্ন পদে বার বার এই নৌকার ব্যবহার, খেয়া পারাপার, বাঁশের সাকোর ব্যবহার ও গুণ টানার ভেতর দিয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশের ছবি চর্যায় চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। পারাপারের মাশুল ছিল কড়ি, চর্যায় তারও উল্লেখ আছে। তাছাড়া বেশ ক’টি পদে আছে কিভাবে নৌকা চালাতে হবে, খুঁটি উপড়ে ফেলে কাছি মেলে ধরে নৌকার গুণ টানতে হবে কিভাবে তারও উল্লেখ আছে, কিভাবে নৌকার জল সেচ করতে হবে তারও নির্দেশ করা অছে। যেমন, ৮ নং চর্যায় পদকার ‘কম্বলাম্বরপাদানাম লিখেছেনঃ
খুণ্টি উপাড়ী মেলিলি কাছি।
বাহ তু কামলি সদগুরু পূছি
‘অর্থাৎ খুঁটি উপড়িয়ে কাছি মেলে দিয়ে হে কামলি তুমি সদগুরুকে জিজ্ঞেস করে বেয়ে চল।’ ১৩ নং চর্যায় কৃষ্ণাচার্য্যপাদানাম (কাহ্নপাদানাম) লিখেছেনঃ
তিশরণ ণাবী কিঅ আঠক মারী।
নিঅ দেহ করুণা শূন মেহেরী
তরিত্তা ভবজলধি জিম করি মাঅ সুইণা।
মাঝ বেণী তরঙ্গ মই মুনি আ
পাঞ্চ তথাগত কিঅ কেড় আল।
বাহহ কাঅ কাহ্নিল মাআজাল
১৪নং চর্যায় পদকার ডো¤ী^পাদানাম লিখেছেনঃ
গঙ্গা জউনা মাঝে রে বহই নাঈ।
তহিঁ চড়িলী মাতঙ্গি পোইআ লীলে পার করেই
বাহ তু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা।
সদগুরু পাঅ-পসাএ জাইব পুণু জিণউরা
পাঞ্চ কেড়– আল পড়ন্তে মাঙ্গে পীঠত কাছী বান্ধী।
গঅণ দুখোলে সিঞ্চহু-পাণী ন পইসই সান্ধি
অথবা ১৫ নং চর্যায় শান্তিপাদানাম লিখেছেনঃ
মা আমোহ সমুদারে অন্তন বুঝসি থাহা।
আগে নাবণ ভেলা দীসই ভান্তিন পূছসি নাহা
ইত্যাদি পদে কাছি টানার যে বর্ণনা আছে তাতে পূর্ববঙ্গীয় দড়াজালের কথা মনে করিয়ে দেয়। পূর্ববঙ্গে তখনও দড়াজাল টেনে মাছ ধরার প্রচলন ছিল। এ অবস্থায় যাদের দিয়ে দড়াজাল টানানো হতো তাদেরকে বলা হতো কামলা। এছাড়া দু’টি চর্যায় ব্যাধ বৃত্তির উল্লেখ আছে,যার একটিতে শিকার ধরার রীতির দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে। চার দিক থেকে জাল পেতে হাক ছেড়ে হরিণ শিকারের বর্ণনা আছে ৬ নং চর্যায়। এ শ্রেণির শিকারীদের অন্যতম বৃত্তি ছিল মদ চোয়ান। পদকার বিরুবাপাদানাম রচিত ৩ নং চর্যায় তার স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। যেমনঃ
এক সে শুÐিনী দুই ঘরে সান্ধই।
চীঅণ বাকলত বারুণী বান্ধই
এছাড়া তাদের জীবিকার আরও বিভিন্ন ধরণের অতি নিম্নমানের উপায় বিভিন্ন পদে বর্ণিত হয়েছে। পদকার শান্তি পাদানাম এর ২৬ নং চর্যায় তুলা ধুনাই করে জীবিকা নির্বাহের কথা রয়েছে। যেমনঃ
তুলা ধুণি ধুুণি আঁসুরে আঁসু।
আঁসু ধুণি ধুণি নিরবব সেসু
এছাড়া পদকার চাটিলপাদানাম রচিত ৫ ও ভুসুক‚ষ্পাদানাম ৪৯ নং চর্যায় রয়েছে কুঠার দিয়ে বৃক্ষচ্ছেদনের বর্ণনা।
কৃষ্টি ও কালচারঃ ১০ নং চর্যায় বর্ণিত হয়েছে নট বৃত্তির কথা । যেমনঃ
এক সো পদমা চউসটঠী পাখুড়ি।
তহিঁ চড়ি নাচই ডোম্বি বাপুড়ি
বিনোদনের পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উপায় হিসেবে তাদের নৃত্যগীতের কলাকৌশল ছিল বিচিত্রমুখী। ১০ নং চর্যার উল্লিখিত লাইন দুটি পাঠে চৌষট্টি দলযুক্ত পদ্মের উপর ডোম্বির নৃত্যের কল্পনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় তৎকালে বিচিত্রমুখী নৃত্যগীত প্রচলিত ছিল। ১৭ নং চর্যায়ও সেকালের নাচ গান-বাদ্য অভিনয় কলার কথা জানা যায়। বাঙালি সমাজের নিম্নস্তরের রমনীরা ছিল নৃত্যগীতিপরায়ণা। নাচ গান করে এরা জীবিকা নির্বাহ করতো। দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ, কষ্ট, সামাজিক অশান্তি, মানসিক দুর্দশা, অভাব, অন্নাভাবও কতগুলো চর্যায় উল্লেখ রয়েছে। কাপালিদের সর্বত্র উলঙ্গ অবস্থায় বিচরণের কথা বিধৃত হয়েছে ১১ নং চর্যায়। ৫০ নং চর্যায় রয়েছে মদে মাতাল হওয়ার বর্ণনা। পূর্বেই উদ্ধৃত করা হয়েছে ৩৩ নং পদটি, যার প্রথমাংশে আর্থিক বিপর্যয়ের কারণে বস্তিতে বসবাসরত দরিদ্র জনগোষ্ঠির দুঃখ দুর্দশার করুণ চিত্র এবং শেষাংশর অর্ন্তনিহিত ভাব আধ্যাত্মবোধক হলেও বাইরে যে অসংগতি ফুটে উঠেছে তা মনে হয় সামাজিক অসংগতিরই প্রতিফলন।
সামাজিক অশান্তিও বিপর্যয়ের সুণিপুণ চিত্র ফুটে উঠেছে কয়েকটি চর্যায়। যেমন ৬ নং চর্যায় ভুসুকুপাদানাম লিখেছেনঃ
কাহেরে ঘিনি মেলি অছহু কীস।
বেঢ়িল হাক পড়ই চৌদীস
অপণা মাংসে হরিণা বৈরী।
খনহ ন ছাড়ই ভুসুক অহেরী
তিন ন ছুবই হরিণা পিবই ন পাণী
পদকর্তা এখানে হরিণের রূপকে ধর্মকথা ব্যক্ত করেছেন। এখানে হরিণ বলতে চিত্তকে বোঝানো হয়েছে। চিত্ত হরিণের কি অসহায় অবস্থা, নিজের জন্যেই সে নিজের শত্রæ। এই ভয়ে সে তৃণও স্পর্শ করেনা জলও পান করেনা। এটিও ভয় কিংবা দুঃখের চিত্র। সে সময়েও চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ব্যভিচার ইত্যাদি ছিল তার দৃষ্টান্ত।
২ নং চর্যায় লিখেছেনঃ
কানেট চোরে নিল অধরাতী
আবার চোরের বিরুদ্ধে সতর্কতার বাণীও রয়েছে কয়েকটি পদে। এছাড়া কতগুলো পদে রয়েছে নারী জীবনের দুঃখ ও কষ্টের বর্ণনা। সমাজে যেমন উচ্চশ্রেণির দ্বারা নির্যাতিত, নিঃগৃহিত হতো নিম্নশ্রেণির লোক, তেমনি আবার লোভ লালসা চরিতার্থ করতে নিম্নশ্রেণির লোকেরাও লিপ্ত হতো পাপাচার ও ব্যাভিচারে। এমনি এক গৃহবধূর ব্যাভিচারের ইঙ্গিত দিয়েছেন লেখক কুক্কুরীপাদানাম ২ নং চর্যায়। যেমনঃ
দিবসহি বহুড়ী কাউহি ডর ভাই।
রাতি ভইলে কামরু জাই
অর্থাৎ যে বধুটি দিনের বেলায় কাকের ভয়ে ভীতু ভাণ করে, রাতের বেলায় সবার অগোচরে সে কামরূপ চলে যায়।
বিয়েঃ বিয়ের ব্যাপারে ছিল নানা রকম বিধি নিষেধ। ব্রাহ্মণরা নিম্নবর্ণের যে কোন রমনীকে বিয়ে করতে পারতো। কিন্তু নিম্নবংশের কোন পুরুষ উচ্চবংশের কোন রমনীকে বিয়ে করতে পারতো না। যৌতুকের লোভে ছোট ঘরে বিয়ে করার কথা বিধৃত হয়েছে ১৯ নং চর্যায়। তবে তাদের ধন উপার্জন ও বণ্টনের প্রধান অবলম্বন ছিল ব্যবসা বাণিজ্য।
চর্যাপদের সময়ে বাংলাদেশ অসহ্য আত্মসন্তুুষ্টি, দুর্বল আত্মশক্তি এবং চারিত্রিক কলংকের ক্রমবর্ধমান অভিশাপে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সমগ্র বাংলাদেশই যেন সেই অন্ধকারের প্রেষণে মৃত্যু যন্ত্রণায়, অভাব দৈন্যপীড়িত পার্বতীর মতো করুণ কণ্ঠে ক্রন্দন করছিল।
নৈতিক অধপতনঃ তৎকালীন সমাজের নৈতিক অধপতনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত চর্যাপদে বিধৃত হয়েছে। বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্রে সেকালের যৌন আচারের উল্লেখ পাওয়া যায়। কামনা বাসনা চরিতার্থের ব্যাপারে কোন বর্ণের লোকদের মধ্যেই সংযমের আভাস পাওয়া যায়না। ধর্মের নামে যৌনাচার উৎসাহ পেতে থাকে অষ্টম শতক থেকে। দেবতার নামে উৎসর্গীকৃত দেবদাসীদের সমাজের উচ্চস্তরের লোকেরা কামনা বাসনা পূরণে ব্যবহার করতো। চরিত্রহীনতা, স্তুতিবাদপূর্ণ আত্মপ্রশংসা শুনা, আর সভা নন্দিনীদের নিয়ে ভোগ বিলাসের পরিবেশে রাজসভা থাকতো মুখরিত। ৩৩ সংখ্যক চর্যায় দরিদ্র অস্পৃশ্যের বাড়িতে উচ্চস্তরের যুবকের আনাগোনার চিত্র বর্ণিত হয়েছে।
দারিদ্র্যঃ উচ্চস্তরের লোকদের ভোগবিলাসী জীবন-যাপনের ঠিক বিপরীত অবস্থা ছিল সমাজের নিম্নস্তরের লোকদের। সেখানে বিরাজ করতো অবিচ্ছিন্ন অভাব, দারিদ্র্য, শোষণ ও অত্যাচার-অবিচার। অন্ত্যজরা শহরের প্রান্তেটিলায় ঘর বেঁধে বসবাস করতো। ব্রাহ্মণদের দৃষ্টিতে এরা ছিল অস্পৃশ্য। ব্রাহ্মণরা এদের ছায়া পর্যন্ত মাড়াতো না।
নৈরাজ্যঃ সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে অষ্টম শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে এক নৈরাজ্য ও স্বেচ্ছাচারী সামন্তগোষ্ঠীর স্বৈরাচরণ জনজীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন বিষিয়ে তুলেছিল। ৪, ৩৩, ৩৮, ৪৯ নং চর্যায় চোরের উপদ্রবের কথা জানা গেছে। ধূর্তবাজ, ঠগ, লম্পট, জোচ্চর সমাজে তখনও কম ছিলনা। ইতিহাসের জন্মলগ্ন থেকেই ভাত এদেশবাসীর প্রধান খাদ্য। প্রাকৃত পৈঙ্গলেও বাঙালির ভাতপ্রীতির কথা উল্লেখ রয়েছে। ভাত না থাকলে সংসারে যে কি চরম অবস্থার সৃষ্টি হয় তা কম মর্মন্তুদ নয়।
সমাজে এ ধরণের অশান্তির মধ্যেও সুস্থ্য শান্তিময় জীবনের আকাক্সক্ষা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, সে সময়েও তার চিত্র বিদ্যমান। চর্যার বেশ কয়েকটি পদে তার সুন্দর বর্ণনা রয়েছে। পার্থিব ধন সম্পদ নেই, অভাবের তাড়না আছে তার মধ্যেও আত্মিক দিক থেকে সুখে থাকার অদম্য চেষ্টার অন্তছিল না। সরহ পাদানাম রচিত ৩৮ নং চর্যা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
কাঅ ণাবড়ি খাণ্টি মণ কেড়–আল।
সদগুরু বঅণে ধর পতবাল
চীঅ থির করি ধরহু রে নাঈ।
আন উপাএ পার ণ জাই
আনন্দ উপভোগের জন্যে ছিল দাবা খেলার প্রচলন। ১২ নং চর্যায় তার উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন চর্যায় সে সময়ের দৈনন্দিন জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমনঃ বাসন, পেয়ালা, হাড়ি, ঘড়ি, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র যেমনঃ পড়হ, মাদল, কর (ঢোল), কাঁসি, বীণা, বাঁশি এবং অলংকারের মধ্যে কানেট (কর্ণভূষণ), ঘণ্টা নেউর (নূপুর), কাঙ্কণ (কাঁকণ), মুত্তিহার (মুক্তাহার), কুÐল ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে। ব্যবহারি অন্যান্য জিনিসপত্রের মধ্যে কুঠার, কোঞ্চাতাল (তালাচাবি), টাঙ্গি, পীড়ি, চীরা (পতাকা), সোনা, রূপা এবং থানা কাচারী ইত্যাদির উল্লেখ আছে বিভিন্ন চর্যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে চর্যায় সাধন সঙ্গিনী হিসেবে নারীর প্রয়োজনের কথা উল্লেখ থাকলেও তৎকালীন সমাজে নারীর জীবন ছিল সবচেয়ে অবহেলিত এবং অভিশপ্ত। তাদের জীবনে দুঃখ ছাড়া প্রাপ্তি বলতে কিছুই ছিলনা। অধিকাংশ সময়ে কেবল ভোগের সামগ্রী হিসেবেই তাদের প্রয়োজন হতো।
সে সময়কার সামাজিক জীবনে বাঙালির আচার ব্যবহার ও রীতি নীতি কেমন ছিল তার বিবরণ একাধিক চর্যায় পাওয়া যায়। বাঙালির বিবাহের সুন্দর সুন্দর বর্ণনা রয়েছে চর্যায়। এসব দেখে অনুমিত হয় তখন থেকেই বাঙালির সংসার গড়ে উঠতো শ্বশুর-শাশুড়ী,জা, ননদ-শালী নিয়ে। ১৯ নং চর্যায় পদকার কৃষ্ণপাদানাম (কাহ্নপাদানাম) লিখেছেনঃ
ভব নিব্বাণে পড়হ মাদলা।
মণ পবণ বেণি করু কশলা
জঅ জঅ দুন্দুহি সাদ উছলি আঁ।
কাহ্ন ডোম্বি বিবাহে চলি আ
ডোম্বি বিবাহিআ আহারিউ জাম।
জউতুকে কিঅ অণুত্তর ধাম
অহণিসি সুরঅ পসঙ্গে জাই।
জোইণি জালে রঅণি পোহাই
ডোম্বি এর সঙ্গে জো জোই রত্ত।
খণহ ন ছাড়ই সহজ উম্মত্ত
‘পটহ ও মাদল জোড়া ঢোল কাঁসি ইত্যাদির জয় জয় দুন্দুভির শব্দ উচ্ছলিত হল, কাহ্ন ডোমনীকে বিয়ে করতে চললো। বিয়েতে তার জন্ম সার্থক হবে-বিয়ের যৌতুক অণুত্তর ধর্ম। অহর্নিশি সুরত প্রসঙ্গে যায়, রমণী পরিবৃত হয়ে বাসর রজণী পোহায়।’
তৎকালীন সমাজের একটি নিখুঁত চিত্র পদটিতে প্রত্যক্ষ করা যায়। সমাজে তখন বহু বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। চর্যাকারদের রচনায় তৎকালীন সমাজের খুঁটি-নাটি প্রায় সকল বিষয়ই উঠে এসেছে। বিভিন্ন পদে আমরা পাই গো-পালন, বলদের ব্যবহার, দুগ্ধ দোহনের কথা, হাতির ব্যবহারও অজানা ছিলনা তাদের। নৌবাণিজ্য, জলদস্যুদের হানা, এমনকি কর্পূর দিয়ে স্বাদ করে পান খাওয়ার কথাও লিখতে ভুলেননি চর্যাকাররা। সমাজে তখন ছিল যোগী, কাপালিক, ক্ষপণক, রসসিদ্ধা প্রভৃতি শ্রেণির ধর্মীয় সাধক। নারীরাও ছিল অনেকের সাধন সঙ্গিণী।
মূলত সাধন সঙ্গীত হিসেবে চর্যাপদগুলোর পরিচয় হলেও এর পদকর্তাগণ লেখার উপকরণ সংগ্রহ করেছেন সমাজের বাস্তব জীবন থেকে। তাই তাদের বক্তব্যেও ফুটে উঠেছে তৎকালীন সমাজ ও জীবনের নানা বাস্তব চিত্র। চর্যাকারদের অনেকেই সমাজ জীবনে উচ্চ পর্যায়ের লোক হলেও তাদের লেখায় যে জীবন চিত্র ফুটে উঠেছে তাতে উচ্চ জীবন ধারার প্রতিফলন নেই বললেই চলে। বরং অধিকাংশ পদেই অন্তজ শ্রেণির দৈনন্দিন জীবন যাত্রার বেদনাবিধূর বাস্তব চিত্র রূপায়িত হয়েছে। এসব পদে তত্ত¡কথায় যাই থাকুক না কেন সেখানে ফুটে উঠেছে সাধারণ মানুষের বাস্তব জীবনচিত্র।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি চর্যাগীতিগুলো আধ্যাত্মিক সাধন সঙ্গীত। সুতরাং সমাজের বাস্তব চিত্র অংকন করা তার উদ্দেশ্য হতে পরেনা। যেহেতু সাহিত্য মাত্রই সমাজ নিরপেক্ষ হয়না সেহেতু উপমা, উৎপ্রেক্ষা, বিষয়বস্তু, রূপকল্প ইত্যাদি ব্যবহারে যুগও জীবনের বাস্তব চিত্রের স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। এমন কি কোন বিশেষ যুগের সাহিত্যে বা সাধন প্রণালীতেও সমাজ ও পরিবেশগত কারণ থাকা অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং চর্যাগীতিগুলোর মধ্যেও তৎকালীন সমাজ জীবনের যে বাস্তব চিত্র পাওয়া যায় তা ইতিহাস বিরোধী নয় বরং এর মধ্যেই নিহিত আছে ধর্মীয় জীবনের অভিপ্রেত। একারণে তৎকালীন সমাজ চিত্র হিসেবেও চর্যাপদগুলো বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
এই খÐচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে তৎকালীন দেশ কাল ও সমাজ জীবনের যে চিত্র আমাদের মনশ্চক্ষুর সামনে ধীরে ধীরে ফুটে উঠেছে তা কৌতূহলপ্রদ এবং নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক চিত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তাই এ কথা অকপটে বলা যায় যে চর্যাপদ বাংলা কাব্যের জন্মলগ্নে সবচেয়ে উজ্জ্বলবর্তিকা, সে বর্তিকার আলো আজও নিভে যায়নি। বরং আপন গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে আপন মহিমা প্রচার তথা সে সময়কার বাংলাদেশের বিভিন্ন অবস্থার কথা জানিয়ে দিতে অনাগতদের। সবশেষে বলা যায় বাংলা কাব্যের বিশাল অঙ্গনে তার আলো শান্তমাধুর্য্যে মহিয়ান।