আসিফ হাসান: বোম্বের নায়ক সুশান্ত রাজপুতের আত্মহত্যা নিয়ে মনস্তাত্ত্বিকদের মতে, অবসাদের এক ও একমাত্র কারণ থাকতে পারে। আবার একাধিক হতাশার যোগফলও বড় হতাশা এবং সেখান থেকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে পারে কাউকে। যদি আত্মহত্যাই করে থাকেন সুশান্ত এবং সেটা যদি হতাশা থেকে হয়, তা হলে কি সবগুলিই ছিল তার নেপথ্যে। কেরিয়ারের নিম্নমুখী গ্রাফ, একাধিক সম্পর্কের টানাপড়েন, লকডাউনের একাকিত্ব—সব মিলিয়েই কি অবসাদ জাঁকিয়ে বসেছিল সুশান্তের মধ্যে? আপাতত উত্তর নেই। তদন্তকারীরা হয়তো পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে একটা উপসংহারে আসতে পারেন, কিন্তু সুশান্তের মধ্যে যে ঠিক কী চলছিল, সেটা হয়তো আর কোনও দিনই জানা যাবে না।
নিজে ব্যোমকেশ বক্সীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সমাধান করেছেন মাদক পাচার রহস্যের। কিন্তু সুশান্ত সিংহ রাজপুতের নিজের মৃত্যুর কারণ এখনও পর্যন্ত ‘আনটোল্ড স্টোরি’। পুরোপুরি রহস্যে মোড়া। মুম্বই ক্রাইম ব্রাঞ্চের গোয়েন্দাদের প্রাথমিক অনুমান, আত্মহত্যা করেছেন বলিউড অভিনেতা। যদিও অন্য সব সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখছেন তাঁরা। কিন্তু যদি আত্মহত্যাই ধরে নেওয়া হয়, তাহলেও উঠে আসছে একটাই প্রশ্ন— কেন? কেরিয়ারের প্রায় শুরুর দিকেই কেন আত্মহত্যা করলেন তরুণ অভিনেতা?
এই প্রশ্নেই উঠে আসছে একাধিক সম্ভাবনা এবং জল্পনা। প্রথমেই এসেছে পাঁচ দিন আগে বলিউডের এক আত্মহত্যার ঘটনা। গত ৮ জুন মালাডের বাড়ির ১৪ তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন দিশা সালিয়ান। সেই মৃত্যুর সঙ্গে সুশান্তের মৃত্যুর কী সম্পর্ক? এই দিশা সালিয়ান ছিলেন সুশান্তের প্রাক্তন ম্যানেজার। বলিউডের অন্দরে যাঁদের আনাগোনা, তাঁরা জানেন, বলিউডে সুশান্তের প্রতিষ্ঠার পিছনে বিরাট অবদান রয়েছে সেলিব্রিটি ট্যালেন্ট ম্যনেজার দিশা সালিয়ানের। কিন্তু পরে সুশান্তের ম্যানেজার হিসেবে আর দেখা যায়নি তাঁকে। যদিও দিশা নিজেই ছেড়েছিলেন, না কি সুশান্ত তাঁকে সরিয়েছিলেন, সেই বিষয়টি স্পষ্ট নয়। দিশার মৃত্যুর তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। তার এক সপ্তাহের মধ্যেই সুশান্তের রহস্যমৃত্যু। দুই মৃত্যু এবং দু’টিই আত্মহত্যা? এ কি নেহাতই সমাপতন? নাকি দুই মৃত্যুর মধ্যে কোনও যোগসূত্র রয়েছে? ভাবাচ্ছে গোয়েন্দাদের।
তবে আত্মহত্যার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না গোয়েন্দারা। তার একাধিক পারিপার্শ্বিক কারণও রয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরেই মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন বলিউডের ‘মাহি’ সুশান্ত। তার জন্য চিকিৎসাও চলছিল। শেষ পর্যন্ত সেই অবসাদের কাছেই কি হার মানলেন ‘পিকে’র সেই ‘সরফরাজ’ সুশান্ত? যদি সেটা সত্যি হয়, তাহলেও অবসাদ বা হতাশারও তো কারণ থাকে। সেই কারণটাই বা কী? অথবা কী কী? তার উত্তর খুঁজতে গিয়েও বেরিয়ে আসছে একাধিক জল্পনা, গুঞ্জন এবং সম্ভাবনা।
টেলিভিশন থেকে বলিউডে পা রেখেছিলেন ‘কাই পো চে’-র মাধ্যমে। বাণিজ্যিক ভাবে সে ছবি সফল। পছন্দ হয়েছিল ফিল্ম ক্রিটিকদেরও। এর পর মহেন্দ্র সিংহ ধোনির বায়োপিক ‘ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ সুপার হিট। বলিউডে কার্যত জমে গেল সুশান্তের কেরিয়ার। তার পর একে একে ‘রাবতা’, ‘কেদারনাথ’, ‘পিকে’, ‘শুদ্ধ দেশি রোমান্স’, ‘ছিঁচোড়ে’র মতো মুভিতে অভিনয়। বিরাট সাফল্য না পেলেও সবগুলি ফ্লপ— এমনও বলা যায় না। কিন্তু এখানেই হতাশার কারণ খুঁজে পেয়েছে বলিউড। কেন? অনেকেই বলছেন, আসলে মূলত ধোনির বায়োপিকের পরে আর তেমন হিট সেই অর্থে দিতে পারেননি সুশান্ত। শুরুর কয়েক বছরেই কার্যত পড়তির দিকে চলে যাচ্ছিল সুশান্তের কেরিয়ার। ‘ছিঁচোড়ে’র পর তেমন ভাল কাজও হাতে ছিল না বলেই খবর। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে বাসা বাঁধছিল হতাশা।
বলিউড মানেই আরব সাগরের ঢেউয়ের মতো মুহূর্তে মুহূর্তে ছড়ায় সম্পর্কের গুঞ্জন। সুশান্তের জীবনেও তার কমতি ছিল না। বরং কিছুটা বেশিই ছিল বলা যায়। কৃতি স্যানন থেকে অঙ্কিতা লোখন্ডে, সারা আলি খান থেকে দিশা পাটানি কিংবা রিয়া চক্রবর্তী— সুশান্তের সঙ্গে সম্পর্কের গুঞ্জন ছড়িয়েছে নানা সময়ে। কিন্তু সেগুলো সব গুঞ্জন হিসেবেই থেকে গিয়েছে। পাকাপাকি ভাবে কোনও নায়িকার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, এমন খবর বলিউডের পাপারৎজিদের কাছেও ছিল না। রিয়া চক্রবর্তীর সঙ্গে সুশান্তের আউটিং, খানাপিনার কিছু ছবি ছড়ালেও পাকাপাকি সম্পর্ক পর্যন্ত গড়ায়নি বলেই খবর। এর মধ্যে আবার শনিবারই ছিল দিশা পাটানির জন্মদিন। আর রবিবার সকালেই সুশান্তের দেহ উদ্ধার। এটাও কি কাকতালীয়? নাকি কোনও যোগসূত্র থাকতে পারে? গোয়েন্দাদের আতসকাচ থেকে বাদ থাকছে না কোনওকিছুই।
দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছিল লকডাউন। দেশের মধ্যে মহারাষ্ট্রেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেশি। তার মধ্যেও আবার মুম্বইয়েই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। শুধু মুম্বই এবং শহরতলিতেই আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। ফলে পুরো বলিউড কার্যত ঘরবন্দি। তার মধ্য়ে আবার এই পুরো লকডাউন পর্বে একাই দিন কাটিয়েছেন সুশান্ত। শুটিং বন্ধ। এখনও চালু হয়নি। আবার লকডাউনের জেরে মুক্তি আটকে গিয়েছিল সুশান্তের অভিনীত ‘দিল বেচারা’র মুক্তি আটকে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে লকডাউন পর্বেও কি হতাশা বাড়ছিল সুশান্তের? উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, তবে তদন্ত সাপেক্ষ, বলছেন মুম্বই পুলিশের তদন্তকারীরা।
তারা দেখা ছিল নেশা, মেধাবী ছাত্র, ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়েন অভিনয়ের টানে
দিল্লি কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রবেশিকা পরীক্ষায় সপ্তম স্থান পেয়েছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানের অলিম্পিয়াডে জয়ী হয়েছিলেন। হতেই পারতেন মেধাবী, উচ্চপদস্থ চাকুরে। কিন্তু তার পরিবর্তে সুশান্ত সিংহ রাজপুত বেছে নিয়েছিলেন রুপোলি দুনিয়াকেই।
বিহারের পটনায় সুশান্তের জন্ম ১৯৮৬ সালের ২১ জানুয়ারি। তাঁদের আদি বাড়ি ছিল বিহারের পূর্ণিয়া জেলায়। পটনার সেন্ট ক্যারেন্স হাই স্কুল, তার পর দিল্লির হংসরাজ মডেল স্কুল থেকে পড়াশোনা করেন তিনি।
ইন্ডিয়ান স্কুল অব মাইনস-সহ মোট এগারোটি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রবেশিকা পরীক্ষায় সফল হন তিনি। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শুরু করেন দিল্লি কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এ।
কিন্তু ক্রমে অভিনয় চেপে বসেছে তাঁর মনে। তিন বছরের মাথায় ছেড়ে দিলেন পড়া। তাঁর মনে অভিনয় ও নাচের প্রতি ভালবাসার বীজ বপন করেছিলেন কোরিয়ো্গ্রাফার শামক ডাভর। তাঁর কাছে নাচের প্রশিক্ষণ নিতেন সুশান্ত।
মুম্বইয়ে এসে সুশান্ত প্রথমে নাদিরা বব্বরের নাটকের দলে যুক্ত হন। সে সময় টেলিভিশনে চকোলেটের বিজ্ঞাপনে তিনি ছিলেন জনপ্রিয় মুখ।
থিয়েটার থেকেই ছোট পর্দায় হাতেখড়ি। ২০০৮ সালে একতা কপূরের মেগাসিরিয়াল ‘কিস দেশ মেঁ হ্যায় মেরা দিল’-এ জনপ্রিয় হয় সুশান্তের অভিনয়। এর পর ‘পবিত্র রিস্তা’ সিরিয়ালেও তাঁর অভিনয় দর্শকদের মন জয় করে নেয়।
২০১৩ সালে প্রথম অভিনয় ছবিতে। অভিষেক কপূরের পরিচালনায় ‘কাই পো চে’ ছবিতে রাজকুমার রাও ও অমিত সাধের সঙ্গে তিনিও ছিলেন মুখ্য অভিনেতা।
দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় বলিউডের বড় পর্দায় ব্যোমকেশ বক্সীকে নতুন রূপে পেশ করেন তিনি। ২০১৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল থ্রিলার ‘ডিটেক্টিভ ব্যোমকেশ বক্সী’।
তার পরের বছরেই সুশান্ত সিংহ রাজপুত নিজেকে ধরা দেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি রূপে। নীরজ পাণ্ডের পরিচালনায় ধোনির বায়োগ্রফি ‘এম এস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’-তে সুশান্তের অভিনয় প্রশংসিত হয়। প্রসঙ্গত তাঁর বোন মিতু সিংহও এক জন ক্রিকেটার।
ধোনির চরিত্র সঠিক ভাবে তুলে ধরতে তিনি মাঠে কাটিয়েছেন বহু সময়। প্রাক্তন জাতীয় উইকেটকিপার কিরণ মোরের কাছে কোচিং শিখেছিলেন। নিখুঁত নকল করেছিলেন ধোনির ব্যাটিং স্টাইল। পর্দায় তার হেলিকপ্টার শট বাহবা কুড়িয়েছিল ধোনিরও।
সুশান্তের ফিল্মোগ্রাফিতে উল্লেখযোগ্য অন্য ছবিগুলি হল ‘রাবতা’, ‘কেদারনাথ’, ‘সোনচিড়িয়া’ এবং ‘ছিছোড়ে’। এ বছর মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল ‘দিল বেচারা’। অসমাপ্তই থেকে গেল সেই ছবির কাজ। পাশাপাশি ১২ জন বিখ্যাত ভারতীয়ের বায়োপিকে তাঁর অভিনয় করার কথা ছিল।
অভিনেত্রী অঙ্কিতা লোখণ্ডের সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্ক ছিল সুশান্তের। ২০১৬ সালে বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাঁদের। ব্রেকআপের কারণ হিসেবে সুশান্তের বদলে যাওয়া অ্যাটিটিউড এবং কৃতী শ্যাননের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা বলা হয়।
অঙ্কিতাও এ ব্যাপারে সুশান্তকেই সরাসরি দায়ী করেছিলেন। তাঁর ইনস্টাগ্রাম পোস্ট দেখেই বোঝা যেত, এই বিচ্ছেদ কতটা কষ্ট দিচ্ছে অঙ্কিতাকে। সেই তুলনায় সুশান্ত অনেক নিরুত্তাপ ছিলেন।
ইন্ডাস্ট্রির অন্দরের খবর, ধোনির বায়োপিক করার সময় থেকেই সুশান্তের মধ্যে বদল আসে। ওই সময়েই অঙ্কিতার সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়। ছবির সাফল্য সুশান্তকে অনেকটা বদলে দিয়েছিল বলেও মনে করেন অনেকে।
‘রাবতা’ ছবির সহনায়িকা কৃতী শ্যাননের সঙ্গেও সুশান্তের সম্পর্ক ছিল বলে গুঞ্জন ছিল ইন্ডাস্ট্রিতে। তবে সেই সম্পর্কও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ২০১৮ সালে দু’জনে আলাদা হয়ে যান।
কয়েক দিন আগেই জন্মদিন ছিল সুশান্তের আর এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী দিশা পাটানির। সহনায়িকা দিশার সঙ্গেও তাঁর বিশেষ সম্পর্ক ছিল বলে অনুমান অনেক অনুরাগীর। তবে সেই সম্পর্ক রয়ে যায় গুঞ্জনের স্তরেই।
এর পর রিয়া চক্রবর্তীর সঙ্গেও সুশান্তের ঘনিষ্ঠতা ঘিরে আলোড়িত হয় গুঞ্জন। শোনা যায়, এই মুহূর্তে রিয়া-ই ছিলেন তাঁর বিশেষ বান্ধবী।
গত ৮ জুন রহস্যমৃত্যু হয় সুশান্তের প্রাক্তন ম্যানেজার দিশা সালিয়ানের। মুম্বইয়ের মালাডের এক বহুতল থেকে পড়ে গিয়ে তিনি মারা যান। পুলিশের ধারনা, তিনি আত্মঘাতী হয়েছেন। দিশার মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছিলেন সুশান্ত সিংহ রাজপুত। তখন কে আর জানত, এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হবে সুশান্তেরও।
মাত্র ৩৪ বসন্ত কাটিয়েই থেমে গেলেন সুশান্ত। ইদানীং তাঁর ছবি প্রত্যাশিত সাফল্য পাচ্ছিল না বক্স অফিসে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ নিজেই নিজেকে দিলেন না। ইতি টানলেন জয়যাত্রায়।
মাকে হারিয়ে ১৮ বছর আগে এক বার বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল তাঁর জীবন। সম্প্রতি কিছুটা হতাশার শিকার এই নায়ক শেষ টুইট করেছিলেন নিজের মাকে নিয়ে। এ বার মায়ের কাছেই চলে গেলেন তিনি। তারকার বলয় ছেড়ে তারাদের দেশে। সেই তারাদের দেশে, রাতের আকাশে যাদের দেখে কাটত তাঁর অবসর।
ফলাফল নয়, প্রচেষ্টাই ঠিক করে দেয় জীবনে কে সফল, কে ব্যর্থ। ‘ছিছোড়ে’ ছবিতে অনিরুদ্ধ পাঠক রূপী সুশান্ত বলেছিলেন তাঁর ছেলেকে। আত্মহত্যার অসারতাকে তুলে ধরা সেই মুখটাই পর্দার বাইরে বেছে নিলেন আত্মহননের পথ। ব্যবধান রয়েই গেল জীবন আর পর্দার চিত্রনাট্যের মাঝে।
তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা