লিয়াকত হোসেন, সুইডেন থেকে: একগুঁয়েমি, অহঙ্কার ও আতি আত্মবিশ্বাস হাসিনাকে পতনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
কিন্তু এটাতো হবার কথা ছিল না, কথা ছিল তিনি হবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু কালের আবর্তে হয়ে গেলেন দলীয় প্রধানমন্ত্রী। সাধারণ জনগণ এটা ভালোভাবে নেয়নি, তাদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এই ক্ষোভ পনের বছরে জমতে জমতে আগুনে পরিণত হয়েছে। যখনই জনগণ কিছু বলতে চেয়েছে, যখনই জনগণ কিছু বলতে গেছে ট্যাগ দিয়ে তাদের আলবদর, রাজারকার বানানো হয়েছে তার ওপর পুলিশের নির্মম অত্যাচারতো আছেই সেসঙ্গে গুম, আয়নাঘর, বিচারবর্হিরভূত হত্যা। জনগণ এগুলো ভালোভাবে নেয়নি।
এদিকে হাসিনাকে সমর্থন জানাতে যেয়ে সংবিধানবর্হিভূতভাবে প্রবাসের বিভিন্ন দেশের আনাচে কানাচে গড়ে ওঠে আওয়ামী দোকান, চেতনার দোকান আর এই দোকানের মালিকরা হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে যেয়ে তাঁকে বোঝানোর পরিবর্তে অন্যায়কে সমর্থন দিয়ে গেলেন। ক্রমে ক্রমে হাসিনা হয়ে গেলেন মানবী থেকে দানবী। হাসিনাকে দানবী বানাতে আপনারাও দায়ী। হাসিনাকে সমর্থন দিয়েছেন ভালো কথা কিন্তু তার অন্যায় পদক্ষেপগুলোকে সমর্থন দিলেন কেন? আপনারা নিজেদের হাসিনার নিকটতম বলে দাবী করেন, তাকে কি বোঝাতে পারতেন না? প্রবাসে অবস্থান করে স্থানীয় রাজনীতিরধারা অবলোকন করেও মেরুদন্ড বিকিয়ে দিলেন?
আল-জাজিরা ‘অল দ্যা প্রাইমিনিস্টার ম্যান‘ নামে একটি ভিডিও তৈরি করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর আশেপাশের কয়েকজনের অন্যায় কীর্তিকলাপ তারা তুলে ধরেছিল। তাকে আপনারা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন, বিশ্লেষণ করলেন না ঘটনাগুলো সত্য কি না। তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে যেয়ে স্যাংসনপ্রাপ্ত বে-নজীরকে নিয়ে যাওয়া হলো আমেরিকায় তারপর বে-নজীরের নজীরবিহীন সম্পদের ইতিহাস বেরিয়ে এলো খবরের পাতায়, এই নিয়ে কি আপনারা প্রতিবাদ করেছেন? করেননি, বরং ত্রিমূর্তি সম্বলিত প্ল্যাকেট সাজিয়ে সমর্থন দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হাইজ্যাক করে একজনকেই একক নায়কে পরিণত করা হল। কেন মুক্তিযুদ্ধে কি তাজউদ্দিন ছিলেন না? সৈয়দ নজরুল ছিলেন না? কামরুজ্জামান ছিলেন না? ভাসানী ছিলেন না? তাঁদেরকে একপাশে সরিয়ে রেখে একজনকেই নায়কের আসনে বসানো হলো, এই ভুল ইতিহাস জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে আপনারা কি প্রতিবাদ করেছিলেন? করেননি। বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালকে টেনে হিঁচড়ে গলায় দড়ি বেঁধে সাদ্দামের মত নামানো হবে এই দৃশ্য কি আমরা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম? এই দৃশ্য সৃষ্টির পেছনে আপনারা কি দায় নন? আপনাদের মেরুদন্ডহীন সমর্থন এরজন্য দায়ী।
রংপুরের শহিদ আবু সাঈদ যাকে সেনাবাহিনী বীর শ্রেষ্ঠের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছেন, রাষ্টীয়বাহিনী দ্বারা তার নির্মম হত্যার বিরুদ্ধে কি প্রতিবাদ করেছিলেন? মুগ্ধ নামের ছেলেটি যে পানির বোতল বিতরণ করছিলো, রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা তাকে হত্যার বিরুদ্ধে কী প্রতিবাদ করেছিলেন? করেননি, আপনারা অভিযোগ জানিয়ে স্ট্যাটাস দিলেন কেন বিটিভি ভাঙ্গা হলো? কেন মেট্রোরেল পুড়িয়ে দেয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী যা করলেন আপনারাও সে পথে গেলেন, ইতোমধ্যে আন্দোলনে যে ২১৭ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ দিলেন তাদের সমবেদনা জানালেন না, না আপনারা না প্রধানমন্ত্রী। ভাঙ্গা জিনিষ জোড়া দেয়া যায় কিন্তু প্রাণ জোড়া দেয়া যায় না। এসব দেখে জনগণ ক্ষীপ্ত হয়েছে, ছাত্ররা ক্ষিপ্ত হয়েছে, ধিক্কার দিয়েছে। ওবায়দুল কাদেরের চিবানো উসকানিমূলক কথাগুলোর প্রতিবাদ করেছিলেন? করেননি।
গার্ডিয়ান বলেছে,‘ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অপব্যবহার করেছেন হাসিনা‘।
কথাটি সত্যের অপলাপ নয়। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান একে একে ধ্বংস করেছেন হাসিনা, প্রতিবাদ করেছিলেন? করেননি। আপনাদের আপাকে কি বুঝিয়েছিলেন ভোটারবিহীন নির্বাচন দেশের জন্য ভালো নয়? বোঝাননি। হাসিনা বঙ্গবন্ধুকে ধ্বংস করেছেন, আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করেছেন আর ছাত্রলীগকে বানিয়েছেন সন্ত্রাসী। জনগণ মনে মনে ধিক্কার দিয়েছে, মুখে কিছু বলেনি। যখন বলেছে তখন তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ‘পালানো’ শব্দটা পত্র-পত্রিকা বহুলভাবে ব্যবহার করেছে। এই দেশে আরো একজন ডিক্টেটর ছিলেন, তিনি কিন্তু পালাননি, কৃতকর্মের ফল ভোগ করেছেন দেশেই কিন্তু হাসিনা পালিয়ে যেয়ে বঙ্গবন্ধু সৃষ্ট আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে দিয়ে গেলেন, এরজন্য কি আপনারা দায়ী নন? আওয়ামী দোকানগুলো দায়ী নয়?
ভিয়েতনাম স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে একহাজার নব্বই বছর।
এক হাজার বছর চীনের আধিপত্য, ষাট বছর ফরাসি আধিপত্য আর ত্রিশবছর মার্কিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। মার্কিনদের বিরুদ্ধে ত্রিশ বছর ছিল কঠিনতম সময়। নাপাম বোমা, ইয়েলো এজেন্ট, আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র দিয়েও মার্কিনরা ভিয়েতকং মুক্তিযোদ্ধাদের পরাজিত করতে পারেনি। আর আমরা নয় মাস যুদ্ধ করেই প্রবাসের আনাচে-কানাচে মুক্তিযুদ্ধের দোকান সাজিয়ে বসলাম, নিজেদের ঢোল নিজেরাই বাজিয়ে চললাম কিন্তু ভিয়েতনামতো তা করেনি। তাহলে আমরা কি ভিয়েতকংদের চেয়েও বড় মুক্তিযোদ্ধা? না, আমরা আমাদের এক অদ্ভূত সুবিধাবাদী প্রজাতিতে পরিণত করলাম, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে পারলাম না। বঙ্গবন্ধুকে গলায় দড়ি বেঁধে টেনে হিঁচড়ে নামানো হলো। আওয়ামী দোকান, মুক্তিযুদ্ধের দোকান খুলেও কোনো কাজ হলো না।
সুইডেন, ৭-৪-২০২৪