ঢাকা, বাংলাদেশ  |  শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪



  বিভাগ : জাতীয় তারিখ : ২৪-০৮-২০২২  


চা শ্রমিকদের আন্দোলন ও এই শিল্পের সঙ্কট!


  রবিউল ইসলাম সোহেল



রবিউল ইসলাম সোহেল: চা-পাতা সংগ্রহের এখন ভরা মৌসুম। বর্ষার শুরু থেকে শীতের আগ পর্যন্ত দেশের বাগানগুলোতে চা-পাতা তোলা হয়। কিন্তু চা-পাতা তোলার চলমান উপযুক্ত সময়ে দেশের চা-শিল্পে দেখা দিয়েছে সংকট। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সিলেট বিভাগের ১৩৫টিসহ দেশের প্রায় ২৪১টি চা বাগানে কাজ বন্ধ। দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে ধর্মঘট পালন করছেন চা-শ্রমিকরা। তারা বলছেন, ‘জীবনযাত্রার ব্যয় যেভাবে বেড়েছে তাতে ১২০ টাকায় আর চলছে না চা-শ্রমিকের জীবন। চা-শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পেট ভরে খেতে পারছেন না। নেই উপযুক্ত বাসস্থান। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকেও তারা বঞ্চিত। তাই ন্যূনতম মজুরি ৩০০ টাকা না করা পর্যন্ত তারা কাজে ফিরবে না।’

তাদের বর্তমান সর্বোচ্চ মজুরি দৈনিক ১২০ টাকা, যা বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও চা বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) মধ্যকার চুক্তির ওপর ভিত্তি করে ২০১৯-২০ সালের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০। প্রথা অনুযায়ী ২০২১-এর জন্য নতুন করে চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, যার মাধ্যমে ১ জানুয়ারি, ২০২১ থেকে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ার কথা। কিন্তু ১৯ মাস পার হয়ে গেলেও সেই মজুরি বৃদ্ধির চুক্তি আজও হয়নি, এখন আন্দোলনের কারণে মালিক পক্ষ ও সরকার মাত্র ২৫ টাকা মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব দিচ্ছে, যা শ্রমিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় বলেই তারা ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছেন।

মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা শ্রমিকরা ধর্মঘট শুরু করলে চা বাগান মালিক বা সরকারি তরফ থেকে মাত্র ২৫ টাকা মজুরি বাড়ানোর যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, একটি অংশ তা মানলেও শ্রমিকদের আরেকটি অংশ ক্ষোভে আর অভিমানে তা মানতে রাজি হননি। তারা বলেছেন ১৪৫ টাকা মজুরির প্রস্তাবে রাজী হওয়ার বদলে তারা পুরনো মজুরিতেই কাজ করবেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, মজুরি সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে শ্রমিকরা পুরনো ১২০ টাকা মজুরিতেই আপাতত কাজে ফিরেছেন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মজুরির বিষয়টি নির্ধারিত হবে।


এদিকে শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী মালিকপক্ষ মজুরি না বাড়ানোর সিদ্ধান্তে অনঢ়। ফলে চা শিল্পে একটি অচলবস্থা তৈরি হয়েছে। দেশের ২৪১টি চা বাগানে এই ধর্মঘট শুরু হয় গত ৯ আগস্ট থেকে। দেড় লাখের বেশি শ্রমিক  চা পাতা তোলার কাজ থেকে বিরত আছেন। শ্রমিক-মালিক ও শ্রম অধিদপ্তরের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকেও সমাধান না আসায় শ্রমিকেরা তাদের ধর্মট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

তথ্য ও উপাত্তে জানা যায়, চা বাগানগুলোতে এ, বি এবং সি এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এ শ্রেণির চা বাগানেই  দিনে সর্বোচ্চ মজুরি ১২০ টাকা। শ্রমিকেরা এখন দিনে ৩০০ টাকা মজুরি  চাচ্ছেন। প্রতি দুই বছর পর পর তাদের মজুরি বাড়ানোর কথা থাকলেও ২০২১ সালের জানুয়ারির পর আর মজুরি বাড়ানো হয়নি। মজুরির বাইরে শ্রমিকেরা সপ্তাহে তিন কেজি আটা পান, দুই টাকা কেজি দরে। এছাড়া তাদের চিকিৎসা ও আবাসন সুবিধা দেয়ার কথা। একই সঙ্গে সন্তানদের শিক্ষা সুবিধা থাকার কথা। বস্তুত চা শ্রমিকেরা ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরির জন্যে আন্দোলন করলেও পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতি শ্রমিক দৈনিক প্রায় ৪২২ টাকা পেয়ে থাকেন এবং মাসিক প্রায় ১১ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন বলে দাবি করছেন চা বাগানের মালিকরা।

গত সপ্তাহে বাংলাদেশ টি এসোসিয়েশনের এক সংবাদ সম্মেলনে উদ্যোক্তারা জানান, একজন শ্রমিক প্রত্যক্ষ সুবিধার মধ্যে শ্রম আইন অনুযায়ী দৈনিক ন্যূনতম গড়ে ১২০ টাকা নগদ মজুরি পেয়ে থাকেন। উদ্যোক্তাদের দাবি, দৈনিক যে নগদ ১২০ টাকার মজুরি প্রদান করা হয় তা সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ ৬ কর্মদিবসের জন্য ৭ দিনের মজুরি প্রদান করা হয়ে থাকে। সে হিসেবে দৈনিক মজুরি গিয়ে দাঁড়ায় ১৪০ টাকা। যেহেতু চা উত্তোলনের কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই, সে ক্ষেত্রে একজন প্লাকার (পাতা তোলা) দৈনিক কর্মঘণ্টার মধ্যে অতিরিক্ত পাতা উত্তোলনের জন্য প্লাকিং (পাতা তোলা) বোনাস পেয়ে থাকেন যা বাগান ভেদে গড়ে দৈনিক ৬৫ টাকা হয়। এছাড়াও রবিবারে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ক্যাশ প্লাকিং এবং মর্নিং ক্যাশ প্লাকিং এর মাধ্যমে আরও অতিরিক্ত আয় করে থাকেন। দেখা গেছে ভালো বাগানে একজন প্লাকার সপ্তাহে চার হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন। এছাড়াও পরিবারের অন্যান্য সদস্যগন মৌসুমে প্লাকিং কাজে অনায়াসে যোগ দিয়ে পারিবারিক আয় বাড়াতে সাহায্য করেন। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় একজন সাধারণ শ্রমিক দৈনিক গড়ে প্রায় ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকা পর্যন্ত নগদ মজুরি পেয়ে থাকেন। তাছাড়া আরও বিবিধ প্রত্যক্ষ সুবিধা যেমন ১৪ দিনের বার্ষিক ছুটি ভাতা, বেতনসহ ১৪ দিনের উৎসব ছুটি ভাতা, ২০ দিনের অসুস্থতাজনিত ছুটি ভাতা, ভবিষ্য তহবিল ভাতা, কাজে উপস্থিতি ভাতা (৪০/৫০ দিনের মজুরির সমান উৎসব ভাতা), ভবিষ্য তহবিলের উপর প্রশাসনিক ভাতার মাধ্যমে সর্বমোট দৈনিক গড়ে  ২৪৬ টাকা নগদে পেয়ে থাকেন।

টি এসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, চা শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের পরোক্ষ যে সকল সুবিধাসমূহ প্রদান করা হয়ে থাকে তা বাংলাদেশের অন্য সব শিল্পের তুলনায় নজিরবিহীন। এই শিল্পে প্রতি শ্রমিককে ২ টাকা কেজি দরে মাসে প্রায় ৪২ কেজি চাল/আটা রেশন হিসেবে প্রদান করা হয়- যার বাজার মূল্য প্রায় ২,৩১০ টাকা। তাছাড়া শ্রমিকদের খাদ্য নিরাপত্তা আরো সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে চা শিল্পে প্রায় ৯৪,২০০ বিঘা জমি চাষাবাদের জন্য বিনামূল্যে চা শ্রমিকদের মধ্যে বন্টন করা হয়েছে। উদ্যোক্তাদের দাবি, চা শ্রমিক ও তার পুরো পরিবারের সকলেই বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা পেয়ে থাকেন অথচ অন্যান্য শিল্পে শুধুমাত্র শ্রমিক নিজেই এই সুবিধা পান। শ্রমিকদের মৃত্যুর পরেও তার পরিবারের জন্য এই সুবিধা বহাল থাকে। উল্লেখ্য যে, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চা শিল্পে ০২ টি বড় আকারের আধুনিক গ্রুপ হাসপাতাল ও ৮৪ টি গার্ডেন হাসপাতালে ৭২১ শয্যার ব্যবস্থা, ১৫৫টি ডিসপেনসারিসহ সর্বমোট ৮৯১ জন মেডিকেল স্টাফ নিয়োজিত আছেন।

টি এসোসিয়েশনের কর্মকর্তাগন জানান, বাংলাদেশে এখন ১৬৮টি বাণিজ্যিক চা উৎপাদনের বাগান কাজ করছে। যেখানে ১ দশমিক ৫ লাখেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। উপরন্তু, বাংলাদেশ বিশ্বের ৩ শতাংশ চা উৎপাদন করে। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশি চায়ের বাজারের মূল্য প্রায় ৩ হাজার ৫শ কোটি টাকা জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। চা শ্রমিকদের ধারাবাহিক কর্মবিরতি ও আন্দোলনের কারণে সিলেট ও চট্টগ্রামের ১৬৮ চা বাগানে থেকে দৈনিক ২০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যমানের চা-পাতা নষ্ট হচ্ছে বলে দাবি তাদের।

সম্মেলনে বলা হয়, চা শ্রমিক সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিতকরণে প্রাথমিক, জুনিয়র ও উচ্চ বিদ্যালয়সহ সর্বমোট ৭৬৮ টি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে যেখানে ১,২৩২ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন যেখানে বর্তমানে ৪৪,১৭১ জন শিক্ষার্থী বিনামূল্যে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে। চা শ্রমিকদের বসত বাড়ির জন্য বিনামূল্যে পরিবার প্রতি ১,৫৫১ স্কয়ার ফিট জায়গার মধ্যে ৩৭০ বর্গফুট বিশিষ্ট সর্বমোট ৬৮,৮০৬ বসতবাড়ি কোম্পানি নির্মাণ করেছে এবং এর বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন। তাছাড়া, শ্রমিকগণ হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু পালন করে থাকেন এবং গবাদিপশু পালনের জন্য চারণভূমি ও রাখালের খরচও কোম্পানি বহন করে থাকে। সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, একজন চা শ্রমিক অবসর গ্রহণ করলে তার পরিবর্তে তার পছন্দ অনুযায়ী পরিবারের একজনকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকরা পেনশনের আদলে সাপ্তাহিক ১৫০ টাকা অবসর ভাতা, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা এবং ২ টাকা প্রতি কেজি মূল্যে চাল বা আটাও পেয়ে থাকেন।

১৯০ বছরের পুরোনো শিল্প হিসেবে বাংলাদেশের অন্যান্য যেকোনো শিল্পের তুলনায় অনেক আগে থেকেই শ্রমিক আইন অনুসরণপূর্বক ৭০ দশকে লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ-এর মাধ্যমে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সম কাজ এবং সম মজুরি নিশ্চিত করেছে। জানা গেছে, চা শিল্পে ১৯৩৯ সাল থেকে শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মাতৃত্বকালীন ছুটির প্রচলন করে- যা বর্তমানে ১৬ সপ্তাহ মাতৃত্বকালীন ছুটি ও আইন নির্ধারিত মাতৃত্বকালীন ভাতা দিয়ে থাকে। চা বাগানগুলো, গর্ভ ও প্রসবকালীন জটিলতাসহ সবধরনের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করছে যা বাংলাদেশে প্রচলিত অন্য শিল্পে বিরল। সর্বোপরি সবদিক থেকেই চা শিল্প অনেক আগে থেকেই সুসংগঠিত একটি শিল্প। শ্রমিকের ভাতা, বিভিন্ন রকম শ্রমিক কল্যাণমূলক যেমন বিশুদ্ধ খাবার পানি, ম্যালেরিয়া প্রতিষেধক, স্বাস্থসম্মত টয়লেট, পূজা, বিনোদন প্রভৃতি কর্মকাণ্ডকে সামগ্রিক আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। উপরোক্ত এ সকল সুবিধা টাকার অংক হিসাবে প্রায় ৪৩ টাকা দাঁড়ায়।  

উল্লেখ্য যে, প্রতিটি চা বাগান (ওয়েলফেয়ার এস্টেট) হিসেবে পরিচালিত হয় এবং ইংরেজি প্রবাদ বাক্যের আদলে বলতে গেলে  বলতে হয় চা বাগান কোম্পানিগুলো তাদের প্রতিটি শ্রমিক পরিবারের সদস্যের ‘জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত’ এর সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি চাহিদার সাথে চা কোম্পানির অবদান অনিস্বীকার্য। অন্যদিকে বিগত ১০ বছরে নিলাম পর্যায়ে চায়ের মূল্য কোনো প্রকার বৃদ্ধি না পেলেও বছরান্তে বাড়ানো হয়েছে শ্রমিকের মজুরি। উক্ত বছরগুলোতে অন্য সকল দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও চায়ের নিলাম পর্যায়ে মূল্যের বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল শুধুমাত্র ০.১৬ শতাংশ। অন্যদিকে শ্রমিকের কল্যাণে মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে ৯৪.২০ শতাংশ। বাংলাদেশে বর্তমান চা নিলাম পদ্ধতিতে চা উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো চায়ের বিক্রয় মূল্য নির্ধারণে কোন কার্যকরী ভমিকা রাখার সুযোগ নেই। এদিকে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত একটি বড় চা কোম্পানির পরিসংখ্যানে গত অর্থবছরে চায়ের উৎপাদন খরচ দেখা যায় প্রতি কেজি ২১৫ টাকা। এই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে অনেক চা বাগানই লোকসানে তাদের ব্যবসায়িক কর্মকান্ড পরিচালনা করছে, ভবিষ্যতে চায়ের মূল্য বৃদ্ধিসহ তাদের আয় ব্যয়ে সমতা ফিরে আসবে বলে আশা করা যায়।

অন্যদিকে টি এসোসিয়েশনের বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে চা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তাতে তারা বলছে: চা শ্রমিকদের অতিনিম্ন মজুরির প্রসঙ্গ উঠলেই চা বাগান মালিকরা দাবি করেন টাকার হিসেবে চা শ্রমিকরা দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি পেলেও অন্য আরো যেসব সুবিধা তারা ভোগ করেন, সেগুলোর আর্থিক মূল্য আরো বেশি, প্রায় ৪০৩ টাকা। এ বিষয়ে নেতৃবৃন্দ বলছেন, বাগান মালিকরা কোন কোন ‘সুবিধাকে’ মজুরি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে চান এবং বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুসারে সেগুলোকে আসলেই মজুরি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিনা সেটি প্রধান বিবেচ্য। চা বাগান মালিকরা যেসব সুবিধাকে মজুরি হিসেবে দেখাতে চান তার মধ্যে রয়েছে রেশন, বাসস্থান, চিকিৎসা সুবিধা, পেনশন, শ্রমিক সন্তানের শিক্ষা, শ্রমিক কল্যাণ কর্মসূচি (যেমন—পানি সরবরাহ, মশার ওষুধ স্প্রে, পয়োনিষ্কাশন, গামছা সরবরাহ ইত্যাদি), শ্রমিকদের বসতির আশপাশে উৎপাদিত ফলমূল, শাকসবজির মূল্য, বাড়তি উত্তোলনের বোনাস, ভবিষ্য তহবিলের চাঁদা ইত্যাদি, কিন্তু শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে একমাত্র রেশন ছাড়া আর কোনোটিকেই মজুরি হিসেবে ধরা যায় না।

শ্রম আইন ২০০৬-এর ধারা ২(৪৫) অনুসারে যেসব সুবিধাকে মজুরি হিসেবে গণ্য করা যাবে না, তার মধ্যে রয়েছে: বাসস্থান, আলো, পানি, চিকিৎসা সুবিধা বা অন্য কোনো সুবিধাদানের মূল্য, অবসর ভাতা তহবিল বা ভবিষ্য তহবিলে মালিক কর্তৃক দেয়া কোনো চাঁদা ইত্যাদি। অর্থাৎ চা বাগান মালিকরা বাগান পরিচালনা ও শ্রমিক নিয়োগ করার অত্যাবশ্যকীয় কতগুলো খরচের খাত যেমন: পানি সরবরাহ, মশার ওষুধ স্প্রে, পয়োনিষ্কাশন, গামছা সরবরাহ ইত্যাদিকে ব্যক্তি শ্রমিকের মজুরি হিসেবে চালিয়ে দিতে চাচ্ছেন, যা শুধু শ্রম আইন নয়, যেকোনো বিবেচনায়ই অগ্রহণযোগ্য।

তাছাড়া চা বাগানের যে জমিতে চা শ্রমিকদের থাকতে দেয়া হয়, সে জমি বাগান মালিকের নিজস্ব জমি নয়, এগুলো সরকারি অর্থাৎ জনগণের জমি। চা বাগানের মালিকরা সরকারের কাছ থেকে লিজ নেন। যদিও কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করার কারণে এসব জমি চা শ্রমিকদের নিজস্ব জমি হিসেবে স্বীকৃত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সিএস কিংবা আরএস জরিপ করার সময় এসব জমিকে স্রেফ খাসজমি হিসেবে দেখানো হয়েছে যেন এসব জমিতে স্রেফ থাকতে দেয়ার বিনিময়ে চা জনগোষ্ঠীকে যুগ যুগ নিম্ন মজুরির জীবনের মধ্যে আটকে রাখা যায়। এ জমিগুলোয় চা জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক অধিকার রয়েছে কারণ ১৫০ বছর আগে তাদেরকে যখন মধ্যপ্রদেশ, ছোট নাগপুর, যুক্ত প্রদেশ কিংবা মাদ্রাজ থেকে এ দেশে নিয়ে আসা হয়, তখন এখানে বসবাস করবার অধিকার দেয়ার কথা বলেই তাদের আনা হয়েছিল।

একজনি শ্রমিক যা মজুরি পায় তা দিয়ে আড়াই কেজি চালই কেনা সম্ভব নয়। অন্যান্য খরচের টাকা কোথায় পাবে। শ্রমিকদের ১২০ টাকা মজুরির মধ্যেও ফাঁক আছে। একজন শুমিক গণমাধ্যমকে বলেন, কমপক্ষে ২৪ কেজি চা পাতা তুলতে পারলে ১২০ টাকা মজুরি দেয়া হয়। এর কম হলে প্রতি কেজিতে ছয় টাকা করে কেটে নেয়া হয়। কিন্তু যদি ২৪ কেজির বেশি হয় তাহলে প্রতি কেজিতে মাত্র দুই টাকা বেশি দেয়া হয়। শ্রমিকেরা যদি চা বাগানের জমিতে ফসল বা শাক সবজির চাষ করে তাহলে তাদের আবার রেশন দেয়া হয় না। চিকিৎসা বলতে স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে যেকোনো রোগে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট ছাড়া আর কিছু দেয়া হয়না। মাছ মাংস বছরে এক-দুইবার  খেতে পারে কোনো উৎসবের সময়। আর সারা বছর ঘরের পাশে লাগানো শাক সবজি দিয়ে চালিয়ে নেন। আর  সব বেলায় খেতে পায় না। মজুরি অনেক কম হওয়ায় চা শ্রমিকদের বলতে গেলে সবাই ঋণগ্রস্ত। তারা বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নেন। প্রতি সপ্তাহেই ঋণের কিস্তি শোধ করতে হয়। ফলে তাদের মজুরির টাকাও ঘরে নিতে পারে না। আর সন্তানরা অপুষ্টিসহ নানা রোগে ভোগে।

সংশ্লিষ্টদের মতে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের দিকে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া ন্যায্য দৈনিক হাজিরা নির্ধারণ, বাগানের সময়ানুযায়ী কাজ করা (যেমন ৮টা-২টা), বাৎসরিক উপস্থিতি ৯০% নিশ্চিত করা, বাগানের বাইরে কাজের জন্য না যাওয়া, চোলাই মদ তৈরি-বিক্রি বন্ধ করা, বাগানের সম্পদ তথা সরকারী সম্পদ নষ্ট/বিনষ্ট না করা, সরকার থেকে অন্যদের যেভাবে ভর্তুকি দেওয়া হয়, এই খাতেও ভর্তুকির ব্যবস্থা করা, বাগান কর্তৃক উৎপাদিত চা-এর দাম ব্রোকার/অকশন হাউজের জন্য নির্ধারণ করা, বৈষম্য দূর করা, প্রতিটি বাগানের বাৎসরিক লভ্যাংশ থেকে ৫-১০% লভ্যাংশ শ্রমিকদের মাঝে উপস্থিতির বিচারে ইনসেন্টিভ আকারে বন্টন করা, এছাড়া সব বাবা মা চায় তার সন্তান শিক্ষিত হোক। জজ ব্যারিস্টার হতে না পারলেও ভালো একটা চাকরি করুক। সে কারণে প্রতিটা বাগানের শ্রমিক কমে যাচ্ছে, ব্যাহত হচ্ছে মানসম্পন্ন চা উৎপাদন। চা বাগানে কাজ করার বিষয়ে উৎসাহ দেয়া- অনেক মানুষ আছে যারা ভিক্ষা করে, কাজ নাই, তাদের এ পেশায় নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে।

চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেণ পাল গণমাধ্যমকে বলেন, চা বাগানগুলোতে স্থায়ী শ্রমিক আছে এক লাখ। আর অস্থায়ী আছে ৫০ হাজার। তাদের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা প্রায় আট লাখ। তিনি বলেন, ‘আমাদের দাবি ২০টি। মূল দাবি হলো মজুরি দিনে ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করতে হবে। এটা পূরণ হলেই আমরা কাজে ফিরে যাব। আমাদের ৩০০ টাকার দাবি পূরণ না হলে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। আমরা আর চলতে পারছি না। দেয়ালে পিঠ থেকে গেছে।’ তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মালিকেরা বলছেন যে চা উৎপাদনে তাদের লোকসান হয়। তাহলে তারা ব্যবসা করেন কীভাবে?’ চা সংসদের সিলেট ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যান জি এম শিবলি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা এখনো কোনো বেতন বাড়াতে রাজি হয়নি। তারা যে ৩০০ টাকা মজুরি চাইছেন সুযোগ সুবিধা মিলিয়ে তার চেয়ে বেশি দিচ্ছি। তাদের সাথে আরো আলোচনা হবে।’

দেশের চা-শিল্পে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। মালিক-শ্রমিক উভয়পক্ষই নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকায় শিগগিরই খাতটির সংকট কাটছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ বিশ্বের তিন শতাংশ চা উৎপাদন করে। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশি চায়ের বাজারের মূল্য প্রায় ৩ হাজার পাঁচশ’ কোটি টাকা। জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। চা শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে প্রতিদিন ২০ কোটি টাকারও বেশি দামের চাপাতা নষ্ট হচ্ছে বলে দাবি বাগান মালিকদের।

শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য একটি গাইড লাইন দেয়া আছে। সেখানে বলা আছে জীবনযাপন ব্যয়, উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা, ব্যবসার সামর্থ্য, মূল্যস্ফীতি, কাজের ধরন, ঝুঁকি ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে ন্যূনতম মজুরী নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে বিভিন্ন সংঘবদ্ধ শক্তির ক্ষমতা ও অস্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ বা পুনর্র্নিধারণ করা হয়। আর সামান্য কিছু মজুরি বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকদের দিনের পর দিন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে হয়, প্রশাসনের নিপীড়নের শিকার হতে হয়। বাংলাদেশে অর্থনীতির উচ্চপ্রবৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধির ভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের ভাগে তা জুটছে না।

রবিউল ইসলাম সোহেল: বিশেষ সংবাদদাতা। আমাদের মানচিত্র


 নিউজটি পড়া হয়েছে ৩০৭ বার  






 

জাতীয়

ঢাকাস্থ ভোলা জার্নালিস্টস ফোরামের সভাপতি রুমেন ও সাধারণ সম্পাদক পরশ

নির্বাচন ২০২৪!

নাজিরপুরে সাময়িক বরখাস্তকৃত এসি ল্যান্ডের বিরুদ্ধে অডিও ষড়যন্ত্রে জড়িত বদলি আরো দুইজন

বিশ্ব মশা দিবস, ডেঙ্গুর আক্রমণ ও মশা নিধনের নামে তামাশা!

প্রথমবারের মত অনুষ্ঠিত হলো 'ঢাকা ক্যাটেল এক্সপো-২০২৩'

ব্যাচভিত্তিক গ্রুপের নামে প্রতারণা, পলাতক রিগ্যান হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা

বড় অসময়ে চলে গেলেন কেকে, মৃত্যু নিয়ে কিছু প্রশ্ন!

ই-কমার্স: গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়া নিয়ে জটিলতা

ক্যাশ সার্ভার স্থানান্তর নিয়ে জটিলতা, বিপাকে পড়বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারিরা

ব্যাংকার্স সিটি প্রকল্পের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

জাতীয় বিভাগের আরো খবর





সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি:
আবদুল্লাহ আল হারুন
প্রধান সম্পাদক:
আসিফ হাসান (নূর নবী)

সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. জিয়াউল হক
বিশেষ সংবাদদাতা:
র‌বিউল ইসলাম সো‌হেল

আমাদের মানচিত্র

ঠিকানা: দেওয়ান কমপ্লেক্স (৩য় তলা), ৬০/ই/১, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়:
কক্ষ নং ১৪/সি, নোয়াখালি টাওয়ার (১৪ তলা), ৫৫-বি, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০

ফোন: ০১৯১৪-৭৩৫৮৫৮, ০১৯১৪-৮৭৫৬৪০
ইমেইল: info@amadermanchitra.news, amadermanchitrabd@gmail.com

Location Map
Copyright © 2012-2024
All rights reserved

design & developed by
corporate work