আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।
এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা
কত জনম-মরণেতে তোমারি ওই চরণেতে
আপনাকে যে দেব, তবু বাড়বে দেনা
- কবিগুরু
গ্রিসে প্রায় চারমাস থেকে জার্মানিতে এসেছিলাম ’৭৭-এর জুন মাসে। দক্ষিণ জার্মানের মোট ৪টি শহরে ছিলাম ২০০২ সাল পর্যন্ত। ঐ বছরই বিদেশিনী সঙ্গীনির সাথে বিচ্ছেদের পর সুইজারল্যান্ডে চলে গিয়েছিলাম। ওখানে ৩-৪ বছর থাকার পর ২০০৬-এর শুরুতে জার্মানিতে, যেখান থেকে চলে গিয়েছিলাম, সেই পুরোনো শহরে আবার ফিরে আসি। সুইজারল্যান্ডের কাহিনী আছে আমার ‘বেলভেদ্রের বিনোদিনী’ উপন্যাসে। কিন্ত ফিরে আসার পর মোটেও ভালো লাগছিল না। চারদিকে, আকাশে বাতাসে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকার স্মৃতি, গন্ধ, বেদনা! এ সময় ফ্রাঙ্কফুর্টের বাঙালিরা বাংলাদেশ থেকে সুগায়িকা সাবিনা ইয়াসমিনকে একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। ফ্রাঙ্কফুর্টে বাঙালির সংখ্যা জার্মানিতে সব সময় বেশি। তিন হাজারের কাছাকাছি। অনেকেই এখানে নাগরিকত্ব পেয়ে পরিবার নিয়ে থাকে। অনেকের সাথে আমার পরিচয় ছিল। তারা বলল ঐ অনুষ্ঠানে যেতে। জোড়াপাহাড়ের শেষ আহবান! প্রায় তিরিশ বছর দক্ষিণ জার্মানিতে বসবাসের পর ফ্রাঙ্কফুর্টের কয়েকজন বাঙালির সাথে হৃদ্যতা গড়ে উঠে। ২০০৬ এর জুন মাসে হিজরত করি বর্তমানে যে শহরটিতে আছি সেখানে। এটি নয়ে-ইজেনবুর্গ, ফ্রাঙ্কফুর্টের র্পাশ্ববর্তী দশ কিলোমিটার দূরে। ততদিনে আমার পরবর্তী তৃতীয় প্রজন্মের সাথে দেখা হয়ে গেছে। এদের কেউ কেউ আমাকে নানা-দাদা ডাকে। এতদিন দ্বিতীয় প্রজন্মের মামা হয়ে ছিলাম। স্থানীয় নাতিদের মধ্যে প্রধান শিশিরার্দ্র মামুন। জার্মানে এসেই সাহিত্য চর্চা শুরু করেছিল। ঢাকায় আমার প্রয়াত ভাই আবদুল্লাহ আল-মামুনের সাথে ওদের থিয়েটার স্কুলে ছাত্র থাকার সময় মামুনের পরিচয়। একদিন নাকি ভাই ক্লাসে ওদেরকে আমার কথা বলেছিলেন যে আমি বহুদিন ধরে জার্মানিতে থাকি। জার্মানিতে এসেই মামুন আমাকে এদিকে সেদিকে খোঁজ নিয়েছিল। অনেক দূরে থাকি, তাই নির্দিষ্ট করতে পারেনি। কিন্ত জোড়াপাহাড়ের ডাক তো বৃথা যেতে পারে না! সাবিনা ইয়াসমিনের অনুষ্ঠানে হলে ঢোকার পথে দেখি একটি ছোট্ট টেবিলে কয়েকটি বই। নতুন প্রকাশিত মামুনের গল্পের বই রাখা। একটা কাগজে লেখা আছে, বইটি কেউ যদি নিতে চান, দয়া করে পাশে রাখা কৌটাতে ৫ ইউরো রেখে দেবেন। বই কেনা আমার প্রধান হবি। জার্মানিতে নতুন বাংলা বই, লেখক এখানকার! আমি পাঁচ ইউরো কৌটায় রেখে এক কপি বই নিয়ে হলে ঢুকে। কিসের গান শোনা, বসে বইটা পড়া শুরু করলাম। স্টেজে তখনও সাবিনা আসেননি। একজন স্থানীয় সৌখিন শিল্পি গান গাওয়ার নামে শ্রোতাদের বিরক্ত করছিল। আমার পাশে একজন বাঙালি যুবক আমার বইটি পড়া দেখে একসময় বলল, লেখক কিন্ত আমার ভাগিনা। আমি কৌতূহলি। বললাম, তাই নাকি? খুব ভালো লেখে। তিনি বললেন, পরিচয় করবেন? আমি বললাম, অবশ্যই। ঐ তো দেখেন স্টেজে, মাইক, লাইট নিয়ে এটা সেটা করছে। দেখলাম, ছোট্ট (ঢাকার ভাষায় পিচ্চি) একটি বালখিল্য বানরের মত লাফিয়ে লাফিয়ে স্টেজে বয়সে তার চাইতে দ্বিগুন ত্রিগুন বড়দের নানা নির্দেশনা দিচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় ওরা এর কথা মেনেও নিচ্ছে। বুঝলাম, চেহারায় ক্ষুদ্র হলে কি হবে, ব্যক্তিত্ব আছে! আমার দেখেই খুব ভালো লাগল। হাতে ওর লেখা বই! লেখক সে যত অখ্যাত বা ছোট হোক, আমার কাছে সে মহান কিছু একটা। আজন্ম আমি বিশুদ্ধ পাঠক। রাস্তার সাইনবোর্ড থেকে পড়ার মত যাই পাই পড়ি। নিজের বই কোনদিন ছাপা হবে তা কখনও ভাবিনি। দেশে থাকতে ৪/৫বার পত্রিকায় কিছু স্টেজ নাটকের সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। তাও আবার ফরমায়েসি। বড়ভাই সংবাদ পত্রিকায় কাজ করতেন, তখন বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। নাটক লিখে, অভিনয় করে ও মুনীর চৌধুরীর শিষ্য হিসেবে সবে মাথা উঁচু করছে। তখন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে নিয়মিত নাটক হতো। আমাকেও টিকেট দিয়ে বলত, নাটকটি দেখে একটা সমালোচনা লিখতে। ওর সময় নেই। আমি বিনা পয়সায় ভালো সিটে সাংবাদিক হিসেবে বসে নাটক দেখার আনন্দে মহা খুশী হয়ে নাটক দেখে ফিরেই ঐ রাতেই সমালোচনা লিখে ভাইকে দিতাম। ওর নামে সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হতো। কার নামে অতসব ভাবতাম না। আমার নামে প্রকাশ হলে আর কে পড়বে? এই হলো আমার ৬২ বছরঅবধি লেখার ছোট্ট ইতিহাস! মামুনের সাথে সে রাতেই হলে পরিচয় হল। ও তো মহাখুশী। একে ওকে ডেকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ওর বইটিতে সই করে আমার পাঁচ ইউরো ফিরিয়ে দিয়ে বলল, নানা, (প্রথম থেকেই ডাকে) আপনি আমার নাটকের শিক্ষক আবদুল্লাহ আল-মামুনের ছোটভাই, আপনার কাছে বইয়ের দাম নেব! আপনি পড়ছেন, এটাই আমার জন্য অনেক কিছু। ব্যস সেই থেকেই শুরু। ওরা একটা ত্রৈমাসিক পত্রিকা বের করত সে সময় নিঃস্বন নাম। কবি শাহীন হাসান ছিল সম্পাদক, ব্যবস্থাপনা, সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে ছিল মামুন। আমি ওদের সাথে যে ক’দিন ছিলাম, প্রচুর গল্প করেছি। ঐ কাজটি আমি খুব ভালো পারি। অভিজ্ঞতাতো আর কম না! দাভোজে প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের সাথে সাক্ষাতকারের গল্পটা বলতেই, মামুন বলল, ঠিক যেভাবে আমাদের বললেন, সেভাবেই লিখে দেন। আমরা নিঃস্বনে প্রকাশ করব। আমি তো প্রথমে সোচ্চারে না করলাম, লেখক হবার আমার কোনো যোগ্যতাও নেই, ইচ্ছাও নেই। এর আগে ১৯৭৯-৮১ সালে ইমদাদুল হক মিলন আমাকে জার্মানিতে বলেছিল, মামা, আপনার মধ্যে লেখক হবার ক্ষমতা ও প্রতিভা দু’টিই আছে। আপনি লিখুন। সে ঐ সময় এখানে আমার সাথে এক বাসায় থাকত। ’৮১ সালে চলে যাবার সময় বলেছিল, আমার সাথে চলুন দেশে। অনেক পত্রিকা আমার জানা আছে, আমি নিজেও দেশে পত্রিকা বের করব। আপনি সাহায্য করবেন, লিখবেন। তার কথা শুনিনি। আমি তখন হাতাশার শিকার। রাতদিন মদ খাই আর ভিডিওতে হিন্দি ছবি দেখি। চাকরি করি না। বেকার ভাতায় চলি। দেশের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। এ স্বর্গ ছেড়ে কে আবার যায় বাংলাদেশে? এই অন্ধকূপ থেকে আমাকে উদ্ধার করেছিল ১৯৮৪ সালে মার্গারেট। সে আরেক কাহিনী।
কম্পিউটারে বাংলা লেখা শেখানোর জন্য মামুন তার বন্ধু রাকিবকে নিয়ে এক সপ্তাহ আমার বাসায় এসে থাকল। ধৈর্যের সাথে খুবই যত্ন করে আঙ্গুল ধরে ধরে বিজয়কে নিয়ে এল সে আমার ঘরে। আমি তখন কম্পিউটারে শুধু ইংরেজি আর জার্মান লিখতে পারতাম। ওরা চলে যাবার পর, দুই-তিনদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে, ‘কাছে থেকে দেখা- প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টন’ কম্পিউটারে লিখে মামুনকে মেল করলাম। ঐ দুই পৃষ্ঠার লেখাটি আমি এখন ২০/২৫ মিনিটেই লিখতে পারি। নিঃস্বনের পরবর্তী সংখ্যায় লেখাটি বের হল। অবশেষে ৬২ বছর বয়সে লেখক হয়ে গেলাম। তারপর আর থামিনি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ২০০০ (এখন প্রকাশিত হয়না) পত্রিকার ২০০৬ সালের ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হল আমার প্রথম মৃত্যু সঙ্গের কাহিনী, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’। ওটা পড়ে ঢাকার আসিফ তো ব্যাকুল। সে তখন ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক খবরের অন্তরালে পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। ওর অনুরোধে এই পত্রিকাতে ধারাবাহিক কয়েকটি ভ্রমণ কাহিনী ছাপা হলো ‘জার্মানির পথে প্রান্তরে’ নামে। ১/১১-এর কারণে ওর পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে আসিফের ইচ্ছে হলো আমার সকল লেখা সংকলিত করে একটি বই প্রকাশ করবে। আমি সম্মতি দিলাম না। তার কাছ থেকে একের পর এক মেইল আসতে থাকল- সে আমার বই বের করবেই। অবশেষে ২০০৮ সালের বইমেলায় বের করল আমার ‘প্রবাসে দৈবের বশে’। প্রথম বইই হিট! কাজেই আমার লেখক হবার জন্য প্রথম আমার হাত ধরেছে মামুন তারপর দেশে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে আসিফ। এরপর কত যে লেখা লিখেছি, তার হিসেব আমার কাছেই নেই। কত বই, কত অনুবাদ, এখানে সেখানে কত লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এবং এখন লিখছি ‘বিটবুর্গ রহস্য’। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বিশের ঊর্ধে।
২০০৬ সালের জুন মাসে মামুন ও তার বন্ধুদের অনুরোধে নয়ে-ইজেনবুর্গ চলে এলাম। সেই থেকে এখানেই আছি। ‘শ্মশান রাজদ্বারে চ’- শ্মশান থেকে রাজদরবারের সঙ্গী মামুনই একমাত্র এদেশে এখনও আমার একান্ত ও আপন। সে এখানে জার্মানে নিয়মিত বাংলা ত্রৈমাসিক ‘দেশ পত্রিকা’ প্রকাশ করছে বহু বছর যাবত। ওখানে আমার নাম আছে প্রধান সম্পাদক হিসেবে। নামমাত্রই। সব কাজ ওই করে। অনেক বলেছি, আমার নাম কেটে দাও। প্রতি সংখ্যায় একটা লেখা দেয়া ছাড়া আমার অবদানতো শূন্য। সে মানতে চায় না। আমার প্রতি ওর একনিষ্ঠ শ্রদ্ধা আর স্নেহের প্রমাণ। এখানে প্রতি সংখ্যা নিঃস্বন এবং সুইডেনের প্রদীপকাঞ্চন-এর পত্রিকা ত্রৈমাসিক অনুশীলনে একটি করে লেখা প্রকাশিত হয়। বর্তমানে সাকুল্যে এই হল আমার সাহিত্য চর্চা। ঢাকায় বন্ধু আসিফ, অনুজপ্রতীম বান্ধব কবি শিমনের চেষ্টা ও যত্নে আমার এযাবত দেশে কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। সামনেও হয়ত হবে। ওরা বলে, মরার পরও আমার অপ্রকাশিত রচনা ওরা প্রকাশ করবে। ভালো কথা। অবশ্য তা আমি জানব না। বর্তমানে বিটবুর্গ রহস্য আসিফের চাপেই লিখছি। ও যদি নাছোড়বান্দার মত গত ৩-৪ বছর ধরে পিছু লেগে না থাকত, এটা কখনই লেখা হত না।
মানুষ নিজেকে সবচাইতে কম জানে, চেনে। এ মহাসত্যটি আজ জীবনের শেষ সীমায় চলে এসে মর্মান্তিকভাবে অনুভব করি। আমার মধ্যে যে একটি দৈত্যের মত ক্ষমতাশালী বৈপরিত্ব বিরাজমান- তা আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করি। একদিকে, একটি অবস্থান থেকে আমার যেমন নড়তে ইচ্ছা করে না, তেমনি আবার বেশীদিন কোনোখানে টিকতেও পারি না! ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোন কোথা’ আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বর্তমান! আজও আমি আসলেই জানিনা, আমি কী চাই? কবিগুরুর একটি অমর আপ্তবাক্য, ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই’, তা আমার জীবনেরও সারকথা কিন্ত যখন এসব ঘটেছে তখন টের পাইনি। মহাপুরুষরা হয়ত পান, আমার মত ব্রাত্যজনের কাছে সে ক্ষমতা নেই। আমরা সেই দলের, ‘চোর চলে গেলে যাদের বুদ্ধি বাড়ে!’ মেট্রিক পরীক্ষার পরে বাবার চাপে আমাকে এইচএসসি বিজ্ঞান পড়তে হয়েছিল। যথারীতি আমাকে ঘিরে বাবার সে উদ্যোগ দু’বছর পরেই মাঠে মারা গিয়েছিল। প্রকৌশলী হবার ভর্তি পরীক্ষায় আমি সম্ভবত পরীক্ষার্থীদের ফলাফলের তালিকায় সব চাইতে নিতে ছিলাম। তবে জীবনের চরম ব্যর্থতার মধ্যেও সামান্য প্রাপ্তিযোগ থাকে। কলেজে দুই বছর বিজ্ঞান পড়ার সময় পদার্থবিজ্ঞানে কিছু কৌতূহল হয়েছিল যা আজও রয়ে গেছে। ইউরোপে এসে স্টিফেন হকিংকে জানতে পারি, পনেরো মিনিটের একটি সামান্য সাক্ষাতও হয়েছিল। তার তিনটি বই বাংলায় অনুবাদও করেছি। নিউটনের বিখ্যাত তিনটি গতিসূত্র আজও মনে আছে। প্রথমটি আমার জীবনে বহুবার বাস্তবায়িত হতে দেখেছি। ‘বাইরে থেকে বলপ্রয়োগ না করলে, একটি চলমান বস্ত সমবেগে চলতে থাকবে এবং একই কারণে একটি নিষ্ক্রিয় বস্তু কখনই তার অবস্থান পরিবর্তন করবে না’- এটাই পদার্থবিজ্ঞানের বিখ্যাত ‘Inertia’ (জাড্য)। আমি কী? জাড্য না সতত চলমান? আজও এটা আমি নিজেই জানিনা।
১৯৭৭ সালে চোরের মত দেশত্যাগ করি। প্রথমে গ্রিসের এথেন্সে ছয়মাস থেকে স্থলপথে ইঁটালি। এরপর সেসময়ের যুগোশ্লাভিয়া, ফ্রান্স হয়ে দক্ষিণ জার্মানি এসে পরপর চারটি শহরে বাস করেছি। ৮-১০টি চাকরি করি। বেশিরভাগ সময় বেকারত্ব, বিদেশিনীর সাথে আঠারো বছর একত্রবাস ও বিচ্ছেদ। নতুন শতকের শুরুতে জার্মানি ছেড়ে সুইজাল্যান্ডে প্রায় পাঁচ বছর এবং পুনরায় জার্মানি ফিরে আসা ইত্যাদি সবমিলিয়ে প্রায় তিরিশ বছরের ভবঘুরে জীবন। এরপর প্রবাসী জীবনের ক্রান্তি বা দ্বিতীয় পর্বের প্রারম্ভ হল। আমি দক্ষিণ জার্মানি থেকে মধ্য জার্মানি, ফ্রাঙ্কফুর্ট চলে এলাম। নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধু, নতুন শুভানুধ্যায়ী। নতুন শহর, নয়ে-ইজেনবুর্গ, ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে দশ কিলোমিটার দূরে। যখন এই বইটি লিখছি, তখন এখানে আমার প্রায় সতেরো বছরের বসবাস হয়ে গেছে! একই বাসায়, একই শহরে এতটা দীর্ঘ সময় একটানা বসবাস, আমার এ জীবনে আর কখনও ঘটেনি। কখনও মনে হয়, এটাই আমার এ জীবনের হয়ত শেষ বাসস্থান!
নয়ে-ইজেনবুর্গে শহরটিতে জনসমষ্টি ষাট হাজার। এখানে শহরের জনসংখ্যা ৫০ হাজর হলে তাকে বলে মহানগর (Grossstadt) এবং এসব শহরের পৌর সভার প্রধানের উপাধি ঙনবৎনঁৎমবৎসবরংঃবৎ (লর্ড মেয়র)। জার্মানি ইউরোপের একটি সমৃদ্ধ দেশ। এর শহরে মনোমুগ্ধকর দালানেকোঠা, সুদৃশ পার্ক, রাস্তাঘাট, দোকানপাট নিঃসন্দেহে নাগরিকদের প্রভুত বিত্তের প্রমাণ। শহরের বাইরে দু’টি পনেরো তালার বিশাল দালানে প্রায় আড়াইশ পরিবারের বসতি। এক কামরার অ্যাপার্টমেন্টসহ বিলাসবহুল বহু কামরার ফ্ল্যাটও আছে। পনেরো কিলোমিটার দূরত্বে ফ্রাঙ্কফুর্টের আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। সেজন্য এ শহরটির একটি বিশেষ জনপ্রিয়তা রয়েছে। এসব কারণেও এখানে জীবন যাপন বেশ ব্যয়বহুল। আমার মত অল্প পেনশনভোগীদের জন্য নিতান্তই কষ্টকর! সেজন্যই এখানকার উন্মুক্ত সাপ্তাহিক বাজারে আমার মত স্বল্পবিত্তরদের আনাগোনা বেশি। জার্মানির সব বড় শহরেই এরকম উন্মুক্ত সাপ্তাহিক বাজার রয়েছে। সাধারণত শহরের মধ্যে, মিউনিসিপ্যাল ভবনের সামনের মাঠে শনিবারে এরকম বাজার বসে। আশেপাশের গ্রাম থেকে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত শাকসবজি, ডিম, রান্নার জন্য তৈরি কাটা মুরগী, গরুর মাংস, দুধ ও দুধজাত সামগ্রী এখানে নিয়ে আসে। ট্রাকের মত গাড়ি, যার পেছনটা দোকান। লাইন করে ট্রাকগুলি নানারকমের পণ্যসম্ভার সাজিয়ে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। খাদ্যদ্রব্য ছাড়াও সংসারের নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন কাঠের চামচ, এনামেল ও লোহার বাসনপত্র ইত্যাদি। রেডিমেড কাপড়ের দোকানও থাকে একটি দু’টি। নয়ে-ইজেনবুর্গের এই সাপ্তাহিক বাজারেই আমার সঙ্গে মেলির দেখা ও পরিচয় হয়েছিল।
ক্রনিক রোগের মত অর্থাভাব আমার নিত্যসঙ্গী। বাংলাদেশে যতদিন ছিলাম, অর্থসঙ্কট সবসময় আমাকে তাড়া করত! কোনদিনই আয় অনুযায়ী ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পরতাম না। বেকারত্বও ছিল নিয়মিত! এর ওর কাছে প্রায়ই হাত পাততে হতো! ইউরোপে এসে দারিদ্রের কষাঘাতটি সেরকম অনুভব করিনি। কারণ এখানে চাকরি না থাকলেও মোটামুটি একটা ভালো অঙ্কের বেকার ভাতা নিয়মিত পাওয়া যায়। সেজন্য যখন চাকরি থাকত না (এবং এটা প্রায়ই হতো), কারো কাছে বাংলাদেশের মত হাত পাততে হত না। জার্মান সঙ্গিনীর সাথে আঠারো বছরতো স্বর্গে(!) ছিলাম। সে ভালো চাকরি করত, আমার মত কখনই বেকার হতো না। বাবা-মা ছিল অর্থবান। প্রায়ই জন্মদিন, ক্রিসমাস, ইস্টার উপলক্ষ্যে মোটা দাগের উপহার আমাদের ব্যাংক একাউন্টে চলে আসত। মনে আছে, দোকানে গিয়ে কখনই সে দাম দেখত না, কোয়ালিটি ছিল তার ক্রয়ের মূলমন্ত্র! জিনিসপত্র বেছে বেছে নিয়ে এসে কাউন্টারে দাম দেবার সময় জানতাম, কোনটার কত দাম! এখন বিশ^াস হয় না, আামাদের দুজনের দু’টি গাড়ি ছিল। আমি জন্ম অলস। প্রায়ই এটা সেটা বাহানা দিয়ে ওর গাড়িতে যাতায়াত করতাম। ওর গাড়ি হলে আর আমাকে চালাতে হত না। আমি গাড়িতে মোটেও আসক্ত নই। কিন্ত কাজ যখন থাকত, তখন তো নিজের গাড়িতেই যাতায়াত করতে হতো। সুইজারল্যান্ডের দাভোজে একটি বিশ^বিখ্যাত হোটেলে কাজের সময় অবিশ^াস্য একটি অঙ্কের বেতন পেতাম। সেটা ছেড়ে যখন আবার জার্মানিতে ফিরে এলাম, আমার একাউন্টে একটি বিরাট সঞ্চয় ছিল। কিন্ত বসে খেলে রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়। জার্মানিতে তখন বসবাসরত বাঙালিদের উদার হস্তে ধার দিয়ে আজ পনেরো বছর পরেও ফিরে পাইনি। কেউ অন্যত্র চলে গেছে, কেউ এখন আর আমাকে চেনে না! টাকা দিয়ে উশুল করার গুণটি (বা পেশীর শক্তি) থাকলে তো আর দেশ ছাড়তে হতো না। যাক, ওসব অন্য ব্যাপার।
২০১০-এ অবসর নিয়ে পরম একটি নিষ্ঠুর বাস্তবের মুখোমুখি হলাম। গত দীর্ঘ তেত্রিশ বছরে মাত্র বারো বছর চাকরি করেছি! বাকি সময় বেকার! পেনশনের আইন অনুযায়ী চাকরি করে যে যত নিয়মিত মাসিক ’অবসর-ফান্ডে’ জমা দেবে, সে হিসেবেই তার পেনশন হবে! বেকার থাকার সময় পেনশনের জন্য এই প্রদানটি সঙ্গত কারণেই বন্ধ থাকে! কাজেই নিউটনের তৃতীয় গতির সুত্রানুযায়ী, ‘প্রতিটি ক্রিয়ার জন্য একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে’, অর্থাৎ চাকরির গোটা মেয়াদ যত কম, অবসর ভাতাও ততই কম! দোকানে জিনিস নিয়ে কাউন্টারে এসে দাম জানার দিন হল শেষ! এখন প্রতিটি জিনিস কেনার আগে মূল্য দেখে বারবার ভাবি, কিনব, না কিনব না! অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেনা আর হয় না। এখানেও নিম্ন মধ্যবিত্তরা (ইউরোপে আমাদের দেশের মত সর্বহারা, বাস্তুহারা দরিদ্র নেই) যেসব দোকানে জিনিসপত্রের দাম কম সেখানেই যায়, যেমন আমি! এখন আমি বাইরে থেকে দোকান দেখেই বুঝতে পারি, ভেতরে মূল্য, অগ্নি না পানি! রেডক্রসের দোকানে সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস (কাপড়চোপড়ই বেশি) নামমাত্র মুল্যে কেনা যায়। বিত্তবানরা সেখানে তাদের অল্পদিন পড়া কাপড়, ব্যবহার করা জিনিসপত্র দান করে! আমি এখনও রেডক্রসের দোকানে যাইনি, তবে সামনে দিয়ে যাবার সময় অর্থাভাবের যন্ত্রনায় ভেতরে যাবার তীব্র আকর্ষণ অনুভব করি। তবে চরম দুঃখ ও কষ্টটি হল, ধীরে ধীরে সমস্ত ম্যাগাজিন, পত্রিকা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এমনকি দৈনিক পত্রিকাটিও! কয়েক বছর আগেও, সকালে প্রাতঃরাশের সময় দৈনিক পত্রিকা হাতে না থাকলে চলত না! আমাকে যারা চেনে, তারা জানে আমি একজন নেশাগ্রস্থ পাঠক। বই. পত্রিকা এখনও গোগ্রাসে পড়ি। হাতের কাছে যাই আছে, তাই পড়ি। কিন্ত ক্ষমতা আর বাসনা, দু’টি দুই জিনিস! বাইরে গেলে, পারলে একবার পাবলিক লাইব্রেরিতে যাই, পত্রিকা পড়ার জন্য!
এ শহরে এসেও আমি প্রথম সপ্তাহেই সাপ্তাহিক বাজারে দিয়েছি। এসব বাজারে, বন্ধ হবার আগে, গেলে অনেক লাভ! তখন দোকানিরা বিক্রি না হওয়া জিনিসপত্র আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাবার বদলে কম দামে বেঁচে দেয়। কৃষকরা আরও বেশি উদার! শাকসবজির বিক্রয়যোগ্যতা খুবই কম। খুব দ্রæত শুকিয়ে খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যায়। কাজেই বেলা বারোটা একটার দিকে (বাজার শুরু হয় সকাল আটটা থেকে, বেলা একটায় বন্ধ হয়ে যায়) তরিতরকারি যেগুল্ োবিক্রি হয়নি, বাড়িতে বয়ে নিয়ে যাবার বদলে, অধিকাংশই তারা ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। আমাদের মত ক্রেতাদের তখনি মাহেন্দ্রক্ষণ। সে সময় ক্রেতাদের ওরা এক কিলো শাকসবজি কিনলে আরেক কিলো এমনিতেই দিয়ে দেয়। এদের ভাষায় গেশেংক (উপহার)! আমরা বলি ফাও! বাল্যকালে আমরাও দৈনিক বাজারে বাইরে থেকে আসা কৃষকদের অবিক্রিত লাউ, সজনা বাজারেই ফেলে দিয়ে চলে যেতে দেখেছি। অনেকেই ওগুলো সংগ্রহ করে গরুদের খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যেত। এখন বাংলাদেশে একটা লাউ (বা সজনার) দাম শুনলে, সেই সব দিনগুলি স্বপ্ন মনে হয়!
আমার বাসা থেকে শহরের মধ্যে সাপ্তাহিক বাজারে যেতে অনেকটা পথ হাঁটতে হয়। বহুতলবিশিষ্ট অট্টালিকাটি যেখানে আমার নিবাস (পাশেই তার মতই আরেকটি সুউচ্চ বিল্ডিং), তা একবারে শহরের বাইরে। এখানে যারা বাস করেন, তারা প্রায় সবাই অবসরে। বুড়ো-বুড়ী দম্পতি বা একা, কচিৎ একাধজন তরুন বা তরুণী। নবদম্পতিরা এখানে যারা থাকেন তারা সব সময় শহরের মধ্যে বাসা খোঁজেন। পেলেই চলে যান। কারণ এখান থেকে পরবর্তী বাস স্টপেজটি হেঁটে যেতে ১০/১২ মিনিট। যাত্রী কম বলে বাসের সংখ্যাও কম। প্রায় সবাইর নিজস্ব গাড়ি আছে। আমার মত কিছু হতভাগা ছাড়া। বিষ্ময় লাগে এখানে ৮০-৯০ বছরের বুড়োবুড়ীরা অসংকোচে, পূর্ণ আত্মবিশ^াসে ও নির্ভয়ে গাড়ি চালায়। গত বছর আমাদের এখানে একজন ১০৫ বছরের বৃদ্ধা মারা যান। সম্পূর্ণ নিরোগ, কোন ক্রণিক রোগ ছিল না। জরায় স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুঅবধি এখানে তার নিজস্ব ফ্ল্যাটে থাকতেন। স্বামী দশ বছর আগে মারা গিয়েছিলেন। ছেলে ইটালি থাকে। তার তিরোধানের আগের সপ্তাহেও আমি তাকে গাড়ি চালাতে দেখেছি!
বড় রাস্তা দিয়ে গেলে, আমার এখান থেকে চার তালার বিশাল ডিপার্টমেন্টাল (এরা ডিসকাউন্টার বলে) স্টোরটি হেঁটে সাধারণত দশ মিনিটেই যাওয়া যায়। এই বিল্ডিং-এ সব রকম দোকানই আছে। রেস্টুরেন্ট, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, খাদ্যদ্রব্য, চোপড়, ফার্মেসি, পত্র-পত্রিকার দোকান ইত্যাদি। একই জায়গায় সব কিছু পাওয়া যায়। এটা পার হয়ে দশ মিনিট হাঁটলেই শহরের মধ্যখানে মিউনিসিপ্যাল ভবন। এর সামনের উন্মুক্ত মাঠে সাপ্তাহিক বাজার বসে। অর্ধাৎ প্রায় পনেরো-বিশ মিনিটের পথ। কিছুদিন পরেই আমি একটি সর্টকাট-ফাঁড়িপথ আবিস্কার করেছি। সেখান দিয়ে দশ-বারো মিনিটেই শহরের মধ্যে যাওয়া যায়।
মেলির বাড়ি বিটবুর্গে। কাহিনীর শুরুতেই আমি আমার শহর নয়ে-ইজেনবুর্গের পাশের গ্রাম বিটবুর্গ সম্পর্কে বলেছি। বিটবুর্গ যেখান থেকে শুরু, সেখানে প্রথম বাড়িটিই ছিল মেলির। আমার বাসা থেকে অল্পক্ষণ হাঁটলেই, শহরের সীমানায় একটি জঙ্গল এবং তার মাঝ দিয়ে পায়ে চলার পথ। শহরবাসীদের জন্য একটি বেড়ানোর জায়গা। এখানে গাড়ি ঢোকানো নিষেধ। জঙ্গলটিতে ঢুকে ২০/২৫ পায়ে হাঁটার পথটি ধরে চললে তা একটা বিরাট রাস্তায় শেষ হয়। বামদিকে বিটবুর্গ চলে গেছে, ডানদিকে ফ্রাঙ্কফুর্ট। বামে হেঁটে গেলে দশ মিনিট পরেই মেলির বাড়ি।
আমাদের দেশের সকাল/সন্ধ্যার দৈনিক বাজার বা হাঁটের পরিস্থিতি মাথায় রেখে ইউরোপের শহরগুলির উন্মুক্ত সাপ্তাহিক বাজারগুলির পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, শৃঙ্খলা বা সৌন্দর্য অনুভব করা মুশকিল। আমরা বাজার মানেই বুঝি, ঠেলাঠেলি, হৈচৈ, ধাক্কাধাক্কি, সংকীর্ণ স্থানে যেখানে একসাথে পাঁচজনের চলাফেরা করা অসম্ভব, সেখানে ২০/২৫ জনের চলাচল, মোটামুটি একটা যুদ্ধ-পরিস্থিতি। হাঁটবাজারের সাথে আমাদের শৈশব থেকেই জানাশোনা। বয়স্ক আত্মীয়স্বজনের হাত ধরে বাল্যকালে ব্যাগ এক হাতে এবং অন্য হাতটি চাচা-মামার হাতে। এভাবে হেঁটে হেঁটে বাজারে যাতায়াত সে সময় আমাদের জন্য একধরনের বিনোদনই ছিল। দুরু দুরু বক্ষে মনে মনে আশা পোষন করতাম তরিতরকারি মাছমাংশ কেনার পর, ফেরার পথে হয়ত একটা লজেন্স বা হাওয়াই মিঠাই, সস্তা বিস্কুট (সে সময় চকলেট এসব বাজারে থাকত না) ভাগ্যে জুটতেও পারে। এই সব ছোট ছোট আশা, উদ্দীপনা আর শিহরন নিয়ে বাজারের সরু অলিতে গলিতে, অনেক সময় পায়ের নিচে থকথকে কাদা, ভাংগা ইটের কষ্টকর ব্যাথায় চলতে হত। সেই সব বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা নিয়ে যখন প্রথমে ইউরোপে শহরের মধ্যিখানে উঁচু উঁচু দালানকোঠার মধ্যে প্রশস্ত মাঠে, পরিস্কার পরিবেশে স্প্তাাহিক বাজারে, পরিচ্ছন্ন পোষাকে ছেলেমেয়েদের কোলাহল, একদামে জিনিস বিক্রি, এসব দেখেছিলাম তখন অবচেতন মনে ভেবেছিলাম, স্বর্গ বোধহয় এধরনেরই কিছু একটা হবে! আমাদের কাছে দোকানেই হোক বা বাজারে হোক, কেনাকাটা মানেই দরদাম! বিক্রেতা এবং ক্রেতা উভয়ে যার যার লাভের জন্য অ¤øানবদনে মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছে, কসম কাটছে!
আমি শান্তিবাদী, নির্বিবাদ মানুষ। শৈশব-বাল্যকাল পেরিয়ে বয়ঃসন্ধিকালের পর পারতপক্ষে আর বাজারে যেতাম না। নিজের সংসার হবার পর, বাড়ির কর্তা হবার জোরে এসব দায়-দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করেছিলাম। এসব করার জন্য বাড়িতে কাজের ছেলেটি বা বুয়া বা আশ্রিত আত্মীয়- এরা তো আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারে সদাই বিদ্যমান থাকত!
ইউরোপে এসে প্রথম যে ধাক্কাটি খেয়েছিলাম তা হল, এখানে কারো বাড়িতে কাজর লোক বা বুয়া নেই। সামাজিক পরিস্থিতি, সমৃদ্ধি, লেখাপড়া এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে শনি-রবিবারে বাড়ির ছেলেমেয়েরা বাসার কাজ, যেমন বাগান পরিস্কার, মেঝে পরিস্কার ইত্যাদির জন্যও বাবা-মার কাছ থেকে পারিশ্রমিক পেয়ে থাকে! তখন শুনেছিলাম এবং পরে নিজেও দেখেছি, এখানকার ধনকুবের, রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা কর্ণধার, তাদের বাসায় সেক্রেটারির সাথে ঘর কন্না করার লোকও থাকে। তাদের বেতন, আমরা যারা এদেশে শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতাম, তার চেয়েও বেশি! ক্রোড়পতিদের বাটলারের গল্প এখানেই প্রথম শুনি! শ্রমের মর্যাদা বা ব্যক্তি স্বাধীনতা, অধিকারের কথা যতই বলা হোক, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তো রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে নিজের ঘরে রান্না করার সময় পান না বা তাকে এসব করতেও হয় না! আর আমরা মধ্যবিত্ত, জন্ম থেকেই শুনে এসেছি, বিশেষ কাজ যেমন ঘর পরিস্কার, বাচ্চাদের দেখাশোনা, বাজার, রান্না ইত্যাদি এসব করবে কাজের লোক। কারণ এ কাজগুলো নাকি ছোটলোকের কাজ। কাজেই পরিবারে এসব নাক উঁচু মনোভাব নিয়ে আমরা বেড়ে উঠি। নিজের সংসারেও এই ধরনের বড়লোকি-ছোটলোকি পদ্ধতি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চালু হয়ে যায়। তদুপরি পোড়া দেশটিতে তো গ্রামের দরিদ্র আত্মীয় স্বজনের কমতি নেই! কেউ না কেউ এসেই যায় এবং হয়ে যায় বাসার কাজের লোক! অন্নবস্ত্রের বিনিময়ে দিবারাত্রি শ্রম এবং কোন বেতন পায় না!
ইউরোপে এসে দ্বিতীয় যে বিস্ময়টির সামনাসামনি হয়েছিলাম, তা হলো কোথাও দরদাম করার অবকাশ নেই। সর্বত্র বিক্রয়মূল্য লেখা আছে। প্রায় সব দোকানেই ‘সেলফ-সার্ভিস’। মানে কেনাকাটার শেষে কাউন্টারে এসে দাম দেবার সময় প্রথমবার দোকানের একজন কর্মচারীর সাথে দেখা হয়। তিনি বসে বসে যন্ত্রের সাহায্যে ক্রীত দ্রব্যাদির মো মুল্য নির্ধারণ করে সামনের যন্ত্রে তা দেখান। এবার আপনি মূল্য পরিশোধ করুন, কার্ড বা নগদ পয়সায়। কার্ডও আপনাকেই মেশিনে ঢোকাতে হবে। রসিদ যেটা বেরিয়ে আসবে, আপনাকেই ছিঁড়ে নিতে হবে। যদি নগদ পয়সায় দাম দেন, তখনি কাউন্টার-বাসিনী সেটা গ্রহণ করে, মূল্য রেখে আপনি যা ফেরত পাবেন, ঐ যন্ত্রের সাহায্যেই ঝর ঝর করে একটা বাটিতে পড়বে এবং আপনার তা স্বহস্তে তুলে নিতে হবে। কাউন্টারের মহিলাটি কেনাকাটার সমাপ্তিতে আপনাকে একটা ধন্যবাদ জানাতেও পারেন বা নাও জানাতে পারেন। তবে যন্ত্রের মত ধন্যবাদ জানাবেন এবং আপনিও ক্রমে ধন্যবাদের উত্তর দিতে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। ‘আবার দেখা হবে’ একে অপরকে প্রায় সবাই বলে কিন্ত দুই পক্ষই ভালো করেই জানে, এটা মনের থেকে উদ্ভূত কোন বাসনা নয়, নেহায়েতই তাৎপর্যহীন এক আনুষ্ঠানিকতা।
কেনাকাটার সময় দরদাম করা আমাদেও জন্য বলতে গেলে অপরিহার্য একটি নিত্তনৈমিত্তিক ক্রিয়া। আমরা জন্ম থেকেই অবিশ^াসী। দোকানি যে জিনিসটিরে যে দামই বলুক, এমনকি আমাদের কাছে তা ন্যায্য মনে হলেও, আমরা চোখ বুঁজে অবলীলাক্রমে বলি, দাম বেশি চাইছে! অনেকেরই এমন একটি অদ্ভুত নীতি আেেছ, দোকানি যে দাম চাইছে, বিনাবাক্যব্যয়ে সেটার অর্ধেক বলে দরদাম শুরু করতে হবে! কিন্ত এখানে আপনি কার সাথে দরদাম করবেন? দোকানে ঢুকে নিজেকে প্রয়োজনীয় জিনিষটি বেছে নিতে হয়। কিছু কিছু জিজ্ঞাসা করতে হলে, দোকানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউকে খুঁজে বের করতে হয়। কিন্ত সে দামের ব্যাপারে কিছুই জানে না। কোনো জিনিসটি কোথায় কোনো সেলফে পাওয়া যাবে বা পাওয়া যাবে না, এই খবরাটই শুধু সে দিতে পারে। প্রথম প্রথম আমিও তাকে বাংলাদেশের থেকে নিয়ে আসা অভ্যাসটি থেকে প্রশ্ন করেছি, ‘এই জিনিসটার দাম কিছু কম করা যায় না?’ সে আমার দিকে বিস্ময়ে ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হয়ত আন্দাজ করার চেষ্টা করেছে, আমার মাথা ঠিক আছে কিনা? কারণ এ ধরনের প্রশ্ন দোকানে ঢুকে কেউ করে না। একবার একজন আমাকে বলেছিল, এই নাও টেলিফোন নম্বর। এটা আমাদের কেন্দ্রিয় অফিসের (তখন বনে) মার্কেটিং বিভাগের। ওখানে জিজ্ঞেস করতে পারো, এই জিনিসটার দাম কম হবে কিনা! এখানে আমরা কেউ এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। আমাদের কাজও নয় সেটা। ধীরে ধীরে ধাতস্থ হয়ে পরে নিজেই নিজের উপরে হেসেছি! জার্মান বান্ধবীকে কাহিনীটা বলার পর ও বলেছিল ও তোমাকে যে দোকান থেকে বের করে দেয়নি, এটাই তোমার ভাগ্য। এধরনের পাগল ও গবেট ক্রেতাদেরকে এখানে ‘লাডেন-ফারবোট’ (দোকানে প্রবেশ চিরতরে নিষিদ্ধ!) করা হয়ে থাকে! একবার তা হয়ে গেলে, তুমি জীবনেও আর ঐ দোকানে ঢুকতে পারবে না! তোমাকে পুলিশেও দিতে পারত, এসব আজগুবি প্রশ্ন করার জন্য!
জার্মানিতে সাপ্তাহিক বাজার নিয়ে এতগুলো কথা বলার পেছনে প্রধান কারণ একটাই। এই কাহিনীর মূল চরিত্র, মেলির সাথে আমার প্রথম সাক্ষাত নয়ে-ইজেনবুর্গের এই বাজারেই হয়েছিল। দেশে আমি কখনই স্বাস্থ্য সচেতন ছিলাম না। সুষম খাদ্য, টাটকা শাকসবজি এসব নিয়ে কোনদিন মাথা ঘামাইনি। দুধ যাও মাঝে মাঝে খেতাম, ডিম ছিল আমার চক্ষুশুল! তবে নেপথ্যে নিরব কারণটি ছিল এগুলোর চড়া দাম! আমার অর্থ-সামর্থ্য এসব কেনার পক্ষে মোটেই অনুক‚ল ছিল না। এশিয়া-আফ্রিকার মানস চিত্রে ইউরোপের যে স্বর্গরাজ্য বিরাজ করে, সেখানে এসে প্রথম দেখলাম খাবার জিনিস সুস্বাদু তো বটেই, দামও সবার ক্রয়সীমার মধ্যেই। ধীরে ধীরে খাওয়ার রুচি বদলে গেল। বিদেশিনী সঙ্গিনীর সাহচর্যে খাদ্য-প্রাণ, ভিটামিন প্রভৃতি, শৈশবে স্বাস্থ্য বইয়ে পড়া এই সব অবোধ্য কথাগুলির সঠিক অর্থ বোধগম্য হল। সেজন্যই খাদ্য তালিকায় প্রধান দ্রব্যগুলো সাপ্তাহিক বাজার থেকে যারা উৎপাদন করে সরাসরি সেই সব কৃষকের কাছ থেকে কেনার প্রেরণা এসে গেল। খাদ্যমূল্যের বিচারে এসবের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি কিন্ত স্বাস্থ্য-রক্ষার নিরিখে অতি প্রয়োজনীয়। কয়েক দশকের প্রবাসী জীবনে যে সব নতুন অভ্যাস জীবনে আগমন করেছিল, তার একটি হল নতুন কোনো শহরে বাস করতে এলে, আমি প্রথমেই এই সাপ্তাহিক বাজারের স্থানটির খোঁজ নিতাম। এরই জেরে নয়ে-ইজেনবুর্গে বাসস্থান বদলে আসার দু’তিনদিন পরেই এর খোঁজে বেরিয়েছিলাম।
মাঝারি ও ছোট শহরে এই ‘ওপেন-এয়ার’ বাজারগুলো নির্মল আনন্দ ও বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু। শনি-রবি ইউরোপে সপ্তাহে দুই যুগ্ম ছুটির দিন। ব্যতিক্রম আছে তবে সেই সব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি নয়। শহরের স্থায়ী বাসিন্দারা আশেপাশের গ্রাম থেকে আসা কৃষকদের এবং অন্য পণ্য-বিক্রেতাদের সঙ্গে সুপরিচিত। যারা বাজারে আসেন অধিকাংশই একে অপরকে চেনেন। তাই এটা শহরবাসীদের জন্য একধরনের মিলন ক্ষেত্র, উন্মুক্ত মুক্তাঙ্গন। তবে আমার মত যারা নবাগত তাদের প্রধম কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়, মূল স্্েরাতের সাথে মিশে যেতে। আমি কয়েকদিন যাবত এখানে বাসা বদল করে এসেছি। কয়েকজন বাঙালি যারা আমাকে এখানে দক্ষিণ জার্মানি থেকে নিয়ে এসেছে, তারা আশেপাশের শহরে থাকে। সবাই আমার চেয়ে বয়সে কম, কয়েকজনের সাথে এখানে এসে পরিচিত হয়েছি। তবে আমি গত প্রায় তিরিশ বছরে এতবার শহর ও বাসা বদল করেছি যে অপরিচিত হয়ে নতুন জায়গায় আগমনে যে একাকিত্ব ও অচেনা পরিবেশে পড়তে হয়, তাতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দেশে থাকতেও আমি প্রায় সময় একাকি কাটিয়েছি। সংসার হবার পর প্রেম ও বিবাহের প্রথম রেশ কেটে যেতেই, যথা পুর্বং! স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের সতীথর্, যদের কয়েকজনের সাথে পরে বন্ধুত্বও হয়েছিল, তারাও কেন জানি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যেত। এই ধরনের বিচ্ছেদ, অবহেলা, অস্বীকৃতি আমার জীবনে বরাবর নিয়মিত ঘটত। শুধু একটা উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম আছে। যার সাথে আমার বন্ধুত্ব গত ২০১৮ সালে পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। তবে এ কাহিনীর সাথে তার কোন সংবদ্ধতা নেই। আমাদের মাঝে দুই মহাদেশের দূরত্ব! আমি বাংলাদেশে গেলে দেখা হয়। প্রাচীন এই বন্ধুত্বের ডোরে আমরা আজও বাঁধা। আমৃত্যু থাকব।
প্রবাসী জীবনে আমি অনেক বিচিত্র ঘটনা, অভিজ্ঞতা, সংযোগ, দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। সামাজিকতার বন্ধন এসব দেশে সম্পূর্ণ আলাদা। এরা আমাদের মত আবেগপ্রবণ নয়। ভেতরের কথা সবটাই ঘরের বৌকেও বলে না। সমৃদ্ধি আর ব্যক্তি স্বাধীনতার চরমে উঠে প্রায় সবাই মহাসাগরের মধ্যে এক একটি আলাদা দ্বীপ হয়ে উঠেছে। মহাকাশে যেমন নক্ষত্ররাজির মধ্যে কোটি কোটি মাইলের ফারাক, এরাও তেমনি এক অপরের থেকে। বলতে গেলে, পুরোপুরিই বিচ্ছিন্ন! আমি শতাধিক জার্মানের সাথে একাধিক চাকরিস্থলে, বহুবার বাসাবদল করে প্রতিবেশী, বিভিন্ন দোকানের বিক্রেতা, ফার্মেসি, ডাক্তার প্রমুখ এদের সাথে পরিচিত হয়েছি, আনেকের সাথে একাত্মও হয়েছি। কিন্ত সব সময়ই ‘আউট অব সাইট, আউট অব মাইন্ড!’ ১৯৭৭ সালে জার্মানে এসে প্রথম কয়েক বছরে যে কয়েকজন স্থানীয় সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী পেয়েছিলাম, তাদের কারো সাথেই আমার এখন কোনো যোগাযোগ নেই। পাঁচ বছর সুইজারল্যান্ডে ছিলাম। ওখানকার সেই সময়ের পরিচিত কারো সাথেই আমার এখন কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। এ বিষয়ে অবিশ^াস্য ও মর্মান্তিক ও নিদারুণ ঘটনাটি হল- যে জীবনসঙ্গিনীর সাথে দীর্ঘ আঠারো বছর ‘লিভ-টুগেদার’ হয়েছিল, সে আজ কোথায় থাকে, তাও জানিনা। এখানে সম্পর্কের অবসান, বিচ্ছেদ বড়ই নিষ্ঠুর, নির্দয় ও নির্মম- যা আমাদের প্রাচ্যের ফর্মুলায় মোটেও মেলে না। নতুন শতকে আমাদের যে বিচ্ছেদ, তা আজও আমি পুরোপুরি সয়ে উঠতে পারিনি। আমি জানি এটা আমৃত্যু আমাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে। কিন্ত অপরদিকে এরা এসব বিচ্ছেদকে তেমন কিছুই মনে করে না। একের পর এক সম্পর্ক করে যায়। বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া এখানে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যপার। কারো গায়ে লাগে না। মৃত্যুসঙ্গ দেবার সময় আমার এত করুণ ও নিদারুন অভিজ্ঞতা হয়েছে যে সেসব মনে হলে এখনও আমি শিউরে উঠি। মায়ের মৃত্যুশয্যায় তার প্রবাসে থাকা সন্তানকে বহুবার জানানো সত্তে¡ও শেষবার দেখতে আসেনি; বরং আমাকে ফোনে বলেছে, মা যদি তাকে উইলে কোনো কিছু দিয়ে যায়, সেটা যেন আমি তাকে জানাই!
এই সব হৃদয়বিদারক ঘটনা, উদাসীনতা আর অবহেলা, সমৃদ্ধ ইউরোপের ‘প্রদীপের নিচে অন্ধকার!’। আমি একা থাকতে অভ্যস্ত, কিন্ত মাঝে মাঝে কথা বলার জন্য কাউকে না কাউকে তো চাই। ইউরোপীয় সমাজে দুঃখ-কষ্ট বন্টণ করার প্রশ্নই উঠে না। এসব এরা বহু আগেই ভুলে গেছে। কিন্ত সামান্য হাসি, মৃদু সম্ভাষণ ও সৌজন্য বিনিময় জাতীয় শিষ্টাচার, সামাজিক প্রাণী হিসেবে মানুষের জন্য অত্যাবশ্যক এবং অনিবার্য। কিন্ত জার্মানিরা পৃথিবীতে নামি দামী বহু দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রকৌশলী, রাজনীতিকের সমাবেশ ঘটিয়েছে কিন্ত সত্যিকারের মানবিক সম্পর্ক, সংবেদনশীলতা ও সহানুভূতির ক্ষেত্রে এরা আমাদের চাইতেও দরিদ্র!
আমার ক্রনিক অসুখ আছে। সেজন্য যেখানেই বাস করি, আমি ডাক্তার আর ফার্মেসিকে, অপর পক্ষ না চাইলেও, জোর করেই একাত্মতার মধ্যে নিয়ে আসি। এটা আমার এক ধরনের উত্তরজীবিতা। দৈনন্দিন সামাজিক জীবনযাপনের জন্য সুবিধাজনক আবহ সৃষ্টির ন্যূনতম উদ্যোগ। ঠিক সেভাবেই আমি সাপ্তাহিক বাজারে যারা আমার প্রয়োজনীয় খাদ্যবস্তু বিক্রি করতে আসে, বেশিরভাগ কৃষক, তাদের সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক করি। যাতে অন্তত সপ্তাহে একদিন পণ্যক্রয়ের সাথে সাথে কিছু কথাবার্তা হয়, শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। এই কারণেই নয়ে-ইজেনবুর্গের সাপ্তাহিক বাজারে আমার সাথে মেলির সাক্ষাত হয়েছিল। এবং ক্রমে তা উভয়ের মধ্যে একটা আত্মীয়তার মানবিক আবরণ সৃষ্টি করে।
পৃথিবীতে যতই ভেদাভেদ থাকুক না কেন, শিক্ষা, অর্থ, সামাজিক অবস্থান, ধর্ম, বিত্ত, ক্ষমতা, গায়ের রং, ভাষা, সংস্কৃতির যতই তারতম্য থাকুক, কিছু কিছু পেশায়, কর্মে এবং জীবনযাপনে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মিল চোখে পড়ে। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহারণ কৃষি ও কৃষক। সর্বত্রই এরা সহজ, সরল, জটিলতা-কুটিলতা এদের মধ্যে অনুপস্থিত। এদের সামাজিক অবস্থান উঁচু-নিচুর মানদন্ডে কখনই উর্ধমুখী নয়। অর্ধশালী নয়, তুলনামূলকভাবে পড়াশুনা কম, কায়িক পরিশ্রমি এবং মিতব্যয়ী, দৈনন্দিন মেলামেশায় ও ব্যবহারে অকৃত্রিম। আমাদের দেশের কৃষকরা নিরন্তর অনিশ্চিয়তা আর দোদুল্যমানতায় ভোগে, নিরন্তর দ্বিধাগ্রস্থ। এখানকার কৃষকরা দরিদ্র নয়, কৃষিকর্ম বহু আগে থেকেই যন্ত্রায়িত। মটর গাড়ি চড়ে এরা ক্ষেতের কাজে আসে। কিন্ত অহংকার নেই, আগন্তকদের সাথে প্রাণখুলে কথা বলে, বিনা সংকোচে আহারের আমন্ত্রণ জানায়। এদের একটাই আশঙ্কা, অস্থিরতা। তাদের পেশায় উত্তররসূরির প্রকট অভাব। এদের সন্তান সংখ্যা ২/৩ জনের বেশি নয়। তারা পৈত্রিক পেশা-খেতের কাজে যেতে অনিচ্ছুক। আমি এখানে যতগুলি কৃষক পরিবারের নিকটে গিয়েছি, তাদের প্রায় সবারই একই দুঃখ, তাদের প্রজন্মের সাথেই বাপদাদার এই পেশাটি লুপ্ত হয়ে যাবে। আরেকটি সমস্যা, কৃষকদের সঙ্গিনী মেলে না, এদের কেউ বিয়ে করতে চায় না। টেলিভিশনে একটা প্রোগ্রাম আছে, ‘বাওয়ার্ন জুখেন ব্রাউট’- কৃষক বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছে! এখানে অকৃতদার কৃষক নিজেকে বর হিসেবে তার গুনাগুন, স্বচ্ছলতা নিয়ে সঞ্চালকের সংগে কথা বলে। ভাগ্য ভালো থাকলে প্রোগ্রাম চলাকালিন কোনো হবু কনে ফোনে যোগাযোগ করে। কিন্ত এরকম ভাগ্যবান কৃষকের সংখ্যা কম। তার পেশাটি তার সাথেই উধাও হয়ে যাবে, এটাই এখানকার কৃষক বাবা-মার মর্মান্তিক হাহাকার। সরকারি হিসেবে প্রতি বছর ছোট-বড়-মাঝারি দেড়শ-দু’শো ফার্ম বিলীন হয়ে যায়। বহু খামারে এখন শিল্পাঞ্চল বা বনাকীর্ণ! সন্তানেরা শহরে, অন্য দেশে। বাপের ভিটার প্রতি কোনও আকর্ষণ নেই। সমৃদ্ধির আরেক অভিশাপ।
মেলিরও এই সমস্যা ছিল। বাপের মাঝারি ফার্মটি সে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলো। স্বামী যতদিন বেঁচে ছিল, দুজনে মিলে দেখাশোনা করত। স্বামীর মৃত্যুর পর চাষবাস অনেক কমিয়ে দিতে হয়। গরুর সংখ্যা কমে আসে। একটিমাত্র কন্যা লিজা বয়ঃসন্ধির সাথে সাথেই বন্ধুসহ আমেরিকায় চলে গেছে। ওরা বিয়ে করেনি, তা নিয়ে মেলির কোনো অনুযোগ ছিল না। তার দুঃখ, একমাত্র উত্তরাধিকারি হিসেবে ফার্মটি সে কেন গ্রহণ করল না! তার বন্ধুটিও একজন কৃষক পরিবারের। তা সত্ত্বেও দুজনেই আমেরিকায় চলে গেল মার্কিনী বৈভবের সন্ধানে! দশ বছর হল কন্যা আটলান্টিকের ওপারে, একবারও মাকে দেখতে আসেনি। অনেকবার বলা সত্তে¡ও মেলি অভিমানে মেয়েকে দেখতে যায়নি। একা একাই আজ কুড়ি বছর ধরে যতটা পারে ও তার মায়ের ফার্মটি ধরে রেখেছে। ফার্মটি তার নানার কাছ থেকে একমাত্র সন্তান হিসেবে তার মা, বিয়ের পর মেলির বাবার সাথে একসাথে চালাত। বাবা মার মৃত্যুর পর মেলি তার মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। কিন্ত তার মেয়ে এটা করেনি। অর্ধেকের বেশি তার জমি এখন অনাবাদি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে সে সরকারের পরিকল্পনাধীন একটি কর্মসুচিতে যোগ দিয়ে ভালো টাকার বিনিময়ে তার অর্ধেক জমিতে চাষাবাদ বন্ধ রেখেছে। এটা ইউরোপীয়ান কাউন্সিলের ‘কৃষি-রাজনীতি’! কৃষি পণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য, জার্মান সরকার খাদ্যদ্রব্য ইটালি, হলান্ড, স্পেন, পর্তুগাল থেকে আমদানি করে। কারণ জার্মানের চাষাবাদ খুবই ব্যয়বহুল। স্থানীয় উৎপাদন, বাইরে থেকে খাদ্যদ্রব্য আমাদানির খরচের চাইতে বেশি! সে হিসেবে কৃষকরা তাদের ন্যায্য দাম পায় না। সেজন্য সরকারকে কৃষকদের বিরাট পরিমাণে ভর্তুকি দিতে হয়! এজন্য জমির চাষাবাদ বন্ধ রাখার জন্য সরকার এককালিন বহু টাকা দিয়ে কৃষকদের চুক্তিবদ্ধ করে। অনাবাদি জমিতে অনেক সময় কলকারখানা, বিনোদন কেন্দ্র নির্মিত হয়ে থাকে। বা আস্তে আস্তে জঙ্গল হয়ে গেছে। এ দু’টি পরিণামই আমি মেলির ফার্মে ঘটতে দেখেছি। সরকার কয়লা উত্তোলনের জন্য তার অনেক জমি অধিগ্রহণ করে। কয়েক বছর পরেই খনির কাজ শেষ হয়ে গেলে, খোঁড়াখুঁড়ির জায়গায় বিরাট একটি হ্রদ হয়ে যায়। পরে বিটবুর্গের একটি বিরাট এলাকা বিনোদন পার্কে রূপান্তরিত হয়। শুধুমাত্র অন্যপ্রান্তের বিটবুর্গ-৪ এ কিছু বসতি থেকে যায়। মেলির বাড়ি ও তার আশে পাশের জঙ্গল আরও বেশি করে গাছা-আগাছায় ভরে গিয়ে হয়ে যায় ঘন বন। গা ছম ছম করা ভুতের বাড়ি! পরিত্যক্ত হয়েছিল কারণ, মেলিকে তার মেয়ে আমেরিকা থেকে এসে নিয়ে গিয়েছিল। এটা ২০১৩-১৪ সালের কথা। এখন সুদুর ইউরোপে দীর্ঘদিন প্রবাসী জীবন যাপন শুরুর আগে দেশের কিছু প্রাসঙ্গিক কাহিনী বলতে চাই।
চলবে…
নয়ে-ইজেনবুর্গ, জার্মানি, জানুয়ারি, ২০২৩