নুরুল আমিন: বাংলাদেশে এখনো জাতীয় নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়নি। এ রকম সময়ে তার দক্ষিণ সীমান্তঘেঁষা মিয়ানমারের আরাকানে কী হচ্ছে, সে বিষয় দেশটির সংবাদপত্র জগতে ভালো মনোযোগ পাবে না, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আরাকান বা রাখাইন প্রদেশের পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য নতুন করে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো মোড় নিচ্ছে বলেই খবর মিলছে। আরাকানের প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান ইতিমধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে। কিন্তু এবার বৌদ্ধ রাখাইনদেরও সেখানে ব্যাপক হারে উদ্বাস্তু হতে দেখা যাচ্ছে।
এক মাস যাবৎ আরাকানের উত্তরে স্থানীয় আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর ব্যাপক যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধাবস্থায় প্রচুর বৌদ্ধধর্মাবলম্বী রাখাইন বসতবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী স্থানীয় বেসামরিক নাগরিকদের এএর বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এ কারণে আহত-নিহত হওয়ার ভয় ছাড়াও অনেকেই পালাচ্ছে মানবঢাল হওয়া এড়াতে।
ওংঢ়ধযধহর ঞবধএক মাস ধরে এই যুদ্ধাবস্থা চললেও তা ব্যাপকতা পেয়েছে ২১ ডিসেম্বর থেকে। ওই দিন মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী দেশটির উত্তরাঞ্চলে একতরফাভাবে চার মাসের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। সশস্ত্র বাহিনী বলছে, তারা আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই যুদ্ধস্থগিত বজায় রাখতে চায়। কিন্তু বাস্তবে এই ঘোষণার পর যুদ্ধ আরও তীব্রতা পেয়েছে।
কাচিন, তাং আর্মিসহ উত্তরের গেরিলা সংগঠনগুলো বলছে, আরাকানকেও যুদ্ধবিরতির আওতায় না আনা হলে তারা এই প্রস্তাবে আগ্রহী নয়। তারা পুরো দেশে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মিকে (কেআইএ) আরকানের এএর অন্যতম বন্ধু সংগঠন বলে বিবেচনা করা হয়। এএ, কেআইএ, তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) হলো মিয়ানমারে ‘নর্দান অ্যালায়েন্স’ নামের গেরিলা জোটের শরিক সংগঠন।
ধারণা করা হচ্ছে, কাচিন ও শ্যান প্রদেশে যুদ্ধবিরতি কায়েম হলে রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনী আরাকানে এএর বিরুদ্ধে অভিযানে ব্যাপকতা দিতে পারবে। কিন্তু নর্দান অ্যালায়েন্স যুদ্ধবিরতি প্রত্যাখ্যান করায় কাচিন ও শ্যান প্রদেশের পাশাপাশি আরাকানেও এখন ব্যাপক আকারে যুদ্ধ পরিস্থিতি ছড়িয়ে পড়ল।
ইরাবতীসহ মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, চলতি সপ্তাহে আরাকানে একদা রোহিঙ্গাপ্রধান রাথিডং টাউনশিপে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী ঘরে ঘরে এএ গেরিলাদের সন্ধানে যৌথ অভিযান চালাচ্ছে। এই অভিযানকালে স্থানীয় সব বৌদ্ধ রাখাইন নারী-পুরুষ-শিশুকে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে প্যাগোডাগুলোয় রাখা হয়েছে। অভিযানের ঘেরাও ভেঙে অনেক বৌদ্ধ পরিবার অন্যত্রও পালাচ্ছে। সাধারণত প্যাগোডাগুলোয় যারাই যাচ্ছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যেসব রাখাইন সম্প্রতি কাচিন সফর করেছে, তাদের বাড়তি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হচ্ছে এবং আটক করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কাচিন প্রদেশেই রয়েছে আরকান আর্মির কেন্দ্রীয় সদর দপ্তর। সেখান থেকেই তারা আরকানের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে থাকে।
আরাকানে মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী সর্বশেষ অভিযানের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে তাদের ওপর সাম্প্রতিক কিছু গেরিলা হামলার ঘটনাকে। অতীতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সময় ‘আরসা’ নামের সশস্ত্র সংগঠনের তৎপরতার কথা বলা হলেও এখন এএর হামলার কথা বলা হচ্ছে। এএর সূত্রগুলোও আরকানের বিভিন্ন স্থানে তাদের কর্মীদের সঙ্গে মিয়ানমার বাহিনীর সংঘাতের তথ্য নিশ্চিত করেছে। তারা এও জানিয়েছে, রাথিডংয়ের পাশাপাশি বুথিডংয়েও অনুরূপ অভিযান চলছে। এটাও বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাপ্রধান বসতি এলাকা ছিল একদা। বর্তমানে এই এলাকাগুলোয় প্রতিটি অভিযানকালেই মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা তাঁদের পাশে কয়েকজন করে বৌদ্ধ রাখাইনকে মানবঢাল হিসেবে রাখছেন। বিশেষ করে অনেকগুলো ভূমিমাইন বিস্ফোরণের পর থেকে এই কৌশল নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, রাথিডং ও বুথিডং ছাড়াও তৃতীয় যে অঞ্চলে মিয়ানমার বাহিনীর অভিযান চলছে, তা হলো পালেতোয়া। এই এলাকাটি বাংলাদেশের বান্দরবানের খুবই নিকটবর্তী। অন্য এলাকাগুলোও বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে বেশি দূরে নয়।
উপরিউক্ত তিন এলাকাতেই ভূমিমাইনের আক্রমণ এড়াতে মাঝেমধ্যে রাষ্ট্রীয় বাহিনী হেলিকপ্টারের সাহায্যে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। পাশাপাশি প্রায়ই এসব এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে মর্টার বিনিময় চলছে। উপরিউক্ত তিনটি এলাকা থেকেই কয়েক হাজার বৌদ্ধ রাখাইন এবং খুমিকে ইতিমধ্যে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছে।
এই যুদ্ধাবস্থার মধ্যেই ২৪ ডিসেম্বর আরকান লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এএলডি) গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা খিন থান মাউংকে তাঁর বাড়িতে হত্যা করা হয়েছে। তিনি এএলডির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডে এএ যুক্ত থাকার অভিযোগ তুলেছে এএলডি। যদিও তার সত্যতা কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র দ্বারা যাচাইয়ের সুযোগ নেই। তবে এই ঘটনার পর থেকে পুরো আরাকান থেকে বৌদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠকেরা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে রয়েছেন। এএলডি হলো আরাকান ন্যাশনাল পার্টির (এএনপি) বাইরে আরকানের পুরোনো একটি রাজনৈতিক দল।
এদিকে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই এএ আরকানজুড়ে পুলিশ স্টেশন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সংস্থার কাছে এই রূপ চিঠি পাঠাচ্ছে যে তারা যেন ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করেন। ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান হলো এএর রাজনৈতিক শাখা। এই সংগঠন আরাকানে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার এবং শিক্ষা ও কাজের রাষ্ট্রীয় সুযোগপ্রাপ্তির বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে থাকে।
এদিকে উত্তরাঞ্চলে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা সত্ত্বেও মিয়ানমারে জাতিগত স্বাধিকারের জন্য সংগ্রামরত অন্যান্য এলাকার গেরিলা সংগঠনগুলোর সঙ্গেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সম্পর্ক গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। কারেনদের সশস্ত্র সংগঠন কেএনইউ এবং শ্যান সংগঠন ‘রিস্টোরেশন কাউন্সিল অব শ্যান স্টেট’ যুদ্ধবিরতিতে থাকলেও সম্প্রতি সাময়িকভাবে শান্তি আলোচনা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
অন্যদিকে, আরকানে চলমান সংঘাতের মধ্যেই ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা মিয়ানমারের এলাকায় সে দেশের একজন পুলিশ সদস্যের লাশ পাওয়া গেছে। গত সপ্তাহে এই পুলিশ সদস্য মংডুতে ১৭ ডিসেম্বর এক সংঘর্ষকালে অপহৃত হয়েছিলেন। ওই সংঘর্ষে আরেকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছিলেন বলে সরকার–সমর্থিত সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবাল নিউ লাইট’ জানিয়েছিল। এ ঘটনায় সীমান্তজুড়ে উত্তেজনা ও ভীতি বেড়েছে।