রবিউল ইসলাম সোহেল: অনেক আলোচনা এবং সমালোচনার মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। ভাষণে সিইসিকে খুব বেশি প্রাণবন্ত মনে হয়নি। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো তপশিল প্রত্যাখান করে হরতালসহ অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই তারা রাজপথে আন্দোলন করছে। আওয়ামী লীগ সরকারও বদ্ধপরিকর সংবিধানের আলোকে নির্বাচন সম্পন্ন করবে। কারণ এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এ নিয়েই এবারের প্রচ্ছদ কাহিনী।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশ নির্বাচনমুখী হয়ে পড়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ছোট বড় অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দল মাঠে তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। ৩০০ আসনে দলীয় মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু করেছে আওয়ামী লীগসহ বেশ কটি দল। এছাড়া স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে ইচ্ছুক প্রার্থীরাও নিজ নিজ এলাকায় গণসংযোগ শুরু করে দিয়েছে। এদিকে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল প্রত্যাখ্যান করলেও নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়নি। তবে তলে তলে তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের শেষ চেষ্টায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা কিংবা অন্য কোনোভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ অনুকূল মনে করলে বিএনপি তাদের সমমনা দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে। সে ক্ষেত্রে তারা ৭ জানুয়ারির পরিবর্তে নির্বাচনের সময় আরেকটু বাড়িয়ে পুনরায় তফসিলের দাবি জানাবে। আর সকল দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দিলেও আইনগত কোনো সমস্যা হবে না বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।
এদিকে তপশিল ঘোষণার পর অশান্ত হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এমনিতেই বিরোধী দলগুলোর ধারাবাহিক কর্মসূচি চলছিল। এরমধ্যে ঘোষণা করা হলো তপশিল। একতরফা এ তপশিলকে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রতিবাদে হরতাল. অবরোধ পালিত হচ্ছে। প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিভিন্ন দল। বেশ কয়েক জায়গায় বিএনপি-আওয়ামী লীগ সংঘর্ষ হয়েছে। ট্রেন ও বাসে আগুন দেয়া হয়েছে। তপশিল প্রত্যাখ্যান করে বিক্ষোভকালে সংঘর্ষ হয়েছে সিলেট, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের ডাকা আধাবেলা হরতালের সমর্থনে বের করা মিছিলেও হামলা হয়েছে। এ ছাড়া টাঙ্গাইলে কমিউটার ট্রেনে ও গাজীপুরে রেললাইনে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন জেলায় যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। অবরোধের সমর্থনে গতকালও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সড়ক-মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিএনপি, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা। এ সময় তারা টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া অবরোধের সমর্থনে মিছিল করেছে জামায়াত, এলডিপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। বিরোধী জোটের অবরোধের কারণে সারা দেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল রাজধানী ঢাকা।
এই মাসে বিরতি দিয়ে দিয়ে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। শুধু বিএনপি বা সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোই না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বারবার তাগিদ দিয়েছে। সর্বশেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির কাছে পাঠানো এক চিঠিতে শর্তবিহীন সংলাপে বসে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ খোঁজার আহ্বান জানিয়েছেন। অবশ্য সরকার ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে সংলাপের পরিবেশ আর এখন নেই। সংবিধান মেনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে।
বিরোধীদের আন্দোলন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের পরামর্শকে উপেক্ষা করেই সরকার নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত কতগুলো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের মিত্র জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যেতে পারে। জাতীয় পার্টি এখনো চূড়ান্তভাবে কিছু বলেনি। তাদের নিয়ে নানা ধরনের গুঞ্জন রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন জাতীয় পার্টি শেষ বিচারে নির্বাচনে যাবে। জাতীয় পার্টির পক্ষে আওয়ামী লীগের নির্দেশ অমান্য করা সম্ভব না। যদিও সম্প্রতি জাতীয় পার্টির এক বৈঠকে দুইজন ছাড়া অধিকাংশ বক্তা নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। ওই বৈঠকে বক্তারা পরিস্কারভাবেই বলেছেন, আওয়ামী লীগের দুর্নীতি ও অপরাধের দায়িত্ব জাতীয় পার্টি নিতে পারে না। কেবলমাত্র দুইজন বক্তা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে মতামত দেন। তারা বক্তব্য দেয়ার সময় অন্যরা দালাল দালাল বলে চিৎকার করে উঠেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে জাতীয় পার্টি দলীয় নেতা-কর্মীদের কথা বা মতে চলে না। দলটিকে বাইরে থেকে পরিচালনা করা হয়। এর চেয়ারম্যান বা মহাসচিব পদে পাপেটের মতো কিছু লোক বসে থেকে বাইরের নির্দেশ পালন করেন কেবল। তাই শেষ পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভিন্ন জায়গায়। জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন বটে, তারা কেন আওয়ামী লীগের নানা কর্মকাণ্ডের দায় বহন করবেন। যদি জাতীয় নির্বাচনে যায় বা মনোনয়ন জমা দেয় তাহলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদেরও যাবতীয় দায় বহন করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের ১৯৯০ সালের কথা স্মরণ করতে হবে। ওই সময় জাতীয় পার্টির ক্ষমতা থেকে পতন হলে সঙ্গে আ স ম আবদুর রবের জাসদকেও পর্দার আড়ালে চলে যেতে হয়েছিল। তাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারে। কিন্তু যদি কোনো কারণে গণেশ উল্টে যায় তবে জাতীয় পার্টিকেও এবার পালাতে হবে বা আত্মগোপনে যেতে হবে। পর্যবেক্ষকদের মতে জাতীয় পার্টি ছাড়া আওয়ামী লীগের জোটে থাকা অন্য দলগুলো ভোটের মাঠে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ না। ওয়ার্কার্স পার্টি বা জাসদ (ইনু) এক নেতা নির্ভর দল। এছাড়া আওয়ামী লীগের কাছাকাছি থাকা ইসলামপন্থী দলগুলোও কিন্তু নির্বাচনী তপশিল প্রত্যাখান করেছে। খেলাফত মজলিশ তপশিল বাতিলের দাবি জানিয়েছে। এর আগে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা সমমনা পাঁচটি ইসলামপন্থী দল তপশিল ঘোষণার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিল। এই দলগুলোর সরকার ঘেষা বলেই পরিচিত। এদের অনেকেই বিএনপির জোট থেকে বেরিয়ে এসেছে। ফলে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে থাকা দলগুলোর মধ্যে জাতীয় পার্টি এখনো নিশ্চিত করেনি নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে। ইসলামপন্থী দলগুলোও সংলাপের কথা বলছে। তাহলে নির্বাচনে যাচ্ছে কারা? আওয়ামী লীগ যাবে। এর সঙ্গে ওয়ার্কার্স পাটি, জাসদ (ইনু), সাম্যবাদী দল থাকতে পারে। বিএনপিতে গুরুত্ব হারানো কিছু নেতাকর্মী নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এদের রাজনৈতিক প্রভাব খুবই নগণ্য। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের পক্ষে কি হাতে গোনা কয়েকটি দলকে নিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে? বিশ্লেষকদের মতে শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিলেও এবারের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া আওয়ামী লীগের জন্য সহজ হবে না। কারণ বিএনপিসহ সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথ ছাড়বে না বলেই মনে হচ্ছে। বিএনপির জোট বা আন্দোলনের বাইরে থাকা বামজোট তপশিল ঘোষণার পরপরই হরতালের ঘোষণা দিয়েছে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি বিএনপির একার দাবি না। ডানপন্থী, মধ্যপন্থী, উদারপন্থী ও বামপন্থী সবার দাবি।
রাজপথের বিরোধী বিএনপিকে নির্বাচনে আনার শেষ চেষ্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়ে শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছেন। তার পক্ষ থেকে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তিন দলের কাছে চিঠি পৌঁছে দিয়ে তাদের সংলাপে বসানোর জন্য দৌড়ঝাঁপ করে এখন পর্যন্ত সুখবর দিতে পারেননি। তবে বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচি সরকারকে চাপে রেখে নির্বাচনের আগে সমঝোতার কৌশল বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়ে বিএনপি এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সংলাপের পক্ষে ইতিবাচক হলেও ইসি এ দলটিকে সংলাপের জন্য তিনবার আমন্ত্রণ জানালেও একবারও যায়নি। বরং এমন একটি ভাব করেছে যেন, বিএনপি সংলাপে না গেলে নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচনের দিকে যেতে পারবে না। নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি শেষবারের মতো ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে নিয়ে সংলাপের আয়োজন করে। তবে এই সংলাপে আওয়ামী লীগসহ ২৬টি দল অংশ নিলেও বিএনপিসহ ১৮টি দল যায়নি। সংলাপের পর আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টিসহ কটি বাম দল, তৃণমূল বিএনপি এবং বেশ কটি ইসলামী দলসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে মাঠে সক্রিয় রয়েছে। দিনদিনই তারা প্রস্তুতি জোরদার করছে। ইতোমধ্যেই সংসদীয় আসনগুলোতে তাদের প্রচার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগসহ কটি দলের ইশতেহার প্রণয়নের কাজও শেষ করে ফেলছে। বর্তমানে দেশে শতাধিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে আওয়ামী লীগসহ অর্ধশতাধিক দল নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় রয়েছে। আর বিএনপিসহ প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে শেষ ধাপের আন্দোলনে রয়েছে। তবে এই দলগুলো প্রকাশ্যে নির্বাচনে যাবে না বললেও নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে তলে তলে।
সারাদেশ নির্বাচনমুখী
নির্বাচন কমিশন তপশিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগসহ বেশ কটি দল স্বাগত জানায়। পরে প্রার্থী নির্বাচনসহ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করে। তবে বিএনপি তপশিল প্রত্যাখ্যান করলেও এ দলের দুই কেন্দ্রীয় নেতা সংবাদ সম্মেলন করে তারাসহ দলটির ১২৫ জন নেতা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে বলে ঘোষণা দেয়। তৃণমূল বিএনপিও সংবাদ সম্মেলন করে তফসিলকে স্বাগত জানিয়ে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এ দলটির চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী ও মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার বিএনপির এক সময়ের প্রভাবশালী নেতা। এ ছাড়া দলটির নির্বাহী চেয়ারম্যান অন্তরা হুদা প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তাই বিএনপি নির্বাচনে না এলে এ দলের অনেক নেতা তৃণমূল বিএনপি থেকে সংসদ নির্বাচন করবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ বিবৃতি দিয়ে তফসিলকে স্বাগত জানিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এছাড়া জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা জানিয়েছেন বর্তমানে দলীয় জাতীয় সংসদের ২৬ সদস্যের মধ্যে ২১ জন রওশন এরশাদের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেবেন। এ পরিস্থিতিতে শিগগিরই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন বলে সূত্র জানায়।
এছাড়া রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি, হাসানুল হক ইনুর জাসদ, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও দিলীপ বড়ুয়ার সাম্যবাদী দলসহ বেশ কটি দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে মাঠের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও নিজ নিজ এলাকায় গণসংযোগ শুরু করেছে। কেউ কেউ উপজেলা চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকারের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।
রাজপথের বিরোধী বিএনপিকে নির্বাচনে আনার শেষ চেষ্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়ে শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছেন। তার পক্ষ থেকে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তিন দলের কাছে চিঠি পৌঁছে দিয়ে তাদের সংলাপে বসানোর জন্য দৌড়ঝাঁপ করে এখন পর্যন্ত সুখবর দিতে পারেননি। এদিকে বিএনপি তফসিলের দিন হরতাল ঘোষণা না করলেও একদিন পর ঘোষণা দিয়েছে রবিবার সকাল ছয়টা থেকে টানা ৪৮ ঘণ্টা হরতাল পালনের। তবে এটি সরকারকে চাপে রেখে নির্বাচনের আগে সমঝোতার কৌশল বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়ে বিএনপি এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সংলাপের পক্ষে ইতিবাচক হলেও ইসি এ দলটিকে সংলাপের জন্য তিনবার আমন্ত্রণ জানালেও একবারও যায়নি। বরং এমন একটি ভাব করেছে যেন, বিএনপি সংলাপে না গেলে নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচনের দিকে যেতে পারবে না। নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি শেষবারের মতো ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে নিয়ে সংলাপের আয়োজন করে। তবে এই সংলাপে আওয়ামী লীগসহ ২৬টি দল অংশ নিলেও বিএনপিসহ ১৮টি দল যায়নি। সংলাপের পর আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টিসহ কটি বাম দল, তৃণমূল বিএনপি এবং বেশ কটি ইসলামী দলসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে মাঠে সক্রিয় রয়েছে। দিনদিনই তারা প্রস্তুতি জোরদার করছে। ইতোমধ্যেই সংসদীয় আসনগুলোতে তাদের প্রচার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগসহ কটি দলের ইশতেহার প্রণয়নের কাজও শেষ করে ফেলছে। বর্তমানে দেশে শতাধিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে আওয়ামী লীগসহ অর্ধশতাধিক দল নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় রয়েছে। আর বিএনপিসহ প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে শেষ ধাপের আন্দোলনে রয়েছে। তবে এই দলগুলো প্রকাশ্যে নির্বাচনে যাবে না বললেও নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে তলে তলে।
কমিশনের প্রস্তুতি সম্পন্ন
নির্বাচন কমিশনসম্পর্কিত সূত্রগুলো জানায়, ভোটগ্রহণের জন্য আগেই গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়সহ মাঠ পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। এখন শুধু ব্যালট পেপার ছাপার কাজ সরকারি মুদ্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে। ফর্মেট প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে, প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর ব্যালট পেপার ছাপার কাজ শেষ করা হবে। আগেই আঞ্চলিক, জেলা, উপজেলা ও থানা নির্বাচন অফিসের নিরাপত্তা চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে ইসি। অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের জন্য স্মার্ট অ্যাপ চালু করা হয়েছে। এখন ঘরে বসেই নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র দাখিল করতে পারবেন।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ছয় কোটি সাত লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন। আর নারী পাঁচ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার হচ্ছে ৮৫২ জন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের জন্য আলাদা আলাদা ভোটার তালিকা প্রস্তুত করেছে ইসি। এই তালিকা অনুযায়ী প্রতিটি সংসদীয় আসনের ভোটগ্রহণ করা হবে।
এবার ৩০০টি সংসদীয় আসনে ভোটকেন্দ্র থাকছে ৪২ হাজার ৩৮০টি। আর ভোটকক্ষ থাকছে দুই লাখ ৬১ হাজার ৬৬৮টি। প্রতিটি ভোটকক্ষের জন্য একটি করে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স রাখা হবে। এছাড়া প্রতি কেন্দ্রে একটি করে অতিরিক্ত ব্যালট বাক্স দেওয়া হবে। সে হিসেবে সংসদ নির্বাচনে তিন লাখের বেশি স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স প্রয়োজন হবে। ভোটগ্রহণের জন্য এবার দশ লাখ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ৩০০ আসনে নির্বাচনের জন্য ৬৬ জন রিটার্নিং অফিসার এবং ৫৯২ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তপশিল ঘোষণা হয়ে গেলেও সকল দলের অংশগ্রহণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে করার জন্য দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের নানামুখী তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। তবে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিপরীত মেরুতে অবস্থান করায় সমঝোতা হবে কি না তা দেখার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে কোনোভাবে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা করা গেলে সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করতে ঘোষিত তপশিল কোনো সমস্যা হবে না বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। তাদের মতে, ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমে ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচন করার জন্য তপশিল ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে নির্বাচনের তারিখ আরও ১১ দিন পিছিয়ে ২৯ ডিসেম্বর করতে পুনরায় তপশিল ঘোষণা করা হয়।
ক্ষমতাসীন সরকারও দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলকে আশ্বস্ত করছেন সংবিধান অনুসারে বিদ্যমান ব্যবস্থায়ই দেশে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশনও সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে সংবিধান অনুসারে তারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি নিয়েছে। কমিশনের পক্ষ থেকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা করণীয় সব করা হচ্ছে। তপশিল ঘোষণার সময়ও সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিয়ে এ বিষয়ে সকলের সহযোগিতা চেয়েছেন। এদিকে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ডিসি-এসপি ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রতি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে ইতোমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছে ইসি। নির্বাচন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে এবং একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিতে সবাইকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে গ্রহণযোগ্য হবে।
এদিকে তপশিল ঘোষণার পর জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীর যোগ্যতাসহ বিস্তারিত পরিপত্র জারি করেছে নির্বাচন কমিশন। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রার্থীকে দলের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক বা সম পদাধিকারীর সইযুক্ত প্রত্যয়নপত্র জমা দিতে হবে। এছাড়া স্বতন্ত্র থেকে প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়নপত্রের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এক শতাংশ ভোটারের সমর্থনসূচক সইযুক্ত তালিকা। তবে কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী আগের কোনো সংসদ নির্বাচনে জয়ী হলে তাকে এক শতাংশ ভোটারের সমর্থনসূচক তালিকা জমা দিতে হবে না।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের জামানত হিসেবে জমা দিতে ২০ হাজার টাকা। ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে হলফনামা জমা দিতে হবে, যেখানে থাকবে আটটি সুনির্দিষ্ট তথ্য। এ ছাড়া আয়ের উৎস, দায়-দেনা, সম্পদ বিবরণী ও আয়কর রিটার্নের কাগজপত্র জমা দিতে হবে। রিটার্নিং কর্মকর্তাকে রিটার্ন দাখিলের কাগজপত্র জমা দেওয়ার পাশাপাশি তার অনুলিপি ইসিকেও দিতে হবে। এ নির্বাচনে প্রার্থীর ব্যয়সীমা হলো ২৫ লাখ টাকা। প্রার্থী বা তার এজেন্টকে একটি তফসিলি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এ ব্যয় করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের নাগরিক ও ২৫ বছর বয়স হলে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য হবেন। প্রার্থীকে বাংলাদেশের যে কোনো নির্বাচনী এলাকায় ভোটার হতে হবে।
তবে আদালতে অপ্রকৃতিস্থ ও দেউলিয়া হলে, অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন বা আনুগত্য স্বীকার করলে, নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দুই বছর বা তার বেশি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে প্রার্থী নির্বাচনের অযোগ্য হবেন। এছাড়াও ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত হলে অথবা অন্য কোনো আইনে নির্বাচনের জন্য অযোগ্য হলে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তবে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীর ক্ষেত্রে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলে গণ্য হবে না। দ্বৈত নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে বিদেশী নাগরিকত্ব ত্যাগ করে এলে নির্বাচনে অযোগ্য হবেন না।
ক্ষুদ্র কৃষিঋণ ছাড়া ঋণগ্রহীতা হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিলের দিনের আগে ঋণ বা তার কোনো কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে এবং টেলিফোন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি বা সরকারের সেবা প্রদানকারী কোনো সংস্থার অন্য কোনো বিল মনোনয়নপত্র দাখিলের দিনের আগে পরিশোধে ব্যর্থ হলে নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। দি ইন্টারনাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট, ১৯৭৩ (অ্যাক্ট নম্বর. ১৯ অব ১৯৭৩)-এর অধীন কোনো অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হলেও নির্বাচন করা যাবে না।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমার ক্ষেত্রে নির্ধারিত ফরমে প্রস্তাবকারী ও সমর্থনকারী স্বাক্ষরিত মনোনয়ন প্রস্তাব মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দাখিল করতে হবে। মনোনয়নে সম্মতি প্রদান করেছেন এবং তার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার বা সদস্য থাকার কোনো অযোগ্যতা নেই মর্মে ঘোষণা দিতে হবে। একজন প্রার্থী তিনটির বেশি নির্বাচনী এলাকার জন্য মনোনয়নপত্র দাখিল করেননি বলে ঘোষণা দিতে হবে। অতীতে তার বিরুদ্ধে করা কোনো ফৌজদারি মামলা থাকলে তার রায়, ব্যবসা বা পেশার বিবরণী দিতে হবে।
আয়ের উৎসগুলো, নিজের বা নির্ভরশীলদের পরিসম্পদ ও দায়ের বিবরণী, অতীতে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হলে ভোটারদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতগুলো পূরণ হয়েছে তার তথ্য, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে একক বা যৌথভাবে বা নির্ভরশীলদের নামে ঋণ থাকলে তার তথ্য, রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র মনোনয়নপত্রের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এবার অ্যাপসের মাধ্যমে ঘরে বসে অনলাইনেও মনোনয়ন পত্র দাখিল করা যাবে।
তপশিল নিয়ে কোন দলের কী অবস্থান
নিবন্ধিত ৪৪ রাজনৈতিক দলের ১৮টি আগামী নির্বাচনের তপশিলকে স্বাগত জানিয়েছে। প্রত্যাখ্যান করেছে ১৬টি। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ (জাপা) ১০টি অবস্থান স্পষ্ট করেনি। তবে এর অধিকাংশ নির্বাচনের পথে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের চিঠির পর সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত কয়েকটি দলও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সংলাপ চায়। দলগুলোর সঙ্গে আলাপে এবং তাদের বিবৃতিতে এ তথ্য জানা গেছে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে নামা বিএনপির সমমনা দলগুলোর একটি বাদে সবগুলো তপশিল প্রত্যাখ্যান করেছে। এগুলো হলো– এলডিপি, কল্যাণ পার্টি, জেএসডি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এনডিএম, মুসলিম লীগ। যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে থাকা আদালতের রায়ে নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামী তপশিল প্রত্যাখ্যান করে হরতালের ডাক দিয়েছে। বাম জোটের নিবন্ধিত দল সিপিবি, বাসদ এবং বাংলাদেশ জাসদ তপশিল প্রত্যাখ্যান করে হরতাল পালন করেছে। বিএনপির সঙ্গে না থাকলেও চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনও তপশিল প্রত্যাখ্যান করেছে। দলটি তপশিলের বিরোধিতায় গণমিছিল ও বিক্ষোভ করেছে। যদিও সরকারের সঙ্গে দলটির সমঝোতার গুঞ্জন রয়েছে। তবে ইসলামী আন্দোলন নেতারা জোরের সঙ্গেই বলছেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবেন না তারা। ছয় দল মিলে গঠন করেছে সমমনা ইসলামী জোট। এই জোটে চারটি দল নিবন্ধিত। এর মধ্যে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং খেলাফত মজলিস তপশিল প্রত্যাখ্যান করেছে।
কোনো জোটে বা আন্দোলনে না থাকলেও ইনসানিয়াত বিপ্লব পার্টিও তপশিল প্রত্যাখ্যান করেছে। তপশিল বর্জন করা ১৬টি দল কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপক্ষে। সমমনা ছয়দলীয় ইসলামী জোট ‘সরকার সমর্থিত’ বলে গুঞ্জন রয়েছে। তবে জমিয়তের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি বলেছেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। একই কথা বলেছেন, ইনসানিয়াত বিপ্লব পার্টির চেয়ারম্যান ইমাম আবু হায়াত। বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন দল এবং ইসলামী আন্দোলন ও বাম জোটের শরিকরা আগে থেকেই এ কথা বলে আসছে। এ দলগুলো সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির পর সব দলের অংশগ্রহণে ভোট চায়।
তপশিলকে স্বাগত জানানো ১৮টি দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন নির্বাচনী জোটে রয়েছে– জেপি, সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাসদ ও তরীকত ফেডারেশন। নির্ধারিত সময়ে ও সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মতো অনড় থাকা এ দলগুলো সংলাপের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের জোটের বাইরে থাকা সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত জাকের পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, এনপিপি, বিএনএফও তপশিলকে স্বাগত জানিয়েছে। এ দলগুলোও নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য নিজেদের প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। তপশিলকে স্বাগত জানালেও সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটসহ কয়েকটি দল সংলাপ চায়।
আগের নির্বাচনে বিএনপির জোটে ছিল আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। এবার দলটি অবস্থান বদল করে তপশিলকে স্বাগত জানিয়েছে। বিএনপির সাবেক নেতাদের নিয়ে গড়া তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএম ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই দুই দলও তপশিলকে স্বাগত জানিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা জানিয়েছে। সংলাপের বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। বিএনপি নেতাদের ‘ভাগিয়ে’ নির্বাচনে আনতে এই দুই দল গড়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ৪ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনের সংলাপে ৪৪ দলের ২৬টি সাড়া দিয়েছিল। বর্জন করা ১৮ দলের ১৬টি তপশিল প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসির সংলাপ বর্জন করা বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ তপশিল নিয়ে ভিন্ন অবস্থানে রয়েছে। বিএনপি সমমনা ১২ দলীয় জোটের শরিক মুসলিম লীগ (বিএমএল) তপশিলকে স্বাগত না জানালেও নির্বাচনের অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন দলের চেয়ারম্যান শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী।
জাপা সূত্রের খবর, নানা বাধ্যবাধকতার কারণে দলটিকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। তবে এ সিদ্ধান্ত এখনই ঘোষণা করা হবে না। নির্বাচনে অংশ নিলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হবে কি না তা যাচাই করছে দলটি। জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, তিনি এখনও আশাবাদী সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হবে।
তপশিলের ব্যাপারে নীরব থাকা বাকি দলগুলোর মধ্যে খেলাফত আন্দোলন সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত। এ দলটি ছয়দলীয় সমমনা ইসলামী জোটের শরিক। খেলাফত আন্দোলন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে জোটের আন্দোলন থেকে পিঠটান দিয়েছে। গণফোরাম ২০১৮ সালে বিএনপির সঙ্গে থাকলেও এবার অবস্থান স্পষ্ট নয়। গণফ্রন্ট, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ কংগ্রেস জানিয়েছে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি চলছে। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি জানিয়েছে, অংশগ্রহণমূলক হলে নির্বাচনে যাবে। এ দলটির প্রধান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ সরকারের কড়া সমালোচক হিসেবে পরিচিত।
রাজপথে সক্রিয় দলগুলোকে পেছনে ফেলে নিবন্ধন পেয়ে আলোচনায় আসা বিএসপির অবস্থানও স্পষ্ট নয়। সরকারের সমর্থক এবং সরকারি সংস্থার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এই দলটির নেতৃত্বাধীন লিবারেল ইসলামিক জোট শুধু সংলাপ নয়, বিএনপি নেতাদের মুক্তি এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনও চাইছে!
নির্বাচনের কৌশল ঠিক করছে আওয়ামী লীগ
বিএনপিসহ বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলার ধারাবাহিকতা ধরে রাখার পাশাপাশি নির্বাচনের ছক কষছে আওয়ামী লীগ। কয়েকজন নীতিনির্ধারক নেতা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়া কিংবা বর্জন-দুটোই মাথায় রেখে নির্বাচনের কৌশল ঠিক করছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি নির্বাচনে এলে ১৪ দল, জাতীয় পার্টিসহ সমমনা কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিয়ে জোট করবে দলটি। বিএনপি নির্বাচনে না এলে দলের প্রার্থী মনোনয়নের পাশাপাশি নির্বাচনী জোট গঠনের প্রক্রিয়া হবে ভিন্ন। মূলত বিএনপির নির্বাচনে না আসার বিষয়টি ভাবনায় রেখে এগোচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। এ ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি আসন উন্মুক্ত রাখার চিন্তা করা হচ্ছে। ওই আসনগুলো সমমনা রাজনৈতিক দলকে ছেড়ে দেওয়া হবে। পাশাপাশি ১৪ দলগতভাবেই নির্বাচনী জোট গঠন করা হবে। আগ্রহ দেখালে জাতীয় পার্টিও থাকবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটে। সেই সঙ্গে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে দলের সম্ভাব্য বিদ্রোহী প্রার্থীর বিষয়ে এবার নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নাও নেওয়া হতে পারে।
এদিকে, বিএনপির কেউ কেউ আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হবেন বলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারা মনে করছেন। এরই মধ্যে এর পূর্বাভাসও মিলেছে বলে সরকারি দলের শীর্ষ নেতারা দাবি করেছেন। তারা বলছেন, বিএনপির সম্ভাব্য শক্তিশালী প্রার্থীদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ দেখিয়েছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী এখন পর্যন্ত তাদের সাক্ষাতের সময় দেননি। সবুজ সংকেত পেলে বিএনপির এই নেতারা নির্বাচনে আসবেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সমকালকে বলেন, বিএনপির অবরোধ-হরতালে জনগণের সম্পৃক্ততা নেই। তারা অগ্নিসন্ত্রাস চালিয়ে জনগণের সম্পদ ধ্বংস করছে। এর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি প্রতিরোধের এ ধারা অব্যাহত থাকবে। এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশি-বিদেশি নানা চাপে রয়েছে আওয়ামী লীগ। শর্তহীন সংলাপেরও তাগিদ রয়েছে। এসব বিষয়ে দলীয়ভাবে এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকরা এও মনে করেন, এ পরিস্থিতি খুব একটা আমলে নেওয়ার মতোও নয়। আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে সবকিছু ঠিকঠাক সামলে নিচ্ছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, চাপ তো আছেই। সেই চাপ গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য। আওয়ামী লীগও তা চায়। তবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী বর্তমান সরকার দায়িত্ব পালন করবে। নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং নির্বাচনে অংশগ্রহণের পর সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হতেই পারে।
এদিকে, বিএনপি নির্বাচনে এলে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় বেশ রদবদলের সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ জোটগতভাবে প্রার্থী দেবে। ১৪ দলীয় জোটের পাশাপাশি জাতীয় পার্টির সঙ্গে নির্বাচনী জোট গড়া হবে। বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং কয়েকটি ইসলামী দলও থাকবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন নির্বাচনী জোটে। এ নিয়ে অবশ্য এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এমনকি ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেনি আওয়ামী লীগ। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ১৪ দলের অন্যতম শরিক দল জাসদের (ইনু) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসুক আর না আসুক– ১৪ দল জোটগতভাবে প্রার্থী দেবে। এ জোটের প্রার্থীদের নৌকা প্রতীক দেওয়া হবে। কোনো প্রার্থী ইচ্ছা করলে দলীয় প্রতীকও নিতে পারবেন।
বিএনপি নির্বাচনে না এলে বিকল্প ভাবনা রয়েছে আওয়ামী লীগের। সে ক্ষেত্রে কয়েকটি আসন উন্মুক্ত রাখার চিন্তা করা হচ্ছে। ওই আসনগুলো আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটের বাইরে থাকা সমমনা রাজনৈতিক দলকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আবার আসন উন্মুক্ত না রেখে ওই সব আসনে দুর্বল প্রার্থী দেওয়ারও চিন্তা রয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের ভোটাররা সমমনা দলের প্রার্থীদের ভোট দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে আসন ভাগাভাগি নিয়ে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের দরকষাকষির সম্ভাবনা খুব কম। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে জাতীয় পার্টিকে নির্দিষ্ট কয়েকটি আসনে আলাদাভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নাও থাকতে পারে। আবার কিছুটা দুর্বল প্রার্থী মনোনয়নের সম্ভাবনাও রয়েছে।
এদিকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, বিএনপির জন্য নির্বাচনের দরজা বন্ধ হয়নি। তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। তবে বিএনপি না এলেও জনগণ নির্বাচনে অংশ নেবে। আওয়ামী লীগ সে ক্ষেত্রে দলগতভাবে ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর উদ্যোগ নেবে। ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ভোটার আগামী নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন বলে তিনি মনে করছেন।
জোটবদ্ধ নির্বাচন কিংবা সমমনা রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর সুবিধার জন্য নির্ধারিত আসন উন্মুক্ত কিংবা দুর্বল প্রার্থী দেওয়ার চিন্তাভাবনা থাকলেও আওয়ামী লীগের যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের বেলায় কোনো ছাড় দেবেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নির্বাচনে জয় পাওয়ার মতো জনপ্রিয়, দক্ষ, সৎ এবং দলের প্রতি শতভাগ আনুগত্য থাকা নেতাদের মনোনয়ন দেবেন। এ জন্য তিনি ৩০০ আসনে দফায় দফায় জরিপও করিয়েছেন।
তপশিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনের হাতে যেসব ক্ষমতা থাকে
সাংবিধানিক একটি প্রতিষ্ঠান হলেও বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীন সেটি নিয়ে সবসময় বিতর্ক দেখা যায়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় অভিযোগ করে করে যে নির্বাচন কমিশন সরকারের ‘আজ্ঞাবহ’ থাকে। অর্থাৎ সরকার সেভাবে চায়, নির্বাচন কমিশনও অতীতে সেভাবেই কাজ করেছে বলে তারা মনে করেন। যদিও ক্ষমতাসীন সরকার সবসময় নির্বাচন কমিশন স্বাধীন বলে দাবি করে। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধান এবং আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, অতীতে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে নির্বাচন কমিশন এমন কোন পদক্ষেপ নেয়নি যাতে ক্ষমতাসীনরা অসন্তুষ্ট হতে পারে। কয়েকটি ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যতিক্রম ঘটেছে।
নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর থেকে কমিশনের হাতে কী ধরনের ক্ষমতা থাকে? সেই ক্ষমতা তারা কতটুকু প্রয়োগ করতে পারে? বাংলাদেশের সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। পর্যবেক্ষকরা,বলছেন এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নিশ্চিত করা আছে। নির্বাচন সংক্রান্ত আইন এবং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের মাধ্যমে।
কর্মকর্তা বদলি
নির্বাচন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীম গণমাধ্যমকে বলেন, তপশিল ঘোষণার পর আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন চাইলে প্রশাসনের মধ্যে রদবদল আনতে পারে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বলা হয়েছে, নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর থেকে বিভাগীয় কমিশনার, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং তাদের অধস্তন কর্মকর্তাদের নির্বাচন কমিশনের সাথে আলোচনা ছাড়া বদলি করা যাবে না। অন্যদিকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে বদলি করার প্রয়োজন হলে করলে নির্বাচন কমিশন লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাবে। এরপর যত দ্রুত সম্ভব সে বদলি কার্যকর করতে হবে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী যদি সরকার কাজ না করে তাহলে আইনের বরখেলাপ হবে। ‘সাধারণত দেখা যায়, সরকার সবসময় তাদের পছন্দমতো কর্মকর্তাদের সেসব জায়গায় নিয়োগ করে দেয়। এটা সব সরকারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য,। নির্বাচন কমিশনের চাহিদা উপেক্ষা করা কিংবা তাদের সাথে আলোচনা না করার নজিরও রয়েছে। ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গাজীপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদকে সে জেলা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়াই তাকে আবারো গাজীপুরে পুনর্বহাল করা হয়েছিল।
বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের তৎকালীন সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, তিনি নির্বাচনের পরেই দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কমিশন সশস্ত্র বাাহিনী বিভাগকে চিঠি দিয়েছিল নির্বাচনের দুইদিন আগে থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার জন্য। কিন্তু সেটি করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। তবে কোনো নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করা কিংবা না করা হলে সেক্ষেত্রে কমিশন কী করতে পারে? “এটা নিয়ে সরাসরি আইনে কিছু বলা নেই। সংবিধানে বলা আছে নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে। কিন্তু যদি না করে বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই।” নির্বাচন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীম গণমাধ্যমকে আরো বলেন, সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে।
এক্ষেত্রে তিনি ভারতের উদাহরণ তুলে ধরেন। যদি সরকার নির্বাচন কমিশনের কোন অনুরোধ উপেক্ষা করে তাহলে সেখানে নির্বাচন কমিশন আদালতে চলে যায়। “বাংলাদেশে কখনোই কোন ইলেকশন কমিশন আদালতে যায়নি,” বলেন মি. আলীম। একই উদাহরণ তুলে ধরেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, আইনের ব্যত্যয় হলে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করে।
প্রার্থিতা বাতিল
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যদি কোনো প্রার্থী নির্বাচনী আইন ও আচরণ বিধির গুরুতর লঙ্ঘন করেন, সেক্ষেত্রে প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে নির্বাচন কমিশন। এ বিষয়টিতে নির্বাচন কমিশনের পুরোপরি এখতিয়ার আছে বলে উল্লেখ করেন মি. আলীম। কিন্তু বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোন উদারহণ নেই বলে উল্লেখ করেন পর্যবেক্ষরা। নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘনের দায়ে জরিমানা ও সতর্ক করার নজির থাকলেও প্রর্থিতা বাতিলের বিষয়টি দেখা যায় না।
রিটার্নিং অফিসারকে নিয়ন্ত্রণ করা
বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে উল্লেখ করা আছে, একজন রিটার্নিং অফিসারকে নির্বাচন কমিশন যেভাবে দায়িত্ব দেবে, তিনি সে দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য থাকবেন। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীমের ভাষায় একজন রিটার্নিং অফিসার একটি এলাকায় ‘অল ইন অল’ বা সর্বেসর্বা। তার তত্ত্বাবধানের নির্বাচন পরিচালিত হয়। জেলা প্রশাসকরা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা নন। তারা যদি নির্বাচনের কমিশনের নির্দেশনা মেনে না চলেন সেক্ষেত্রে কমিশন কী করতে পারে?
“রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ ও বাতিল করা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন তাকে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগের বিষয়টি বাতিল করতে পারে,” বলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম. সাখাওয়াত হোসেন।
ফলাফল বাতিল
এর আগে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশোধনী অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। বিষয়টি নিয়ে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয়েছিল- ‘নির্বাচনের পরে ফলাফল বাতিল করতে পারবে না কমিশন’। এতে নির্বাচন কমিশনের ‘ক্ষমতা খর্ব হয়েছে’ বলে বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়।
তখন নির্বাচন কমিশনের সচিব গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন যে নির্বাচনী কার্যক্রম ও ভোট চলাকালে নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা কমিশনের হাতে আছে। যে সংশোধনী যুক্ত করা হয়েছে সেটি হচ্ছে – নির্বাচনের ফলাফল গেজেট বা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হবার পরে পুরো নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করা যাবে না। পরবর্তীতে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে যে ভোট চলাকালীন নির্বাচনের কমিশনের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা আছে। কমিশন আবশ্যিক মনে করলে ফলাফল গেজেট প্রকাশ করা স্থগিত রাখতে পারবে। নির্বাচন কমিশন বলছে এই ক্ষমতা আগে ছিল না। নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ তদন্ত করতে পারবে, যেটি আগে পারতো না বলে নির্বাচন কমিশন দাবি করছে। তদন্তের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সংগত মনে করলে যেসব কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে সেসব কেন্দ্রের ফলাফল বাতিল করতে পারবে।
২০২২ সালের অক্টোবর মাসে গাইবান্ধায় একটি আসনে উপ-নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দিন ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে সেদিনই ভোটগ্রহণ বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন কমিশনের এই ক্ষমতা বহাল আছে।
ভোট আয়োজনে আত্মবিশ্বাসী ইসি
বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে আত্মবিশ্বাসী নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনী এলাকায় সংঘাত-সহিংসতা এড়াতে দফায় দফায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বসছে ইসি। পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রাখতে নির্বাচনের পরেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ১৫ দিন মাঠে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। মনোনয়নপত্র দাখিলে বাধা, নির্বাচনে পেশিশক্তির নিয়ন্ত্রণে কমিশন অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের ব্যবস্থা নিয়েছে। ভোট কেন্দ্র খুঁজে পাওয়ার ভোগান্তি লাগবে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে কমিশন। এবারে স্মার্টফোনের মাধ্যমে কেন্দ্রে ও কেন্দ্রের পোলিং সম্পর্কিত তথ্য ভোটাররা জানতে পারবেন। এ জন্য ডিজিটাল অ্যাপস চালু করেছে কমিশন। ইসি বলেছে, শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য কমিশন বিভাগীয় ও জেলা সফর করবে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান গণমাধ্যমকে বলেন, আসন্ন সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করতে নির্বাচন কশিমন সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের আত্মবিশ্বাস রয়েছে যে সব অংশীজনের সহযোগিতায় ভোট সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর হবে। ইতোমধ্যেই বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের তাঁদের দায়িত্ব ও করণীয় সম্পর্কে সচেতন করা হয়েছে এবং এ জন্য ভিন্ন ভিন্ন পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে। অচিরেই মাননীয় কমিশনারদের বিভাগ, জেলা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বৈঠক, সম্ভাব্য প্রার্থী, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করার পরিকল্পনা রয়েছে। ‘সব দলের প্রতি আহ্বান থাকবে মতভেদ, মতানৈক্য নিরসন করে নির্বাচনে এসে ভোটারদের কাক্সিক্ষত প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে উৎসাহিত করুন’ সম্মানিত ভোটারদের প্রত্যাশাপূরণে সর্বদাই গুরুত্ব দিয়ে আসছে এ কমিশন এবং একটা সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে সর্বাত্মক সবকিছুই করব ইনশাআল্লাহ। এদিকে সংসদ নির্বাচনের তিন-চার দিন আগেই জেলায় জেলায় ব্যালট পেপার পৌঁছে দেবে নির্বাচন কমিশন। তবে সেই ব্যালট পেপার ভোট কেন্দ্রে ভোটের আগের রাতে, নাকি ভোটের দিন সকালে যাবে সেই বিষয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন। এ ছাড়া নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দে আগে সব ধরনের প্রচার-প্রচারণা নিষিদ্ধ করেছে কমিশন। অন্যদিকে তপশিল ঘোষণা হওয়ায় এখন জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বদলির ক্ষেত্রে ইসির অনুমোদন নিতে হবে। সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হতে স্থানীয় সরকারের মেয়র বা চেয়ারম্যানকে আগে পদত্যাগ করতে হবে। ভোট পর্যবেক্ষণে দেশি সংস্থার আবেদন ২৫ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়ার সময় নির্ধারণ করেছে ইসি। নির্বাচনে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় ভোটারপ্রতি ১০ টাকা ব্যয় করতে পারবেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। নির্বাচনী ব্যয় নির্ধারণ করে দিয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপনে এই ব্যয়সীমা ঠিক করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জাতীয় সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, একজন প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা। নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেছেন, ভোটের তিন-চার দিন আগেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের ব্যালট পেপার জেলা পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দের পর ব্যালট পেপার ছাপানোর কাজ শুরু করবেন তারা। ব্যালট পেপার জেলা পর্যায়ে চলে যাবে নির্বাচনের তিন-চার দিন আগে। ভোট কেন্দ্রে কখন পাঠানো হবে এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তপশিল ঘোষণা হওয়ায় এখন জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বদলির ক্ষেত্রে ইসির অনুমোদন নিতে হবে বলে জানান ইসি সচিব। তিনি বলেন, নির্বাচনের প্রার্থী হতে স্থানীয় সরকারের মেয়র বা চেয়ারম্যানকে আগে পদত্যাগ করতে হবে। পদত্যাগ কার কাছে করবেন, সেটা আইনে বলা আছে। তিনি বলেন, ‘আগাম প্রচারণা বিষয়ে আমরা আন্তমন্ত্রণালয় সভায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছি, তারা তাদের মতো করে উদ্যোগ নেবেন।’
তথ্যসূত্র: প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়া