ঢাকা, বাংলাদেশ  |  শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪



  বিভাগ : ফিচার তারিখ : ২৯-০৫-২০১৯  


মুর্শিদাবাদের পথে ঘাটে--১


  লিয়াকত হোসেন



লিয়াকত হোসেন: মুর্শিদাবাদকে নিয়ে এক বিশেষ নস্টালজিয়া আছে।

বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলাকে শঠতার মাধ্যমে পলাশির প্রান্তরে পরাজিত করে ইংরেজ সমগ্র বাংলা তথা ভারতবর্ষ অধিকার করে নিয়েছিল। পলাশি বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পলাশিতে ইংরেজদের বাংলা বিজয় ভারতবর্ষে বৃটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করে। এদিক দিয়ে মুর্শিদাবাদ উপমহাদেশীয় ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। তাই মুর্শিদাবাদ, হাজারদুয়ারী, মতিঝিল, খোশবাগ দেখার ইচ্ছে ছিল অনেক আগেই। এর আগেও ভারত ভ্রমণ করেছি দুবার। মুর্শিদাবাদের কথা চেতনায় থাকলেও যাওয়া হয়নি। এবার বিশেষত দুটি কারণে দেশে যাওয়ার প্রয়োজন সৃষ্ট হলে মাঝের সময়টুকু মুর্শিদাবাদ যাওয়া ঠিক হল।

 জনার্দন কর্মকারের তৈরি কামানের সামনে লেখক

ইন্টারনেটে কিছু তথ্য জোগাড় হল।

কলকাতা হতে মুর্শিদাবাদ দূরত্ব প্রায় দুশ নয় কিলোমিটার। সড়কপথে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়, তবে রাস্তা তেমন ভালো নয় আর যেতে সময় লাগবে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা। রেলপথে দূরত্ব একশত নব্বই কিলোমিটার। যেতে সময় লাগবে সাড়ে চার ঘন্টা। অবশেষে ট্রেনে যাওয়াই ঠিক হল কিন্তু ইন্টারনেটে ট্রেনের টিকেট বুকিং দেবার ব্যবস্থা থাকলেও ঝামেলামুক্ত নয়। আর ওদিকে ইন্টারনেট ঘেটে মুর্শিদাবাদে বেশকিছু হোটেল পাওয়া গেলেও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো হতে অনেক দূরে। আর যে হোটেলটি মোটামুটি ভালো ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর কাছাকাছি সেটি আবার নেটে বুকিং দেবার সিস্টেম নেই। সরাসরি টেলিফোন করে বুক দিতে হয়। এসব ঝামেলা এড়াতে নেটে খুঁজে খুঁজে একজন গাইড পাওয়া গেল। তাঁকে সব জানিয়ে মেইল করার পর কয়েকটি হোটেলের ঠিকানা পাঠালেন। তিনি জানালেন মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো আমাদের ঘুরে দেখাবেন। তবে শুধু তাঁর ফি দৈনিক দুই হাজার রুপি। ভারতের দিল্লি, আগ্রার তাজমহল, কুতুবমিনার, রাজস্থান, ফতেপুর সিক্রি, সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি, সম্রাট আকবরের দরবার, সত্যজিতের সোনারকেল্লা, চিতোরের রানী পদ্মাবতীর বাড়ি সব জায়গায় গাইড নিয়ে ঘুরেছি, তবে দৈনিক দু হাজার রুপি চার্জ কেউ করেননি। কাজেই মুর্শিদাবাদের গাইডকে অযৌক্তিক মনে হল।

 মাথায় তখন মুর্শিদাবাদের ভাবনা জাঁকিয়ে বসেছে।

ভাবতে ভাবতেই একদিন মুর্শিদাবাদ রেলওয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী হোটেল ইন্দ্রজিতে টেলিফোন করলাম। সংক্ষেপে প্রয়োজন জানিয়ে তিন দিনের জন্য হোটেলের একটি রুম বুক দিতে চাইলাম। হোটেল ম্যানেজার জানালেন, কোন অসুবিধে নেই, তবে তিনদিনের রুম ভাড়ার অর্ধেক মূল্য হোটেল অ্যাকাউন্টে পাঠাতে হবে। বিষয়টি যৌক্তিক হলেও জানালাম, টাকা পাঠাতে অসুবিধে নেই তবে পাঠানোর যে খরচ তাতে আরো একদিন কি দুদিন হোটেলে থাকা যায়। ম্যানেজার সাহেব সব শুনে নাম ঠিকানা লিখে জানালেন কলকাতা এসে তাঁকে আবার টেলিফোনে যোগাযোগ করতে। ব্যবস্থা একটা হল তবে সংশয় গেলনা। তিনিতো ভুলেও যেতে পারেন কিংবা নাম ঠিকানা হারিয়েও যেতে পারে! যাহোক ই-ভিসায় ভারতীয় ভিসা হল। কিন্তু কলকাতা হতে মুর্শিদাবাদ ট্রেন টিকেটের ঝামেলা দূর হলনা। কেউ কেউ বললেন, কলকাতা নেমে ট্রেনের টিকেট করে নিতে কিন্তু সেটাতে মন সায় দিলোনা। কারণ তাৎক্ষণিক টিকেট পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। কথায় কথায় ঢাকায় আসিফ ভাইকে বিষয়টা জানালাম। সুইডেন হতে মাঝেমধ্যেই তার সাথে কথা হয়। এটা সেটা নিয়ে আলাপ হয়। আর দেশে গেলে আসিফ ভাইকে নিয়েই বিশেষ কিছু কাজ সেরে নেই। সব শুনে আসিফ ভাই বললেন,‘এটা কোন বিষয়ই নয়। বলেনতো টিকেটের ব্যবস্থা করি।’ বিষয়টা তার কাছে ‘বিষয়’ না হলেও আমার কাছে ঝামেলা। অবশেষে শুধু ট্রেনের টিকেটই নয়; ঢাকা-কলকাতা বিমান টিকেটের ব্যবস্থাও আসিফ ভাইই করলেন।

নির্ধারিত সময়ে সুইডেন হতে বাংলাদেশ হয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ খ্রি. তারিখ বেলা দশটায় কলকাতা এসে উপস্থিত হলাম। একরাত হোটেল প্যালেস ইন-এ থেকে পরদিন ভোরে কলকাতা রেলওয়ে স্টেশনে আসলাম। ‘হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেস’ ছাড়বে সকাল সাড়ে ছয়টায়। অচেনা জায়গা বলে প্রায় দুঘন্টা আগেই চলে এসেছি, স্টেশনের ঘুম ভাঙ্গেনি। যাত্রিরা ইতস্তত কাঁথা-চাদর মুরি দিয়ে শুয়ে। টিকেট কাউন্টারে প্রশ্ন করে জানতে পেলাম, হাজার দুয়ারীর এখনও ঘোষণা হয়নি। ধীরে ধীরে দু’চারজন করে স্টেশনে আসছেন। তবে প্রায় সবাই ‘মৈত্রী এক্সপ্রেসের’ যাত্রী। মুর্শিদাবাদ যাবেন এমন কোন যাত্রী দেখছিনা। কিছুক্ষণ পর একজোড়া তরুন-তরুনী প্রবেশ করলেন। কাছাকাছি একটি বেঞ্চে লাগেজ রেখে তারা মুর্শিদাবাদের আলাপ করছিলেন। মনে হল সেদিকেই যাবেন। কাছে যেয়ে আলাপ করে জানা গেল তারাও হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেসে যাবেন তবে মেয়েটি নেমে যাবে মুর্শিদাবাদের এক স্টেশন আগে। আর ছেলেটি নামবে মুর্শিদাবাদ পেরিয়ে এক স্টেশন পর। আমরা মুর্শিদাবাদ প্রথম যাত্রী ঐতিহাসিক স্থানগুলো দেখতে যাচ্ছি জেনে বললেন, কোন অসুবিধে নেই স্টেশনেই আমাদের নামিয়ে দেবেন।

 

  বেগম  আজিমুন্নিসার সমাধির সামনে

 

‘হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেসে’ অনেকদিন পর ট্রেনের আমেজ পাওয়া গেল।

চা-ওয়ালা, চানাচুর-ওয়ালা, কাপড়, ওষুধ, বই, পত্র-পত্রিকা বিক্রেতার হাঁকডাকে আমাদের প্রথম শ্রেণির কামরাও ভরে উঠলো। একজন চাওয়ালা যাত্রীদের সবার হাতে একটি করে বিস্কিট ও চায়ের কাগজের গ্লাস ধরিয়ে দিচ্ছেন। আমি পুরো এক প্যাকেট বিস্কিট চাইলাম। কিন্তু না তিনি একটি একটি করে বিস্কিট চায়ের সঙ্গে বিক্রি করেন, পুরা প্যাকেট নয়। ভোরে হোটেল হতে ব্রেকফাস্ট সেরে বের হতে পারিনি তাই কলা আর গরম চা-পানেই যাত্রাপথ কাটিয়ে দিলাম। ঘড়ির কাঁটায় তাকিয়ে দেখি প্রায় চলে এসেছি। একটি স্টেশনে গাড়ি থামতেই মেয়েটি দূর হতে বিদায় নিয়ে নেমে গেল। মেয়েটিকে বিদায় দিয়ে ছেলেটি আমাদের কাছে এসে হাসিমুখে জানালো পরের স্টপেজ মুর্শিদাবাদ আমাদের গন্তব্যস্থল। ছেলেটিই আমাদের লাগেজ প্লাটফর্মে নামিয়ে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো, ‘ঐযে আপনাদের হোটেল। স্টেশন গেট পার হয়ে বাঁদিক দিয়ে হেঁটে চলে যাবেন।’ নাম জিজ্ঞেস করতেই জানালো তার নাম ‘আসিফ ইকবাল’। ছুটি নিয়ে বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। নামটি শোনার পর ভাবছিলাম ঢাকার ‘আসিফ ভাই’-এর কথা। দুটি নামে ও কর্মে কি অদ্ভূত মিল।

 মুর্শিদাবাদ স্টেশন পার হয়েই সামনে এসে দাঁড়ালাম।

স্টেশন চত্বরে একটি গাছ। গাছের ছায়ায় কয়েকটি ছোট-খাট দোকান। লোকজনের ভিড় নেই। ছিমছাম শহর। আসিফের দেখানো পথে বাঁদিক দিয়ে এগিয়ে গেলাম। ঘোড়ার গাড়িসহ একটি টাঙ্গা দাঁড়িয়ে। গোবরের গন্ধ আসছে। ভাবছিলাম হোটেল বুকিং ঠিক আছে কিনা। সুইডেন হতে রওয়ানা হবার আগে এববার ও ঢাকা হতে একবার টেলিফোনে ম্যানেজারকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। শেষবার বিষ্ণু নামে একজন টেলিফোন ধরেছিলেন। হোটেলে প্রবেশ করেই কাউন্টারে ম্যানেজার ও বিষ্ণু দুজনকেই পাওয়া গেল। এখন টুরিস্ট সিজন নয় তাই হোটেল রুমও পাওয়া গেল। বিষ্ণুই দোতলার রুম দেখিয়ে লাগেজগুলো উঠিয়ে আনলো। জানতে চাইলো এখন কিছু খাবো কিনা? লাঞ্চ আর ডিনারে কি অর্ডার হবে? কি পাওয়া যায় জানতে চাইলে জানালো, ‘স্যার শুধু অর্ডার করবেন, আপনারা আমাদের অতিথি মেহমান’। বিষ্ণু এমন হাসিমুখে বললো যেন আমরা সত্যি মেহমান। যে কদিন ছিলাম বিষ্ণুই আমাদের সকালের নাস্তা থেকে রাতের খাবারসহ তিন বেলার ভার নিয়েছে। আর যতœ করে দাঁড়িয়ে থেকে পরিবেশনও করেছে।

 দুপুরে মাছ ভাত ডাল সবজি আর দই দিয়ে খাবার পর বিল এলো মাত্র পঁচিশ রুপি।

কলকাতার পিয়ারলেস ইন-এ এক লাঞ্চে ভাত, শুকতো আর ডালের বিল এসেছিলো দুহাজার একশত রুপি। সে তুলনায় মুর্শিদাবাদের লাঞ্চ অনেক উপাদেয়। লাঞ্চের পর বিষ্ণু জানালো ঐতিহাসিক স্পটগুলো হোটেল হতে খুবই কাছে। টুকটুকওয়ালাকে বললেই নিয়ে যাবে ও ফেরার পথে হোটেলে পৌঁছে দেবে।

 নিমক হারাম দেউরি, মীরজাফরে বাড়ি

 

 মতিঝিল

বিকেলে মতিঝিল দেখতে বের হলাম। হোটেল হতে বের হয়েই রাস্তার পাশেই টুকটুক পাওয়া গেল। টুকটুক এক ধরনের তিন চাকার বাহন। বেশ প্রশস্ত, বসে আরাম। আর মুর্শিদাবাদের প্রায় সব রাস্তা ও অলিগলি কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো সমান, তাই ঝাঁকির ভয় নেই। টুকটুক ড্রাইভার মতিঝিল যাওয়া আসা আর অপেক্ষার জন্য একশত রুপি চাইলেন। নবাব আলীবর্দীর সময় মুর্শিদাবাদে অট্টালিকা তৈরিতে ইটের প্রয়োজন হলে এই স্থান হতে মাটি কাটা হয় এবং ধীরে ধীরে জলে পূর্ণ হয়ে ঝিলে পরিণত হয়। কথিত আছে ঝিলে ঝিনুক হতে মতি উৎপন্ন হতো বলে ঝিলের নাম হয় মতিঝিল। ঝিলের পাড়েই ছিল ইতিহাসখ্যাত সিরাজের বিরোধিতাকারি ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ। নবাব আলিবর্দির জামাতা নবাব নওয়াজিস খান ১৭৪০ সালে মতিঝিল প্রাসাদের গোড়াপত্তন করেন। পলাশী যুদ্ধের পর ১৭৫৮ সালে নবাব মীরজাফর মতিঝিল প্রাসাদ নতুন করে তৈরি করেন। ১৭৭১ হতে ১৭৭৩ পর্যন্ত ওয়ারেন হেসটিংস ও লর্ড ক্লাইভ এই প্রাসাদে ছিলেন। বর্তমানে ভারত সরকার মতিঝিলকে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে নতুন করে সাজিয়েছেন। দীর্ঘ লম্বা গোলাপ বাগান। বাগান ঘিরে পায়ে চলা পথ। মাঝে মাঝে ফুল গাছ ঘিরে বসার জায়গা। তবে যতটুকু না ইতিহাস জানতে তার থেকে নিভৃতে সময় কাটাতে তরুণ-তরুনিরাই আসে বেশি। ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো। মতিঝিলের প্রবেশ ও বহির্দ্বার দিয়ে বের হয়েই দেখলাম টুকটুক দাঁড়িয়ে। হোটেলে ফিরে টুকটুকওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম আগামীকাল সারাদিন আমাদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব দেখাতে পারবে কি না? নাম জিজ্ঞেস করতেই জানালো নাম সাইফুদ্দিন। টুরিস্ট এলেই সব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখায়। আগামীকাল ঠিক এগারোটায় আসতে বললাম। হোটেলে ফিরেই বিষ্ণু জানালো ডিনার তৈরি। সবজি, গলদা চিংড়ির কসানো তরকারি, ডাল আর দই।

 বিশাল কামান ও জনার্দন কর্মকার

পরদিন বিষ্ণুর পরিবেশিত কন্টিনেন্টাল নাস্তার পর ঠিক এগারোটায় হোটেলের বাইরে এসে দেখি টুকটুকসহ সাইফুদ্দিন অপেক্ষায়। জানতে চাইলাম কোথা থেকে শুরু করা যায়? সাইফুদ্দিন জানালো আজ নদীর এপারের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখা শেষ করে কাল ভাগীরথির ওপারে ‘খোশবাগ’। সাইফুদ্দিন টুকটুক ঘুরিয়েই আমাদের নিয়ে এলো বিখ্যাত জাহানকোষা কামান দেখাতে। এই জায়গাটির আগে নাম ছিলো তোপখানা। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এখানে অস্ত্রাগার তৈরি করেছিলেন, তবে সেসব এখন আর নেই। শুধু বর্তমানে বেদীর স্থান করা বিশাল জাহানকোষা কামান যার দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে পাঁচ মিটার, ওজন প্রায় আট মন। একবার কামান দাগাতে দরকার হতো ত্রিশ কিলো বারুদ। ঢাকার বিখ্যাত বাঙালি কারিগর জনার্দন কর্মকার ১৬৩৭ সালে কামানটি তৈরি করেছিলেন। বর্তমানে হাজারদুয়ারী প্যালেস ও ইমামবাড়ার মাঝে বেদীর উপর বিশাল আর একটি কামান আছে, নাম ‘বাচ্চোওয়ালী তোপ’। কামানটি দাগা হয়েছিলো মাত্র একবার এবং এর শব্দ এতো তীব্র ছিলো যে তা দশ মাইল পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়। এতে বহু গর্ভবতী মহিলার গর্ভপাত ঘটে। এই কামানটিও তৈরি করেছিলেন বাঙালি জনার্দন কর্মকার। কামানগুলো দেখে মনে হল বাঙালিই বাঙালির সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। এতো বিশাল বিশাল কামান থাকতেও পলাশির প্রান্তরে বাংলার নবাবকে হারতে হল। পলাশির যুদ্ধে নবাবের কামানগুলো ছিলো অত্যধিক ভারি। বৃহদাকার বিশেষ প্রজাতির ষাড় দিয়ে কামানগুলো বহন করা হত ও স্থানান্তর সহজবোধ্য ছিলানা। অপরদিকে ইংরেজদের কামানগুলো ছিলো হালকা ও চাকা লাগানো, সহজেই সেগুলো স্থানন্তর করে বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে বসানো হতো। কাজেই বলা যায় জনার্দন কর্মকাররা বিশাল বিশাল কামান তৈরি করে পলাশি পরাজয়ের ইতিহাসই রচনা করেছিলেন। ‘বাচ্চোওয়ালী তোপের’ শব্দে যদি দশ মাইল দূরের গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত ঘটে, তবেতো সে কামানের শব্দে ক্ষুদ্র ইংরেজ বাহিনীর তপলুন নষ্ট হয়ে যাবার কথা।

 

ভট্টধাম মন্দির-এর সামনে

 কাটরা মসজিদ, ইমামবাড়া, নেমকহারাম দেউড়ি ও হাজারদুয়ারী

কামানগুলো দেখার পরই আমরা বিখ্যাত কাটরা মসজিদে এলাম। সাইফুদ্দিন টুকটুক রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে আমাদের ভেতরে যেতে বললো। মসজিদের চৌদ্দটি সিঁড়ির উপর মূল প্রবেশদ্বার। সিঁড়ির নীচে নবাব মুর্শিদকুলির কবর। কবরটি ঘের দেয়া এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। বিশাল মসজিদের চারদিকে ছিল চারটি বাইশ মিটার উঁচু মিনার। বর্তমানে রয়েছে মাত্র দুটি। অন্যগুলি ভেঙ্গে যায় ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে। মসজিদ চত্বরের চারপাশে ছোট ছোট প্রকোষ্ঠ, সেগুলি দূরের যাত্রী কোরআন শিক্ষার্থীর জন্য নির্দিষ্ট ছিল। কাটরা মসজিদ হতে বের হয়ে যাত্রাপথে লতাগুল্মে ঢাকা অসমাপ্ত ফৌতি মসজিদ দেখালো সাইফুদ্দিন। নবাব সরফরাজ খাঁ মসজিদটি নির্মাণ শুরু করেছিলেন, তবে গিরিয়ার যুদ্ধে নবাব মারা গেলে ঐ মসজিদ নির্মাণে আর কেউ উদ্যোগ নেয়নি। আমরা এসে উপস্থিত হলাম নেমকহারম দেউড়ি বা জাফরাগঞ্জ প্রাসাদে। এটিই ছিল নবাব আলীবর্দি খাঁর বৈমাত্রিয় বোনের স্বামী মীরজাফরের প্রাসাদ। ভেঙ্গেচুরে গেছে প্রাসাদটি। ভাঙ্গা দেয়ালের গায়ে ঝোলানো সাইনর্বোড। লেখা ঐড়ঁংব ড়ভ ঘধধিন ঝুবফ গফ ঔধভধৎ অষর কযধহ. ভেঙ্গে পড়েছে উঁচু প্রবেশদ্বার, দেউড়ি। উপরন্ত সর্বসাধারন ও পর্যটকদের জন্যও ভাঙ্গা প্রাসাদে প্রবেশ নিষেধ। এই প্রাসাদের কোন এক কক্ষে মীরনের নির্দেশে হত্যা করা হয় নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে। সেজন্যই বোধহয় এই প্রাসাদের নাম নিমকহারাম দেউড়ি। অগণিত মানুষের অভিশাপ নেমে এসেছে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িটির উপর। নেমকহারাম দেউড়ির কাছেই জাফরাগঞ্জ সমাধিক্ষেত্র। মীরন ছাড়া মীরজাফর ও তার বংশের প্রায় সবার কবরই রয়েছে এখানে। এরমধ্যে দেখা হয়ে গেল নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর কন্যা আজিমউন্নিসা বেগমের সমাধি, নবাব সুজাউদ্দীন খাঁর সমাধি। সমাধিসংলগ্ন ১৭২৫ সালে নির্মিত মসজিদ, জগৎশেঠের বাড়ি, নশিপুর রাজবাড়ি, কাঠগোলার জৈন মন্দির। এসে উপস্থিত হলাম ‘ইমামবাড়া’য়। নবাব সিরাজদৌল­া এখানে কাঠের একটি ইমামবাড়া তৈরি করেছিলেন কিন্তু সেটি আগুনে পুড়ে গেলে ১৮৪৭ সালে বিশাল ইমামবাড়াটি তৈরি করেন মীরজাফরের বংশধর নবাব ফেরাদুন জা।

 হাজারদুয়ারী

ইমামবাড়ার সম্মুখেই হাজারদুয়ারী।

তিনতলা প্রাসাদটির উচ্চতা আশি ফুট। বিশাল প্রাসাদটিতে এক হাজার দরজা আছে বলেই নাম ‘হাজারদুয়ারী’। তবে একহাজার দরজার মধ্যে একশতটি নকল এবং কক্ষ একশত চৌদ্দটি। মুর্শিদাবাদের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ ও মুর্শিদাবাদ মানেই হাজারদুয়ারী। ১৮২৯ সালে মীরজাফরের আরেক বংশধর নবাব নাজিম হুমায়ুন জা ভাগীরথি নদীর পশ্চিম পাড় হতে মাত্র চল্লিশ ফিট দূরে প্রাসাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। হাজারদুয়ারীর পুরানো নাম ছিল ‘বড় কুঠি’। সে আমলে দুই আনায় রাজমিস্ত্রি আর পাঁচ পয়সায় মজদুর পাওয়া যেতো। তবুও প্রাসাদ তৈরিতে খরচ হয়েছিলো ষোল লাখ টাকা। প্রাসাদ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিলো চুন-সুড়কি, ডিমের কুসুম, মৌরী ভেজানো জল, খয়ের ভেজানো জল ইত্যাদি। মূলত ইংরেজ অতিথিবর্গের আনন্দদানের জন্যই প্রাসাদটি বিশেষভাবে নির্মাণ করা হয়। হাজারদুয়ারীর দরবার হলে রয়েছে রানী ভিক্টোরিয়ার দেয়া ক্রিস্টাল ঝাড়বাতি- যা কিনা বাকিংহাম প্যালেসের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম। হাজারদুয়ারীর এক তলায় অস্ত্রাগার। এইসব অস্ত্রের মধ্যে নবাব আলীবর্দির তলোয়ার, বন্দুক, নাদির শাহের শিরস্ত্রাণ, মীর কাশিমের ছোরা, যে ছোরায় মোহাম্মদী বেগ সিরাজকে হত্যা করেছিলো- সেটিও রক্ষিত আছে। হাজারদুয়ারীতে উনিশটি আর্ট গ্যালারী। আর্ট গ্যালারীগুলোতে বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের চিত্রকলা। সে চিত্রকলায় লর্ড ক্লাইভ থেকে শুরু করে মীরজাফর ও তাঁর বংশধর নবাব ও সন্তানদের বড় বড় ওয়েলপেন্টিংএ সমৃদ্ধ। সেসবইতো বিশ্বাসঘাতকদের চিত্র। সেখানে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার কোন চিত্র নেই। সিরাজ যেন ঐ বিশ্বাসঘাতকদের মধ্য বেমানান। পর্যটকরা মূলত মুর্শিদাবাদের ইতিহাস জানতে হাজারদুয়ারী দেখেই প্রীত হন কিন্তু ইতিহাসতো শুয়ে আছে ভাগীরথি নদীর ওপারে।

এরমধ্যে লাঞ্চের সময় পার হয়ে গেছে।

সাইফুদ্দিন ভাগীরথী নদীর তীরে একটি হোটেলে আমাদের নিয়ে এলো। জানালো পর্যটকরা এলে এই হোটেলেই আসেন। হোটেলটির নাম মনে নেই, তবে রান্না ছিল অপূর্ব স্বাদের। আর খাবার পর দইও সুস্বাদু। দোকানী খাবার পর থালা সাজিয়ে পান নিয়ে এলেন। কিন্তু অভ্যেস নেই বলে নেয়া গেলনা। বেলা পরে এসেছে। সাইফুদ্দিন হোটেলের সম্মুখে আমাদের নামিয়ে দিয়ে হাসি মুখে জানালো আগামীকাল আমাদের ভাগীরথীর ওপারে ‘খোশবাগ’ নিয়ে যাবে। ‘খোশবাগ’ সিরাজের সমাধি।

 

খোশবাগে শায়িত বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার কবর। ছবি: লেখক

 খোশবাগ

নবাব আলিবর্দী খাঁ তাঁর জীবদ্দশায় নিজ সমাধির জন্য এই স্থানটি নির্বাচন করেন। স্থানটি সুরক্ষার জন্য চারদিকে উঁচু প্রাচীর বেস্টন ও মনোরম পুস্পবৃক্ষাদি রোপন করার পর এর নাম হয় ‘খোশবাগ’। নবাব আলিবর্দী, সিরাজোদ্দৌলা, সিরাজ পতিœ লুৎফা, সিরাজের দুই মেয়ে ও সিরাজের বংশধরদের সমাধি রয়েছে এই খোশবাগে। রয়েছে আরো কিছু সমাধি।

 পরদিন সকালে ঠিক দশটায় চলে এলো সাইফুদ্দিন।

আমরা টুকটুকে উঠে বসলাম। আজ যাত্রা ভাগীরথীর ওপারে।  শহর হতে ‘খোশবাগে’ যেতে হলে নৌকায় ভাগীরথী পার হতে হয়। আমরা ঘাটে এসে দাঁড়ালাম। বেশ বড় নৌকা যাত্রীসহ যানবাহনও পার হয়। আমরা যাতায়াতে সর্বমোট বিশ রুপি টিকেট কেটে নৌকায় উঠলাম। বাঁশের পাটাতন ধরে দাঁড়ানোর জন্য উঁচু করে কয়েকটি বাঁশ খুটি দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়েছে। আমাদের সঙ্গে সাইফুদ্দিনও টুকটুক নিয়ে এলো। অনেকেই পার হচ্ছেন স্কুটার, মটর সাইকেলসহ। যন্ত্রচালিত নৌকায় কয়েক মিনিট লাগলো ভাগীরথী পার হতে। ওপারে পাকা শানবাঁধানো রাস্তা। কিছুদূর যাবার পর টুকটুক বাঁক নিলো। বাঁক নেয়া রাস্তাটি ভালো নয়। এবড়ো থেবড়ো তাই ঝাঁকি লাগছে। সাইফুদ্দিন জানালো আমরা প্রায় এসে গেছি। বিস্ময় লাগলো সিরাজের সমাধিক্ষেত্রে যাবার রাস্তাটি দেখে। এযে অবহেলার নিদর্শন। ‘খোশবাগের’ একপাশে এসে টুকটুক দাঁড়াল। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা জায়গাটির প্রবেশপথে কয়েকজন দাঁড়িয়ে। ‘খোশবাগের’ দেয়াল বিবর্ণ হয়ে গেছে। রাস্তার পাশে দুটি বিবর্ণ সাইনবোর্ড, একটি একেবারেই পড়া যায়না, অন্যটি কষ্ট করে পড়া যায়। ‘নবাব আলিবর্দী খাঁ দিল্লির জামে মসজিদের অনুকরণে ৭.৬৫ একর জমির উপরে ‘খোশবাগ বা ‘গার্ডেন অফ হ্যাপিনেস’ তৈরি করেন। এটি চারদিকে ২,৪৭১ ফুট উচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। এখানে চারদিকে দেওয়া বিশিষ্ট চত্বরের মধ্যে বৃটিশদের গুলিতে নিহত দানেশ ফকির-এর সমাধিও রয়েছে। সিরাজের মৃত্যুর পর তাঁর বেগম লুৎফউন্নিসা ঢাকা থেকে ফিরে আসেন এবং মৃত্যুর আগে বেশ কয়েক বছর এই খোশবাগেই ছিলেন। ১৭৮৬ খৃ. লুতফউন্নিসার মৃত্যুর পর তাঁকে সিরাজের পাশেই সমাধিস্থ করা হয়।’

(চলবে)

লিয়াকত হোসেন: সুইডেনপ্রবাসী লেখক 


 নিউজটি পড়া হয়েছে ২১৯৩ বার  


 এই ধারাবাহিকের সকল পর্ব  

•   মুর্শিদাবাদের পথে ঘাটে--১


•   মুর্শিদাবাদের পথে ঘাটে--২






 

ফিচার

ব্লাডি মেরি: আয়নার আড়ালের রহস্য!

‘হিপনোথেরাপি: সম্মোহনের মাধ্যমে চিকিৎসাপদ্ধতি’

স্মৃতিময় চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-১

ইলুমিনাতি: রহস্যেঘেরা একটি গুপ্ত সংঘটন

বাংলাদেশ-সুইডেন প্রশাসনিক তুলনামূলক চিত্র

আত্মহত্যা কোনো প্রতিবাদ নয়, অপরাধ

পলাশি থেকে বত্রিশ নম্বর, বিশ্বাসঘাতকতার নির্মম ইতিহাস!

কোডেক্স গিগাস: শয়তানের বাইবেল

বিশ্বে জনসংখ্যা কমবে নাটকীয় হারে!

রক্তদান এবং নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন হোক সর্বজনীন

ফিচার বিভাগের আরো খবর





সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি:
আবদুল্লাহ আল হারুন
প্রধান সম্পাদক:
আসিফ হাসান (নূর নবী)

সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. জিয়াউল হক
বিশেষ সংবাদদাতা:
র‌বিউল ইসলাম সো‌হেল

আমাদের মানচিত্র

ঠিকানা: দেওয়ান কমপ্লেক্স (৩য় তলা), ৬০/ই/১, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়:
কক্ষ নং ১৪/সি, নোয়াখালি টাওয়ার (১৪ তলা), ৫৫-বি, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০

ফোন: ০১৯১৪-৭৩৫৮৫৮, ০১৯১৪-৮৭৫৬৪০
ইমেইল: info@amadermanchitra.news, amadermanchitrabd@gmail.com

Location Map
Copyright © 2012-2024
All rights reserved

design & developed by
corporate work