তাপস দেব: সফররত অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো টি ২০ সিরিজ জয় করেছে বাংলাদেশ। দেশের মাটিতে তাৎপর্যপূর্ণ এ সিরিজ জয়ের মধ্য দিয়ে টাইগাররা জয়ের ধারা অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে, যা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। উল্লেখ্য, মাত্র কিছুদিন আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট, ওডিআই ও টি ২০-তে সিরিজ জয় নিয়ে দেশে ফিরেছে টাইগাররা। সাফল্যের এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে তাদের। ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশের পদচারণা ও আধিপত্য বিস্তারের আগে এদেশে জনপ্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। সময়ের আবর্তনে ফুটবলের রং অনেকটাই ফিকে হয়ে এলেও ক্রিকেটে আমরা হাঁটি হাঁটি পা পা করে ভালোই অগ্রসর হয়েছি এবং স্বপ্ন দেখছি বিশ্বকাপ জয়ের। এ স্বপ্ন দেখা যে মোটেই অসংগত নয়, তার প্রমাণ পাওয়া গেল জিম্বাবুইয়ে ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টাইগারদের সিরিজ জয়ের মাধ্যমে
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, অর্থবিত্তের বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান তেমন সুসংহত নয়। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে হিমশিম খায়। দেশের সার্বিক ক্রীড়াঙ্গনেও এ অবস্থার প্রতিফলন ঘটছে। ব্যতিক্রম কেবল ক্রিকেট। দেশের ক্রিকেটাররা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঠাঁই করে নেওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি কঠোর শ্রম ও চেষ্টায় বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, অন্তত একটি ইস্যুতে দলমত নির্বিশেষে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ; আর তা হলো ক্রিকেট। ক্রিকেট বাংলাদেশকে অনেক কিছু দিয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম ও পরিচিতি বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াক্ষেত্রে বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন, তার সিংহভাগই এসেছে ক্রিকেটের হাত ধরে। এ কারণে দেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বাড়ছে। ক্রিকেট দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতেও ভূমিকা রাখছে। ফলে আমাদের জন্য ক্রিকেট খেলা হয়ে উঠেছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মূলত এ জন্যই ক্রিকেটের আরও উন্নয়ন কাম্য। আশার কথা, এ ব্যাপারে সরকারের যথেষ্ট সুদৃষ্টি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও একজন ক্রীড়ামোদী মানুষ। তিনি খেলোয়াড়দের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্রিকেটের সার্বিক উন্নয়নে উদারভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছেন। তবে এসবের বিপরীতে ক্রিকেটারদের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশাও ব্যাপক। দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণে টাইগাররা সচেষ্ট থাকবে-এটাই কাম্য।
অস্ট্রেলিয়াকে ৬২ রানে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পথে দুর্দান্ত বোলিং করেছেন সাকিব আল হাসান। সর্বশেষ ম্যাচে ৯ রানে ৪ উইকেট নেওয়া সাকিবকে ঘিরে সতীর্থদের উল্লাস অস্ট্রেলিয়াকে ৬২ রানে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পথে দুর্দান্ত বোলিং করেছেন সাকিব আল হাসান।
‘অস্ট্রেলিয়াকে এভাবে হারানোর সুযোগ কি বারবার আসে? অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আর সিরিজ জিতি না-জিতি, সারা জীবন গল্প করার মতো জিনিস পেয়ে গেছি!’ ‘দুই ম্যাচ হাতে রেখে সিরিজ জেতার পর হোটেলে ফিরে মোবাইল ফোনে অট্টহাসিতে বলছিলেন বাংলাদেশ দলের এক খেলোয়াড়। আসলেই এবারের অস্ট্রেলিয়া সিরিজটা মনে রাখার মতো হলো নানা কারণেই।
নিজেদের ১৫ বছরের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ খেলল বাংলাদেশ। যে দলটার সঙ্গে গত ১৫ বছরে চারটি ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়েছে, সে চারটিও আইসিসির টুর্নামেন্টে। আর এবার সাত দিনেই অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলা হয়েছে পাঁচ ম্যাচ। ঘরের মাঠে সুযোগটা দারুণভাবেই কাজে লাগিয়েছে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি জেতা তো হয়েছেই। দুই ম্যাচ বাকি থাকতে প্রথমবারের মতো সিরিজও মুঠোয় পুড়েছে বাংলাদেশ। আর তাতেই লেখা হয়েছে ইতিহাস। ৩-০ করে ফেলা সিরিজের স্কোরলাইন শেষ পর্যন্ত ৪-১ করে প্রাপ্তির ষোলোকলা পূর্ণ করেছেন মাহমুদউল্লাহরা।
টি-টোয়েন্টি মানেই চার-ছক্কার বন্যা, ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিংয়ে দর্শকদের পূর্ণ বিনোদন। এবার অস্ট্রেলিয়া সিরিজে অবশ্য ব্যাটিং-বিনোদন কমই হয়েছে। গানের মতো ‘চার-ছক্কা হই হই’ নয়, বরং বলতে হয়েছে, ‘চার-ছক্কা কই, কই?’ পাঁচটি ম্যাচই হয়েছে লো স্কোরিং আর ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। মিরপুরের মন্থর ও ঘূর্ণি উইকেটে ১৩০ রানই হয়েছে পাহাড়সমান। অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডার ড্যান ক্রিস্টিয়ান তাই বলেছেন, ‘এখানে ১২০ মনে হয় ১৯০ রানের মতো!’
বোলারদের সিরিজ
টি-টোয়েন্টিতে বোলারদের নিয়মিত হাসির সুযোগ কমই আসে। সবাই রানপ্রসবা উইকেটে ব্যাটসম্যানদের তাণ্ডব দেখতে চায়। আর তাতে বারোটা বেজে যায় বোলারদের! ব্যাটিং-ঝড় থামাতে অবশ্য বোলারদের এখন দক্ষতার সঙ্গে মাথাটাও সমান চালাতে হয়। পরিস্থিতি বুঝে বের করতে হয় নানা অস্ত্র। এই সিরিজে দুই দলের বোলারদের দিকে নিয়মিতই উইকেট বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বোলাররা সেটির সহায়তা নিয়ে নিজেদের কাজটা শুধু ঠিকঠাক করে গেছেন। আর এতে সবচেয়ে বেশি সফল বাংলাদেশ পেসার মোস্তাফিজুর রহমান। চওড়া হাসি ছিল স্পিনার নাসুম আহমেদ, মেহেদী হাসানদের মুখেও। ধারাবাহিক ভালো করেছেন অস্ট্রেলিয়ার বোলাররাও। টি-টোয়েন্টি সিরিজে বোলারদের এমন দাপট কমই দেখা যায়।
দুই দলই সিরিজটা খেলেছে নিজেদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ছাড়াই। বাংলাদেশ পায়নি তামিম ইকবাল-মুশফিকুর রহিমের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের। অস্ট্রেলিয়া দলেও ছিলেন না অ্যারন ফিঞ্চ, স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নারদের মতো তারকা খেলোয়াড়েরা। সিরিজটা ছিল তাই তরুণ ও অনিয়মিত খেলোয়াড়দের মেলে ধরার মঞ্চ। সেটি তাঁরা ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের নাসুম আহমেদ, আফিফ হোসেন, নুরুল হাসান সোহান, সাইফউদ্দিন, শরিফুল ইসলামের কাছে সিরিজটা বিশেষ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ বাংলাদেশ ক্রিকেট মনে রাখবে আরও একটি কারণে। মহামারিতে এখন সব সিরিজই হয় জৈব সুরক্ষাবলয় তৈরি করে। গত ৯ মাসে দেশের মাঠে বাংলাদেশ পাঁচটি সিরিজ-টুর্নামেন্ট এভাবেই আয়োজন করেছে। তবে অস্ট্রেলিয়া সিরিজ আয়োজনে অনেক নতুনের সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছে বাংলাদেশকে। অস্ট্রেলিয়ার বিশেষ ইমিগ্রেশন থেকে শুরু করে মাঠে খেলোয়াড়েরা হাতে হাত পর্যন্ত মেলাননি। সফলভাবে সিরিজ আয়োজন করতে বিসিবি হাসিমুখে অস্ট্রেলিয়ার সব শর্তই পূরণ করেছে। বাংলাদেশ সফরে এসে মাঠের বাইরে নিজেদের সব চাওয়া পূরণ হলেও মাঠে শিরোপার ‘চাওয়া’টা অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার পূরণ হয়নি! ঁ
বাংলাদেশ সিরিজ জয় উৎসর্গ করেছে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে
প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সিরিজ জিতেছে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। সেই জয়ও যেনতেন নয়; অস্ট্রেলিয়ার মতো দলকে রীতিমতো ৪-১ ব্যবধানে বিধ্বস্ত করে। কঠিন সময়ে বিরাট এক আনন্দের উপলক্ষ্য এনে দিয়েছে বাংলাদেশ দল। আর এই স্মরণীয় জয়টা বাংলাদেশ দল উৎসর্গ করেছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাহাদত বরণ করা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারকে।
মিরপুরে সিরিজের শেষ ম্যাচটা বাংলাদেশ জিতেছে ৬০ রানে। ম্যাচের পরই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এই সিরিজ জয় বাংলাদেশ দল উৎসর্গ করছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারকে যাঁরা শাহাদত বরণ করেছিলেন ১৯৭৫ সালের এই মাসে।
শোকের মাস তো আছেই। সময়টাও খুব কঠিন যাচ্ছে চারদিকে। মহামারিতে প্রতিদিন দেশে মানুষ মারা যাচ্ছে দুই শতাধিক। এই কঠিন সময়ে একটু হাসির উপলক্ষ্য এনে দিয়েছে বাংলাদেশ দল। ম্যাচ জয়ের প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশ অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ বলেছেন, ‘এটা ছিল দারুণ দলীয় প্রচেষ্টা। প্রতিটা ম্যাচে ছেলেরা যেভাবে লড়েছে, এটা দেখাটা ছিল দারুণ তৃপ্তিদায়ক। সব সময়ই আমরা মনে করেছি নিজেদের উঠানে আমরা খুবই ভালো দল। বাংলদেশে যেই খেলতে আসুক আমরা কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবই। আমরা প্রতিটি সিরিজ জিততে চাই। যদিও র্যা ঙ্কিং বলছে ভিন্ন কথা। তবে সব সময়ই মনে করি, টি-টোয়েন্টিতে খুব ভালো দল হওয়ার ভালো সম্ভাবনা আছে আমাদের।’
বাংলাদেশ সফরে আসছেন না উইলিয়ামসনের মতো তারকা ক্রিকেটাররা
পঞ্চম টি-টোয়েন্টি শেষ করে সেদিন রাতেই দেশে ফিরে গেছে অস্ট্রেলিয়া। একঝাঁক তারকা ক্রিকেটার ছাড়া বাংলাদেশ সফর শেষ করে গেছে তারা। পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে ২৪ আগস্ট বাংলাদেশে আসবে নিউজিল্যান্ড। তারাও হেঁটেছে অস্ট্রেলিয়ার পথে। তারকা ক্রিকেটারদের ছাড়াই বাংলাদেশ সফরে আসবে কিউইরা।
অস্ট্রেলিয়ার মতো নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সব ম্যাচও হবে মিরপুরে। মিরপুরের উইকেট নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে কতটা ভূমিকা রাখবে, সেই প্রশ্ন তো রয়েছেই। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে মিরপুরের নিচু ও মন্থর উইকেট দেখে এই দল ঘোষণা হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও আসছে! নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড (এনজেডসি) অবশ্য বলছে ভিন্ন কথা। বাংলাদেশ সফর দিয়ে শুরু হয়ে ভারত সফর দিয়ে শেষ হবে নিউজিল্যান্ডের চার মাসের লম্বা এই সফর। জৈব সুরক্ষাবলয়ে ক্রিকেটারদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে খেলোয়াড়দের ওপর থেকে চাপ কমাতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে এনজেডসি।
বাংলাদেশের কাছে সিরিজটা ৪-১ ব্যবধানে হেরেছে অস্ট্রেলিয়া। দলের নিয়মিত খেলোয়াড়দের ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার এই হার খুব একটা চিন্তায় ফেলতে পারেনি কিউইদের। কেন উইলিয়ামসন-ট্রেন্ট বোল্টদের ছাড়া দল ঘোষণা যেন সেটাই প্রমাণ করে। অবশ্য শুধু অস্ট্রেলিয়ার সিরিজ হার কেন, বাংলাদেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের অতীত ইতিহাসও যে সুখকর নয়।
শুধু বাংলাদেশ সফর নয়, সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান সফরেও উইলিয়ামসন-বোল্টদের ছাড়াই খেলবে নিউজিল্যান্ড। এ দুই সফরের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলও ঘোষণা করেছে এনজেডসি। বিশ্বকাপ দলের কোনো খেলোয়াড়ই নেই এ দুই সফরে। টানা সিরিজে খেলোয়াড়-কোচদের চাপ কমাতে চারটি ভিন্ন দল ঘোষণা করেছে তারা।
তবে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে আমিরাতে হবে স্থগিত আইপিএলের বাকি অংশ। এখানেই হবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ মাথায় রেখে আইপিএলের বাকি অংশে বিশ্বকাপ দলে থাকা খেলোয়াড়দের খেলার সুযোগ করে দিয়েছে এনজেডসি। সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে খেলবেন উইলিয়ামসন, মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে বোল্ট, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে খেলার অনুমতি পাচ্ছেন কাইল জেমিসন।