আসিফ হাসান (নূর নবী): অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছড়ায় বলতে হয়, ‘ক্ষুদ্র মশা/মশার কামড় খেয়ে আমার স্বর্গে যাবার দশা’!
আজ ২০ আগস্ট, বিশ্ব মশা দিবস। ১৮৯৭ সালের এই দিনেই আবিষ্কৃত হয় মশার সঙ্গে ম্যালেরিয়া রোগের সম্পর্ক। আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী রোনাল্ড রস। মশাবাহিত রোগের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হয়। দ্য লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের উদ্যোগে ১৯৩০ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দিনটি পালিত হচ্ছে। বিভিন্ন জীবনঘাতী রোগের বাহক মশা। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগগুলোর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ থাকতে হয় বছরের বড় একটি সময়। শারীরিক আকৃতিতে অতি ক্ষুদ্র। কিন্তু এই ক্ষুদ্র পতঙ্গই নাভিশ্বাস তুলে দিতে পারে। এই মশার কল্যাণে আমরা এই সময়ে ভুগছি এক মহা আতঙ্কে। দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই মারাত্মক আকার ধারণ করছে। এই ভাইরাসটি মশাবাহিত। যে মশা এই ভাইরাসটির বাহক সেটির নাম এডিস। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এডিস মশা নিধনের জন্য যে কার্যক্রম চালাচ্ছে তার কোনো বাস্তব কার্যকারিতা ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বলে দাবি করেছেন কীটতত্ত্ববিদরা। এতে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মারা যাচ্ছে মানুষ। কীটতত্ত্ববিদদের দাবি, দেশে প্রাকৃতিক কারণে যেভাবে মশার বৃদ্ধি ও ডেঙ্গু সংক্রমণ হচ্ছে তা প্রাকৃতিকভাবেই কমে আসছে। তারা আরো বলেন, দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশন ব্যর্থ। তারা আরো বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে যে ডেঙ্গু রোগীর পরিসংখ্যান দেওয়া হচ্ছে তা খণ্ডিত। সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তামাশা করছে।
গত ১৯ জুলাই শনিবার দুপুরে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে দেশে চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতির সমাধানে করণীয় বিষয়ে জনগণকে অবহিতকরণে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘কেন এই ডেঙ্গু মহামারী? পরিত্রাণ কোন পথে?’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলন ডাকে বাংলাদেশ ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ। সংবাদ সম্মেলনে সাবেক সচিব মার্গুব মোরশেদ, কীটতত্ত্ববিদ ইন্দ্রাণী ধর, অধ্যাপক ড. আবু ফায়াজ মো. আসলাম, মেডিকেল কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক তাহমিনা আক্তার, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. আফরোজা সুলতানা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইফুর রহমানসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে সঞ্চালনা করেন ‘কীটতত্ত্ববিদ ও বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতি’র সাবেক সভাপতি এবং জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘কীটতত্ত্ববিদের দায়িত্বের জায়গা থেকে আমরা কথা বলছি। ম্যান মসকিউটো এফেক্ট কমাতে হবে। একটি পূর্ণাঙ্গ মশা ৩/৪ সপ্তাহ পর্যন্ত ডেঙ্গু ছড়াতে পারে। উড়ন্ত মশা মারার বিকল্প নেই। ফগিংয়ের মাধ্যমে ২০ শতাংশও মশা মারা সম্ভব নয়। ইউএলভি ফর্মুলার মাধ্যমে এডাল্ট মশা মারতে হবে।’ মশা যে পর্যায়ে চলে এসেছে সেখান থেকে কন্ট্রোল করা কঠিন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে নিয়ন্ত্রণে এসেছে।’
মনজুর চৌধুরী আরো বলেন, ‘আমরা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মশা নিধন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। তারা মশা মারতে যে কীটনাশক প্রয়োগ করছে, তার প্রয়োগ প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে আরও গবেষণা করতে হবে। তারা বিটিআই নামে যা এনেছে তা পয়জন। কোনো ধরনের নিয়মনীতি না মেনে এ বিটিআই আনা হয়েছে এবং তা প্রয়োগও করা হয়েছে। বিটিআইয়ের বিভিন্ন ক্লাসিফিকেশন আছে। যেটা উত্তর সিটি করপোরেশন এনেছে সেটা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি সেটা পাবলিক হেলথের জন্য নয়, কৃষির জন্য। সিটি করপোরেশন একটি চক্রে আটকে আছে। তারা বিভিন্ন সময় পাখি ছাড়ে, ব্যাং ছাড়ে কিন্তু কার্যকরী কিছুই হচ্ছে না।’ তারা মশা নিধনে পানিতে হাঁস, ব্যাঙ ছাড়ছে। মশা নিধন করতে ফড়িং ছাড়ছে, এসব কার্যক্রম খুবই হাস্যকর, লোক দেখানো। এসব কার্যক্রমের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।’ এছাড়া মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশনগুলো যেসব কর্মসূচি নিচ্ছে সেগুলোর কোনও কার্যকারিতা নেই। সুতরাং এসব ফগিং করলেও যা, না করলেও তা। তিনি বলেন, মশা মারার জন্য যে সময়ে ফগিং দেওয়া হয়, সে সময়ে মশা তার নিজ জায়গায় থাকে না। বিভিন্ন দিকে উড়াউড়ি করে। ঠিক সূর্যদয় ও সূর্যাস্তের পূর্ব মুহূর্তে মশা কামড়ায়। এজন্য ফগিংটা হওয়া উচিত সেই সময়ে। ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে ফুলহাতা শার্ট, হাতে পায়ে মোজা, দিনে মশারির ভেতর ঘুমানো এবং অফিসে প্রতিদিন সকালে অ্যারোসেল ব্যবহারের পরামর্শ দেন এই কীটতত্ত্ববিদ। পাশাপাশি যে এলাকায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাবে সেখানে ক্রাশ কর্মসূচি চালানোর কথা বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ প্রত্যেকেই প্রচারণা চালাচ্ছে যে, দূষিত পানিতেও এডিস মশা জন্মায়। এর কোনও বৈজ্ঞানিক রেফারেন্স তারা দেখাতে পারবে না। এডিস মশা কখনই দূষিত পানিতে জন্মায় না। এছাড়াও বলা হচ্ছে তিন দিনের জমা পানিতে এডিস মশা জন্মায়, কিন্তু বিষয়টি তা নয়। এডিস মশা জন্মাতে অন্তত ৭দিন সময় লাগে। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি মনজুর চৌধুরী বলেন, “যেখানে অল্প সময়ে বেশি সংখ্যক রোগী, যেখানে পাওয়ার কথা না সেখানেও রোগী পাওয়া যায় সেটাই মহামারী। “জুলাই মাসে যে আক্রান্ত এবং মৃত্যু হয়েছে, সেটা আক্ষরিক অর্থেই মহামারী। মানুষ ভয় পেতে পারে এজন্য সরকার ঘোষণা করতে পারছে না।” এ বছর অগাস্টের প্রথম ১৭ দিনেই দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৪৫ জনে। এত রোগী এ বছর আর কোনো মাসে দেখা যায়নি। এর আগে জুলাইয়ের ৩১ দিনে ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশে নয়জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়। তাতে এ বছর এডিস মশাবাহিত রোগটিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৫৩ জনে। একই সময়ে যে ১৫৬৫ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, তাদের নিয়ে এ বছর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫ হাজার ৮৭৭ জনে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. আফরোজা বলেন, মশাকে আমরা আসলে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিচ্ছি না, যে কারণে মশার কবল থেকেও আমরা বের হয়ে আসতে পারছি না। ২০ আগস্ট মশা দিবস, এই দিবসটা উপলক্ষে আমাদের আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিৎ। এই দিবসটা উপলক্ষেও যদি আমরা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারি এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারি, তাহলেও ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কাজে আসতো। তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রকোপ বাড়ার কারণে এখন শহরের মানুষেরা মোটামুটি সচেতন হলেও গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে সচেতনতা নেই বললেই চলে। এজন্য সরকারের কাছে আমার আহ্বান থাকবে, অন্তত মশা দিবসটাকে কেন্দ্র করে এই বছর না হোক, আগামী বছরগুলোকে কেন্দ্র করে কিছু কার্যক্রম ও পরিকল্পনা হাতে নেওয়া উচিৎ।
ব্যক্তি সচেতনতায় গুরুত্বারোপ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবু ফয়েজ মো. আসলাম বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে কি প্রটেকশন নিয়েছি, সেটা আমাদের ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার আমার জন্য কী করছে সেটা পরের বিষয়। কারণ আমি যদি ফুল হাতা জামা পড়ি, আমি যদি দরজা-জানালাটা সময়মতো বন্ধ করে দেই বা স্ক্রিন ব্যবহার করি, দিনে ঘুমানোর সময় আমি যদি মশারী ব্যবহার করি, এসব ক্ষেত্রে আমাকে মশা কামড়ানোর সম্ভাবনাটা অনেকাংশেই কমে যাবে।
গবেষণায় গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, আমাদের এমনকিছু লোক থাকতে হবে, যারা সবসময় এই বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করবে। কারণ মশা প্রতিনিয়ত তার ধরন পাল্টাচ্ছে। আমরা যে ওষুধগুলো ব্যবহার করছি, সেগুলো কি নতুন ধরনেও কার্যকর হচ্ছে কিনা, সেগুলোও গবেষণা করতে হবে।
কীটতত্ত্ববিদ সাইফুল আলম বলেন, ‘২০১৬ সালের পর থেকে সারা বছরই কম বেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। তার মানে আমরা মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সারা বাংলাদেশকে নিয়ে একটি কন্ট্রোল প্রোগ্রাম নেওয়া দরকার। কিন্তু আমাদের এখানে পরীক্ষিত কোনে মশা কন্ট্রোল পদ্ধতি চালু নেই। মশা নিধনের ক্ষেত্রে আমরা ইনডিশিসনে ভুগি। আমরা কি ফগিং করব নাকি লার্ভিসাইড নাকি টিকা আনব। কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা আছে কিনা সেটা দেখতে হবে। আমরা কত দিনের মধ্যে মশা নিয়ন্ত্রণ করব সেটার নির্ধারণ করতে হবে।’
সাইফুল আলম আরও বলেন, ‘জনগণের বাড়ি-বাড়ি যদি ইনসেকটিসাইড পৌঁছে দেওয়া যায়। তবে আমরা জনগণের হাতে কোন ধরনের অস্ত্র দেইনি, দেওয়া হয়নি কোনো ট্রেনিং। কিন্তু বলছি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে আগে জনগণের হাতে মশা মারার অস্ত্র দিতে হবে।’