ঢাকা, বাংলাদেশ  |  শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪



  বিভাগ : ভ্রমণ তারিখ : ২৪-১০-২০২২  


গোতল্যান্ড: অপার সৌন্দর্যের এক মায়াবী দ্বীপ


  লিয়াকত হোসেন



লিয়াকত হোসেন: সুইডেনের মূলভূমি থেকে মাত্র নব্বই কিলোমিটার দূরে কাচস্বচ্ছ বাল্টিক সাগরে ভাসছে ৩১৪০ বর্গ কিলোমিটারের মাঝারি দ্বীপ গোতল্যান্ড। দ্বীপটি নিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই কিংবদন্তী আছে। কোন এক জাদুকরের মন্ত্রে দ্বীপটি প্রতি সন্ধ্যায় ভেসে উঠতো আবার প্রভাতের সঙ্গে সঙ্গেই সাগরের গভীরে তলিয়ে যেত। নবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত সুইডিশ লেখিকা সেলমা লর্গালফের অমর চরিত্র নয় বছর বয়সী বালক নীল্স হলর্গেসন বালুচরে একটি পয়সা খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ করেই দ্বীপটির দেখা পেয়েছিল। সে শুধু স্বল্প সময়ের জন্য, তারপরই দ্বীপটি চোখের নিমেষে হারিয়ে যায়। কিংবদন্তী আছে দ্বীপের প্রথম বাসিন্দার নাম সেলভার, যিনি দ্বীপে এসে প্রথম আগুন জ্বালিয়ে ছিলেন। আগুনের আলো পেয়ে দ্বীপটি আর অদৃশ্য হয়ে যায়নি। সেলভারের কবর এখনো আছে। দ্বীপের পূর্ব উপকূলে বোগে নামক জায়গায় প্রাচীন কবরটি পাথর দিয়ে সীমানাবদ্ধ করে সাজানো। কিন্তু কিংবদন্তী যাই বলুক জোয়ার ভাটার জন্যই দ্বীপটি সাগরে তলিয়ে যেতো আবার ভেসে উঠতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

ফোরো দ্বীপ
প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতানুযায়ী সাত হাজার বছর আগে থেকেই এই দ্বীপে মানুষ বসবাস করে আসছে। কালক্রমে দ্বীপটি বাল্টিক সাগরের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়। বেশ কিছু আরবীয় দিরহাম আবিস্কৃত হয়েছে দ্বীপটিতে। অনুমান করা হয় বাণিজ্যসূত্রে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে দ্বীপটির সংযোগ ছিল, বিশেষ করে আব্বাসীয় খলিফাদের যুগে। পরবর্তীতে জার্মানরা বাণিজ্য উপলক্ষে এসে ১৩৯৮ সালে দ্বীপটি অধিকার করে নেয়। জার্মান অধিকৃত থেকে ১৪০৮ সালে ডেনিস প্রাধান্যের পর ১৬৪৫ সালে দ্বীপটি পুনরায় সুইডেনের অন্তর্ভুক্ত হয়। সমগ্র দ্বীপটির জনসংখ্যা মাত্র ৬১ হাজার তবে প্রতিবছর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেপূর্ণ দ্বীপটিতে প্রায় পাঁচ লাখ ভ্রমণকারি পরিদর্শনে আসেন। স্টকহোম থেকে দ্রæতগামী আধুনিক জাহাজ বা আকাশ পথে যাওয়া যায়। জাহাজে নিজস্ব গাড়িও সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যায়। গোতল্যান্ড পরিভ্রমণে জাহাজ থেকে যখন নামলাম তখন দুপুর হয় হয়।
গোতল্যান্ডে এর আগেও একবার এসেছি।

বাল্টিক সাগরের তীরে
গোতল্যান্ড এমনি এক মায়াবী দ্বীপ যেখানে বার বার আসা যায়। ভিসবির পুরানো শহরটি এক ঐতিহাসিক নিদর্শন। শহরটির চারদিক দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেয়ালের পাশেই শহর অধিকারকে কেন্দ্র করে ডেনিসদের সাথে হয়েছিলো এক ভয়াবহ যুদ্ধ। এই যুদ্ধকে বলা যায় এক ভয়ঙ্কর  মধ্যযুগীয় গণহত্যা। যুদ্ধ হয় প্রশিক্ষিত ডেনিস সেনাবাহিনীর সঙ্গে গোতল্যান্ডের কৃষক সম্প্রদায়ের।

গোতল্যান্ডের সুন্দরী ললনারা

গোতল্যান্ড যুদ্ধ
১৩৬১ সালের জুলাইয়ের শেষ দিকে ডেনিস রাজা ভালদেমার আটার্ডাগের অধীনে ডেনিশ সৈন্যদের সঙ্গে এক নৃশংস সংঘর্ষে গোতল্যান্ডের ১৮০০ কৃষক প্রাণ হারিয়েছিলেন। সুইডিশ ভূমি স্কোনে ও ওল্যান্ড প্রদেশের কিছু অংশ জয় করার পর ডেনিস রাজা গোতল্যান্ডকে বশীভূত করার প্রয়াসে ধাবিত হন। পধিমধ্যে এক জলাভূমির পাশে গোতল্যান্ডের কৃষকরা আগ্রাসী রাজার অগ্রযাত্রাকে ব্যহত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। শেষ যুদ্ধটি হয়েছিলো ভিসবি শহরের প্রাচীরের নীচে। গোতল্যান্ডের কৃষক, শিশু কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সবাই দ্বীপের প্রতিরক্ষায় যোগ দিয়েছিলো। ১৯শে জুলাই ভিসবি আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। রাজা ভালদেমার বিজয়ী হলেও গোতল্যান্ডের অর্ধেকের বেশি কৃষক যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। রাজা ভালদেমারের পুত্র ক্রিস্টোফার ডেনিস বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত ছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে তার সুগঠিত বর্ম ও পোশাক খুঁজে পাওয়া যায়।

যুদ্ধের পর মৃত সৈনিক ও তাদের ব্যাহৃত সরঞ্জাম দ্রুতই গণকবরে সমাহিত করা হয়।
১৯২০ এর দশকে প্রতœতাত্তি¡করা যুদ্ধের জায়গাটি খনন করার পর মৃত সৈনিকদের দেহাবশেষ, বর্ম এবং যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রের সন্ধান পান। প্রতœবস্তু সন্ধানের মধ্য দিয়ে মধ্যযুগীয় যুদ্ধের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের কঙ্কাল বিশ্লেষণ করে হাড়ের আঘাত থেকে যুদ্ধের কৌশল বিশ্লেষণপূর্বক ব্যবহৃত অস্ত্র শনাক্ত করা হয়। সৈন্যদের বর্ম সেই সময়ের মান নির্ধারণে সহায়তা করে। প্রাপ্ত বর্মগুলির মধ্যে একটি পাওয়া যায় যা বাভো বা শেল্টো রুর্দার অন্তর্গত। তারা নেদারল্যান্ডের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের দুই ভাই। বর্মের উপর বিভিন্ন ব্রোঞ্জ প্রতীকগুলো বংশের বিভিন্ন শাখার প্রতিনিধিত্ব করে। কিছু মুদ্রাসহ একটি চামড়ার থলি পাওয়া গেছে যা থেকে ধারনা করা যায় সৈনিকটি ভালদেমারের সেনাবাহিনীতে ছিলেন। ভিসবি প্রাচীরের পাশে ঘটে যাওয়া যুদ্ধের সহিংসতা, যুদ্ধের পদ্ধতি যুগে যুগে ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুরতার নিদর্শন।

ভেড়ার দ্বীপ
ভিসবি শহরের চারপাশে রয়েছে সে যুগের জীবন্ত ইতিহাস।
ভিসবিতে বর্তমান সময় ও প্রাচীন ইতিহাস পাশাপাশি সহাবস্থান করে চলেছে। শহরটি মধ্যযুগীয় ৩.৫ কিমি দীর্ঘ পাথরের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা যা ১৩ শতকে আক্রমণকারীদের হাত থেকে শহরটি রক্ষার জন্য নির্মিত হয়েছিলো। দেয়ালগুলো চুনাপাথর, কাদামাটি ও বিশেষ সামগ্রী ব্যবহার করে ঢালাই করা হয়েছিলো। শহরের তিনটি প্রধান প্রবেশপথের পাশাপাশি ৫০টিরও বেশি টাওয়ার রয়েছে। চলার পথে এমন চিহ্ন রয়েছে যা দর্শনাথীদের ভিসবির চারপাশে মূল দুর্গ, পাথরের বসতবাড়ি এবং গির্জার ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। ভিসবি দেয়ালের মধ্যে প্রায় ২০০টি সু-সংরক্ষিত পাথরের স্থাপনা আছে, কিছু গথিক শিল্পে অনুপ্রাণিত, অন্যগুলো সূক্ষ্ম ধাপযুক্ত। শহরের ১৮শ শতকের কাঠের কটেজগুলির দরজা সবুজ রঙে আঁকা, সবগুলি সরু পাথরের খিলান দ্বারা সংযুক্ত কিন্তু ভিসবির প্রতিকী কাঠামো গভীর লাল কাঠের বার্মিস্টার হাউজ যা ১৭শ শতকের মাঝামাঝি জার্মান কণিক হ্যান্স বার্মিস্টার তৈরি করেছিলেন।

গোতল্যান্ডের খাবার ও পানীয়তে রয়েছে অনন্য স্বাদ।
বিশেষ কয়েটি খাবার ট্রেডমার্ক হিসেবে পরিচিত। সামুদ্রিক মাছের ঐতিহ্য ও বিভিন্ন সামুদ্রিক খাবার স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় ভেড়ার মাংস উপাদেয়। ভেড়ার লালন পালন ভাইকিং যুগ থেকে এবং মাংসের গঠন এবং স্বাদের জন্য ভেড়ার মাংশ গোতল্যান্ডের উৎকৃষ্ট পণ্য। এই দ্বীপের বন্য রসুনও উপাদেয়। প্রতি বছর নভেম্বরে এই দ্বীপে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ খাদ্য উৎসব। স্থানীয় ভাবে তৈরি ‘গোতল্যান্ডপানীয়‘ একটি ধোঁয়াটে মিষ্টি জুনিপার গন্ধযুক্ত ঐতিহ্যবাহী পানীয় যা শতাব্দী ধরে তৈরি হয়ে আসছে।
বারশ শতকের ভিসবি পূর্ববর্তী ভাইকিং বাণিজ্য কার্যালয় বাল্টিক সাগরজুড়ে বাণিজ্যের জন্য একটি নেতৃস্থানীয় বাণিজ্যিক কেন্দ্রে বিকশিত হয়েছিলো এবং একশত বছর পরে হ্যানসেটিক লীগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর হয়ে ওঠে ভিসবি। সেযুগে বড় বড় পাথরের ঘর তৈরি করা হয়েছিলো, বহু গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এবং নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য সুন্দর শহরটি প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষা করা হয়েছিলো। বর্তমানে ভিসবি শহরের প্রাচীরটি সমগ্র ইউরোপের অন্যতম সেরা সংরক্ষিত প্রাচীর। মধ্যযুগে ভিসবি ছিল সুইডিশ রাজধানী স্টকহোমের চেয়েও বড় ও গুরুত্বপূর্ণ।



ফোরোসুন্দ: ক্রিমিয়ার যুদ্ধ ও ফোরোসুন্দ
দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘণ্টা জাহাজ যাত্রাশেষে ভিসবি থেকে আমাদের যেতে হবে ভিসবির উত্তরে প্রায় ৫৬ কিলোমিটার দূরে গ্রিস্মীয় গ্রাম ফোরোসুন্দে। সেখানে সমুদ্রের ধারে কটেজ নেয়া আছে। এই ছোট এলাকার অধিবাসীর সংখ্যা মাত্র ৮০০শত। গোতল্যান্ডের মেইনল্যান্ড ও ফোরোর মধ্যবর্তী প্রণালীর নামও ফোরোসুন্দ। এলাকাটি ভ্রমণ স্থান হওয়ায় ধীরে ধীরে অনেক কটেজ ও রিসোর্ট গড়ে উঠেছে।
ফোরোসুন্দের সঙ্গে ভয়াবহ ক্রিমিয়ার যুদ্ধের যোগসূত্র আছে
ক্রিমিয়ার যুদ্ধ হয়েছিলো ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ তিন বছর। কৃষ্ণ সাগরের ক্রিমিয়া উপদ্বীপে সংঘটিত হয়েছিলো ইতিহাসের এক নৃশংস সংঘাতপূর্ণ যুদ্ধ। রাশিয়ার প্রভাবশালী জার প্রথম নিকোলাস মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরে প্রভাব বিস্তার করার লক্ষ্যে অগ্রসর হলে বৃটিশ ও ফরাসিরা প্রমাদ গোনে। মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগর বেহাত হলে ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের বাণিজ্যের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। তাই জার নিকোলাসের অভিযানে বাঁধা প্রদানে বৃটিশ, ফরাসি, সার্বিয়া ও টার্কির অটোম্যান সাম্রাজ্য এক হয়ে ক্রিমিয়া অঞ্চলে সৈন্য সমাবেশ করে। তিনবছরব্যাপী যুদ্ধে আনুমানিক ৬,৫০,০০০ হাজার সৈন্য প্রাণ হারায়। এরমধ্যে ৫,০০০০০ লাখই ছিলো রাশিয়ার।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধে মিত্রবাহিনীকে সহায়তার লক্ষ্যে ফোরোসুন্দ প্রণালীতে স্থাপিত হয়েছিলো মিত্রবাহিনীর নৌবহর। সে সময় ফোরো প্রণালীতে তৈরি হয়েছিলো তিনটি বিশাল দুর্গ। প্রায় একশত বছর পরিত্যক্ত থাকার পর একটি দুর্গকে হোটেলে রূপান্তরিত করা হয়। ফোরোতে আজও বিশজন বৃটিশ সৈন্যের সমাধি বিদ্যমান।

ভিসবি শহর
এই যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে ফ্লোরেন্স নাইটইংগেল আধুনিক নার্সিং সেবার প্রসার করেন। Alfred, Lord Tennyson রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা The Charge of the Light Brigade. যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে একজন আর্টিলারি অফিসার পদে নিযুক্ত ছিলেন লিউ টলস্টয়। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও ভয়াবহতা নিয়ে তিনি পরবর্তী সময়ে রচনা করেন মহাকাব্যিক উপন্যাস War and Peace, যুদ্ধ ও শান্তি।
২০১৪ সালে পুরো ক্রিমিয়া ঊপকূল ইউক্রেনের কাছ থেকে দখল করে নেয় রাশিয়া। বর্তমান চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে (২০২২) ইউক্রেন দাবি জানিয়ে বলছে ক্রিমিয়া ফেরত পেলেই তারা যুদ্ধ শেষ করবে। কিন্তু ইউক্রেনের ক্রিমিয়া ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

ফোরো দ্বীপ
গোতল্যান্ড দেখতে এসে দ্বীপটির শেষ মাথায় উত্তর পূর্বে ফোরোসুন্দ প্রণালি পার হয়ে বাল্টিক সাগরের উপর ছোট ভূখন্ডটিকে অবহেলা করা যায়না। সমুদ্রে ভেসে থাকা খন্ডটির নাম ‘ফোরও’। অর্থাৎ ভেড়ার দ্বীপ। দ্বীপে প্রচুর ভেড়া পাহাড়ের কোলে সবুজ উপত্যকায় চড়ে বেড়ায়। ভেড়ার সংখ্যাধিক্যেই দ্বীপটির নাম ‘ফোরও’ বা ভেড়ার দ্বীপ। অবশ্য নাম নিয়ে মতান্তরও আছে, অনেকে বলেন ইংরেজি শব্দ ‘ফার অ্যাওয়ে’ বা বহুদূর শব্দ থেকেই ‘ফোরও’ শব্দটি এসেছে। কিন্তু সুইডিশ ভাষায় Får(ফোর) শব্দের অর্থ ভেড়া আর ö শব্দের অর্থ দ্বীপ। তাই মনে হয় নামকরণের দিক থেকে দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটিই ঠিক। দ্বীপটির মাঝে এমনও জায়গা আছে যেখানের গাছপালা মাটি থেকে মাত্র এক বিঘৎ উঁচু, ছোট ছোট গাছগুলো কাদাময়। দেখে মনে হয় দ্বীপের এই অংশটি এই মাত্র সমুদ্রতল থেকে উঠে এসেছে। ফোরওতে যেতে হলে ফোরোসুন্দ প্রণালি পার হয়ে যেতে হয়। তবে সামরিকভাবে ছোট দ্বীপটির বিশেষ গুরুত্ব থাকায় সুইডিশ নাগরিক ব্যতীত অন্য কারো জন্য দ্বীপটির দ্বার উন্মুক্ত নয়।
দ্বীপের আয়তন মাত্র ১১৩.৩০ কিলোমিটার, জনসংখ্যা মাত্র ৫০০ শত। পুরো দ্বীপটি প্রদক্ষিণে দেড় ঘণ্টার বেশি সময় নেয় না। কংক্রিট ও পিচ ঢালা উঁচু নিচু পথ, রুক্ষ সবুজ বনানী, পাখি ও সাগরের ডাকে অপূর্ব নির্জন স্বর্গ। স্বর্গের টানেই বিশ্ববিখ্যাত সুইডিশ চলচিত্রকার ইংগম্যার বেরিম্যান জীবনের চল্লিশটি বছর আমৃত্যু এখানেই কাটিয়ে গেছেন। তাঁর সম্মানে দ্বীপেই গড়ে উঠেছে বেরিম্যান সেন্টার।
ইংগম্যার বেরিম্যান তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি চলচ্চিত্রের দৃশ্য ধারন করেন এই দ্বীপেই। মৃত্যুর পর দ্বীপেই স্বামী-স্ত্রী উভয়ের শেষকৃত্য সমাধা করা হয় এবং প্রকৃতির ছায়ায় বিভোর থেকেই বলেছেন, Actually, I don't know what happened. If you want to be solemn you can say that I had found my landscape, my real home. If you want to be funny you can talk about love at first sight.”
ফোরোর সমুদ্রের তীর ধরেই বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃতিক বিস্ময়ে গড়ে উঠা হাজার হাজার বছরের পুরানো চুনা পাথরের রাউক। প্রকৃতির ছোঁয়ায় কোন কোনটির আকৃতি কুকুরের মতো, কোনোটি মানুষের মাথার মতো, কোন কোনোটি উঁচুনিচু পাহাড় সদৃশ্য। ফোরোর প্রাকৃতিক সংরক্ষিত স্থান গামলাহাম বা পুরানো বন্দর এলাকাটি ৩.১২ হেক্টরজুড়ে বিভিন্ন আকৃতির রাউকে সমৃদ্ধ। এখনেই বিখ্যাত কুকুর আকৃতির রাউকটি নীল সমুদ্রের জলে দাঁড়িয়ে। মূল সড়ক থেকে বাঁদিকে পিচ ঢালা বনের ভেতর দিয়ে পথ। পথের শেষে বালির উপর গাড়ি রাখার যায়গা। এরপর সাদা পাথরের উপর দিয়ে হাঁটা পথে সাগরতীরে। পৃথিবীর বহু দেশ থেকে অগণিত পর্যটক এই স্থান দর্শনে আসেন। সাগরের হাওয়ায় কিছু সময় মুগ্ধতা নিয়ে বিচরণ করেন। আমরা বালির উপর গাড়ি রেখে পাথরের পথ দিয়ে হেঁটে এগিয়ে গেলাম।
এখানে তিনজনের সঙ্গে দেখা
মধ্যবয়সী একজন, আর দুজন তরুণ-তরুণী। পাহাড়ের এক কোনে প্রখর রৌদ্রের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছেন। আমারা কিছুটা সময় কাটিয়ে ফেরার পথে সুদৃশ্য গির্জার পাশে কফি হাউজে ফিরে এলাম। কফি হাউজের লনে কফি পান করতে করতে দেখি তিনজন হেটে যাচ্ছেন রাস্তা ধরে। রাস্তাটি সোজা গিয়েছে ফোরো ফেরি ঘাটে। ফেরি ঘাট থেকে গামলেহাম বা পুরানো বন্দর প্রায় দশ কিলোমিটার। আসা যাওয়া বিশ কিলোমিটার। এই পথটুকু তারা পাড়ি দিয়েছেন হেঁটে। ফেরি পার হয়ে ফোরোসুন্দ বা ভিসবি অবধি হেটে যাবেন কিনা জানা নেই। হুমায়ূন আহমদের হিমু হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে সারা শহর হেঁটে বেড়াতো, হাঁটাতেই তার আনন্দ। ঐ তিনজনের গায়ে হলুদ পাঞ্জাবী নেই তবে পিঠে হলুদ র‌্যাকস্যাক। তিনে মিলে হাঁটায় এক আনন্দ আছে। তিন খুব শক্তিশালী সংখ্যা। তিন-এ আছে আমি, তুমি এবং সর্বশক্তিমান। সে জন্যই ত্রিভূবন, ত্রিকাল, ও ত্রিসত্যি।

ফোরো দ্বীপের জনসংখ্যা পাঁচশত হলেও সবাই সম্পদশালী
দ্বীপেই উৎপন্ন হয় মধু, গম, যব, আলু সাগরের মাছ আর ভেড়া। আলু আর ভেড়ার মাংস খুবই উপাদেয়। নবেল ফেস্টের রান্নায় ব্যবহার হয় ফোরোর আলু। ঠিক হল কয়েক কেজি উপাদেয় ও বিখ্যাত আলু কেনা যাক। রাস্তার ধারে কাঠের ফলকে লেখা, ‘এখানে ফ্রেশ সবজি পাওয়া যায়’। গাড়ি ঘুরিয়ে দোকানের এলেই দেখা গেল, বিরাট এক ভিলা। ভিলার গ্যারেজটাই দোকান। বিখ্যাত আলুর বিখ্যাত দাম। দুই কেজি চল্লিশ ক্রোনার, প্রায় চারশো টাকা। কিন্তু দাম দিতে যেয়ে দেখা গেল দোকানে কোন দোকানি নেই। দ্রব্যমূল্য লেখা আছে, খোলা একটি ক্যাশ বাক্স আছে। দাম মিটিয়ে দিতে পারেন অথবা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতে পারেন। আমরা পয়সা গুনে দাম মিটিয়ে দিলাম। ফোরোতে এখনো সততার মৃত্যু হয়নি।

ফোরোর আর একটি দর্শনীয় স্থান ডিগারহুবুদ
ডিগারহুবুদ মানুষের মাথা সদুশ্য এক প্রাকৃতিক রাউক, সুইডেনের বৃহত্তম রাউক এলাকা যার দৈর্ঘ প্রায় ৩.৫ কিলোমিটার। এখানেই রয়েছে কয়েকশত রাউক। রাউকগুলো যুগ যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে সাগরের নীল জলের উপর, কিছু দাঁড়িয়ে সাগরের বেলাভূমিতে। সাগরের তীর ধরে কয়েক কিলোমিটার পিচ ঢালা আঁকাবাঁকা পথ। পথের মাঝে মাঝে গাড়ি রাখার জায়গা। পড়ন্ত বিকেলে অনেকেই গাড়ি থামিয়ে প্রকৃতিকে উপভোগ করছেন।
‘সিলভিস ডটার‘ এই ছোট্ট দ্বীপের এক আর্শ্চয দোকান।
দ্বীপের ভেতর সবুজ গাছ-গাছালিতে পূর্ণ বিশাল এক কনফেকশনারি। যেখানে পরিবেশিত হয় সদ্য তৈরি বিভিন্ন উপাদেয় রুটি, কেক ও ধূমায়িত কফি। বেশ জায়গাজুড়ে এক পারিবারিক দোকান। দোকানের সম্মুখে কাউন্টারে থরে থরে সাজানো সদ্য তৈরি রুটি, দোকানের পেছনেই কারখানা। টুরিস্ট সিজন চলে যাবার পরও ভিড়ের কমতি নেই। পাঁচশত জনসংখ্যার ছোট এই দ্বীপের এই দোকানে এতো ভিড় ভাবাই যায়না।

ফোরোর প্রাকৃতিক দৃশ্য বিস্ময়কর
গোতল্যান্ড ও ফোরো দ্বীপ দুটি অপেক্ষাকৃত সমতল হওয়ায় সাইকেল চালানোর উপযুক্ত ও উন্মুক্ত জায়গা। একস্টা নামের উপকূলটি অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে দ্বীপের পশ্চিমে ডিউপভিক গ্রাম থেকে হাম্মারউদ্দেন পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় সাইকেল চালনার স্বর্গ। সাইকেল চালকদের নিয়ে একটি মজার বিশ্লেষণ আছে। একজন ব্যাংকার বলেছেন Bicycle is the slow death of the planet. এই কথা বলে ভদ্রলোক বিশ্বের তাবৎ অর্থনীতিবিদদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছেন এবং খুব মজা করে সত্যটি তুলে ধরেছেন,
সাইকেল যারা চালায় তারা আসলে সেই দেশের ইকোনমিটাই ধ্বংস করে দেয়।
সে গাড়ি কেনেনা, গাড়ি কেনার জন্য লোনও নেয়না। যেহেতু গাড়ি নেই তাই কোন ইন্স্যুরেন্স পলিসি নেই। সে তেল কেনেনা। গাড়ির সার্ভিসিং, মেরামতের জন্য টাকা খরচ করতে হয়না। তাকে গ্যারেজ ভাড়া দিতে হয়না। গাড়ি যেহেতু নেই তাই বড় ধরনের কোন দুর্ঘটনাও নেই। গাড়ি চালানোর জন্য তাদের মাল্টিলেইন হাইওয়ের প্রয়োজনও হয়না।
সাইকেল নিয়মিত চালালে ওই লোক মোটা হবেনা। ছিপছিপে স্বাস্থ্যবান লোকেরা ইকনোমির জন্য ভালো নয়। কারণ তাদের খুব বেশি ওষুধের প্রয়োজন পরেনা। তাদের ঘন ঘন হাসপাতালে যাবার প্রয়োজন হয়না, ডাক্তার দেখাতে হয়না। অর্থাৎ দেশের জিডিপিতে তারা কিছুই যোগ করেনা। অন্যদিকে ম্যাকডোনাল্স-এর প্রতিটি নতুন আউটলেট কমপক্ষে ৩০টা নতুন চাকরি তৈরি করে। কীভাবে? ম্যাকডোনাল্স আপনার হৃদরোগের সহায়তা করবে, ডেন্টিস্টদের কাছ যেতে সাহায্য করবে, পুষ্টিবিদের কাছে নিয়ে যাবে এতে করে ইকনমি সচল থাকবে। হাঁটাহাঁটি করা আরো খারাপ, এরা সাইকেল কেনার জন্যও পয়সাও খরচ করেনা। ব্যাংকার ভদ্রলোকের বিশ্লেষণে কোন পথ বেছে নেবেন সে ভাবনা আপনার। আমার সাইকেল থাকলেও দ্বীপ ভ্রমণে গাড়িই আমার বাহন।
(চলবে)

স্টকহোম, সুইডেন
২০২২ সেপ্টেম্বর ৭


তথ্য সূত্র:

1. Gotlands historia: Roger Öhrman

2. Visby Brandskattning: Dick Harrison

3. Bilturer i Sverige: Jorgen Hansen

4. ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া: লিয়াকত হোসেন


 নিউজটি পড়া হয়েছে ৬৮১ বার  


 এই ধারাবাহিকের সকল পর্ব  

•   গোতল্যান্ড: অপার সৌন্দর্যের এক মায়াবী দ্বীপ


•   গোতল্যান্ড: অপার সৌন্দর্যের এক মায়াবী দ্বীপ (শেষ পর্ব)






 

ভ্রমণ

নেপাল: হিমালয়ের পাদদেশে

গোতল্যান্ড: অপার সৌন্দর্যের এক মায়াবী দ্বীপ (শেষ পর্ব)

ওলান্ডের পথে- ২

ওল্যান্ডের পথে-১

লাদাখের ডায়রি- ১

ভ্রমণ বিভাগের আরো খবর





সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি:
আবদুল্লাহ আল হারুন
প্রধান সম্পাদক:
আসিফ হাসান (নূর নবী)

সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. জিয়াউল হক
বিশেষ সংবাদদাতা:
র‌বিউল ইসলাম সো‌হেল

আমাদের মানচিত্র

ঠিকানা: দেওয়ান কমপ্লেক্স (৩য় তলা), ৬০/ই/১, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়:
কক্ষ নং ১৪/সি, নোয়াখালি টাওয়ার (১৪ তলা), ৫৫-বি, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০

ফোন: ০১৯১৪-৭৩৫৮৫৮, ০১৯১৪-৮৭৫৬৪০
ইমেইল: info@amadermanchitra.news, amadermanchitrabd@gmail.com

Location Map
Copyright © 2012-2024
All rights reserved

design & developed by
corporate work